যুদ্ধের ইতিহাস
আমার যতদূর মনে পড়ে ১৯৬৬ সাল হবে। আমি তখন উত্তর রাঙ্গুনীয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির ছাত্র। আমাদের গ্রামে তখন কিছু কিছু কমিউনিষ্ট নেতাদের আগমন ঘটত। বিপ্লবী নেতাদের মধ্যে কমরেড মনিসিংহ, কমরেড দেবেন সিকদার, কমরেড আব্দুস ছাত্তার মহোদয়রা আসিয়া গোপনে সচেতন নাগরিকদের নিয়ে পাকিস্তানী শাসকদের শোষণের বিরুদ্ধে মানুষকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে সভা সমাবেশ করতেন। ১৯৬৯/১৯৭০ দিকে মজলুম জননেতা মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও আওয়ামীলীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের রাঙ্গুনীয়া কলেজ মাঠে কয়েকবার পাকিস্তানী শাষকদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির জন্য সভা সমাবেশ করেছেন। সে সময় আমরা যারা হাই স্কুলের ছাত্র ছিলাম সবাই মিলে ১১ দফার সমর্থনে মিছিল করে জনসভায় অংশগ্রহণ করি। তখন আমরা ধীরে ধীরে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে লাগলাম। ৬৯ এর গণ অভ্যূথানে শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগার থেকে ছাড়িয়া দিতে তখন পাকিস্তানের জান্তা সরকার বাধ্য হয়। ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও পাকিস্তান পিপলস পার্টি নেতা জুলফিকর আলী ভূট্টোও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান চক্রান্ত করে জাতীয় সংসদের সভা আহ্বানে নানা তালাবাহানা করতে থাকে। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে বাঙ্গালী জাতির স্বাধীকারের দাবিতে বিশাল জনসভায় দিক নির্দেশনা মূলক এক ভাষণ দেন। ইতঃবসরে জল আনেকদূর গড়িয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্র পূর্বক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গোপনে বাঙ্গালী নিধনের জন্য ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ গভীর রাতে নিরস্ত্র জনতার উপর অপারেশন সার্চ লাইট ফরমান জারী করে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নির্বিচারে কামানের গুলি মেরে লাখ লাখ নিরহ বাঙ্গালী হত্যায় মেতে উঠে। এদিকে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ গভীর রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র বিডিআর ওয়ালেস মারফৎ চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান সাহেবের নিকট পাঠালে তিনি তখন চট্টগ্রাম বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র প্রচার করিতে থাকেন। ইতোমধ্যে পাকিস্তানী হানাদার বাহীনি নজির বিহীন ভাবে বাঙ্গালীর উপর সীমাহীন গণহত্যা, নির্যাতন, জ্বালও পোড়াও, লুটতরাজ ও ধর্ষণ চালিয়েছিল। তখন গ্রামে মহল্লায় সকলে সংঘবদ্ধভাবে সকল যুব সমাজ প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। অনেকে জীবনের নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় আবালবৃদ্ধবণিতা সকলে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয়ের আশায় সীমান্ত অতিক্রম করতে বাধ্য হয়। আমাদের গ্রামেও সেই হামলার শিকার আমরা হয়েছি। যখন শত্রু সেনাদের নির্যাতন ও হামলা তীব্র আকার ধারণ করে তখন গ্রামের নিরীহ জনগণ প্রাণের ভয়ে বাড়ী ঘরের মায়া ত্যাগ করে যে যেদিক পায় সেদিকে ছুটেছে। আমরাও দুটি পরিবার অনেক কষ্ট স্বীকার করে দুই দিন অনাহারে থেকে তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাই এলাকার ধনপাতা পরে কৌশল্যাঘোনা নামক জায়গায় আশ্রয় নিই। সেখানে পরিবার পরিজন রেখে আমি একদিন জেলা সদর রাঙ্গামাটি যায়। সেখানে আমার বড় ভাইয়ের বন্ধুর সাথে দেখা হলে সে আমাকে বলে যে তোমার দাদা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। তুমিও কি মুক্তিযুদ্ধে যাবে? কিন্তু আমি ওনাকে কিছু না বলে আমার অন্তরে যে হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের বিভীষিকার আগুন কুরে কুরে জ্বলছিল। তবে তিনি বলেছিলেন যদি যাও আমাকে বলিও। আরও কিছু যুদ্ধে যাবে, তুমিও তাদের সাথে যেতে পারবে। বিকালে বাড়ি গিয়ে মা—বাবার অনুমতি নিয়ে একদিন গোপনে রাংগামাটি গিয়ে দাদার বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে তাদের সেই দলের সাথে বিধাতার নাম স্মরণ করে ভারতে যাওয়ার জন্য রাংগামাটি থেকে বরকল ভায়া লঞ্চযোগে হরিনা বাজার, টেগা, হয়ে তিনদিনে ভারতের মিজুরামের দেমাগ্রী শহরে পেঁৗছি। তখন বোধ হয় ১৯৭১ এর মে/জুন মাস হবে। আমি কিন্তু সে সময় রাংগুনীয়া কলেজের ইন্টারের ১ম বর্ষের ছাত্র। পরে সেখানে একদিন বিশ্রাম নিয়ে মিজোরাম রাজ্যের রাজধানী আইজলে যাই। তারপর সেখান থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় যায়। সেখাানে একদিন বিশ্রাম করে মুজিবনগর সরকারের নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করলে আমাদেরকে হরিনা ক্যাে¤প নিয়ে যায়। সেখানে নাম ঠিকানা এন্ট্রি করে পালাটানা ট্রেনিং সেন্টারে নিয়ে যায়। আমি যত সহজে সংক্ষেপে স্মৃতিচারণ করতেছি তাহা কিন্তু বাস্তবে তত সহজ ছিলনা। ট্রেনিং সেন্টারে প্রথমে পাঞ্জাবী রেজিমেন্টের কো¤পানী কমান্ডার সুবাদার মেজর পরবর্তীতে লেফট্যানেস্ট কর্নেল কর্তৃক দেড় মাস প্রশিক্ষণের পর ত্রিপুরা রাজ্যে উদয়পুর জেলার অমরপুর সাব ডিভিশনাল টার্নজিট ক্যাে¤প পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঐ খানে আমাদেরকে ২০ জনের গ্রুপ করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে বাংলাদেশে— ঢুকিয়ে দেবার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেয়। পরের দিন গ্রুপওয়াইজ সেখান থেকে নতুন বাজার হয়ে একেবারে ভারত বাংলাদেশ সীমানার শিলাছড়া বাজার টার্নজিট ক্যাে¤প অবস্থান নিই। শিলাছড়া বাজার থেকে বাংলাদেশের তবলছড়ি বাজার হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে এক নজরে দেখা যায়। আমাদের গ্রুপটিকে রামশিরা সীমানা দিয়ে গভীর রাতে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। সারারাত অযোধ্যা, খেদাছড়া মাটিরাংগার গুইমারা ভায়া সিন্দুকছড়ি পৌঁছি। সেখানে একরাত্রি অবস্থান করে পরের দিন রাংগামাটি জেলার কাউখালীর উদ্দেশ্যে রওনা করি। এগুলি পাহাড়ী হাঁটা পথ জঙ্গলে ভরা। আমরা ১ নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমানের অধীনে প্রথমে ছিলাম পরে মেজর রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে—যুদ্ধ শেষ করি। কাউখালী থেকে বেতবুনিয়ার দিকে আমরা পথে জানতে পারলাম আমাদের আগের বেইজের গ্রুপটি পাকিস্তানী শত্রুর হাতে ধরা পড়ে। ঐ গ্রুপে স্বপন চৌধুরী, সুব্রত সাহা ও মোঃ নুর নবী গংরা ছিলেন। তাদেরকে হানাদার বাহিনী খুব নির্মম ভাবে হত্যা করে। আমাদেরকে ভারতীয় ক্যাে¤পর নির্দেশ মতে স্ব স্ব এলাকার জনগণের জানমাল