অন্যান্য তথ্য
মুক্তিবার্তা নম্বর | লাল মুক্তিবার্তা ১০১০৬০০৬৪ |
---|---|
ভারতীয় তালিকা নম্বর | *** |
মুক্তিবার্তা নম্বর | লাল মুক্তিবার্তা ১০১০৬০০৬৪ |
বাংলাদেশ গেজেট নম্বর | বেসামরিক গেজেট ৬৩০ |
মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান কি না? | yes |
মুক্তিবার্তা নম্বর | লাল মুক্তিবার্তা ১০১০৬০০৬৪ |
---|---|
ভারতীয় তালিকা নম্বর | *** |
মুক্তিবার্তা নম্বর | লাল মুক্তিবার্তা ১০১০৬০০৬৪ |
বাংলাদেশ গেজেট নম্বর | বেসামরিক গেজেট ৬৩০ |
মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান কি না? | yes |
নাম | বয়স | শিক্ষাগত যোগ্যতা |
---|---|---|
সাইফুল ইসলাম | জন্ম-২৮.০৩.১৯৭৩ ইং | বিএ |
নিাহিদা ইসলাম | জন্ম-২৬.০৪.১৯৮০ ইং | এসএসসি |
একাত্তরের সেই মহান যুদ্ধের কথাঃ
মহান মুক্তিযুদ্ধ আমার জীবনের এক স্বর্ণালী অধ্যায়। একটি যুক্ত স্বাধীন দেশের জন্য একজন যোদ্ধা হিসেবে ১৯৭১ সালের রণাঙ্গনের স্মৃতিগুলো এখন বারবার মনে ভেসে ওঠে। যুদ্ধের প্রতিটি অধ্যায়ে আমার সাথী বীর মুক্তিযোদ্বাদের সুখ গুলো ভুলতে পারিনা বিশেষ করে যারা রাত শহীদ হয়েছিলেন।
পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকদের শাসন শোষণ, অত্যাচার নিপীড়ণ, বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, আন্দোলন সংগ্রাম, জেল জুলুম হুলিয়া অবশেষে নিরস্ত্র বাঙ্গালী উপর নির্লজ্জ্ব হানাদারের আক্রমণ, পরে প্রতিরোধ যুদ্ধ, না মানের সেই মহান মুক্তিযুদ্ধ সবই যে আমার চোখে উজ্জ্বল ধ্রুবতারার মতো প্রেরণা, যা মনে হলেই মনে ভিন্ন অনুভূতির সৃষ্টি করে। এখন স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের বীরত্বের গৌরবোজ্জ্বল স্মারক লাল-সবুজ পতাকা দেখলে বুকটা গর্বে ভরে যায়। এই বীরত্বগাঁথার সঙ্গে সম্পৃক্ততায় নিজেকে ধন্য মনে করি। আমি সবসময়ই গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন আমাদের নেতৃবৃন্দকে, বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে। পানি ছাড়া মাছ বাঁচে না, তেমনি মহান মুক্তিযুদ্ধে এদেশের মুক্তিকামী জনগণ ছাড়াও আমাদের বিজয় হতোনা। যুদ্ধকালীন সময়ে এ জাতির আবাল বৃদ্ধবনিতা যাঁরা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছেন তাঁদেরকেও গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। আমি যাঁদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধ করেছি সহযোগী সাহসী সেই রণাঙ্গনের সাথী বন্ধু, প্রেরণা দাতা, প্রশিক্ষণ দাতা, কমান্ডার, সহযোদ্ধা সবার সবার কথা খুব মনে পড়ে। যাঁরা বেঁচে নেই সেই বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা সবসময় মনে প্রাণে এবং যাঁরা বেঁচে আছেন এ জাতির অহংকার গাজী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন ।
আমি অত্যন্ত আনন্দিত মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী এবং বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের ধারায় সারা বিশ্বে চমক সৃষ্টি করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে বর্তমান সরকার যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করছে। বর্তমান সরকারের সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা সবচেয়ে বেশী সম্মান স্বীকৃতি মর্যাদা পেয়েছে, এ জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি রইলো প্রগাঢ় কৃতজ্ঞতা।