বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুল হক | mssangsad.com

মুক্তিযোদ্ধার প্রোফাইল

Visitor: 15576

বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুল হক

মুক্তিযোদ্ধা পরিচিতি নম্বর : মুক্তিযোদ্ধা পরিচিতি নম্বরঃ ০১৫৮০০০১২৯৮
  • পিতার নাম: সমজিদ আলী
  • মাতার নাম: আবেজা বেগম
  • স্ত্রীর নাম: আন্জুমান আরা বেগম
  • জম্ন তারিখ: ৩০.০৯.১৯৫৪ ইং
  • মৃত্যু তারিখ: ০৯.১১.২০২৫ ইং
  • মোবাইল: ০১৭১৫০২৩২৩৩
  • গ্রাম: অর্জুনপুর
  • ইউনিয়ন: উঃ শাহবাজপুর
  • উপজেলা: বড়লেখা
  • জেলা: মৌলভীবাজার

অন্যান্য তথ্য

মুক্তিবার্তা নম্বর ***
ভারতীয় তালিকা নম্বর ***
মুক্তিবার্তা নম্বর ***
বাংলাদেশ গেজেট নম্বর বেসামরিক গেজেট ১৯৯২
মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান কি না? yes

সন্তানদের নাম ও বয়স

নাম বয়স শিক্ষাগত যোগ্যতা
আহমেদ তানভীর সজিব জন্ম-১৯৮৬ ইং সাল স্নাতক
আহমেদ ইয়াসিফ সাদি জন্ম-১৯৯০ ইং সাল স্নাতক
আহমেদ সাইফ সামি জ্ম-১৯৯৩ ইং সাল স্নাতক
আহমেদ সাইদ সাফি জন্ম-২০০৩ ইং সাল এইচএসসি

যুদ্ধের ইতিহাস

 

১৯৭০ সালের নির্বাচন খুব কাছ থেকেই দেখেছি। ভোটার হইনি বলে ভোট দিতে পারিনি। আমরা ছিলাম ছাত্র ইউনিয়ন সমর্থক। আযাদের আসনে আওয়ামীলীগের জনাব তইমুছ আলীর বিপরীতে কুঁড়েঘর মার্কা নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন দাদা অপূর্ব কান্তি ধরা তবারক ভাই ছিলেন এমসি কলেজের ছাত্র এবং জেলা পর্যায়ের নেতা। আমরা তখন মাত্র এস এস সি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছি। প্রথম প্রথম কিছু দিন সাইকেল নিয়ে বাড়ী থেকে ক্লাশ করেছি। কলেজ থেকে ফিরে ভাত খেয়েই চলে যেতাম শাহবাজপুর বাজারে। আমাদের তখন অনেক কাজ। পোষ্টার লেখা, পোষ্টার লাগানো, বাজার থেকে কালেকশন করা ইত্যাদি আরোও কত কিছু। সন্ধ্যার পর যিছিল। আযাদের অফিস ছিল বর্তমানে সোনালী ব্যাংক যে বিল্ডিং এ সেখানে। শীতের রাতে প্রায়ই যেতে হতো চা বাগানে ভোটের প্রচারনায়। চা বাগানের শ্রমিক ভাইদের ভোট ছিল আমাদের একটা ভোট ব্যাংক। তাই মাঝেমাঝে গিয়ে কুড়েঘরের প্রচারনা এবং ভোট প্রাপ্তির নিশ্চিয়তা নিশ্চিত করতে হতো।

সে সময় সারা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে স্বাধীকার আন্দোলনের জোয়ার। সুতরাং ভোটে আমরা হেরে যাই। পুরো পূর্ব পাকিস্তানে যাত্র তিন জন ছাড়া সব আওয়ামী লীগ প্রার্থীরাই জয়লাভ করেন। আমাদের ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টির একমাত্র প্রার্থী বাবু সুরঞ্জিত সেন প্রাদেশিক পরিষদের এম এল এ নির্বাচিত হন। এই তিন জনের মধ্যে একমাত্র সুরঞ্জিত বাবুই ছিলেন স্বাধীনতার পক্ষের লোক। সুরঞ্জিত বাবু মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে কিছুদিন আমাদের ৫নং সেক্টরের টেকেরঘাটের সাব-সেক্টর কমান্ডার ।

১৯৭০'র মাঝামাঝি সময় বিয়ানীবাজার কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ১ম বর্ষে ভর্তি হই । প্রথম প্রথম কিছুদিন সাইকেল নিয়ে কোনাগ্রাম হয়ে কলেজ করতাম। যাঝ পথে কোনাগ্রামে বড় ফুফুর বাড়িতে প্রায়ই খাওয়া দাওয়া করতে হতো। ৭১'র শুরুতে চারদিকে নির্বাচন উত্তর সরকার গঠন নিয়ে চলছে নানা আলোচনা/ আন্দোলন। এরই মাঝে আমরা ছাত্র ইউনিয়নসহ কিছু ছাত্র স্থানীয় থানার ওসি সাহেবের সহযোগিতায় ও আনসার কমান্ডার আলাউদ্দিন ভাইয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে কাঠের রাইফেল (পরবর্তীতে থানা থেকে সংগৃহীত থ্রি নট থ্রি রাইফেল) দিয়ে রাতের বেলায় বিয়ানীবাজার পঞ্চখন্ড হরগোবিন্দ হাই স্কুলের একটি কক্ষে প্রাথমিক শরীর চর্চা ও রাইফেল চালানোর সম্যক জ্ঞান লাভ করছি। যদিও আশেপাশের লোকজন জানতো আমরা রাতের বেলায় হারিকেন জালিয়ে স্কুল রুমে নাটকের মহড়া দেই।

বিয়ানীবাজারে আমাদের আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষন শুরুর দিন ডাকবাংলোতে টিলার উপরের পবিত্র চত্বরের মাটিতে হাত রেখে কথাসাহিত্যিক আকদ্দস সিরাজুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনে প্রত্যাশী চল্লিশজন যুবক ও তরুনকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আনুগত্যের শপথবাণী পাঠ করান। ছাত্রদের মধ্যে আমরা বেশির ভাগই ছিলাম ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী সমর্থক। ছাত্র ইউনিয়নের প্রেরনা ছিল দেশপ্রেমের প্রেরনা। এই সংগঠনের আদর্শ তার প্রতিটি নেতা-কর্মী সমর্থককে দেশপ্রেমিক হিসাবে গড়ে তোলার পক্ষে ছিল আলোকবর্তিকা।

আমাদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষন দেওয়ার জন্য যে মহৎ মানুষটি সর্বপ্রথম এগিয়ে এলেন - তিনি হলেন মাথিউরা গ্রামের কাজী আলাউদ্দিন। কাজী আলাউদ্দিন ছিলেন পাকিস্তান আনসার বাহিনীর বিয়ানীবাজার থানা কমান্ডার। উনি খুবই আন্তরিকতার সহিত আমাদের অস্ত্রচালনা ও যুদ্ধের সকল কলা কৌশল শিখাতে লাগলেন। তখন প্রশিক্ষক হিসাবে আরোও এগিয়ে এলেন কোনাগ্রাম গ্রামের লম্বা মতিন খ্যাত আব্দুল মতিন। উনি ছিলেন সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য। প্রশিক্ষক হিসাবে আরোও ছিলেন সুপাতলা গ্রামের পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত সদস্য চুনু মিয়া আর ইউনাইটেড ব্যাংকের জামির ভাই তো ছিলেনই। ব্যাংক এর নৈশ প্রহরীর বন্দুক আর বাঁশের লাঠি নিয়ে আমরা প্রশিক্ষন শুরু করি। এরই মধ্যে আমাদের সাথে এসে প্রশিক্ষক হিসাবে যোগদেন ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা ঢাকাস্থ ধানমন্ডি থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ঘুংগাদিয়া গ্রামের জনাব আব্দুন নূর সাহেব (রাজ্জাক মিয়া সাহেবের বড় ভাই)। উনার কাছ থেকে আমরা ঢাকার সম্যক অবস্থা এবং বংগবন্ধুর গ্রেফতারের বিশদ খবরাদি জানতে পারি। আরোও জানতে পারি উনার পালিয়ে আসার সময় রাস্তায় দেখা পাক বাহিনীর বিভিন্ন নৃশংসতার বর্ণনা।

জনাব নূর আসার পর আমাদের ট্রেনিং এ নুতন ভাবে প্রানসঞ্চার হলো। এমনকি বিভিন্ন সুত্র থেকে কিছু রাইফেলও যোগাড় হয়ে গেল। বিয়ানীবাজার এ অবস্থিত ইপিআর ক্যাম্প ইনচার্জ এক সুবেদার - সুবেদার মতিউর রহমান এর নেতৃত্বাধীন সকল সদস্যরা আমাদের অতি আন্তরিকতার সহিত তাদের সকল অস্ত্র ও গোলাবারুদের উপর প্রাথমিক একটা প্রশিক্ষণ দিয়ে দিয়েছিলেন।

প্রায় ১৫/২০ দিন ট্রেনিং নেয়ার পর একদিন মৌলভীবাজার থেকে জনাব কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরীসহ কয়েকজন নেতৃবৃন্দ বিয়ানীবাজারে আসেন এবং আমরা ট্রেনিং নিচ্ছি জানতে পেরে আমাদের মুরব্বি কথা সাহিত্যিক জনাব আকদ্দছ সিরাজ ও অন্যান্য নেতাদের বলেন, আযাদেরকে যদি মৌলভীবাজার পাঠানো হয় তবে উনারা তেলিয়াপাড়াতে আমাদের আরও উচ্চতর ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করবেন। সে মোতাবেক খুব সম্ভবত ১৭ই এপ্রিল আমরা ৪০ জনের একটি দল বিয়ানীবাজার থেকে মৌলভীবাজার পউছে পিটি আই স্কুলে অবস্থান নেই।

আমরা যখন উচ্চতর ট্রেনিং এ যাওয়ার জন্য মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, তখন সদ্য বিবাহিত ছোট বোনটার জন্য মনটা বড় কাতর হয়ে উঠলো । বিয়ের যাত্র সপ্তাহ খানেক হয়েছে, কিন্তু তার বাড়ীতে আমার যাওয়া হয়ে উঠেনি। সিদ্ধান্ত নিলাম ট্রেনিং এ যাওয়ার আগে একবার ওকে দেখে আসব। কিন্তু যাব কি করে? একমাত্র কুলাউড়া লাতু ট্রেনটা অসহযোগ আন্দোলনের কারনে বন্ধ। অগত্যা নিজের সাইকেল নিয়েই জুড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে দিলাম। প্রায় দুই আড়াই ঘন্টা সাইকেল চালিয়ে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে বোনের বাড়িতে পৌছে গেলাম। বোনকে দেখাযাত্র ও জোরেজোরে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। যাই হউক, ওকে শান্ত করে ওদের বাড়ীর সবার সাথে কূশল বিনিময়ের পর খাওয়া দাওয়া শেষ করি। ওর শশুড় বাড়ির লোকজন ছিলেন আমাদের পূর্ব পরিচিত এবং আত্বীয়৷ আমার মেঝ বোনের বাড়ীও ছিল জুড়িতেই। সন্ধ্যার আগে আগেই ছোট বোনের বাড়ী থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি মেঝ বোনের বাসায়। ওখানে আমার ছোঠ দুটি ভাগ্না ছিল। রাতের বেলা ওদের সাথে খেলাধুলা করে ঘুমিয়ে পড়ি। বোনকে পরের দিন সকাল সকাল রওয়ানা দেব এই তাগিদ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। জুড়ি থেকে ফিরে আমাদের গ্রামের একজনকে আমার সাইকেল ও একটা রুমাল দিয়ে বলি সেটা সে যেন আমার বাড়িতে পউছে দেয় বিশেষ করে রুমালটা যেন আমার যাকে দেয়। আমার ধারনা ছিল, আমি বাড়িতে গেলে হয়তো আমার আর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া হবে না। মা-বাবা ও ভাই কেউই আমাকে এই একটি অনিশ্চয়তার মধ্যে যেতে দেবে না। আমার যা বাবা ছিলেন খুব সাধারন ঘরের মানুষ। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী আর মা গৃহিণী। আমরা ৭ ভাই বোনের মধ্যে আমি ছিলাম ৫ম। আমার বড় ভাই বাবার ব্যবসায় সহায়তা করার পাশাপাশি আমাদের সহায় সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন। আমার মা- বাবা অর্থাৎ পুরো পরিবারের স্বপ্ন ছিল আমি লেখাপড়া করে যেন জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করি।