রক্ষা, শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও হানাদার বাহিনী কতৃর্ক সৃষ্ট তাদের দোসরদের নির্মূল করায় হচ্ছে প্রধান উদ্দেশ্য। আমরা বেতবুনিয়া থেকে রাঙ্গুনীয়া থানার পশ্চিম দিকের পাহাড়ে রাজানগরের খন্ডল্যা পারার পশ্চিমে পাহাড়ে অবস্থান নিই। ইতোমধ্যে পাকিস্তানী হানাদার বাহীনির সাথে আমাদের রানীর হাটের পশ্চিমে ঠান্ডা ছড়িতে কিছু খন্ড যুদ্ধ হয়। সেখানে শত্রু পক্ষ পিছু হটতে বাধ্য হয়। আমরা আরও জানতে পারি আমাদের আার একটি গ্রুপ রাংগুনীয়ার পূর্বদিকের পাহাড়ের আগুনীয়া চা বাগানে অবস্থান করতেছে। তাদের সাথে আমাদের যোগযোগ স্থাপন হয়। আমরা সোর্স মারফত জানতে পারি তৎকালীন রাজানগর ইউপি চেয়ারম্যান কোব্বাদ চৌধুরীর নেতৃত্বে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। তার দোসর বাহিনী গ্রামে বাড়িঘরে আগুন ও স্থানীয় লোকজনকে ধরে পাকিস্তানী সেনা ক্যাম্পে দিয়ে আসত। তৎমধ্যে লেলাং এলাকার মনীন্দ্র পাল হত্যা অন্যতম। আমরা জানতে পারি রাজাকার, আলবদর, আলসামস ও বিহারী আসিয়া গ্রামের নিরীহ লোকজনকে ধরে নিয়ে থানায় নির্যাতন চালাত। তাহা প্রতিরোধ করার নিমিত্তে আমরা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে পাহাড়ে নেয়া অবস্থান নেয়া দুই গ্রুপ মিলে আপারেশনের প্রস্তুতি নিই। আমাদের একটি দল হোচনাবাদ খিলমোগল সাহাপাড়ায় এ্যামবুশে ছিল। এর মধ্যে রাজাকার, আলবদর ও স্থানীয় দালালচক্র সহ হোছনাবাদ ও লালানগর গ্রামে হানা দেয় এবং অনেক লোকজনকে কোমড়ে দড়ি দিয়ে থানার টর্চার সেলে নিয়ে যাচ্ছিল,
এই খবর আমরা জানতে পেরে অমনি দুরন্ত গতিতে চতুর্দিকে খবর দিয়ে আমরা আরও দুই দলে বিভক্ত হয়ে হানাদারদেরকে মোগল দীঘির পাশে চতুর্দিকে ঘিরে ফেলি। শত্রুদের দিকে অবিরাম গ্রেনেড ও গোলা বর্ষন করে হানাদারদেরকে ছত্রভঙ্গ করে তাদের কবল থেকে লোকজনকে রক্ষা করতে সক্ষম হই। পরে আহত অবস্থায় কয়েকজন দালাল চক্রকে ধরে আমাদের ক্যাে¤প নিয়ে যাই এবং পরে তাদের বিচারের জন্য আইনে সোপর্দ করি। এরপর জানাজানি হয়ে যায় যে চতুর্দিকে এখন মুক্তি বাহিনী এসে গেছে। হানাদারদের কর্তৃক যেসমস্ত গ্রাম বাসীকে আমরা মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলাম তন্মধে দেখি আমাদের গ্রামের ভূবন কবিরাজের বাড়ীর গোপাল কাকাও আছে। বিভিন্ন অসুবিধা চিন্তা করে আমি কিন্তু সে দিন নিজ পরিচয় দিই নাই। এরপর থেকে গ্রামে গ্রামে পুরো থানার দালালচক্র পলায়ন করতঃ বিহারী রাজাকার সহজে গ্রামে হানা দিতে সাহস করত না। তখন রাজাকার আলবদররা থানা কিংবা জেলায় চাকুরী ছেড়ে নিজের জীবন বাঁচাতে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিতে তৎপর হয়ে উঠে। তখন দেশের বা গ্রামের মানুষ একেবারে নিরবে, নিরাপদে ও স্বঃস্থিতে চলাফেরা করছিল। তখন কিন্তু নভেম্বরের শেষ কিংবা ডিসেম্বরের /৭১ এর প্রথম দিকে চলে আসছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনী ভারতীয় মিত্রবাহীনিরা চতুর্দিকে পাকিস্তানী হানাদার বা শত্রুদেরকে ঘিরে ফেলেছিল। পাকিস্তানী সৈন্যরা মুভমেন্ট করার শক্তি ও সাহস হারিয়ে ফেলেছিল। ঢাকা ও আসে পাশের শত্রু সৈন্যদের আস্তানায় ইতোমধ্যে— বোম্বিং শুরু হয়ে গেছে। পাকিস্তানীরা তখন একেবারে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। তাদের রসদ শেষ, অস্ত্র শেষ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কিন্তু কোন