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সোনালী স্মৃতিতে মাঝে মাঝে হারিয়ে যাই। সেই স্মৃতি ভেসে উঠলে প্রতিটি ঘটনা খুব কাছের এবং আপন মনে হয়। অসীম সাহসিকতা আর দেশপ্রেমের মমত্ববোধে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা অর্থাৎ সে সময়ের তরুণ ৰুবারা যে অসীম সাহসিকতা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা বিরল। নতুন প্রজন্ম অর্থাৎ আমাদের আগামীর সন্তানদের জন্য আমরা মরণপণ যুদ্ধ করেছি। আমাদের সন্তানরা স্বাধীন সমৃদ্ধ দেশে তাদের মেধা বিকাশ ঘটিয়ে সারাবিশ্বে দেশকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করবে সেই শ্বপ্ন নিয়েই আমরা যুদ্ধ করেছিলাম।
যে জাতি তার ইতিহাস জানে না, সে জাতি অগ্রসর হতে পারে না। দেশ ও জাতির জন্য যাঁদের অবদান তাঁদের স্মরণ করলে প্রেরণার সৃষ্টি হয়। সে প্রেরণার এগিয়ে যাওয়ার সাহস সঞ্চার হয়। সেই সাহসেই হয় জয়। "জয় বাংলা, বাংলার অর" এই ঐতিহাসিক স্লোগান জামানের উজ্জীবিত করেছে, এখনও জয় বাংলার ধ্বনী মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় চিতিয়ে উঠে বুক। আমাদের সাহসের কথা, আমাদের ত্যাগের কথা, দেশের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণ বিসর্জনের কথা নতুন প্রজন্মের জানা প্রয়োজন, কি করেছি আমরা। মহান মুক্তিযুদ্ধে নানা ত্যাগ তিতিক্ষা ছিল, রক্ত প্রাণ গেছে, কিন্তু এখন আর সেই ত্যাগের, প্রাণ বিসর্জন দেয়ার স্মৃতি অম্লান নেই। এখন স্বাধীন দেশ, এখন তরুণ যুবাদের আর রক্ত প্রাণ দিতে হবে না, শুধু মেধা প্রজ্ঞায় দেশকে সুন্দর ভাবে গড়তে হবে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাই নতুন প্রজন্মকে প্রেরণার জন্য আমার যুদ্ধকালীন কিছু কথা তুলে ধরার প্রয়াস করছি। বয়সের কারণে নানা স্মৃতিভ্রম আছে, মনের ভাব লেখায় প্রকাশ করতে নানা ভুল থাকতে পারে তবু যতটুক মনে পড়ে তাই তুলে ধরছি।
আমি নজরুল ইসলাম, আমার পিতা হাজী মোঃ ইয়াসিন এবং মাতা কামরুন্নেসা। আমার ভাই বোনদের মধ্যে সবার বড় বোন উম্মে কুলসুম, তারপর ভাই ড. গোলাম মোস্তফা, পরে আমি নজরুল ইসলাম, পরে মাজেদুল ইসলাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম সোলায়মান, বোন আলো ও সবার ছোট সাজেদা। ১৯৪৫ সালের ১২ মার্চ ঢাকার দক্ষিণ যাত্রাবাড়িতে আমার জন্য। পড়া লেখা শুরু দোলাইরপার উচ্চ বিদ্যালয়ে, পরে স্যানিংদীর কালি কুমার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে মেট্রিক, ১৯৭০ সালে কায়েদে আজম কলেজ বতর্মানে যা সরকারী শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে আই এ পাস করি। সংক্ষিপ্তসারে আমি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে, ১৯৭১ সালের মে মাসে ভারতের ত্রিপুরা যাই সেখানে ট্রেনিং শেষে মুক্তিযুদ্ধের ২ নং সেক্টরের অধীনে যুদ্ধকালীন সময়ে “ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন" - এর কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করি। গেরিলা এবং সম্মুখ যুদ্ধ সহ ঢাকায় বিভিন্ন অভিযানে অংশ নিয়েছি।
পাকিস্তানী শাসকদের নানা দুঃশাসন সবসময়ই মনে পীড়া দিয়েছে। প্রতিবাদে মন বিক্ষুব্ধ হয়েছে। ১৯৭১ এর পূর্ববর্তী সময়ে পাকিস্তানীদের সাথে অসহযোগ আন্দোলন সংগ্রাম, গণঅভূত্থান, বিশেষ করে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হলে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচীতে অংশ নিয়েছি।
বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষণের সময় আমি ছিলাম রাজশাহীতে। সেখান থেকে ৮ই মার্চ রেডিওতে এই ভাষণ আমরা গুনি। সে কি ভাষণ, প্রতিটি শব্দ মনের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। মহান নেতা জাতির জনক যখন বলছিলেন, “তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম- আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম- স্বাধীনতার সংগ্রাম"। জয়বাংলা!!! সেই ভাষণ আর সেই তেজদীপ্ত শ্লোগানে মনে ঝড় উঠে, সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মতো গর্জে উঠি তখন, জয়বাংলা ধনীতে। যুদ্ধের প্রস্তুতি মনে তিত্তি সৃষ্টি করে। আমরা তখন প্রতিদিনই ঢাকার খোঁজখবরের অপেক্ষায় থাকি। তবে যে দিনের ঘটনা পত্রিকার পেতাম তা একদিন পর। রেডিওর পাশে বসে থাকতাম, তু কিছু বলে কিনা। রাজশাহীতে তখন স্থানীয় যুবকদের সাথে নিয়ে আমরা নানা দলা - পরামর্শ করতে থাকি, আমাদের কি করণীয়, আমরা কি করবো। ২৭ মার্চ দুপুর বেলা আমরা বোস পাড়ায় তেমনি যুবকদের নিয়ে বসা ছিলাম, তখন একজন পুলিশ সদস্য সেন্ডো গেঞ্জি খাকি প্যান্ট পড়ে সাইকেল দিয়ে আমাদের কাছে এসে বলে, আমরা পাঞ্জাবীদের সাথে বিদ্রোহ করেছি। আমাদের রেশন বন্ধ করে দিয়েছে, পুলিশ লাইনে বাগামী পুলিশ আমরা দুই দিন যাবৎ অনাহারে আছি, আমাদের পাঠা তখন আমরা সেখানকার উঠতি ছেলেরা মিলে বাড়ি বাড়ি থেকে খাবার সংগ্রহ করে পুলিশ লাইনে পাঠালাম। সেই দিনই দুপুরে ভারতের আকাশবাণীতে একই শিল্পীর আসরে চলছিল পান, একটি গানের পরেই শুনতে পাই, একটি বিশেষ ঘোষণা, "আমি দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায় বলছি, ঢাকার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ঢাকার সাথে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।” আমরা তখন কি করবো দিশেহারা। এমন সময় রাজশাহী রেডিও ওপেন হয়। সেখানে শুনতে পাই বিশেষ ঘোষণা, যার যা বৈধ অস্ত্র নিকটস্থ থানায় জমা দেন। এখবর শুনতে পাওয়ার পথে দেখি ৬ জন লোক (বিহারী) ৬ টি বজ্রক আর একটি পয়েন্ট টুটু রাইফেল আর কিছু গুলি নিয়ে পান খেয়ে হাসতে হাসতে থানার দিকে যাচ্ছে, আমরা যুবকরা তখন তাদেরকে পথে থামিয়ে দেই, এবং ধমক দিয়ে তাদের কাছ থেকে অস্ত্র গুলো ছিনিয়ে নেই, তারা ভয়ে সে গুলো আমাদের কে দিয়ে বলে লে-বাবা -লে, আমাদের যুবকদের মধ্যে আমি ছাড়া কেউ অস্ত্র চালাতে পারে না। কেননা আমার মামা আব্দুর রশিদ সাহেব শিকারী ছিলেন, উনার সাথে আমি শিকারে গিয়ে বন্ধুক ও টু টু রাইফেল চালানো শিখেছিলাম। ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্র গুলো কিভাবে চালাতে হয় সাথের যুবকদের অল্প সময়ের মধ্যে শিখিয়ে দেই। এদিকে আমার চাচা হাজী আমির হোসেন সাহেব রাজশাহীর স্বনামধন্য একজন প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার ছিলেন, তিনি আমাকে এবং আমার চাচাতো ভাই শাহজাহান ও বাবুলকে ঠিকাদারী কাজ শেখানোর জন্য রাজশাহীতে নিয়ে গিয়েছিলেন। রাজশাহীতে যাবার পর সেখানকার যুকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়, আমি ঢাকার ছেলে এ জন্য তারা আমাকে খুব মানতো। আমরা খবর পাই রাজশাহী পুলিশ লাইনে বিদ্রোহ হয়েছে। এবং পুলিশ পাইনে পাষানী আর্মি বাঙ্গালী পুলিশদের নিরস্ত্র করে হত্যা করছে। খবরটা জেনে আমরা রাজশাহীর শীপুরে অবস্থিত পুলিশ লাইনের