আমি যে বয়সে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম সেটাকে কিশোর বয়স বলা যায়। আমি তখন যাত্ৰ ইন্টারমিটিয়েট ১ম বর্ষে পড়ি। বুঝে হোক আর ইমোশনালী হোক, আমরা যুদ্ধ করার জন্যই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। তবে এটুকু তো বুঝতাম যে মুক্তিযুদ্ধ যানে পুতুল খেলা নয়, পাকিস্তানের যত একটা রেগুলার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করা। মৃত্যুকে আলিংগন করা। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আমরা একটি খুবই সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

আমাদের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ আলাপ আলোচনা করে ঠিক করলেন জনাব মানিক চৌধুরীর কথামত ৪০ জনের একটি দলকে মৌলভীবাজারে পাঠিয়ে দেবেন। আমাদের নিয়ে যাবার জন্য বাস ঠিক করা হলো। যতদূর মনে পড়ে ১৭ই এপ্রিল যাত্রার তারিখ নির্ধারিত হলো। তারিখটা সবাইকে জানিয়ে দেয়া হলো। আমি নির্ধারিত দিনে আমার লজিং বাড়ি অর্থাৎ অধ্যক্ষ জনাব ইমদাদুর রহমান'র গ্রামের বাড়ি ঘুংগাদিয়া হতে কিছু লাগেজ ও কাপড়চোপড় নিয়ে বিয়ানীবাজারে চলে আসি।

 

বিয়ানীবাজার থেকে বাস ছাড়বে সেটা আগেই বলা হয়েছিল, তাই সেখানে গিয়ে সবার সাথে অপেক্ষা করতে থাকি। লাগেজ বলতে একটা বিছানার চাদর, একটা বালিশ ও একটা পাতলা কাঁথা। একটি কাপড়ের ব্যাগে দুই তিনটা কাপড়। পরবর্তী দিনগুলো কেমন হবে সে সম্পর্কে কারও কোনো ধারণা ছিলোনা। সুতরাং আমাদের সাথে কি কি জিনিষ নিতে হবে তাঁর কোন নির্দিষ্ট কোন তালিকা কেউ জানতো না।

যাই হোক, সেদিন অনেক্ষণ অপেক্ষা পর জানা গেল আজকে আর যাওয়া হচ্ছে না। কি কারণে জানি আমাদের জন্য নির্ধারিত বাস আর আসবে না, পরদিন আসবে। অগত্যা বাড়ি ফিরে আসতে হল। আমি বাড়ি ছাড়ার সময় শুধু যাত্ৰ দুদুকে (প্রিন্সিপাল সাহেবের ছোট ভাই) বলে এসেছিলাম তাই ফিরে আসাতে কেউ কোন সন্দেহ করেনি। অবশ্য বাড়ি ফিরে আসার সময় বিছানার পুটলিটা একটা দোকানে রেখে গিয়েছিলাম পরদিন নিয়ে যাব বলে। রাতের বেলা আমি এবং দুদু একই ঘরে অর্থাৎ ওদের টঙ্গি বাড়িতে ঘুমাতাম। আমার ফিরে আসাতে মনে হল দুদু বেশ খুশিই হয়েছে। সে বারবার বলছিল, যুদ্ধে যাবার আগে আরও একদিন বেশী গল্প করা যাচ্ছে বলে।

যদিও আমি তাকে পড়াতাম, কিন্তু আমাদের মধ্যে বয়সের খুব বেশি ফারাক ছিল না। আমাদের দু'জনের সম্পর্ক ছিলো বন্ধুর মত। সেদিন বাড়ি ফিরে আসার পর আমি আর দুদু মিলে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করেছিলাম।

পরদিন আমাদের জন্য নির্দিষ্ট বাসে করে মৌলভীবাজার যাত্রা করি। বাসষ্ট্যান্ডে সহপাঠীসহ অনেকেই আমাদের বিদায় দিতে এসেছিলেন। সবার কাছ থেকে চোখের জলসিক্ত বিদায় নিয়ে আমরা মৌলভীবাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। কাজী আলাউদ্দীন ভাই আমাদেরকে গাইড করে মৌলভীবাজার পর্যন্ত নিয়ে আসবেন সেটা পূর্বেই ঠিক করা হয়েছিল। কমান্ডার কাজী আলাউদ্দিন ভাই ছাড়াও আমাদের সঙ্গী হলেন বিয়ানীবাজার কলেজের অধ্যাপক, আমাদের বাংলা শিক্ষক জনাব মাহবুবুর রশিদ চৌধুরী। তাঁর বাড়ি শায়েস্তাগঞ্জ বিধায় গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পথে মৌলভীবাজার অবদি তিনি আমাদের সঙ্গী হয়েছিলেন। দেশের এমন উন্মাতাল সময়ে কলেজে যেহেতু ক্লাস হচ্ছে না, তাই পরিবার পরিজন ছেড়ে বিয়ানীবাজারে একা থাকাটা সমিচীন হবে না ভেবে তিনি গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মৌলভীবাজারে পৌঁছে তিনি স্থানীয় ব্যবস্থায় শায়েস্থাগঞ্জ যাবার সীদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আমাদের গাড়িটা মৌলভীবাজারে পিটিআই স্কুলের সামনে আসামাত্র কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী ও কর্নেল এমএ রব সাহেব গাড়ির কাছে এসে আমাদের স্বাগতম জানালেন।

বিয়ানীবাজার থেকে এসেছি শুনে তাঁরা অত্যন্ত খুশি হন। পিটিআই স্কুলের একটি ঘর দেখিয়ে আযাদের বিশ্রাম নিতে বলা হলো। তাঁরা দু-এক দিনের মধ্যে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তেলিয়াপাড়া পাঠিয়ে দেবেন বলে আমাদের দলনেতা কাজী আলাউদ্দিন সাহেবকে আশ্বস্ত করলেন। কমান্ডার আলাউদ্দীন মানিক চৌধুরী ও কর্নেল রব সাহেবকে বললেন, প্রাথমিকভাবে আমরা ওদেরকে নিয়ে এসেছি। গাড়ির অভাবে সবাইকে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। গাড়ির ব্যবস্থা হলেই বাকিদের নিয়ে আসবেন। ঘন্টাখানেক পর আমাদের নিকট থেকে অশ্রুসজল নয়নে বিদায় নিলেন কাজী আলাউদ্দিন কমান্ডার বিয়ানীবাজার থেকে মৌলভীবাজারের কাঁচা রাস্থাটা উঁচু নিচু পাহাড়ের গা ঘেসে চলা। খানা খন্দে ভরা সমস্ত রাস্থায় বিছানো ছিলো বড় বড় বোল্ডার। আমাদের বাসটা ছিলো ব্রিটিশ মডেলের কাঠের বডির লক্করঝক্কর মার্কা। ফলে এ দীর্ঘ যাত্রায় শরীরে ভালো ধকল লেগেছিল। তাই দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা একটু জিরিয়ে নিলাম। এ সময় কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী আমাদের নিকট এসে জানতে চাইলেন, তোমাদের মধ্যে কারা অস্ত্র চালাতে জানো? দশ- বারোজন হাত উঁচিয়ে জানালো যে, তারা আগে আনসার বাহিনীর সদস্য ছিল। রাইফেল চালনায় তাদের প্রশিক্ষণ রয়েছে, গুলিও চালাতে জানে। কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী তাদেরকে নিয়ে কন্ট্রোল রুমের দিকে চলে গেলেন। অস্ত্রাগার থেকে সবার হাতে একটি করে রাইফেল ও কিছু বুলেট ধরিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন শেরপুর ফ্রন্টে। শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর ওপারে পাক সেনারা অবস্থান করছিল। পরদিন সকালবেলা পাকিস্থানী হানাদাররা শেরপুর ফেরিঘাটে অতর্কিত হামলা চালায়। এদের মধ্যে কয়েক জন শত্রুবাহিনীর যুদ্ধবিমান থেকে ছোঁড়া মেশিনগানের গুলিতে আহত হন। শেরপুর ফেরিঘাট পাহারায় যে ক'জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ফেরিঘাটের তুলনায় তা কোনোভাবেই পর্যাপ্ত ছিল না। সেখানে সশস্ত্র আরো যোদ্ধার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু প্রশিক্ষিত যোদ্ধা তো আর এখানে নেই, তাই হাতের নিকট যাকে পাওয়া গেছে তাকেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল তড়িঘড়ি করে। যুদ্ধ করতে না পারুক, অন্তত অন্যদের তো সাহায্য করতে পারবে এমন মানসিকতায়। শেরপুর ফেরিঘাট সিলেট থেকে সড়ক পথে পাকিস্তানি বাহিনীর ঢাকার সাথে যোগাযোগের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। সেজন্য শেরপুর ফেরিঘাটকে যুক্তবিাহিনীর দখলে রাখা অত্যন্ত জরুরী। আর হানাদার বাহিনী তো চাইছেই যে কোনো মূল্যে শেরপুর ফেরিঘাটকে তাদের দখলে নিতে। ফলে তারা বারবার বিমান হামলা করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ভেঙে দিতে চাইছিলো।

শেরপুর যুদ্ধে আমারা যারা যাইনি তারা পিটিআই স্কুলে প্রতিক্ষায় থাকি কখন আমাদের ডাক পড়ে তেলিয়াপাড়া যাওয়ার। কখন অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবো মুক্তিযুদ্ধে। মাতৃভূমি সোনার বাংলাকে স্বাধীন করে মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারবো। আমরা অস্থির হয়ে আছি কখন ডাক আসে তেলিয়াপাড়া যাওয়ার পরদিন সকাল বেলা পিটিআই স্কুলে যথারীতি অপেক্ষায় বসে আছি তেলিয়াপাড়া যাওয়ার সংবাদ শোনার আশায়। এরই মধ্যে সংবাদ আসে শেরপুর ফেরিঘাটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিমান হামলা হয়েছে। আমরা মৌলভীবাজার থেকেও যুদ্ধ বিমানের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। পিটিআই স্কুলের কন্ট্রোল রুম সহ সর্বত্র এক ধরনের অস্থিরতা দেখা দিল। বেলা এগারোটার দিকে কন্ট্রোল রুমে ডাক পড়ল যতিউর ভাইয়ের। কর্নেল এম এ রব মতিউর ভাইকে নির্দেশ দেন - তার নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি দল তৈরি করতে, যাদেরকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার জন্য এক্ষুনি রওনা দিতে হবে। সুনামগঞ্জের এমএনএ জনাব ওবায়দুর রাজা চৌধুরীর কাছে অত্যন্ত গোপনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত এক বার্তা পৌঁছে দিতে। বার্তাটি পৌঁছে দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মৌলভীবাজারে ফেরত আসতে হবে। জনাব ওবায়দুর রাজার নিকট থেকে কোন বার্তা থাকলে তাও নিয়ে আসতে হবে। যেতে হবে পায়ে হেঁটে তবে যাওয়ার বেলায় শেরপুর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসবে একটি জিপ গাড়ি। জিপটি সম্ভবত কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরীর সাহেবের। মতিউর ভাই আমাদের পাঁচ জনকে নিয়ে দল গড়লেন। দলে আছি যতিভাইসহ আমরা ছয়জন। মতি ভাই, সুবাস, ফারুক, পংকি, সাবু এবং আমি ( পংকি, সাবু এবং আমি ছাড়া বাকি তিন জনই গত হয়েছেন। বর্তমানে আমরা তিন জনই যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা) তাড়াতাড়ি দুপুরের খাবার খেয়ে কন্ট্রোল রুমে যাওয়ার পর আমাদের সবাইকে একটি করে থ্রি- নট-থ্রি রাইফেল এবং সাথে কোমরে বাঁধার উপযোগী কোমরের বেল্ট আকারে বুলেট ব্যাগে বেশ কিছু বুলেট দেওয়া হয়। যেহেতুে আমাদের প্রাথমকি অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ ছিল তাই অস্ত্রগুলো দেওয়া হয় আমাদের চলার পথে নিরাপত্তার প্রয়োজনে। পথে পাকিস্তানি হানাদারদের কবলে পড়ার সম্ভাবনা না থাকলেও দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্ত হবার আশঙ্কা কোনোভাবেই ফেলে দেওয়া যায় না। বলা তো যায় না পথে কখন কি বিপদ ঘটে। আমাদের অন্যান্য সাথীরা - খয়রুল, আহবাব প্রমুখরা রয়ে গেলো মৌলভীবাজারের পিটিআই স্কুলের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। আমাদের সবার প্রত্যাশা ছিল আমরা সুনামগঞ্জ থেকে ফিরে এসে এক সাথে প্রশিক্ষণ নিয়ে একই সাথে শত্রুর মোকাবেলা করতে যুদ্ধের মাঠে নামবো। কিন্তু আমাদের সেই একসাথে প্রশিক্ষণ নেবার, যুদ্ধে নামার প্রত্যাশা আর পূরণ হয়নি। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই আমরা পরস্পর থেকে। আমাদের ছয়জনের আর কোনদিনও মৌলভীবাজার ফিরে আসা হয়নি। আমরা যখন সুনামগঞ্জ থেকে ফিরে আসছিলাম ততদিনে মৌলভীবাজার পাকিস্তানি হানাদারদের দখলে চলে গেছে। কি আর করা, মৌলভীবাজার যাওয়া তো আর নিরাপদ নয়, তাই পুনরায় সুনামগঞ্জের দিকে ফিরে যাই।

