অন্যান্য তথ্য
মুক্তিবার্তা নম্বর | লাল মুক্তিবার্তা ০১০৮০১০২২৪ |
---|---|
ভারতীয় তালিকা নম্বর | *** |
মুক্তিবার্তা নম্বর | লাল মুক্তিবার্তা ০১০৮০১০২২৪ |
বাংলাদেশ গেজেট নম্বর | *** |
মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান কি না? | yes |
মুক্তিবার্তা নম্বর | লাল মুক্তিবার্তা ০১০৮০১০২২৪ |
---|---|
ভারতীয় তালিকা নম্বর | *** |
মুক্তিবার্তা নম্বর | লাল মুক্তিবার্তা ০১০৮০১০২২৪ |
বাংলাদেশ গেজেট নম্বর | *** |
মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান কি না? | yes |
নাম | বয়স | শিক্ষাগত যোগ্যতা |
---|---|---|
কাজি ইনাম আসিফ (বারিন) | জন্ম-১৪.০৬.১৯৮২ ইং | বিএফএ (ঢাবি) |
বাসমা কাজী | জন্ম-২১.১১.১৯৯৫ ইং | বিএসসি (অনার্স) |
মুক্তিযুদ্ধের খন্ড চিত্রঃ
গোয়ালন্দ ঘাট ও দক্ষিণবঙ্গের পতন...
২১ এপ্রিল ১৯৭১ । খুব ভোরে গগনবিদারী আওয়াজে ঘুম ভেংগে গেল। অচেনা এই শব্দটা শুনে প্রথমে ভাবলাম মেঘ ডাকছে। কিন্তু কিছুক্ষন পরেই বুঝলাম পাকিস্তানি মিলিটারি গোয়ালন্দ আক্রমন করেছে আর এগুলো কামানে গোলা নিক্ষেপের আওয়াজ। ক্রমশ সেই আওয়াজে পায়ের নিচের মাটি পর্যন্ত কেঁপে উঠছিল। আমি কেনো যাদের অনেক সাহসী বলে জানতাম তারা পর্যন্ত ভয়ে কাঁপতে শুরু করলেন। অজ্ঞাত কারণে আমি নিজেকে নতুন করে আবিস্কার করতে শুরু করলাম, আমার ভিতরের ভীতু মানুষটি ভয় পাবার বদলে হাতদুটি মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠলো। ২৫শে মার্চ ঢাকায় সংঘটিত গনহত্যার পর থেকে আমার প্রয়াত মামা শহীদ বকু চৌধুরীর নেত্রীত্ত্বে ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও যশোর সহ দক্ষিনবংগ মুক্ত ছিল। আমি দুইবার সেই প্রতিরোধ প্রক্রিয়ার ব্যবস্থাপনা দেখতে গিয়েছিলাম, মামা নিজে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। দুইটি দুই ইঞ্চি মর্টার, গোটা দশেক এল এম জি, একটা এইচ এম জি। আর শ'খানেক মার্কফোর, থ্রি নট থ্রি ও জি থ্রি রাইফেল নিয়ে ইপিআর বাহিনী ও আনসার সদস্য তো আছেনই। নদীপথে পাকিস্তানি আর্মিদের প্রতিরোধের জন্য যথেষ্ট মনে হয়েছিল সেদিন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের স্যাবার জেট ফাইটার এর বোমা বর্ষণ আর চতুর্মুখী আধুনিক অস্ত্রের আক্রমণের কাছে এই প্রতিরোধ টিকিয়ে রাখা গেলোনা, গোয়ালন্দের পতন হোলো। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে এগিয়ে আসতে থাকলো হানাদার খুনী পাক বাহিনী। চারিদিকে মৃত্যুর মচ্ছব। নির্বিচারে চলছে নিরিহ মানুষ হত্যা। আমরা শ'তিনেক স্বপরিবারে স্ববান্ধব জানা অজানা মানুষ নিয়ে বাঁশ বাগানের গভীরে আত্নগোপন করে থাকলাম। হেলিকপ্টার থেকে চলছে হেবি মেশিনগানের গোলাবৃষ্টি, নীচে চীনা রাইফেল ও জি থ্রী রাইফেলের বিরতিহীন গোলাগুলি। বাঁশে লেগে তা আরও ভয়াবহ করে তুলছিল। ঘন গাছের বাগানে এক শুকনো খাদে কয়েক'শ মানুষ, কুকুর, বেড়াল এমন কি শেয়াল, সাপ, বেজী সবাই নিরব। অবোধ শিশুও কান্না ভুলে ছিল সেদিন। তারপর যখন সবকিছু চুপচাপ, দিনের পরন্ত বিকেলে চিরকালের ভিতু আমি ও আমার সমবয়সী মামাত খালাত ভাইয়েরা বেড়িয়ে এলাম জংগল থেকে। চারদিকে পোড়ার গন্ধ আর মৃত্যুর আর্তনাদ। একজন খবর দিলো, অন্যান্ন বাড়িতে হত্যা কান্ড তো হয়েছেই সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটনা ঘটেছে চরচাদপুরে, সেখানে তরিপুল্লা বিশ্বাসের বাড়ীর সবাই নিহত। ছুটে চল্লাম। গিয়ে দেখি ৮০ বছরের অচল বৃদ্ধ থেকে ৮ দিনের শিশু, কেও রক্ষা পায়নি নরপশুদের বন্দুকের গুলি থেকে। মাত্র একজন নড়াচড়া করছে তখনও, মাথার খুলি গেছে উড়ে, শরীরে অনেক গুলির আঘাত। যোয়ান শরীর থেকে প্রানপাখী ছেড়ে যেতে চাইছে না। আমার ভেতরের আজীবন ভিতু মানুষটি হঠাৎ বদলে গেল। আমি প্রায় মৃত মানুষটিকে উল্টে পাল্টে দেখলাম। বাঁচবার কোনই আশা দেখতে পেলামনা। তার কষ্ট দেখে নিজেকে সামলে রাখিতে পারলাম না। কোমর থেকে ৩২ ক্যালিবারের পিস্তল টেনে বের করে তার থেতলানো মাথায় ঠেকিয়ে তিনবার ট্রিগার টেনে দিলাম। তার আত্মার শান্তি হলো। আমি নবজন্ম লাভ করলাম।
মুক্তিযুদ্ধে ঈদ উল ফিতরঃ
স্মৃতির জানালা থেকে একফালি রোদ ...
২১শে নভেম্বর, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ তখন একেবারে তুঙ্গে, বাংলাদেশের সকল সেক্টরেই মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনে এতই পর্যুদস্ত যে হানাদার পাকিস্তানী সেনারা শহর ছাড়া বাইরে যাওয়া নিরাপদ মনে করছিল না। তারা শহর ভিত্তিক অবস্থানে থেকে দিনের বেলায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করতো অতি সতর্কতার সাথে। এত সাবধানতা সত্তেও নানা জায়গায় গেরিলাদের চোরাগুপ্তা হামলার শিকার হতো প্রায়শই এবং তাতে প্রানহানী হতো বেশ। ৮ নম্বর সেক্টরের "মোকাররম-নীতিভুষন সাহার" নেত্রীত্ত্বে ফরিদপুর কোতয়ালী থানা সহ আশেপাশের বিরাট অঞ্চল নিয়ে গঠিত আমাদের সাব-সেক্টর (Sub-Sector No:- G-4-B/FK-1) এর FF অংশের কমান্ডার মোকাররম হোসেনের অস্থায়ী হেড-কোয়ার্টার বানানো হয়েছিল তখন চাঁদপুর গ্রামে, একেবারে আমার নানাবাড়ীতেই। অক্টোবরের শেষ দিক থেকেই শুরু হয়েছিল রমজান মাস, অতএব নভেম্বর এর ২০/২১ তারিখে ঈদ হবার কথা। এই সময় আমাদের এলাকার অধিকাংশ অংশই ছিল মোটামুটি ভাবে মুক্তিবাহিনীদের