দিকে বাঙ্গালী পুলিশদের সহায়তার জন্য রওনা হই। আমরা কখন যুবক মিলে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্র গুলো নিয়ে রাজশাহী পুলিশ লাইনের দিকে রওয়ানা হলাম, পাকানীরা বাঙ্গালীদের মারছে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে রাজশাহীর বাগালী জনতা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। আমরা যুবকরা মিলে রাজশাহী পুলিশ লাইনে যাই, গিয়ে দেখি নৃসংশ ঘটনা, মাথায় গুলিতে নিহত অনেক লাশ, মাঝে মাঝে গুলি হচ্ছে, কোথা থেকে গুলি আসে তা বুঝা যায় না। দেখি মাথা উঁচু করলেই গুলি লাগে। দূর থেকে এসব দেখে পাশের পদ্মা নদীর তীর দিয়ে ত্রুপিং করে সন্ধ্যার সময় সেখান থেকে আমরা চলে আসি। পুলিশ লাইন নৃশংতার পর রাজশাহীতে পাকিস্তানী আর্থিরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিযান চালায়, তারা নৃশংস হত্যা যজ্ঞ শুরু করে। পাকিস্তানী জর্জিয়া বিভিন্ন বাড়িতে ঢুকে আওয়ামীলীগের বড় নেতা, বেশ কিছু হিন্দুদের বাড়িতে হানা দিয়ে তাদের হত্যা করে। রাজশাহীতে আমাদের বাড়িতেও আর্মি ঢুকে আমরা বাড়ি ছিলাম না। আমাদের বাড়ি তছনছ করে। আওয়ামীলীগের যারা ভালো ডোনার ছিল, আওয়ামী লীগকে চাঁদা দিত, সাহায্য দিত, তাদের এসে আর্মিরা খোঁজ শুরু করে। আমার চাচা মরহুম আমির হোসেন আওয়ামীলীগের ডোনার ছিলেন, তাই চাচার বাড়ি তছনছ হয় ।
এসব ঘটনায়, আমার ফুফু এসে বল্ল, তোদের এখানে রাখা ঠিক হবে না। কারণ, তোরা যে অস্ত্র কেড়ে নিয়েছিস, সেটা ওরা জেনে গেছে। ঢাকায় চলে যা। আমাকে টাঙ্গা গাড়ির মাঝখানে বসিয়ে মাথায় পট্টি দিয়ে তুলে দিল, আর আমার চারপাশে বাচ্চাদের বসিয়ে দিয়ে আমার ফুফু আমাকে শহর থেকে বিদায় নিলেন। তারপর কিছু হাঁটি, কিছু টাঙালা চড়ি। এ সময়ে পাকিস্তানী যুদ্ধ বিমান আকাশে টহল নিচ্ছিল। আর ইপিআর সদস্যরা সেই বিমানের দিকে লাইট মেশিন গান নিয়ে গুলি ছুড়ছিল। সেখানে এক ইপিআর-এর অফিসারের কাছে আমি পরিস্থিতি জানতে চাইলাম, তিনি বল্লেন, সব বাঙ্গালী যারা ব্যারাকে ছিল, পাঞ্জাবিরা তাদের অস্ত্র নিয়ে যাচ্ছে এবং বাঙ্গালীদের বন্দী করছে। আমরা যারা বর্ডার ডিউটিতে ছিলাম তারা কেউ অস্ত্র জমা দেই নাই, ব্যারাকে হাজির হই নাই। আমরা বিদ্রোহ করেছি। ফিরে আস 1 পাবনা আসলাম। বিদ্যুৎ নাই, অন্ধকার দলে দলে লোক একটি মাঠে যাচ্ছে আসছে। আমরা মাঠের দিকে গেলাম, গিয়ে দেখি মাঠে ১৪ জন পাঞ্জাবীর লাশ একটার পর একটা স্তুপ করে রেখেছে। বাঙ্গালী ইপিআর পুলিশ ও ছাত্র-জনতা মিলে তাদের মেরে ফেলেছে। যেখানে আমার এক চাচা নাজমুল হুদ (চলচিত্র ও নাট্যাভি। আমরা ছিলাম অনাহারে। তারপর ভোরবেলা রওয়ানা দিয়ে নগর বাড়ি ঘাটে এলাম । সেখানে দেখি আমাদের মতো বয়সের কিছু ছেলে হাতে বন্ধুক নিয়ে ডিউটি করছে। আমাদের জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাবেন। রাম, থিকা যান আরিচা হয়ে। তখন নদীর পাড়ে অস্থায়ী হোটেল বসেছে, ওখানে চার আনা করে খাবার দেয় - পানি সহ ছোট ছোট চিংড়ি মাছের ঝোল ও ভাত। এসব খেয়ে রওনা হলাম এবং জনপ্রতি দেড় টাকা দিয়ে নদী পার হয়ে আরিচা এলাম। তারপর ওখান থেকে আমরা কিভাবে আসবো। সন্ধ্যার সময় কাষ্ট হবে। এমতাবস্থায় ঢাকা যাওয়ার গাড়ি খুজি, কিন্তু টেক্সি গাড়ি ভাড়া জনপ্রতি ৫ থেকে ৭ শ টাকা চাইছে। এমন সময় একটি ছেলে অল্পবয়সি ড্রাইভার বলল, " আমি পল্টন যাবো, স্যারের (গাড়ির মালিক) বাসায়। স্যার তো বগুড়ার