আমরা জিপ গাড়ী নিয়ে শেরপুর পৌছার পরই কাল বিলম্ব না করে ড্রাইভার তড়িঘড়ি করে বিরান মহাসড়কের ওপর আমাদের নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে দ্রুত পিছন ফিরে মৌলভীবাজারের দিকে ছুটে চলল। ইতিমধ্যে জনশূন্য হয়ে পড়েছে গোটা শেরপুর এলাকা। ফেরিঘাটে প্রহরারত ডিফেন্সের বাঙ্কারগুলোতে ইষ্ট বেঙ্গলের কিছু সেনা সদস্য ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ব্যতীত আর কোথাও কোনো মানুষজনের চিহ্ন দেখা গেল না। বৈশাখ মাসের তপ্ত রোদের তীব্রতায় শেরপুর অঞ্চল দেখে মনে হলো যেন এক গা ছমছম করা জনমানবহীন জনপদ।

 

 

একেতো নতুন জায়গা আবার সবাই গৃহছাড়া, এলাকা একেবারেই অচেনা। আশা ছিল গাড়ী থেকে নেমে ড্রাইভার সাহেবের কাছ থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার রাস্তার হদিস নিতে পারবো কিন্তু সে সুযোগ আর হয়ে উঠেনি, বেচারা প্রাণ নিয়ে পলায়নপর। আমাদের ইচ্ছা ছিল যাতে করে শেরপুর ছেড়ে সন্ধ্যার আগে ভাগেই সুনামগঞ্জের দিকে যতদূর সম্ভব রাস্তা এগিয়ে যাব। ড্রাইভার নিরাপদ দূরত্বে গাড়ি থামিয়ে আমাদেরকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ী ঘুরিয়ে নিয়ে আমাদের কোনকিছু জিজ্ঞেস করার সূযোগ না দিয়েই চোখের পলকে মৌলবী বাজারের দিকে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় আমাদের প্রতি সামান্য সৌজন্যবোধ দেখিয়ে বলেও গেলননা। । ড্রাইভার আমাদের সৌজন্য না দেখিয়ে চলে গিয়ে আসলে কোনো অন্যায় করেনি। পৃথিবীতে মানুষের কাছে তার নিজের জীবনের মায়া অন্য সব কিছুর উর্ধে। নিজের জীবনের চেয়ে মানুষের কাছে আর কোন কিছু প্রিয় হতে পারে না। এই বিবেচনায় ড্রাইভার বেচারা তার প্রাণের মায়াতেই এই রকম করেছে। আমি বা আমার সহযোদ্ধা ভাইদের জীবনের চেয়ে মানুষের কাছে আর কোন কিছু প্রিয় হতে পারে না। এই বিবেচনায় ড্রাইভার বেচারা তার প্রাণের মায়াতেই এই রকম করেছে। আমি বা আমার সহযোদ্ধা ভাইদের কারুরই কিন্তু ফিরে যাওয়ার কোন সুযোগই ছিলনা। মাতৃভূমির স্বাধীকারের প্রশ্নে আমরা পরস্পরের কাছে ওয়াদাবদ্ধ ছিলাম কেউ কাউকে আমৃত্যু ছেড়ে যাব না। দেশ মাতৃকার এই দূর্দিনে জেনেশুনে মৃত্যুকে হাতে নিয়েই ঘর ছেড়েছি। বাড়ীর কথা, বিশেষ করে যা, বাবা আর ভাই বোনের কথা সব সময় মনে হতো তখন মন চলে যেত মায়ের আদূরে যাখা মুখ খানি দেখতে আর বাবার শরীরের ঘ্রান নিতে। আমি আবার অনেক বড় হয়ে ও বাবার কাছে ঘুমাতাম। তখন কান্না ও আসত, কিন্তু পরক্ষনে নিজেকে সামলিয়ে নিতাম এই ভেবে, আমরা দেশমাতাকে স্বাধীন করতেই ঘর ছেড়েছি। শেরপুরের অবস্থা এমনই ছিল যে, যে কোন সময় পাকিস্থানি যুদ্ধবিমান এসে এই এলাকায় হামলা চালাতে পারে।

বৈশাখের উত্তপ্ত রোদে মধ্যে আমরা কিংকর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছি জনশুন্য রাস্তারউপর। আমাদের যাথায় তখন একটাই চিন্তা, কিভাবে আমরা শেরপুরের এই ফেরিঘাট এলাকা ছেড়ে বৈশাখের উত্তপ্ত রোদে মধ্যে আমরা কিংকর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছি জনশুন্য রাস্তারউপর। আমাদের যাথায় তখন একটাই চিন্তা, কিভাবে আমরা শেরপুরের এই ফেরিঘাট এলাকা ছেড়ে কোন জনপদের কাছাকাছি গিয়ে আশ্রয় নিব। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি কোন দিকে যাব? কোন দিক দিয়ে গেলে আমাদের সুবিধা হবে। আশেপাশে কোন মানুষজন নেই যার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে নেব সুনামগঞ্জ যাওয়ার পথের ঠিকানা। এতদঞ্চলের আশেপাশের বিস্তির্ন পুরা এলাকায়ই কোন লোকজনের অস্বিত্ব নেই। প্রাণের ভয়ে সব মানুষই তাদের ছোটখাটো সহায় সম্বল নিয়ে চলে গেছে নিরাপদ আশ্রয়ে। খালি অবস্থায় পড়ে আছে ঘরবাড়ি, দোকানপাট। এরই মধ্যে দেখা গেল কিছু কিছু মানুষ নিজের ব্যবসা বা বসত বাড়ির যায়ায় সাহসে বুক বেঁধে আতংকের মধ্যে রয়ে গেছে, তারাও দোকান ও বাড়িঘরের আনাছে কানাছে লুকিয়ে লুকিয়ে উকিঝুকি দিচ্ছে। কিংকর্তব্য অবস্থায় রাস্তার ওপর জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আমরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে যাত্রাপথ সম্পর্কে আলোচনা করছি। আমাদের আর কোনো দিকে কোনো খেয়ালই নেই। আচমকা একটা উচ্চস্বরে ধমক আমাদের সপ্রতিভ করে তোলে, আমরা ভয়ে হতবহিবল হয়ে উঠি। যেদিক থেকে ধমক এসেছে সে দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই স্বল্প দূরে দাঁড়িয়ে আছেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আজিজ। তার চোখেমুখে যেন আগুন জ্বলছে। তার একখানা হাত ব্যান্ডেজ দিয়ে গলার সাথে ঝুলানো। অন্য হাতে একটি এসএমজি আমাদের দিকে এমন ভাবে তাক করে ধরে আছেন যেন কোন ব্যত্যয় হলেই ব্রাশ ফায়ার করবেন। উনাকে দেখে মনে হলো বিমান হামলায় আহত হয়েছেন। পরে জেনেছি বিমান থেকে ছোড়া মেশিনগানের গুলি এসে লেগেছে তাঁর হাতে। পরে অবশ্য যুদ্ধ বিমানের তান্ডব প্রত্যক্ষ করেছি নদী পাড়ের বাঙ্কারে গিয়ে ঢোকার সময়। শূন্য বাঙ্কার, তবে প্রমাণ রয়ে গেছে সকাল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা বাঙ্কারে অবস্থান করছিল। রাতের খাবারের অবশিষ্টাংশ এখনও বাঙ্কারের বাইরে সাক্ষী হয়ে পড়ে আছে।

নদী পাড়ের বাঙ্কারগুলোর একটিতেও কোন যোদ্ধার অস্তিত্ব নেই, সবাই বিমান হামলার ভয়ে যে যেদিকে পারে পালিয়ে গেছে। বাঙ্কারগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ক্যাপ্টেন আজিজ আমাদের সাথে অনেক চোটপাট দেখালেন। উনি হয়ত ভেবেছিলেন আমরা পলাতক যোদ্ধা৷ গালি দিলেন ফৌজি কায়দায় উর্দু বাংলা মিলিয়ে অত্যন্ত রূঢ় ভাষায়। আমরা তার গালিগালাজ হজম করে নিলাম ঠান্ডা যাথায়। কিছুক্ষণ বকাঝকার পর ক্যাপ্টেন যেন কিছুটা নমনীয় হলেন আমাদের প্রতি এবং নরম সুরে স্বগদোক্তির যত আক্ষেপের সঙ্গে বললেন, এভাবে আমরা সবাই যদি ডিফেন্স ছেড়ে পালিয়ে যাই তাহলে কিভাবে দেশকে শত্রু মুক্ত করব আর কেমন করেই বা দেশ স্বাধীন করব। এরূপ করলে যে আমাদের স্বাধীনতার আশা বাদ দিয়ে দিতে হবে! ক্যাপ্টেনের রাগ প্রশমিত হয়েছে দেখে আমাদের দলনেতা মতি ভাই ক্যাপ্টেনকে বললেন, আমরা পলাতক নই বা পালিয়েও যাচ্ছি না স্যার। মৌলভীবাজার হেডকোয়ার্টার থেকে এসেছি, যাব সুনামগঞ্জ।

কর্নেল এমএ রব সাহেবের নিকট থেকে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় বার্তা নিয়ে সুনামগঞ্জের এমএনএ ওবায়দুর রাজা চৌধুরীর নিকট যাচ্ছি। আমাদেরকে প্রদত্ত পরিচয়পত্রখানা ক্যাপ্টেন আজিজের দিকে এগিয়ে দিলেন। ক্যাপ্টেন আমাদের আরো নিকটে এসে পরিচয়পত্রখানা হাতে নিলেন। আমাদের মুখে বিস্তারিত জেনে, পরিচয়পত্র যাচাই করে আশ্বস্ত হলেন যে, আমরা পলাতক নই বা পালিয়েও যাচ্ছি না। আমরা যাচ্ছি মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ এক কাজের বার্তাবাহক হয়ে ইতিহাসের অংশ হতে। ক্যাপ্টেন বোধ হয় লজ্জা পেলেন মনে মনে অহেতুক আমাদের ভর্ৎসনা করার জন্য। ক্যাপ্টেন বিনম্র সুরে বললেন, তোমরা মনে কিছু নিয়ো না। বিমান হামলার পর থেকে ডিফেন্সের লোকগুলোকে, বিশেষ করে আনসারদেরকে কোনোভাবেই ধরে রাখা যাচ্ছে না। তোমরা যনে কিছু করোনা। আমরাও যেন প্রাণ ফিরে পেয়ে আনন্দিত হলাম, একে অন্যের দিকে চেয়ে সাহস সঞ্চয় করলাম।