দখলে। তাই স্থানীয় জনগনের মনে আরো একটু সাহস সঞ্চার করার জন্য আমাদের চাঁদপুর ঈদগা মাঠে ঈদের জামাত আয়োজনের কথা ভাবলেন শীর্ষ কমান্ডাররা। অপেক্ষকৃত মুক্ত এলাকায় ঈদ আয়োজনে বিপদের সম্ভাবনা যেমন ছিল তেমনই ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও জনসাধারনের মনোবল বাড়াবার সুযোগ। এই থানার সেকেন্ড ইন কমান্ড (2IC) ফয়েজ ও আমি আলোচিত সময়ে খলিলপুরের এক গহীন গ্রামের মধু মোল্লার বাড়ীতে দুই শতাধিক মুক্তিবাহিনী নিয়ে ঘাঁটি গেড়ে আশেপাশে রেল ও সি এন্ড বি ব্রিজে অপারেশন করে বেড়াচ্ছি। খান সেনা, পাঞ্জাব পুলিশ আর তাদের স্থানীয় দোশররা আমাদের জ্বালায় অস্থির। প্রতিরাতেই কোন না কোন ব্রীজে পাহারারত মিলিটারি ও রাজাকারদের ঘুম হারাম করে দিয়ে আসি চারদিক থেকে এলো-পাথারি গোলাগুলি করে, সিভিল অপারেশন হিসেবে স্থানীয় পিস কমিটির চেয়ারম্যান বা সদস্যদের বাড়ীর মানুষ গুনে আসি প্রতিদিন। এইসব বাড়িতে লোকজনের চলাচলের উপর আমাদের নজরদারী থাকতো। এ নিয়ে অনেক মজাদার ও বিপদজনক অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে যা অন্য একদিন বিস্তারিত ভাবে বলা যাবে। ঈদের ব্যাপারে আলোচনার জন্য হেডকোয়ার্টার থেকে আমাদের দুজনকেই তলব করা হোলো। গভীর রাতে আমরা দুইজন সাথে কয়েকজন বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে হেডকোয়াটারে উপস্থিত হলাম। কারন অনেক বিপদজনক এই পথ পাড়ি দিতে আমাদের দুইবার রেল লাইন ও সি এন্ড বি রাস্তা পাড় হতে হবে আগমন ও প্রত্যাবর্তন করার সময়, তাই উপযুক্ত প্রস্তুতি ও দক্ষ সহযোগী সাথে নিতে হলো আমাদের। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হলো যে, নিরাপত্ত্বার সার্থে ঈদের ঠিক আগের রাতে গ্রামের সবাইকে এই ঈদের জামাতের কথা জানানো হবে, তার আগে কেও জানতে পারবেনা। সমস্ত এলাকা জুড়ে নিরাপত্ত্বার জন্য নানা স্তরে পাহারার ব্যাবস্থা রাখতে হবে, এমবুশ থাকবে আক্রমন হতে পারে এমন সকল সম্ভব্য স্থান সমুহে। নির্ধারিত যায়গায় ও ঈদগা মাঠে স্বসস্ত্র পাহারা থাকবে আর আমরা সবাই তো অস্ত্র সহই নামাজ পড়বো সবার সাথে। এমনি একটা ফুলপ্রুফ নিরাপত্ত্বা ব্যাবস্থার পরিকল্পনার ভার দেয়া হলো আমার ও ফয়েজের উপর। এলাকাটা আমার নখদর্পনে ছিল বিধায় মূল দায়ীত্ত্বে থাকতে হবে আমাকেই। প্রসঙ্গত এখানে বলে রাখা খুবই প্রয়োজন যে, পাকিস্তানী বর্বর শাসকেরা এদেশের উপর অত্যাচারে মাত্রা আরো বাড়াবার জন্য পাকিস্তানেই কুখ্যাত জেনারেল টিক্কা খানকে এখানকার গভর্নর নিয়োগ দিয়ে এনেছে, যে কিনা তার নিজের দেশেই ঈদের জামাতে গুলি চালিয়ে স্বদেশী মানুষ হত্যা