লোক। স্যারকে আরিচা নামিয়ে দিয়েছি। আমার সাথে আপনারা ঢাকায় যেতে পারেন" । বলল, একটু খেয়ে নেই। এদিকে গাড়িটিতে কারা যেন সাইলেন্সার বক্সের মধ্যে ন্যাড়া ঢুকিে রেখেছিল। আমরা বুঝি নাই। এরপর যখন নয়ারহাটের কাছাকাছি আসি, তখন গাড়ি বন্ধ হয়ে যায়। ভাগ্য ভাল তখন আমরা ইপিজারটিসি'র একটি বাস পেয়ে গেলাম। গাড়িতে লাকড়ি বোঝাই। আমরা দুই ভাই, চাচাতো ভাই -বাবুল - গাড়ি থামালাম এবং বললাম, আমরা ঢাকা যাব। ড্রাইভার বলল, আমি ঢাকায় যাব না। মিরপুর ব্রিজের এপার নামিয়ে দিতে পারব। ভাবলাম, মিরপুর নামতে পারলে পাশের গ্রামে আশ্রয় নিতে পারব। ও বলল, "ওপারে ভয়ানক অবস্থা, বাঙ্গালী মানুষ দেখলেই মেরে ফেলে"। পরে আমাদের নামিয়ে দিলে আমরা ব্রিজটার কাছাকাছি গেলাম । দুটো স্কুটার এলো। ৪/৫জন যাত্রী নামিয়ে দিল। আমাদের একটা স্কুটার জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাবেন? বললাম যাত্রাবাড়ি এবং জিজ্ঞেস করলাম কত নিবেন? বলল, আগে বসেন তাড়াতাড়ি, কারফিউ পড়ার সময় বেশি নাই। আসার সময় দেখলাম অনেক অনেক লাশ, কুকুর খাচ্ছে, শুকুনে খাচ্ছে। পাঞ্জাবীরা মাঝে মাঝে গাড়ি চেক করছে কিন্তু আমাদের গাড়ি চেক করে নাই। আমাদের বয়স কম ভেবে হয়তো গাড়ি চেক করে নাই। অবশেষে ভাতার আমাদের শাসিয়ে দিলেন। টাকা দিতে চাইলাম। টাকা নিলো না। বললো, "থাক আপনারা ছাত্র মানুষ। কানাজার যাব। অবশেষে বাড়িতে পৌঁছলাম। বাড়ি পৌঁছতেই মা চাচীরা আমাদের মুখ দিয়ে গোসল করিয়ে বাড়িতে ঢুকালেন। মা চাচীরা মনে করেছিল আমাদের মেরে ফেলা হয়েছে, জীবন্ত দেখে আমাদের পেয়ে এ গোসল করিয়েছে। পরে কিভাবে আসলাম খবর নিল। আমিও ঢাকার অবস্থা জানলাম। তখন এপ্রিলের শুরু ঢাকার কারফিউ চলছে। মাঝে মধ্যে দুই তিন ঘন্টার জন্য কারফিউ শিথিল করে। আমরা তখন পাড়ার যুবকরা এক হওয়ার চেষ্টা করি। এবং বেশ কজন জড়ো হয়েছিলাম, তখন কি করবো এ জন্য। এসময় যারা ছিলেন তারা হচ্ছেন আমিন লক্ষর, কলু ভাই, আলমাস ডাই, করিম ভাই, সাজিদ, মन, র, আশরাফ সহ মন্ত্রার ১৫/ ১৬ জন। তখনের একটি ঘটনা। আমার বন্ধু আমিন লস্করের এপেন্ডেসাইটিস এর অপারেশন হবে, রক্তের দরকার, আমরা বন্ধুরা নাজিমুদ্দিন, দবির, আশরাফ, ইকবাল সহ অনেকে তখন রক্ত দেয়ার জন্য মিটফোর্ড হাসপাতালে গেলাম। হাসপাতালে গিয়ে দেখি রোগীদের ভীড়, বেশীর ভাগ পুলিশ সদস্য, তারা প্রায় সবাই গুলিতে আহত। তাদের কাছে জানলাম তারা কেউ বংশাল ফাঁড়ির, কেউ রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সদস্য। এরমধ্যে বেশ কজন মারাও গেছে। এ পরিস্থিতিতে আমরা রক্ত দিতে পারলাম না। কারণ ছিল না, যাত্রা বাড়ি ফিরতেই শুনি গুলির শব্দ। পাঞ্জাবিরা গুলি করছে। আমার মামাতো ভাই আবদুর রহমান পাহলোয়ানের পেটে ৫ টি গুলি লেগেছে। রহমান ভাই বলেন পুকুর ঘাটে যাও সেখানে আলমাস পড়ে আছে। আমরা পুকুর ঘাটে গিয়ে ৫ টি গুলিবিদ্ধ এবং গুরুতর আহত আলমাস ভাইকে উদ্ধার করি এবং হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করার ১০ দিন পর তিনি শহীদ হন। এদিকে আবদুর রহমান পালোয়ান ভাই ৩ মাস হাসপাতালে থেকে সুস্থ হয়ে বাড়িতে আসে। এপ্রিল মাসে জিঞ্জিরাতে পাকিস্তানী আর্মিরা অনেক লোক মেরেছে। আমি, দবির, নাজিম উদ্দিন গেলাম জিঞ্জিরা দেখতে। আমরা ভুল করে শাঁখারী বাজারের দিকে গেলাম। সেখানে আর্মিরা আমাদের ফ্রন্ট করল, জিজ্ঞেস করল, কিধার যানা হ্যায়?' বললাম ইধার যানা হ্যায়। বলল, "খাও"। আমরা