বৈশাখের উত্তপ্ত রোদে যধ্যে আমরা কিংকর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছি জনশুন্য রাস্তারউপর। আমাদের যাথায় তখন একটাই চিন্তা, কিভাবে আমরা শেরপুরের এই ফেরিঘাট এলাকা ছেড়ে কোন জনপদের কাছাকাছি গিয়ে আশ্রয় নিব। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি কোন দিকে যাব? কোন দিক দিয়ে গেলে আমাদের সুবিধা হবে। আশেপাশে কোন মানুষজন নেই যার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে নেব সুনামগঞ্জ যাওয়ার পথের ঠিকানা। এতদঞ্চলের আশেপাশের বিস্তির্ন এলাকায়ই কোন লোকজনের অস্বিত্ব নেই। প্রাণের ভয়ে সব মানুষই তাদের ছোটখাটো সহায় সম্বল নিয়ে চলে গেছে নিরাপদ আশ্রয়ে। খালি অবস্থায় পড়ে আছে ঘরবাড়ি, দোকানপাট। এরই মধ্যে দেখা গেল কিছু কিছু মানুষ নিজের ব্যবসা বা বসত বাড়ির যায়ায় সাহসে বুক বেঁধে আতংকের মধ্যে রয়ে গেছে, তারাও দোকান ও বাড়িঘরের আনাছে কানাছে লুকিয়ে লুকিয়ে উকিঝুকি দিচ্ছে।

 

 

ক্যাপ্টেন আজিজ তখন আমাদেরকে বললেন, এখন খোলা জায়গায় দঁড়িয়ে থাকা কিংবা খোলা জায়গা দিয়ে হাঁটা মোটেই নিরাপদ নয় । তোমরা এক কাজ করো, যেকোন একটা বাঙ্কারে গিয়ে ঢুকে যাও।নদী পাড়ে অনেক বাঙ্কার আছে, একটাতে ঢুকে নিরাপদ হয়ে যাও। বলা তো যায় না কখন কোন সময় হানাদারদের যুদ্ধবিমান এসে হামলা করে বসে। দিনের এই সময়টাতেই হামলার আশঙ্কা বেশি থাকে। নিজেদের বাঁচিয়ে রেখেই কিন্তু দেশের কাজ করতে হবে। অহেতুক প্রাণ বিসর্জন দেওয়া চলবে না। কিছুটা আদেশের সুরেই বললেন যাও বাঙ্কারে চলে যাও। আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না বিপদ যাথায় নিয়ে। বিকেলের দিকে ফাঁক বুঝে বাঙ্কার থেকে বেরুবে, তখন তোমাদের জন্য পথচলা নিরাপদ হবে। পাকিস্তানি হানাদারেরা ক্ষেপা কুত্তার মত হয়ে গেছে। যাও তোমরা বাঙ্কারে চলে যাও। ক্যাপ্টেন আজিজ নিজে আর এই খোলা স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে চাইছেন না। তিনি চাইছেন  আমরা চলে গেলে তিনিও তার নিজের বাঙ্কারে গিয়ে আশ্রয় নেবেন। আমারা নদী পাড়ের পশ্চিম দিকে হাঁটতে শুরু করলে ক্যাপ্টেন নিজের ফেরিঘাটের পূর্ব প্রান্তে তার নিজের বাঙ্কারের দিকে পা বাড়ালেন।

 

বাঙ্কার অর্থাৎ মাটির নিচের যুদ্ধাকালীন নিরাপত্তা গর্তে অবস্থানে আমরা কেউ অভ্যস্ত নই। জীবনে কখনও বাঙ্কারে ঢুকে দেখিনি এবং ঢুকে পরখ করার দরকারও পড়েনি। যদিও বাঙ্কারের অভিজ্ঞতা এইই প্রথম সবার জন্য। কিন্তু আমি বাংলাদেশ ও ভারতের সীমানা ঘেষা এলাকার সন্তান, তাই সীমান্তপ্রহরী ক্যাম্পে তাদের নিরাপত্তা বাংকার দেখে অভ্যস্থ ছিলাম। তবে শুধু দেখেছি কখনও ঢুকিনি বা ঢোকার দরকার ও পড়েনি। যে কখনো বাঙ্কারের গভীরে প্রবেশ করেনি তার পক্ষে বাঙ্কার যাহাত্ম্য বুঝা মোটেই সম্ভব নয়। আমরাও কিছু বুঝতে পারতাম না যদি না সেদিন ক্যাপ্টেনের তাড়া খেয়ে বাঙ্কারের ভিতরে গিয়ে না ঢুকতাম।

নদীপাড়ের উচু বাঁধকে সামনে আড়াল করে খোড়া হয়েছে বাঙ্কারগুলো। চল্লিশ পঞ্চাশ গজ পরপর একেকটি বাঙ্কার। প্রশস্ত দেখে মানুষ শূন্য একটি বাঙ্কারে আমরা ছয়জনই ঢুকে পড়ি। আযাদের ইচ্ছায় আমরা ছয়জন একত্রে একই বাঙ্কারে অবস্থান করি এই ভেবে যে, যদি মরি তবে যেন একসাথে যরি। বাঙ্কারগুলোর সবকটিই খালি পড়ে আছে। একটিতেও কোনো মানুষ নেই। তবে বাঙ্কারগুলোয় যে মানুষ ছিল তার কিছু কিছু প্রমাণ এখনো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বাঙ্কারের আশপাশে। ক্যাপ্টেন আজিজের অভিমতের সাথে আমাদের ও ধারণা জন্মে পাকিস্তানি বিমান হামলার পর মানুষ ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে বাঙ্কার ছেড়ে। বাঙ্কারে প্রবেশের সময় আমাদের কোনো প্রকার সমস্যা হয়নি, সহজেই প্রবেশ করতে পারি। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় বাঙ্কারে প্রবেশের পর। মহা মুশকিলে পড়ে যাই বাঙ্কারের অভ্যন্তরে অবস্থান নিয়ে। বাঙ্কারের অভ্যন্তরে এক ধরনের ভ্যাপসা গন্ধ এবং প্রচন্ড গরম। ভ্যাপসা গন্ধ ও প্রচন্ড গরমের সংমিশ্রনে অস্বস্তিকর একটা বিদঘুটে পরিবেশ বিরাজ করছিল, আমাদের শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল খুব।

তাছাড়া বাঙ্কারের অভ্যন্তর ভাগ ছিল অত্যন্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন। দিনের বেলাতেও মনে হচ্ছে রাতের অন্ধকার। বাঙ্কারে প্রবেশ করার পর আমারা নিজেদের নিরাপদ ভাবার পরিবর্তে উল্টো যনে শঙ্কা জাগলো এবার বুঝি যারাই যাব অন্ধকার কূঠরে শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে! মনে হলো আমরা জীবনৃত, কবরের বাসিন্দা হয়ে গেলাম। বাঙ্কারের অভ্যন্তরে কবরের আবহ যেনো বিরাজমান। গ্রীষ্মের গরম যে কি পরিমাণ ছিল তা বুঝিয়ে বলার মতো নয়। আধ ঘন্টার মধে আমরা ঘেমে নেয়ে জবজবা হয়ে যাই। মাটির নিচের গর্তের গরম যে এতো বিদঘুটে-বাঙ্কারে অবস্থান না করলে বুঝতেই পারতাম না। অস্বস্তি আমাদের সবার গলা চেপে ধরে। সবকিছু মিলিয়ে আমরা আমাদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হই বাঙ্কারে অবস্থান আর নয়; মরতে হয় বাইরে যুক্ত আলো-বাতাসে গিয়েই মরবো। বাঙ্কার নামক কবর গুহায় শত্রুর যুদ্ধবিমান এসে আক্ৰমণ করার আগেই যে দমবন্ধ হয়ে মরতে বসেছি।

তাছাড়া বাঙ্কারে অবস্থানকালে যুদ্ধবিমান এসে হামলা করলে বাঁচার জন্য চেষ্টা ব্যতিরেকেই হাত-পা গুটিয়ে বসে থেকে মরতে হবে। যুদ্ধ বিমান থেকে কামানের ভারী গোলা বাঙ্কারের উপর পড়লেই শেষ, তখন আর বাঁচার চেষ্টা করা সাধ্যে কুলাবে না। মরতে হবে অন্ধকারের ভিতর অসহায় ভাবে ছটফট করে করে। মনে হল যেন মরনের দ্বারপ্রান্তে দাড়িয়ে আছি প্ৰান ভয়ে ভীত আমরা ছয়জন মানুষ। তখন যা, বাবা আত্মীয় স্বজনের কথা বারবার মনে পড়ছিল, আহত পাখির যত ছটফটানো অবস্থায় মনে হল আমাদের কবর হয়ে গেছে। এলাকায় তো কোনো মানুষজনই নেই। আমরা পাঁচজন মুসলিম সন্তান বাঙ্কার কে কবর হিসাবে পেয়ে গেলেও সমস্যা একটা থেকেই যায়। আমাদের সঙ্গী একমাত্র হিন্দু ভাই সুবাস চক্রবর্তী কে নিয়ে মনে চিন্তা খেলে গেল। সুবাসের তো কবরে চলবে না - তারতো প্রয়োজন হবে চিতায় চড়ে দাহ, তা না পারলে কেমনে কি? (বি:দ্র: যতদুর জানি, সুবাসটা সত্যি আর আমাদের মাঝে নেই, ওর দাহ কাজ টা যে শেষ হয়েছে গেছে।

স্বাধিনতার পর ও নাকি ভারতে চলে গিয়েছিলো। সেখানেই সে। যারা গেছে। বাকি আমরা পাচজন এখনো বেচে আছি। মতিভাই লন্ডনে, সাবু আর আজিজ আমেরিকায়, ফারুক বিয়ানীবাজার আর আমি ঢাকায়)। আমাদের দলনেতা মতিউর ভাই বললেন, আমি আর পারছি না। আর কিছুক্ষণ এই গর্তে অবস্থান করলে নির্ঘাত যারা যাব । আমি বাঙ্কার ছেড়ে বাইরে যাচ্ছি। তোমরা কি করবে? মতিউর ভাইয়ের সাথে আমরা সবাই সহমত পোষণ করি। আর বাঙ্কারের অভ্যন্তরে অবস্থান নয়, বাইরে চলে যাব। সিদ্ধান্ত হয় বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে আমরা খুব দ্রুত এবং সতর্কতার সাথে চলে যাব আমাদের পাশে অদূরের গ্রামখানিতে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেনো ক্যাপ্টেন আজিজ সাহেবের নজরে পড়ে না যাই। ক্যাপ্টেনের ধারণা সঠিক হলে পাকিস্তানি যুদ্ধবিমানের পুনরায় আক্রমনের সময় হয়ে গেছে। ক্যাপ্টেনের ধারণা ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে যুদ্ধবিমান পুনরায় এসে আবার হামলা করতে পারে।

আমরা তাই আর কালবিলম্ব না করে বাঙ্কার ত্যাগ করি।বাঙ্কার ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসার পর যুক্ত আলো-বাতাস পেয়ে আমাদের বুক ভরে উঠলো স্বস্তির নিঃশ্বাসে। আমরা যেনো নতুন করে প্রাণ ফিরে পেলাম দেহে। মনেহল নবজীবন লাভ করলাম ছয় জন তরতাজা যুবক। ভুলে যাই ক্যাপ্টেনের চোখ রাঙানির কথা, পাকিস্তানি যুদ্ধবিমানের হামলার সম্ভবনার কথা। যুক্ত আলো হাওয়া আমাদের এতোই বেশি অভিভূত ও আপ্লুত করে ফেলে, আমরা যেনো আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের কথা পর্যন্ত বিস্মত হয়ে যাই। সম্ভবত আমি হঠাত্ সম্বিত ফিরে পেয়ে সবাইকে হুঁশিয়ার করে বলি যে, এখানে এভাবে আমাদের আর দাঁড়িয়ে থেকে সময়ক্ষেপণ করা ঠিক হচ্ছে না । আমাদের উচিত সর্বাগ্রে কোথাও কোনো নিরাপদ স্থানে গিয়ে আশ্রয় খুঁজে নেয়া। দ্ৰুত এই স্থান ত্যাগ না করলে বিপদ হয়ে যেতে পারে। আমার সতর্কবাণীতে সবারই জ্ঞান ফিরলো। তাই তো, এখানে যাঠের মাঝে আমরা যে মৃত্যুর দোরগোড়াতেই দাঁড়িয়ে রয়েছি। সামনের পারকুল গ্রামকে উদ্দেশ্য করে আমরা হাঁটতে লাগলাম সযত্নে, সন্তর্পনে ক্যাপ্টেনের দৃষ্টি সীমানা এড়িয়ে।