করে নির্দয়তার এই খ্যাতি লাভ করে এসেছে ইতিমধ্যেই। ঈদের দিন ২১ নভেম্বর আমাদের ক্যাম্পের সদস্য ছাড়াও বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে প্রায় শ'তিনেক মুক্তিযোদ্ধা চলে আসলো এবং অবস্থান নিলো তাদের নির্ধারিত যায়গায়। সকাল দশটার দিকে ঈদের জামাত শুরু হলো চাঁদপুর গ্রামের অতি পুরাতন সেই ঈদগাঁয়, নামাজের পর আমরা প্রত্যেকে যার যার অস্ত্র থেকে এক রাউন্ড করে গুলি ছুড়ে এলাকায় আমাদের আধিপত্য প্রমান করলাম, পূর্ব্ব সিন্ধান্ত অনুযায়ী। নামাজের আগে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে এই প্রথমবার আমি ও আমার কয়েকজন যোদ্ধা মিলে আমাদের পুকুরে সত্যিকারের গোসল করলাম। নানু আমাকে একটা ইস্তারী করা পাঞ্জাবী বের করে দিলেন আলমারী থেকে, সাথে একটা নুতন লুঙ্গী, এগুলি পরবার মত মনের অবস্থা আমাদের ছিলনা, তাই সেগুলি কাঁধের "হ্যাভার স্যাগে" ঢুকিয়ে ফেললাম তারাতারি। নামাজ শেষে আমরা সেখানে উপস্থিত সবার সাথে কোলাকুলি করে আবার সেই নানা বাড়ীতে ফিরে এলাম। অনেকদিন পরে নানুর হাতের রান্না খেলাম পেটপুরে। আমার চেহারা আর পোষাক আশাকের দুরাবস্তা দেখে নানুর চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না আর তা দেখে নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছিল আমার। তাই কমান্ডারের অনুমতি নিয়ে ভিন্ন পথে দ্রুত নিজের ক্যাম্পের দিকে রওনা হলাম। তবে টেক্কা খানকে টেক্কা দিয়ে আমাদের ঈদ পালন স্থানীয় মানুষজনের মনে অনেক সাহস জুগিয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নাই। এটাই আমাদের পরাধীন বাংলাদেশে সব শেষ ঈদ। (২১শে নভেম্বর আর একটি কারনে বাংলাদেশের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে, এই দিনেই বাংলাদেশের স্থল বাহিনী, নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনী মিলে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী গঠিত হয় ১৯৭১ সনে, এজন্য এই দিনকে "বাংলাদেশ সেনা বাহিনী দিবস" বা "Bangladesh Armforces Day" হিসেবে পালন করা হয়।) বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই রচনার প্রতিটি অংশের দায় লেখকের।® ঐতিহাসিক এই ঘটনা নিয়ে লিখবার জন্য আমার প্রিয় বন্ধু, সহযোদ্ধা ও কমান্ডার ফয়েজ শাহনেওয়াজ যে তাগিদ ও দায়ীত্ত্ব দিয়েছে তার জন্য আমি ঋনী রইলাম তার কাছে। ঘটনাকালে আরো অনেক সহযোদ্ধা নানা ভাবে অবদান রেখেছিল, স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার কারনে তাদের নাম উল্লেখ করতে পারলামনা বলে লজ্জিত।
ফেসবুক আইডিঃ https://web.facebook.com/architectdilu