সদরঘাট নিয়ে নৌকা নিয়ে জিঞ্জিরা গেলাম। গিয়ে দেখি শুধু ধোঁয়া, ছাই। কিছু মানুষ বিলাপ করে কান্নাকাটি করছে। এগুলো দেখে আমরা পোস্তগোলা দিয়ে নদী পার হয়ে চলে আসছি, আমরা চিন্তা করি, কিভাবে প্রতিশোধ নেওয়া যায়। আমাদের ভেতরে প্রতিশোধের আগুন। এছাড়া আমরা তখন স্কুল কলেজ এবং মহল্লার বন্ধুরা এক সাথে দলবল নিয়ে চলতাম। আমার দুই ক্লাসমেট দবির উদ্দিন ও সিরাজ । আমরা সব দেখে ভাবছি কি করব। ওরা (পাকসেনা) বাড়িতে বাড়িতে এসে যুবকদের মেরে ফেলে আর যুবতীদের ধরে নিয়ে যায়। আমার ক্লাসমেট এবং দনিয়ার পূণ্যবাবুর ছেলে গান্নার বোন ও ভাতিজিকে নিয়ে গেল শ্যামপুর তেলকল আর্মি ক্যাম্পে, পরদিন খোঁজখবর নিয়ে দেখা গেল মেয়ে দুইটির লাশ নদীতে ভাসতেছে। দিন দিন পাকিস্তানী হানাদাররা অত্যাচার বেশী শুরু করলো, আমরা কি করব কোন দিক পাচ্ছিনা এর কিছুদিন পর গুনি রূপগঞ্জের বরপায় মুক্তিবাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এবং ব্রিজ ভেঙে দিয়েছে। এর মানে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। ঠিক করলাম, আমরা যুদ্ধে যাবো। যাত্রাবাড়ি ওয়াপদার নিরিবিলি মাঠে আমরা ২০/২৫ জন বসতাম। আমরা প্রায়শ বিকেলে সব যুবক মিলে মিটিং করি, কিভাবে কি করা যায়। আমরা একদিন কমলাপুরে যাই, সেখানে গিয়ে মিটিং করি । মিটিং এ ছিলো হানিফ, জিন্নাহ, আবুল হোসেন, আমার ক্লাশ ফ্রেন্ড মেসবাহ উদ্দিন সাবু, বন্ধু পপ গায়ক আজম খান, ফুয়াদ, ভুলু, নিলু খগেন্দ্রনাথ (বগা) সহ বেশ কজন। লাস্ট মিটিং করি কমলাপুরের মধুমিতা ও মনমিতা নামে দুইটা হোটেল ছিলো সেখানে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম সবাই যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং নেবো, শুনলাম নরসিংদীতে ট্রেনিং হয় সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। আমরা যাওয়ার দিন তারিখ ঠিক করলাম। পরে জানলাম নরসিংদীতে ট্রেনিং হয় না ট্রেনিং হয় ভারতের আগরতলায়, আমরা আগরতলা যাবার সিদ্ধান্ত নেই। এবং যাত্রাবাড়ি আর কে চৌধুরীর সাহেবের বাড়ির পিছনে একত্রিত হবো বলে প্লান করি। কিন্তু এরই মাঝে খবর পাই আলমাস ভাই মারা গেছেন । আলমাস ভাইকে সকালে কবর দিলাম। পরে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য মনস্থির করে মার কাছে অনুমতি নিলাম, মা বল্লেন " যাও আল্লাহ ভরসা” । মাকে সালাম করে, যাত্রাবাড়ি আর কে চৌধুরীর বাড়ির পেছনে জড়ো হই। আমি, হানিফ, জিন্নাহ, আবুল হোসেন এ কজন। সিদ্ধান্ত নরসিংদী যাব। দবির আর মতিন আমাদের বাসে উঠিয়ে দেয়। আমরা চারজন নরসিংদীর বাসে চড়লাম। বাসে একজন মুরুব্বী আমাদের দেখছিলেন একসময় কাছে এসে আমাদের বললেন, " বাবা ভোমরা নরসিংদী পর্যন্ত যাইও না। তোমরা একটু আগেই নেমে পড়ো। চেক হবে। তোমাদের যে বয়স, সমস্যা হবে"। তখন আমরা নরসিংদীর অল্প আগেই নেমে গেলাম। ঐ মুরু আমাদের ডিরেকশন দিয়ে দিলেন এবং বললেন যুবকদের পাড় করার জন্য সেখানে একটা ছোট লঞ্চ আছে লক্ষ পর্যন্ত হেঁটে যাও। গাড়িতে যাবে না। গাড়িতে গেলে ওরা চেক করবে। আমরা ওখানে গিয়ে লঞ্চে চড়লাম। লঞ্চে নদী পাড় হলাম। লঞ্চে আমাদেও কাছ থেকে কোন ভাড়া নেয়নি। এবং যারা ছিল তারা বলে দিল, আমরা কিভাবে কোথায় যাব। আমরা কিছুদূর যাওয়ার পর সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় একটা হিন্দু বাড়িতে গেলাম। তখন আমরা সব সময় হিন্দুবাড়িকে প্রাধান্য নিতা। কারণ, তারা