মিনিট দশেক হাঁটার পর পারকুল গ্রামের জল হাওয়া ছুঁতে সক্ষম হই। তবে গ্রামের ভিতরে ঢুকি না, হাঁটতে থাকি গ্রামকে ডানে রেখে গ্রামের বামপাশ ঘেঁষা যেটোপথ ধরে। মনে হল নিজ গ্রামেই যেন চলে এসেছি? বাংলামায়ের সব গ্রামই যে একই রকম। গেয়ে উঠলাম সমস্বরে "এ কি অপরূপ রূপে মা তোমার হেরীনি পল্লী জননী"। সুর আর বেসুরো গলায় কত গান গেলাম। কত দেশাত্মবোধ গান যে যনে আসল প্রাণ ফিরে পেয়ে।

 

 

বাঙ্কার অর্থাৎ মাটির নিচের যুদ্ধাকালীন নিরাপত্তা গর্তে অবস্থানে আমরা কেউ অভ্যস্ত নই। জীবনে কখনও বাঙ্কারে ঢুকে দেখিনি এবং ঢুকে পরখ করার দরকারও পড়েনি। আমাদের সবার জন্য বাঙ্কারের অভিজ্ঞতা এটাই প্ৰথম তবে আমি যেহেতু বাংলাদেশ ও ভারতের সীমানা ঘেষা এলাকার সন্তান, তাই সীমান্তপ্রহরী (ই,পি,আর) ক্যাম্পে তাদের নিরাপত্তা বাংকার দেখেছি। শুধু দূর থেকে দেখেছি মাত্র কখনও ঢুকিনি বা ঢোকার দরকার ও পড়েনি। যে কখনো বাঙ্কারের নিশিকালো অন্ধকারে প্রবেশ করেনি তার পক্ষে বাঙ্কারের ভয় জাগানিয়া গুমোট ভাব বুঝা মোটেই সম্ভব নয়। আমরাও কিছু বুঝতে পারতাম না যদি না সেদিন বাঙ্কারের ভিতরে গিয়ে না ঢুকতাম । সাধারনত কোন উচু পাহাড়ের পেছনের ঢালে বা কোন উচু সড়ক বা নদীর বা খালের বন্যা নিয়ন্ত্রন উচু বাঁধকে আড়াল করে বাঙ্কারগুলো খুড়া হয়ে থাকে। শুকনো খালের ঢালু খাড়িতেও খোলা প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করা যায়। শেরপুর ফেরিঘাটে বন্যা নিয়ন্ত্রন বাধের পেছনে আনুমানিক ১০০ ফুট পরপর অনেকগুলি বাঙ্কার রয়েছে। সেখানেই বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আজিজ তার গ্রুপ নিয়ে ডিফেন্স করে যাচ্ছেন। নদীর অপর পারে পাক আর্মি কয়েকদিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে নদী পার হতে।

তখনকার সময়ে এই রাস্তাই ছিল রাজধানীর সাথে একমাত্র সড়ক পথ। ক্যাপ্টেন আজিজ তার বাহিনী ও স্থানীয় ভাবে সংগৃহিত আনসার, মোজাহিদ, পুলিশ ও কিছু ইপিআর নিয়ে অত্যন্ত সাহসিকতার সহিত প্রতিরোধ করে যাচ্ছেন। কিন্তু সকালের বিমান হামলার পর প্রতিরক্ষাব্যূহ প্রায় তছনছ হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। অনেকেই এদিক ওদিক পালিয়ে যাচ্ছে। ক্যাপ্টেন আজিজ আপ্রান চেষ্টা করছেন সবাইকে ধরে রেখে যতক্ষন পারা যায় পাক বাহিনীকে নদীর ওপারে ঠেকিয়ে রাখতে।

পাক যুদ্ধ বিমানের পরবর্তি হামলার আগেই আযাদেরকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হবে এই চিন্তা করে আমরা খোলা জায়গায় না দাঁড়িয়ে আপাততঃ একটি বাংকারে ঢুকে পড়লাম। বাংকার তো নয় যেন সাক্ষাত যমঘর। ভিতরের ভ্যাপসা গরমে ভিজে জব জবা হয়ে আমরা আর কোন ভাবেই ভিতরে থাকতে না পেরে বিমান হামলার সম্ভাব্য হামলার আশংকা থাকা সত্তেও বাইরে বের হয়ে আসি। কুশিয়ারাকে ডানে রেখে আমরা পশ্চিম দিকে খুব দ্রুততার সাথে হাটতে থাকি। উদ্দেশ্য পরবর্তী বিমান হামলার আগে যেন কোন নিরাপদ আশ্রয়ে পৌছাতে পারি।

বাঙ্কার ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসার পর যুক্ত আলো-বাতাস পেয়ে আমাদের বুক ভরে উঠলো স্বস্তির নিঃশ্বাসে। আমরা যেনো নতুন করে প্রাণ ফিরে পেলাম দেহে। মহান আল্লাহতালার কাছে শুকরিয়া জানালাম আমাদেরকে এখনো বাচিয়ে রাখার জন্য। আমরা ছয় জন মনে হল নবজীবন লাভ করলাম। আমরা সাময়িক ভাবে ভুলে যাই আমাদের বিপদের সম্ভাবনার কথা, ভুলে যাই পাকিস্তানি যুদ্ধবিমানের সম্ভাব্য হামলার কথা। খোলা বাতাসে প্রানভরে নিঃশ্বাস নিয়ে আমরা দ্রুত হাটতে থাকি দূরের দৃষ্টি সীমায় যে গ্রামটি দেখা যাচ্ছে তার উদ্দেশ্যে। নব উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত হয়ে আমরা দৌড়াতে থাকি। প্রায় মিনিট পনের হাঠার পর পৌছে যাই সেই গ্রামের সুশীতল ছায়ারাশিতে।

 

আমরা গ্রামের ভিতরে ঢুকি না, হাঁটতে থাকি গ্রামকে ডানে রেখে গ্রামের বামপাশ ঘেঁষা জমির আল ধরে। গ্রামটি দেখে মনে হল যেন নিজ গ্রামেই যেন চলে এসেছি? বাংলামায়ে সব গ্রামই যে একই রকম। গেয়ে উঠলাম সমস্বরে "এ কি অপরূপ রূপে যা তোমার হেরী পল্লী জননী"। সুর আর বেসুরো গলায় কত গান গেলাম। কত দেশাত্মবোধ গান যে মনে আসল প্রাণ ফিরে পেয়ে। আমরা বনকাদিপুর গ্রামকে বায়ে রেখে পড়ন্ত বিকেলে মথুরাপুর পৌছি। পুরা গ্রামের লোকজন ইতিমধ্যে ভয়ে আরো ভাটির দিকে চলে গেছে। আমরা এখন মোটামুটি শেরপুর থেকে একটা নিরাপদ দূরত্ব পাড়ি দিয়ে চলে এসেছি। শেরপুরের প্রতিবন্ধকতার কারনে আমাদেরকে এই ভাটির দিকে চলে আসতে হয়েছে। নতুবা স্বাভাবিক সময় হলে আমরা শেরপুর সাদীপুর ফেরি পার হয়ে বালাগঞ্জ থেকে জগন্নাতপুরের রাস্তা দিয়ে সুনামগঞ্জ যাওয়ার সহজ রাস্তায় যাওয়ার চেষ্টা করতাম। এখন আমাদেরকে ঘোরা পথে অনেকদূর হেটে সামনের দিগলবাগ খেয়া পার হয়ে হাওর বিল আর ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে জগন্নাতপুর পৌছাতে হবে। আমরা এখন অনেক পরিশ্রান্ত। তাই একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। সবাই গাছের ছায়ার নীচে আশ্রয় নিলাম। পড়ন্ত বিকেলে একটা মৃদুমন্দ ঠান্ডা বাতাস আমাদের শরীর জুড়িয়ে দিল। তৃষ্ণা নিবারন করার জন্য পুকুর থেকে পেট ভরে পানি পান করে নিয়ে বোরো ধানের খড়ের বিছানা করে আমরা সবাই শুয়ে পড়ি। সবার চোখ যেন লেগে আসছিল।

 

 

 

আমরা যখন বিশ্রাম নিচ্ছি, কেউ উদাস ভাবে মনে মনে দুপুরের ঘটনার রুমন্তন করছি, কেউ কেউ সিগারেট ধরিয়ে সুখটান দিচ্ছে তখন হঠাত করে যুদ্ধ বিমানের বিকট আওয়াজে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে শুয়া বসা থেকে লাফিয়ে উঠে নিজেদের নিরাপদ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠি। কেউ কেউ ঝুপের আড়ালে, খড়ের গাদায় হুড়মোড় করে নিজেদের সর্বাত্মক লুকিয়ে ফেলার ব্যর্থ প্রয়াশে নিয়োজিত হই। যুদ্ধবিমান দুটি আমাদের মাথার উপরে একেবারে নীচ দিয়ে উড়ে শেরপুর ফেরির দিকে চলে গেল। এত নীচ দিয়ে যাচ্ছিল যেন মনে হচ্ছিল রাইফেল দিয়ে গুলি করলেই পড়ে যাবে । আসলে তা কিন্তু নয়। আমরা গুলি করলে হয়তো কোন ভাবেই বিমানের গায়ে লাগাতে পারতাম না উপরন্তু ওরা আমাদের অস্তিত্ব টের পেয়ে যেত। আর তখনই আমাদের টার্গেট করে ফেলতো। সুতরাং বিমান দুখানা ঢাকার দিকে এক্কেবারে চলে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা নিজেদেরকে লুকিয়ে রেখেছিলাম।

 

কোথা দিয়ে যে বেলা পড়তির দিকে চলে গেলো বোঝাই যাইনি। বিকেলের ঝাঁঝহীন মিষ্টি রোদ জানিয়ে দিলো বেলা আর বেশি বাকি নেই, দিনের আলো ফুরিয়ে যাওয়ার সময় সন্নিকটে এসে গেছে। এভাবে এখানে বসে থাকা আর সমীচীন হবে না। সন্ধ্যা সমাগত, বিমান হামলার ভিতর দিয়ে কিভাবে যে বেলা গড়িয়ে গেছে তা আমাদের খেয়ালেই ছিল না। রক্তিম সুর্য্যটা বলে দিচ্ছে সন্ধ্যা হতে আর বেশি দেরি নেই। সুরমা নদী ডানে রেখে আইনপুর গ্রাম পাড়ি দিয়ে আমরা সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় দীগলবাগ বা আশপাশের কোন নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হবে।

নদী পাড়ের গ্রামগুলোর একটি থেকে আরেকটির দূরত্ব অনেক। ছোট্ট গ্রাম দুর্গাপুর পর্যন্ত যেতে যেতে সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে। অজানা অচেনা জায়গায় রাতের অন্ধকারে পথ চিনে চলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়, নিরাপদ ও নয়। তাই আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিই, রাতের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নেবার। রাতের অন্ধকারের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াও পেটের ক্ষুধাও নিবারন করতে হবে। জনশূন্য গ্রাম। মানুষজন পাকিস্তানিদের বিমান হামলার ভয়ে বাড়িঘর ফেলে রেখে নিরাপদ আশ্রয়ে দূরের আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে চলে গেছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর গ্রামের এক গৃহস্থ বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় চাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। একটি বাড়িতে মাত্র একজনকে পেলাম যিনি রয়ে গেছেন গৃহস্থালি পাহারা দেওয়ার জন্য। অন্যরা সবাই নিরাপদ এলাকায় চলে গেছেন। বয়স্ক লোকটি আমাদেরকে সশস্ত্র অবস্থায় দেখে প্রথমে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। যুক্তি বাহিনীর লোক শুনে তিনি আশস্ত হন।