সাহায্য আসতে পারেছ না। ভারত সরকার ইতোমধ্যে স্থল পথ, জল পথ ও আকাশ পথ অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। পাকিস্তানী সৈন্যরা এখন দিশেহারা হয়ে একেবারে, হতাশ হয়ে পড়েছে। কেননা পাকিস্তান সরকার মনে করেছিল আমেরিকা ও চীন যুদ্ধে যে সাাহায্য সহযোগিতা করার কথা ছিল তারা কিন্তু করছেনা। কারন যদিও আমেরিকা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ৭ম নৌবহর পঠানোর কথা বলেছিল, কিন্তু এখন রাশিয়া ভারত মৈত্রী চুক্তির ফলে রাশিয়া তখন আমেরিকার ৭ম নৌবহরের বিরুদ্ধে ৮ম নৌবহর ও অন্যান্য অস্ত্র সরবরাহের ঘোষণা দেয়। ফলে আমেরিকা ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে এবং পাকিস্তানকে সহযোগিতা করতে অপারগতা প্রকাশ করে এবং চীন অযথা কেন ভারত বাংলাদেশ— যৌথবাহিনী বনাম পাকিস্তানীদের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে? তাই চীনও সাহায্যের হাত ফিরিয়ে নেয়। ফলে পাকিস্তান একবারে দিশেহারা। তখন ভারতীয় মিত্র বাহিনী পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডারদের প্রধান লেফট্যানেন্ট জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরা ওয়ারলেসের মাধ্যমে পাকিস্তানী পূর্বাঞ্চলের কমান্ডাদের প্রধান লেফটা্যনেন্ট জেনারেল এ. কে. এম নিয়াজীকে জানিয়ে দেয়া হয় যে, যদি সে তার সকল বাহিনী সহ সারেন্ডার না করে তাহলে তাদের পরিনতি অত্যন্ত ভয়াবহ হবে। প্রথমে নিয়াজী আত্মসমর্পন করতে অস্বীকার করে। কিন্তু সে দেখে যে, অবস্থা বেগতিক। তার বাহিনীরা ইতোমধ্যে ক্যা¤প ছেড়ে ঢাকার দিকে ধাবিত হচ্ছে। তখন তিনি অনেক চিন্তা ভাবনা করে ভারতীয় বাহিনীর নিকট সময় প্রার্থনা করেন। ভারতীয় মিত্র বাহিনী প্রধান একদিনের সমর দেন এবং বলেন, যদি আত্মসমর্পন করেন তাহলে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। জেনারেল নিয়াজি দেখেন যে, তিনি যুদ্ধ কি দিয়ে করবেন, গোলাবারুদ, রসদ ও অর্থ সব শেষ। উপায়ন্তর না দেখে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার নিকট সকল বিষয়াদি বর্ণনা করে তার বার্তা পাঠান এবং বলেন, আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যদি মিত্র বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ না করিলে অত্যন্ত ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তবে জেনেভা কনভেনশন রীতি নীতি মেনে চলা হবে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তার পরিষদীয় মন্ত্রীবর্গ ও উপদেষ্টাদের নিকট হতে জরুরীভাবে মতামত নিয়ে পূর্ব বাংলায় তাদের দোসর ঢাকার সেনাবাহিনীর প্রধান নিয়াজির নিকট আত্মসমর্পন করার জন্য নিদ্দের্শনা দেন।
এমতাবস্থায় নিয়াজি আর উপায়ন্তর না দেখে মিত্র বাহিনীর প্রধান জগজীৎ সিং অরোরার নিকট তার বার্তার মাধ্যমে জানানো হয় যে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসর্মপণ করবে তবে ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফ্ট্্যানেন্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নিকট আত্মসমর্পন করবেন। তাই ভারতীয় বাহিনীর প্রধান ও পাকিস্তানী বাহিনীর প্রধান উভয়ের বার্তালাপের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিকাল ৫ টায় ঢাকাস্থ স্থানীয় রেসকোর্স ময়দান যেখানে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু লাখ লাখ মানুষের সম্মুখে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনা করছিলেন সেই স্থানটিই নির্ধারন করা হয়। বিভিন্ন জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত আসে সেই মহেন্দ্রক্ষনটি। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিকাল ৫টা ঢাকা রেসকোর্স ময়দান। সেই রেসকোর্স ময়দানে একটি টেবিল ও ২টি চেয়ার এবং আত্মসমর্পনের দলিল ও কলম টেবিলের উপর রাখা হয়। সেই ঐতিহাসিকক্ষণে বিশাল জনসমুদ্র চতুর্দিকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সৈন্যরা কঠোর পাহারারত। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী প্রথমে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর প্রধান এ. কে নিয়াজি স্বয়ং পরবতীর্ সকল কমান্ডার ও সিপাহী মিলে সর্বমোট ৯৩,০০০ (তিরানব্বই হাজার) সৈনিক একে একে সবাই তাদের অস্ত্র মাটিতে রেখে দুইহাত উপরে তুলে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং অরোরার নিকট আত্মসমর্পন করেন। যা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। যা ইতিপূর্বে কখনো পৃথিবীতে ঘটে নাই। ইতোমধ্যে—বাংলার দামাল মুক্তিসেনা ও জনসাধারণের মধ্যে থেকে চতুর্দিকে জয় বাংলা, বাংলার জয় ধ্বনি প্রতিধ্বনিতে উচ্চাসিত হতে লাগল। জেনেভা কনভেনশন চুক্তি মতে উভয় সেনা প্রধান সেই ঐতিহাসিক দলিলে সই করল এবং আত্মসমর্পন করা সকল সেনাদের কঠোর নিরাপত্তায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হল এবং আত্মসমর্পন কৃত সকল অস্ত্রসস্ত্রও নিয়ে যাওয়া হল।
শত্রুমুক্ত হল বাংলাদেশ, বিশ্বমানচিত্রে স্থান পেল লাল সবুজের পতাকা। গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে একটি দেশ পৃৃথিবীর দরবারে স্থান পেল। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবি হউক।
আমার সেদিনের সেই অথার্ৎ ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের সেই সুমহান দিনগুলিতে সাধারণ মানুষের চোখে মুখে গৌরবের যেই দীপ্তি আমি দেখেছি সেই রূপ বিজয়ের গৌরব মন্ডিত আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছিল। হানাদার পাকিস্তানী সেনাও তাদের এদেশীয় দোসরদের দ্বারা বাংলার যেই অত্যাচার ও অসহনীয় নির্যাতন করা হয়েছিল তার মধ্যেই বিজয়ের দিনে সাধরণ জনগনের যেই হাসি আমি দেখেছি তা আজ আমার চোখে ভেসে উঠে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজরিত অবর্ণনীয় গৌরবের আবীর মাখা আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্মৃতি। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে এত দুঃখ, কষ্ট, নির্যাতন, নিগ্রহ, বেদনা যন্ত্রণা ও ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের সাগর পেরিয়ে ও ২ লক্ষ মা—বোনের ইজতের বিনিময়ে সাফল্যের সৈকতে পেঁৗছানো তরনী এবং পরাধীনতার গ্লানি বক্ষ বিদীর্ন করে স্বাধীনতার রক্তিম সূয্যর্কে আলিঙ্গন করতে যখন আমার সূয্যর্ সন্তানরা বাংলাদেশের রক্তস্নাত মাটিতে পর্দাপন করলাম তখন মুক্তি পাগল বাংলার মানুষের যে উচ্ছ্বসিত সংবর্ধনা পেয়েছিলাম তার তুলনা কোন কিছুর সঙ্গে মিলানো যায় না। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পেরে আমি নিজকে ধন্য ও গর্বিত মনেকরি। কেননা বাংলামায়ের দুঃসময়ে শত্রুর মোকাবিলা করাই হচ্ছে যুব সমাজের শ্রেষ্ঠ সময়। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবি হউক।