বিট্রে করবে না। সেখানে একটি হিন্দু বাড়িতে যাওয়ার পর তারা আমাদের সম্পর্কে জানলো। তারা আমাদের চিড়ামুড়ি খাওয়াল। ওখানে রাত্রে ৪ জনের মধ্যে একজন জাগি, তিনজন ঘুমাই, আবার একজন জাগি বাকি তিনজন ঘুমাই। এভাবে রাত কাটে। ভোর না হতেই আলো আঁধারে জম তাদের দেখানো পথে হাঁটা শুরু করি। কিছু কাঁদা-মাটি, কিন্তু অরুনা, কিছুটা পানির পথ এবং এলাকাবাসীর কাছে বলে বলে আমরা দুনিনে আগরতলা গিয়ে পৌঁছলাম। আমি, জিন্নাহ, আবুল হোসেন ও হানিফ আমরা চার বন্ধু প্রথম আগরতলা কলেজটিলায় যাই, সেখানে গিয়ে দেখি অনেক মানুষের ভীড়। আগরতলা গিয়ে দেখা হলো গাজী গোলাম মোস্তফার সাথে। তিনি নরসিংদীর খ্যাতনামা আওয়ামীলীগ নেতা ও সংগঠক। এছাড়া কলেজটিলায় আমাদের পরিচিত বন্ধু বান্ধব অনেকের সাথে দেখা হয়। তাদের কথায় আমরা মতিনগর ক্যাম্পে যাই। তখন আমাদের পরিচয় জানতে চাইলে বলি ঢাকা যাত্রাবাড়ি থেকে এসেছি। সেই ক্যাম্পে তখন ২ নং সেক্টরের উপাধিনায়ক ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দার সাহেব ঢাকার ছেলেদের খুজছিলেন। অরজিনাল ঢাকার পোলাপান, ঢাকায় বসবাস করে এমন, মানে ঢাকাইয়া। আমাদের পেয়ে তিনি খুব খুশি হলেন। তিনি আমাদের চিনলেন এবং আমাদের মতিনগরে গ্রেনেড বিষয়ে প্রাথমিক ট্রেনিং দিলেন। আমাদের টেনিং দিয়ে প্রথমবার জনপ্রতি ২ টি করে গ্রেনেড দিয়ে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। বলেন যে তোমরা শুধু ঢাকার শহর গরম রাখবা। এটা দিয়ে প্রমাণ করবা যে, ঢাকায় প্রতিরোধ আছে বা হচ্ছে। ঢাকায় এসে আমাদের কাজ ছিল শত্রুদের আড্ডা । ার বিভিন্ন জায়গায় গভর্ণর হাউজের গেইটে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনের চতুর, যেখানে বাড়ি ছিল, এছাড়া কমান্ডার চুলা ফ্যাক্টরীর সামনে দুইটা, হামিদুল হক চৌধুরীর লেসের সামনে কমলাপুর বাত্রাবাড়ি পোস্তগোলা জুরাইনের বিভিন্ন গ্যা হলেই দুটো- হোতা নিয়ে ৪ জনে গেলেও মারতাম। আমার সাথে ছিল হানিফ, জিল্লাহ ও আবুল হোসেন। আর তখন মানুষজন কম ছিল তাই সহজেই পালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। ট্রেনিং এ আমাদের বলেই নিয়েছিল, হিট অ্যান্ড রান, মারবা আর পালাবা, ধরা পড়া না এছাড়া বলেদিয়েছিলো “কোন নিরীহ লোক যেন তোমাদেও দ্বারা ক্ষতি না হয়। আমরা তিন চার দিনের মধ্যেই গ্রেনেড শেষ করে আবার ফিরে গেলাম আগরতলায়। দ্বিতীয় বার যখন গেলাম তখন মতিনগর আর ক্যাম্প ছিলনা। এটা চলে গেল মেলাঘরে। মেলাঘরে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখা হলো শহীদুল্লাহ খান বাদল ভাইয়ের সাথে, ক্যাপ্টেন হায়দার ভাই এবং বাদল ভাই আমাদের নিয়ে গেলেন সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ সাহেবের কাছে। তিনি আমাদের নাম পরিচয় জানলেন এবং খুশীও হলেন। সেখানে আমরা ১৮ দিন ট্রেনিং নেই। সেখানেই আমাদের সাথে দেখা হয় . আমার কলেজের বন্ধু মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ভাইয়ের সাথে দেখা হয় গাজী গোলাম দোস্তগীর, আবু সাঈদ ভাই, সামাদ ভাই, আলম ভাই, মোজাম্মেল, আনোয়ার গিয়াসউদ্দিন সহ আমাদের তেজগাঁও থানা এলাকার অনেকের সাথে। এই ক্যাম্পে বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংসের জন্য এক্সপ্লোসিভ ট্রেনিং, স্টেনগান খোলানো-লাগানো, এস.