 

তাঁর ভয়ে কেটে যাওয়ার পর তৎপর হয়ে ওঠেন আমাদের সাহায্য করার জন্য। সাধ্যমতো সাহায্যও করেছিলেন তিনি সেদিন। রাতে আমরা বাহিরের ঘরের একটি রুমে কোন রকম শুয়ে বসে রাত কাটিয়ে দেই। রাতের বেলা গৃহস্ত তার নিজ হাতে আমাদের রান্না করে খাওয়ালেন। পরদিন প্রত্যুষে আমরা গৃহস্তের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আউসকান্দির দিকে যেতে থাকি। বিদায়ের আগে গৃহস্তের কাছ থেকে জেনে নেই কোন দিকে গেলে সুনামগঞ্জ যাওয়ার রাস্তা আমাদের জন্য সহজ ও নিরাপদ হবে। আমাদের ধারনা, আউসকান্দি বাজারে গেলে চা নাস্তা কিছু খেয়ে পরে গৃহস্তের দেখানো পথে নদী পার হয়ে আমরা সুনামগঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে পারবো। আউসকান্দি বাজারে ঢোকার পর লোকজন আমাদেরকে ঘিরে ধরে জানতে চায় শেরপুরের সর্বশেষ অবস্থা। আমরা কোন কিছু খাওয়ার অর্ডার দেয়ার আগেই অন্যরা সবাই আমাদেরকে খাওয়ানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। কার আগে কে দাম মিটিয়ে দিবে তার জন্য রিতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।

 

আউসকান্দি থেকে বের হয়ে পরপর কয়েকটি মাঠ ও গ্রাম পেরিয়ে কসবা গ্রামের লিপাই মিয়ার বাড়ি এসে পৌঁছি। উনি আওয়ামীলীগের লোক, উনার কাছ থেকে আমরা সহযোগিতা পাব এই আশায় উনার সাথে দেখা করি। উচা লম্বা লিপাই মিয়া আমাদের দেখেই হাকডাক শুরু করলেন আমাদের দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করার জন্য। আমরা দেখলাম উনার বাড়ি জুড়ে যেন এক এলাহি কান্ড চলছে। উজানের এবং আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটে আসা অনেকেই জড়ো হয়েছেন উনার বাড়িতে। জল টংগিতে বসে মাদের সাথে বসে গল্প করছেন, আবার গল্পের মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে তদারকি ও করছেন নতুন কারা এলো, কাদের খাওয়া- দাওয়ার ব্যবস্থা এখনো হয়নি, নবাগতদের থাকার খাওয়া কি করা যায়,ওঠা কারো কোনো প্রকার অসুবিদা হচ্ছে কি- না কিংবা কেউ কোন অসুখ বিসুখে পড়লো কি-না।

 

আমরা দুপুরে উনার বাড়িতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে লিপাই মিয়াকে তাড়া দিচ্ছি আমাদেরকে বিদায় দেয়ার জন্য। উনিও আমাদের সাথে খাওয়া দাওয়া শেষ করে বাড়ির ভিতর দিকে চলে গেলেন। ফিরে আসবাক্‌ বে লেন সাথে এক ভদ্রলোককে নিয়ে। উনি আজযান মিয়া যার বাড়ি সুনামগঞ্জের রাস্থায় পড়ে। উনিও উনার বাড়িতে যাবেন যার সাথে আমরা অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারবো।

 

 

লিপাই মিয়ার বাড়ি থেকে আমাদের চলার পথের সাময়িক সঙ্গী হলেন আজমান উল্লাহ। সম্পর্কে লিপাই মিয়ার ভাই। তিনি তাঁর বাড়ি যাবেন। ভায়রা ভাইয়ের বাড়ি এসেছিলেন আংশিক বেড়াতে এবং আংশিক পার্থিব প্রয়োজনে। আমাদের সুনামগঞ্জ যাওয়ার রাস্তা আজমান উল্লার গ্রাম আলেকদি গ্রামের পাশ দিয়ে। আজমান উল্লাকে আলোকদি গ্ৰাম পৰ্যন্ত পথের সঙ্গী হিসাবে পেয়ে আমাদের অনেক উপকার হয়। কাউকে আর পথের দিশা জিজ্ঞেস করে বিরক্ত করার দরকার হয়নি। লিপাই মিয়া ও যেনো আশ্বস্ত হলেন আজমান উল্লাহ যেচে আমাদের সঙ্গী হলে। নতুবা লিপাই মিয়াকে আসতে হতো তাঁর স্থাপিত বাজার লিপাইগঞ্জ অবধি আমাদের পথ চিনিয়ে দেওয়ার জন্য। কুশিয়ারা নদীর তীরে নিজ স্ব জমির ওপর লিপাই মিয়ার বাজার লিপাইগঞ্জ বাজার। নদীর অপর পাড় দিয়ে আমাদের সুনামগঞ্জ যাওয়ার রাস্তা। বাজার সংলগ্ন ফেরিঘাট দিয়েই আমরা নদী পাড়ি দিয়ে নদীর দক্ষিণ পাড় থেকে উত্তর পাড়ে যাই। আলেকদি গ্রামের প্রবেশ মুখে ঢুকতেই আজমান উল্লাহ আমাদের চেপে ধরলেন তাঁর বাড়িতে যাওয়ার জন্য।  এমনভাবে ধররেন তাঁর অনুরোধ কোনো প্রকারেই আমাদের পক্ষে আর উপেক্ষা করা সম্ভব হয় নি- যেহেই হলো ভদ্রলোকের অনুরোধ রক্ষার্থে তাঁর বাড়িতে। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তিনি আবার আমাদের ভাত না খাইয়ে ছাড়বেন না। আমরা বললাম ভাত খাওয়ানোর দরকার নেই চা দিয়ে দেন। চাতেই আপনার অতিথেয়তা পেয়ে আমরা খুশি হবো। ভদ্রলোক বললেন মজার কথা আমি ভাই ভাত খাওয়া মানুষ, চা খাই না, তাই চা রাখার রেওয়াজও নেই আমার বাড়িতে।

 

কথাটা কিন্তু সত্যি নয় তাঁর ঘরে চায়ের সব সরঞ্জামই আছে আসল কথা হলো তিনি আমাদের ভাত খাওয়াবেন বলে পণ করে বসে আছেন। তিনি তার বাড়িতে চায়ের প্রচলন নেই বললেও ভাত খাবার পর বিদায় নেবার বেলা আমাদের সামনে এনে রাখা হলো অত্যন্ত সুস্বাদু চা। সম্পন্ন কৃষক। গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু-মহিষ। খাবার খেতে বসে আমরা বিষ্ময়ে অবকা হয়ে যাই। তাঁর বাড়িতে এসে ওঠার আধা ঘন্টা সময়ও অতিবাহিত হয়নি এরই মধ্যে এতো আয়োজন। যেনো জামাই খাওয়ানোর ব্যবস্থা। নিজের পুকুর থেকে তুলে রান্না করা যাছের তিন মাছের তিন পদের সঙ্গে মোরগভুনা। বাটি ভর্তি দুধের সর (মালাই)। দুধের ফিরিস্তি আর নাইবা দিলাম। খেতে বসে জানতে পারলাম আজমান উল্লাহ নাকি কসবা গ্রাম থেকে ভায়রা একজন লোক পাঠিয়ে তাঁর বাড়িতে আগাম সংবাদ দেন যে, আমাদের জন্য খাবার তৈরি করে রাখতে। আজমান উল্লাহ আক্ষেপ করে বললেন এখন তাঁর আর বয়স নেই যুদ্ধে যাওয়ার শরীরও নেই নতুবা তিনি আমাদের সঙ্গে শামিল হতেন যুদ্ধ করার জন্য। তারপরও বোঝাপড়া করে দেখবেন শরীরের সাথে, শরীর যদি সায় দেয় তাহলে অবশ্যই তিনি যুদ্ধে যাবেন- হাতিয়ার হাতে নিয়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়বেন মাতৃভূমি মুক্তির প্রত্যাশায়। যদি শরীর না মানে কি করবেন-চেষ্টা থাকবে মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সাহায্য-সহযোগিতা দ্বারা দেশের জন্য কাজ করার। আমাদের মনে প্রত্যয় জন্মে আজমান উল্লাহ মুখে যা বলছেন তা তিনি অবশ্যই করবেন। স্বল্প সময়ের পরিচয়ে তাঁর ভিতরের বাঙালিত্বেও আগুনের ফুলকির যে প্রমাণ পেলাম আমরা অভিভূত না হয়ে পারিনি। ভাটি বাংলার এই কৃষকের হৃদয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আকৃতি যেনো খোদাই করে লেখা। আজমান উল্লার বাড়ি থেকে বেরুতে বিকেল হয়ে যায়। আজমান উল্লাহ চাইলেন আমাদের এগিয়ে দিতে তিনি শিবগঞ্জ বাজার অবধি যাবেন। আলেকদি গ্রাম থেকে শিবগঞ্জ বাজার যাইল দই আড়াইয়ের পথ। বয়স্ক মানুষ এতো পথ হেঁটে যাবেন আবার ফিরে আসবেন চাট্টিখানি কথা নয়। আমরা তাঁকে বারণ কের তাঁর গ্রামের শেষ প্রান্ত থেকে বাড়িতে ফিরিয়ে দিই। এমনিতেই আমাদের জন্য অনেক করেছেন। বিদায়কালে আমাদের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন, দরকারে কাজে লাগাবেন। কথা বলতে গিয়ে কন্ঠ বুঝ আসে, চোখ দু'টিও জলে ভিজে যায়। ভাবখানা যেনো তিনি তাঁর ছয়জন পরমাত্মীয়কে বিদায় জানাচ্ছেন জন্মের মতো। এই সব সাধারণ মানুষের নিখাদ ভালোবাসা আর প্রেরণা ছিল বলেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছিল। পথ চলতে চলতে দেখলাম অসীম আগ্রহ ভরে মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের দেখছে।

 

 

 

লিপাই মিয়ার বাড়ি থেকে আমাদের চলার পথের সাময়িক সঙ্গী হলেন আজযান উল্লাহ। সম্পর্কে লিপাই মিয়ার ভাই। তিনি তাঁর বাড়ি যাবেন। ভায়রা ভাইয়ের বাড়ি এসেছিলেন আংশিক বেড়াতে এবং আংশিক পার্থিব প্রয়োজনে। আমাদের সুনামগঞ্জ যাওয়ার রাস্তা আজমান উল্লার গ্রাম আলেকদি গ্রামের পাশ দিয়ে। আজমান উল্লাকে আলোকদি গ্রাম পর্যন্ত পথের সঙ্গী হিসাবে পেয়ে আমাদের অনেক উপকার হয়। কাউকে আর পথের দিশা জিজ্ঞেস করে বিরক্ত করার দরকার হয়নি। লিপাই মিয়া ও যেনো আশ্বস্ত হলেন আজমান উল্লাহ যেচে আমাদের সঙ্গী হলে। নতুবা লিপাই যিয়াকে আসতে হতো তাঁর স্থাপিত বাজার লিপাইগঞ্জ অবধি আমাদের পথ চিনিয়ে দেওয়ার জন্য। কুশিয়ারা নদীর তীরে নিজস্ব জমির ওপর লিপাই মিয়ার বাজার লিপাইগঞ্জ বাজার। নদীর অপর পাড় দিয়ে আমাদের সুনামগঞ্জ যাওয়ার রাস্তা। বাজার সংলগ্ন ফেরিঘাট দিয়েই আমরা নদী পাড়ি দিয়ে নদীর দক্ষিণ পাড় থেকে উত্তর পাড়ে যাই। আলোকদি গ্রামের প্রবেশ মুখে ঢুকতেই আজমান উল্লাহ আমাদের চেপে ধরলেন তাঁর বাড়িতে যাওয়ার জন্য। এমনভাবে ধররেন তাঁর অনুরোধ কোনো প্রকারেই আমাদের পক্ষে আর উপেক্ষা করা সম্ভব হয় নি- যেহেই হলো ভদ্রলোকের অনুরোধ রক্ষার্থে তাঁর বাড়িতে। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তিনি আবার আমাদের ভাত না খাইয়ে ছাড়বেন না । আমরা বললাম ভাত খাওয়ানোর দরকার নেই চা দিয়ে দেন। চাতেই আপনার অতিথেয়তা পেয়ে আমরা খুশি হবো। ভদ্রলোক বললেন মজার কথা আমি ভাই ভাত খাওয়া মানুষ, চা খাই না, তাই চা রাখার রেওয়াজও নেই আমার বাড়িতে।

কথাটা কিন্তু সত্যি নয় তাঁর ঘরে চায়ের সব সরঞ্জামই আছে আসল কথা হলো তিনি আমাদের ভাত খাওয়াবেন বলে পণ করে বসে আছেন। তিনি তার বাড়িতে চায়ের প্রচলন নেই বললেও ভাত খাবার পর বিদায় নেবার বেলা আমাদের সামনে এনে রাখা হলো অত্যন্ত সুস্বাদু চা। সম্পন্ন কৃষক। গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু-মহিষ। খাবার খেতে বসে আমরা বিষ্ময়ে অবকা হয়ে যাই। তাঁর বাড়িতে এসে ওঠার আধা ঘন্টা সময় ও অতিবাহিত হয়নি এরই মধ্যে এতো আয়োজন। যেনো জামাই খাওয়ানোর ব্যবস্থা। নিজের পুকুর থেকে তুলে রান্না করা যাছের তিন মাছের তিন পদের সঙ্গে মোরগভুনা। বাটি ভর্তি দুধের সর (মালাই)। দুধের ফিরিস্তি আর নাইবা দিলাম। খেতে বসে জানতে পারলাম আজমান উল্লাহ নাকি কসবা গ্রাম থেকে ভায়রা একজন লোক পাঠিয়ে তাঁর বাড়িতে আগাম সংবাদ দেন যে, আমাদের জন্য খাবার তৈরি করে রাখতে। আজযান উল্লাহ আক্ষেপ করে বললেন এখন তাঁর আর বয়স নেই যুদ্ধে যাওয়ার শরীরও নেই নতুবা তিনি আমাদের সঙ্গে শামিল হতেন যুদ্ধ করার জন্য। তারপরও বোঝাপড়া করে দেখবেন শরীরের সাথে, শরীর যদি সায় দেয় তাহলে অবশ্যই তিনি যুদ্ধে যাবেন- হাতিয়ার হাতে নিয়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়বেন মাতৃভূমি যুক্তির প্রত্যাশায়। যদি শরীর না মানে কি করবেন-চেষ্টা থাকবে মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সাহায্য-সহযোগিতা দ্বারা দেশের জন্য কাজ করার। আমাদের মনে প্রত্যয় জন্মে আজমান উল্লাহ মুখে যা বলছেন তা তিনি অবশ্যই করবেন। স্বল্প সময়ের পরিচয়ে তাঁর ভিতরের বাঙালিত্বেও আগুনের ফুলকির যে প্রমাণ পেলাম আমরা অভিভূত না হয়ে পারিনি। ভাটি বাংলার এই কৃষকের হৃদয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আকৃতি যেনো খোদাই করে লেখা। আজমান উল্লার বাড়ি থেকে বেরুতে বিকেল হয়ে যায়। আজমান উল্লাহ চাইলেন আমাদের এগিয়ে দিতে তিনি শিবগঞ্জ বাজার অবধি যাবেন। আলেকদি গ্রাম থেকে শিবগঞ্জ বাজার মাইল দই আড়াইয়ের পথ বয়স্ক মানুষ এতো পথ হেঁটে যাবেন আবার ফিরে আসবেন চাট্টিখানি কথা নয়। আমরা তাঁকে বারণ কের তাঁর গ্রামের শেষ প্রান্ত থেকে বাড়িতে ফিরিয়ে দিই। এমনিতেই আমাদের জন্য অনেক করেছেন। বিদায়কালে আমাদের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন, দরকারে কাজে লাগাবেন। কথা বলতে গিয়ে কন্ঠ বুঝ আসে, চোখ দু'টিও জলে ভিজে যায়। ভাবখানা যেনো তিনি তাঁর ছয়জন পরমাত্মীয়কে বিদায় জানাচ্ছেন জন্মের মতো। এই সব সাধারণ মানুষের নিখাদ ভালোবাসা আর প্রেরলা ছিল বলেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছিল। পথ চলতে চলতে দেখলাম অসীম আগ্রহ ভরে মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের দেখছে।

 

কেবল চোখের দেখা দেখেই শেষ নয় কাছে এসে কথা বলতে চায়, কিছু না কিছু খাওয়াতে চায়, পকেটো টাকা-পয়সা, বিড়ি-সিগ্রেট গুঁজে দিয়েও যেনো তৃপ্ত নয় পুরোপুরি আরো কিছু দেওয়ার বাকি রয়ে গেছে। মানুষ চাইতো উধাড় করে সবকিছু দিয়ে দিতে। শিবগঞ্জ বাজার মূলত হাট। আশপাশের গাঁও-গেরামের মানুষ এই হাট থেকেই তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় সওদাপাতি কিনে থাকেন। ছোট্ট নদীটির দক্ষিণ পারের হাট শিবগঞ্জ। গ্রাম্য হাটগুলো সাধারণত যে রকমের হয়ে থাকে শিবগঞ্জ সেই রকমেরই হাট-সপ্তাহে দুই দিন বসে। সেদিন ছিল শিবগঞ্জের হাটের দিন। আমরা শিবগঞ্জ বাজার গিয়ে পৌঁছলে হাটজুড়ে হৈ চৈ শুরু হয়ে যায় । বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ি, মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখে। চা পানের পর চায়ের দোকানদার আমার নিকট থেকে পয়সা নিতে চায় না জোর করে দিতে চাইলে উল্টো রাগ করে বলে তোমাদের নিকট থেকে পয়সা নেয়া অন্যায়। মানুষের এই আচরণ হলো পক্ষান্তরে দেশ ও জাতির প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। নদী পাড়ি দিয়ে খেয়া নৌকার মাঝিকে তার পারাপারের টাকা দিতে গেলে মাঝি টাকা নিলো না। সবিনয়ে বললো মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট থেকে আমি টাকা নিতে পারি না নিলে অপরাধ হবে।

আমার উচিত ছিল আপনাদের কিছু দেওয়া কিন্তু আমার সেই সামর্থ্য নেই। তাই দেশের কাজ যেটুকু সম্ভব নিজের শরীর দিয়েই করতে চেষ্টা করব মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে। নদী পাড়ি দিই সন্ধ্যার ঘোর লাগা সময়ে। পথ কিছুট হেঁটে যাওয়ার পর রাত নামে। মেঘ জোছনার রাত। আমরা পথ হাঁটছি মেঘের ফাঁকে ফাকে গলে পড়া জোছনার আধো আধো আলোয় পথ দেখে। মেঠোপথ হাঁটতে হচ্ছে হোঁচট খেয়ে খেয়ে। অচেনা অজানা জায়গার মেঠোপথ, তার ওপর আলো আঁধারী রাত পথ চলতে হচ্ছে পদক্ষেপ গুণে গুণে। বিস্তীর্ণ মাঠ লোকালয় এখনো অনেক দূর। হঠাৎ দশ বারোজন লোক ছুটে এসে আমাদের পথ াগলে দাঁড়ায় হাত পনেরো কুড়ির ব্যবধানে। লোকগুলো ছিল লুটেরা। ওরা ভাবচিল আমরা বুঝি শরণার্থী, ভারতের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি সোনা-দানা, টাকা- পয়সা সঙ্গে করে নিয়ে। তাদের সাথে জোরালো আলোর চর্টলাইট এবং দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র। তাদের তাতের চর্চলাইটের আলো এসে আমাদের ওপর পড়ার পর তারা আমাদের কাঁধে ঝুলানো রাইফেল দেখতে পায় এবং প্রাণপণ দ্রুত দৌড়ে পালিয়ে যায়।  পেছন থেকে অনুনয় করে ডেকেও ফিরাতে পারিনি। আমরা ভাবছিলাম ওরা আমাদের পাকিস্তানি হানাদার ভেবে প্রাণের ভয়ে পালাচ্ছে। কিন্তু না, বিষয়টা আদৌ তা নয়। বিষয়টা খোলাসা হয় ঘোষগাঁও ও যাওয়ার পর। ওরা কেবল রাতের বেলাতেই নয় দিনে দুপুরেও নাকি ফাঁকা মাঠে পথচারীদের ওপর হামলা লটতরাজ করে থাকে। ভারতে আশ্রয় প্রত্যাশী গৃহত্যাগী বিপদগ্রস্ত মানুষের ওপর হামলা করে যথাসর্বস্ব এরা কেড়ে নেয়। ঘোগাঁও পৌঁছতে আমাদের বেশ রাত হয়ে যায়। নিঝুম রাতের ঘুমিয়ে পড়া গ্রাম। মানুষ জনের সাড়াশব্দ নেই। আশ্রয় নেবো কোথায় ভেবে পাচ্ছি না। গ্রামের ভেতরের রাস্তা দিয়ে হাঁটছি অন্ধকারে ও পথ ঠুকে ঠুকে। এমন সময় চোখে পড়ে রাস্তার পাশে এক বাড়ির গোয়াল ঘর, গোয়াল ঘরে একজন লোক আলো হাতে গরু বাছুরের তদারকি করছে। আমরা এগিয়ে গিয়ে বাড়ির বাইরে থেকে ডাক দিলে লোকটি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে এবং আমাদের বিস্তারিত জানার পর ভেতর বাড়িতে নিয়ে যায়। আশ্ৰয় দেয় রাতে থাকার।  আমরা রাতের মতো থাকার জন্য নিরাপদ আশ্র পেয়ে আশ্বস্ত হই। উল্লেখ্য যে, আযাদের আশ্রয়দাতা গৃহস্ত অত্যন্ত দীন- দরিদ্র মানুষ। তবে হ্যাঁ অন্তর অত্যন্ত বিশার । লোকটির অনুরোধ সত্ত্বেও আমরা রাতে খাবার খেতে সম্মত হইনি-মিথ্যে করে বলি সন্ধ্যার সময় খেয়েছি তাই এখন আর পেটে ক্ষুধা নেই। ভেবে দেখলাম এতো রাতে আমাদের জন্য খাবার যোগাড় করা লোকটির পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে। গরিব মানুষ ঘরে হয়তো ছয়জন মানুষের খাবার মতো চাল-ডালের ব্যবস্থা নেই। তারা নিজেরা তো রাতের খাবার অনেক আগেই শেষ ঘুমাবার পাঁয়তারয় ছিল। আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে ঝঞ্চাটে পড়ে গেলে এমনিতেই। অবাক করা বিষয় হলো বাড়ির অন্যান্য পরিবার গুলোর সবাই সম্পদশালী, দরদোর পাকা। কিন্তু এই ঘরেও কোন মানুষ নেই সবাই প্রবাসে। ঘরগুলোর দরজায় তালা ঝোলানো। আমাদের আশ্রয়দাতা অত্যন্ত দরিদ্র। তার সামর্থ্য নেই বিদেশ যাওয়ার যতো তাই তিনি বৌ বাচ্চা নিয়ে বড় বাড়ি এক প্রান্তে পড়ে আছেন। নিজের কুঁড়েঘরেই বাস করে দিন যাপন করছেন। নিজের কোনো জমিজমা নেই অন্যের জমিতে বর্গাচাষ করে ভাগে যা পান তাই তাঁর সংসারে চলে। নড়বড়ে একখানা চৌকিতে শুয়ে কোনো রকমে ঘুমিয়ে আমরা রাত কাটাই। ভোরে ঘুম ভাঙে লোকটির ডাক শুনে। রাতে ঘুমাবার আগে তাঁকে বলে রেখেছিলাম খুব ভোরে জাগিয়ে দিতে। সামান্য চা-মুড়ি খেয়ে আমরা বিদায় নিয়ে চলে যাই জগন্নাথপুর বাজারের দিকে। ইচ্ছে বাজারে গিয়ে শক্ত কিছু খাবার কিনে খাব। জগন্নাথপুর প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা। আমরা বাজারে গিয়ে ঢুকতেই মানুষ ঘিরে দাঁড়ায় আমাদের চারদিকে। অবস্থা দেখে প্রথমে আমরা ভড়কে গেলেও পরে বুঝতে পারি এই মানুষ গুলোর সবাই আমাদের শুভানুধ্যায়ী । সবাই আমাদের নিকট থেকে খবরাখবর জানতে উদগ্রীব। আমরা এক চা দোকানে বসে পরোটা ভাজি খেতে খেতে মানুষের সাথে আলাপ হয়। প্রাক্তন এক পুলিশ সদস্য জানতে চাইলেন আমাদের বাড়ি ঘরের ঠিকানা বিয়ানীবাজার থানায় বাড়ি শুনে বললেণ আপনারা পঞ্চখন্ডি লোক। ভদ্রলোক তার এলাকার মানুষের কাছে পঞ্চখন্ডের যাহাত্ম্য বর্ণনা করে গেলেন অত্যন্ত চমৎকার বয়ানে। পরে জানা গেলো ভদ্রলোক তাঁর চাকরি জীবনে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছেন বিয়ানীবাজার থানা জলটুপ থাকাকালীন সময়ে। ছিলেন সিপাহীর দায়িত্বে এলাকার মানুষের সাথে ছিল খুবই ভালো সম্পর্ক। পঞ্চখন্ডের প্রশংসায় তিনি পঞ্চমুখ। পেটভরে পরোটা ভাজি ও চা-পান শেষে বিদায় নিতে যাব বিভ্রাট দেখা দিলো তখনই। আমরা আমাদের খাবারের মূল্য পরিশোধ করতে গেলে এক সাথে ছয় সাত জন লোক পয়সা নিতে আমাদের বারণ করেন, এবং তাদের নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় আমাদের খাবারের পয়সা দেওয়া নিয়ে। তারা প্রত্যেকেই চাইছেন নিজের থেকে আমাদের খাবারের পয়সা পরিশোধ করে ধন্য হতে। প্রতিযোগিতার সহজ সমাধান করে দিলো চা দোকানদার নিজে। প্রায় আমাদের বয়সী লোক। গভীর প্রত্যয়ের সাথে যখন বললো আপনারা পয়সা দেওয়ার জন্য একে অন্যের সাথে।

 

রাতের অন্ধকারে পথচলা মুশকিল উপরন্তু বিপদ আপদের কথা তো বলা যায় না। রাতের বেলা সুনামগঞ্জ শহরে গিয়ে ঢোকাও বিপদজ্জনক। শহরের মানুষ পাকিস্তানি সৈন্য ভেবে আমাদের ওপর আক্রমণ করেও বসতে পারে। মনে আশার সঞ্চার হয় অদূরে রাস্তার ওপর একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পেয়ে। কাছে গিয়ে দেখে মনে হলো লোকটি কিসের যেনো অপেক্ষা করছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আযাদের দেখে কি ভাবলো কে জানে চেহারা দেখে আঁচ করা গেলো না। তবে আমরা আযাদের পরিচয় দেওয়ার পর থতমত খেয়ে গেলো। পরে অবশ্য সামলে নিয়ে স্বাভাবিক পর্যায়ে আসে। আমরা ভাবলাম আমাদের লোক তাই রাতে থাকার জন্য তার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি। লোকটি সোজাসাটপটাভাবে আমাদের তার গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের কথা বললো। স্কুলে ঘরে গিয়ে রাত কাটাতে পারেন। এয়াড়া আমি থাকার আর কোনো জায়গা দেখছি না। রাতের খাবার না হয় আমি আমরা বাড়ি থেকে পাঠিয়ে দেবো। আপনার স্কুল ঘরে চেল যান সামনের রাস্তা দিয়ে একটু ভিতরে গেলেই স্কুল ঘর পেয়ে যাবেন। আমি একজনের অপেক্ষা করছি অনেক দূর থেকে দেখা করতে আসছে। সে আমার বাড়ি চেনে না তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। আমরা বললাম স্কুল ঘরে আলো ছাড়া থাকবো কি করে? আমাদের কথা শেষ করতে না দিয়েই বললো চিন্তা করবেন না। আমার বাড়ি থেকে আলো ও জন্য হারিকেন পাঠিয়ে দেবো বাড়ি গিয়েই। আমরা ভাবলাম লোকটি যখন বাঙালি তখন নিশ্চয়ই জয় বাংলার সমর্থক। কিন্তু না আমাদের ধারণা আদৌ সঠিক ছিল না। ব্যাপারটা ছিল পুরোপুরি বিপরীত ধরনের। লোকটির মনে ছিল ভীতি। সে চাইছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের সামনে থেকে সটকে পড়ে। লোকটা ছিল সুনামগঞ্জ অঞ্চলের কুখ্যাত রাজারা নেতা ছাত্তার রাজাকার, জয় কলসের ছাত্তার রাজাকার। যার ভয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মানুষ ছিল আতঙ্কগ্রস্থ। কাকে কখন ধরে নিয়ে তুলে দেয় পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে, সে নিজেও হত্যা করতে পারে। ছাত্তার রাজাকারের নাম শুনলে সেই সময় গর্ভবতী মেয়েদের গর্ভেও ভ্রণি পর্যন্ত নাকি ভয়ে শিউরে উঠত। ভাগ্য আমাদের সুপ্রসন্ন ছিল তাই ছাত্তার রাজাকারের বাড়ি খাবার খেতে হয়নি। আমরা প্রাণে বেঁচে যাই নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে। আমাদের প্রাণে বাঁচিয়ে দেন উজানী গাঁয়ের এক কৃতী সন্তান ন্যাপ কর্মী ঝালু মিয়া ওরফে ছোট্ট ঝালু। ঝালু মিয়া একজন নিবেদিত প্রাণ বাঙালি এবং মুক্তিযোদ্ধাও। ঝালু মিয়া ছিলেন সুনামগঞ্জ শহরে। সকালবেলা সুনামগঞ্জ গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তাঁর মহকুমা নেতৃবৃন্দেরও সাথে আলাপ আলোচনা করে নিজেদের করণীয় বিষয় নির্ধারণী বৈঠক মিলিত হতে। সুনামগঞ্জ মহকুমা ন্যাপের তিনি একজন সদস্য। রাতে শহর থেকে ফিরে গ্রাম এসে ঢোকার মুখেই সংবাদ পেয়ে যান প্রাইমারি স্কুলে এসে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নিয়েছেন। আর যুক্তিযোদ্ধার আশ্রয়দাতা ছাত্তার রাজাকর। ছাত্তার রাজাকার নাকি গ্রামের মানুষকে নিষেধ করেছে স্কুল ঘরে যেতে। শাসিয়েও দিয়েছে এই বলে যে, যে স্কুল ঘরের দিকে যাবে তার পরিণতি ভালো হবে না। ছাত্তার রাজাকার গ্রামের প্রভাবশালী ধনী ব্যক্তি আবার বিডি মেম্বারও তাই গ্রামে তার বেজায় প্ৰতাপ৷ ঝালু মিয়া শহর থেকে বাড়ি ফিরে না এল আমাদের পরিণতি খুবই খারাপ হতো হয়তো ছাত্তার রাজাকারের হাতে সুযোগ ছিল খাবারের সাথে বিষ প্রয়োগ করে আমাদের হত্যা করার। তার বাড়ি হতে খাবার এল নিঃসন্দেহে সরল নে সেই খাবার খেতাম। সংবাদ শুনেই হস্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন ঝালু মিয়া স্কুল ঘরে। এসেই জানতে চান ছাত্তার রাজারের বাড়ি থেকে খাবার এসে গেছে এখনো আসেনি, এসে থাকলে সেই খাবার আমরা কি খেয়েছি। রাজাকার ছাত্তারের বাড়ি থেকে এখন পর্যন্ত খাবার আসেনি শুনে ঝালু মিয়া আশ্বস্ত হলেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললেন ছাত্তারের বাড়ির খাবার এলে আপনারা সেই খাবার খাবেন না। ছাত্তার লোকটি বাংলার স্বাধীনতা বিরোধীদের একজন। খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতে পারে এই লোক। ক'দিন আগে পাকিস্তানি আমিও একখানা গিা সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ এলে ছাত্তার সুনামগঞ্জ চুটে যায় আর্মিদের সাথে মিলিত হতে এবং সুনামগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মার খেয়ে পাকিস্তানি পাকিস্তানি আর্মিরা পালিয়ে যাওয়ার সময় ছাত্তার তাদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করে। গ্রামে এক তরুণকে ঝালু মিয়া তার বাড়ির পাঠিয়ে হারিকেন আনালেন। হারিকেন এলে আমরা স্কুলে ঘরের ভিতরে ঢুকে সুস্তি হয়ে বসতে পাই। এতোক্ষণ তো আমরা বারান্দার মাটিতে বসে অপেক্ষায় ছিলাম ছাত্তার রাজাকার কখন তার বাড়ি থেকে আমাদের জন্য হারিকেন পাঠায়। কখন আমরা হারিকেনের আলোয় সব দেখে শুনে সুস্তিও হয়ে আমরা করতে পারবো। ঝালু মিয়ার বাড়ি থেকে খাবার এলো অনেক রাত করে। তবে কেটলি ভরে চা আসে মুড়ি সমতে রাত আটটার দিকে। খাবার ছিল ডাল ভাত সাথে হাঁসের ডিম ভুনা। খুব ভোরে আমরা যাত্রা শুরুর প্রস্তুতি নিই। কিন্তু ঝালু মিয়াসহ গ্রামের অন্যরা একটু ভালো করে নাস্তা করিয়ে রাতের খামতি না পুশিয়ে ছাড়বেন না। আযাদের ইচ্ছা ছিল রোদ তেঁতে ওপর ঝালু মিয়া নিজের আমাদের সাথে বসে রাতের খাবার খেলেন। রাতে ঘুমালেন ও আমাদের যতোই স্কুলে ঘরে বেঞ্চে শুয়ে। আমরা তাঁকে বলি আপনি বাড়ি যান এখানে আমাদের কোন অসুবিধা হবে না, অযথা আপনি আমাদের সাথে থেকে কষ্ট করবেন না। বাড়ি গিয়ে আমারম করে ঘুমান। ঝালু মিয়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে ছেড়ে বললেন দেশ হানাদারমুক্ত না হওয়া অবধি বাঙালির আরাম করে ঘুমবার আর অবকাশ নেই। বাঙালি সেই দিনই আরাম করে ঘুমাতে পারব, যেদিন বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হবে, যেদিন বাংলাদেশের যুক্ত আকাশে লাল সবুজের পতাকা নিঃশঙ্কাভাবে পত পত শব্দে উড়তে পারবে। রাতে এক ফাঁকে ঝালু মিয়া তাঁর বাড়ি গিয়ে বৃদ্ধা যাকে বলে আসনে রাতে তিনি স্কুল ঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে খাকবেন। সংসারে ঝালু মিয়ার আপনজন একমাত্র বৃদ্ধা যা-ই আছেন। যা ছেলের সংসার। আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। পৈত্রিক জমি-জমা আছে অল্পই। নিজে এ পর্যন্ত কিছুই করতে পারেননি, করার ধান্ধায়ও নেই। নিজে চাষাবাদেও নেই। বর্গাদার থেকে ফসল যা ঘরে ওঠে তা দ্বারাই যা ছেলের সংসার চলে কোনো রকমে। ঝালু মিয়া এই সময়ে দেশ এবং রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত আছেন। কথায় কথায় বললেন আপনারা যান, আমরাও আসছি পিছ পিছন। আমাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হবে মেঘালয়ে। আপনাদের তো আগরতলায়। এমএনএ ওবায়দুর রাজা চৌধুরী গেছেন শিলং ফিরে আসলেই জানা যাবে আমরা..........

চলবে

 

আরও ছবি

ভিডিও