এল. আর, স্ক্রিনট থ্রি রাইফেল ও লাইট মেশিন গান খোলানো-লাগানো, প্রশিক্ষণ নেই। প্রতিদিন দু বেলা ট্রেনিং হতো। দুপুরে রেস্ট। সকালে বিকালে ট্রেনিং। এক্সপ্লোসিডের ট্রেনিং আবার সবাইকে দেয় নাই। যারা লেখাপড়া জানে সাহসী, তাদেরই দিয়েছিল। ক্যাপ্টেন হায়দার তাই ঢাকা অপারেশনের জন্য ৭ জনের একটি গ্রুপ করে দেন এবং নাম দেন “ম্যাগনেফিসেন্ট সেভেন" গ্রুপ। আমি ছিলাম গ্রুপের কমান্ডার। আমার টু-আইসি ছিলো ইঞ্জিনিয়ার আবুল বাশার রাজশাহী বাড়ি, জিন্নাহ, হানিফ, আবুল, ভুলু আর রূপগঞ্জের আহসান উল্লাহ। হায়দার সাহেব তাঁর নিজের লাল জিপে করে আমাদের সাতজনকে বর্ডার এর কাছাকাছি এনে নামিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা ঢাকার ফিরলাম, এবার অপারেশন বিদ্যুৎ লাইন পানির লাইন এবং পাকিস্তানী আর্মিদের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা। এবার এসে স্তানীয় কিছু ট্রেনিং দিয়ে আমার বাহিনী বড় করি। খালী জুরাইন, মুরাদপুর, মাতুয়াইল, বাসাবাড়ি, মিত্রহাজিরবাগ, কাজলা দনিয়া প্রত্যেক এলাকার বন্ধু-বান্ধব আমরা এক হয়ে বিরাট বাহিনী গড়ে তুললাম । গ্রুপে আমার নেতৃত্বে যারা ছিল তারা হচ্ছে গ্রুপের টু আইসি ইঞ্জিনিয়ার আবুল বাশার, আহসান উল্লাহ, মোঃ হানিফ, মোঃ জিন্নাহ, মোঃ আবুল হোসেন, মোঃ রেজভি, মোঃ সবির উদ্দিন, মোঃ আশরাফ, মোঃ সিরাজ আব্দুল মতিন, যাত্রাবাড়ির মোঃ নাসির, প্রফেজ আহসান উল্লাহ, শহীদ ফারুক, শহীদ মোজা, নুরুল ইসলাম, সামসুদ্দিন, মোঃ ইব্রাহিম, নবু, বাবু, সানু, সামসু, মানিক, মোঃ জয়দর আলী, মোঃ রতন, মোঃ এনামুল, মোঃ সালাউদ্দিন, মোঃ মোবারক, মোঃ হারুন, মোঃ সোলায়মান, মধু মেম্বার, আব্দুস সালাম, বংশালের আদুল কাদের, বংশালের লবু মিয়া, বংশালের মোঃ জিন্নাহ, বাবুল মিয়া, মোঃ আলিম, মোঃ মোনায়েম (ঘনা), মোঃ রশিদ, মুন্সিগঞ্জের নিলু, খগেন্দ্রনাথ খগা, বাবুল মোল্লা, কাজলার মোঃ নাসির, মোঃ সুবেদ আলী, মোঃ কামিজউদ্দিন, কাজলার মোঃ শাহজাহান, মোঃ ফালু, সহীদ, মোঃ ফারুক, মোঃ লেলু মিয়া, কবির ভুইয়া, করিম ভাই, মোঃ নাইয়ুম, আলী হোসেন, নাজিম উদ্দিন মাস্টার, মোঃ ওয়াদুদ, আলতাফ হোসেন সহ আরো অনেকে। ঢাকার আমার বিভিন্ন উপদল করে ভাগ ভাগ হয়ে যাই। আমরা একসাথে সবাই থাকতাম না। কারণ ধরা পড়লে যেন এক ভাগ ধরা পড়ে। সবাই যেন ধরা না পড়ে। প্রথম দিকে আমাদের কাছে হেডি আর্মস ছিল না। হেভি অন্ত্রের মধ্যে ছিল স্টেনগান। পরে থ্রি নট থ্রি রাইফেল দুটি এস এল আর ইন্ডিয়া থেকে আনি। আমাদের কাছে এক্সপ্লোসিভ ছিল। আমাদের বলে দেয়া হয়েছিল কম এক্সপ্লোসিভ খরচ করে বেশি ধ্বংস করার কথা। আমরা ট্রান্সফরমার ধ্বংস করি, মান্ডা থেকে ডেমরা হয়ে ফতুল্লা হয়ে যে ৬৩ শ ভোল্ডের বৈদ্যুতিক লাইন গেছে, সে লাইনের বড় বড় মোটা খাম্বা, পারা খারা এবং ট্রান্সফর্মার ফেলে দেই এবং বৈদ্যুতিক লাইন বিচ্ছিন্ন করি। সন্ধ্যা হলেই আমরা এই অপারেশন চালাতাম । অপারেশনে আমাদের এক্সপ্লোসিভ শেষ হয়ে গেলে, আমরা আবার ভারত যাই । এবার আমাদের হেভি অস্ত্র দিল এলএমজি। এর মধ্যে আমাদের অনেকগুলো ছেলে ধরা পড়ে গেল ।
এদের মধ্যে মবির অন্যতম। দবিরকে ওর তাই মুনায়েমসহ ধরে নিয়ে গেল। বংশালে ও আমাদের একটা গ্রুপ ছিল। নবু কাদির, বংশালের জিন্নাহ, বাদশা, আমি আরো অনেক নাম এখন ঠিক মনে করতে পারছিনা তাদেরও আর্থিয়া ধরে নিয়ে যায়। আমরা খবর নিলাম যে টাকা নিলে আরিন পাওয়া যার। আমি সেটর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ সাহেব কে গিয়ে বললাম, আমরা কিভাবে টাকা ও অস্ত্র জোগাড় করতে পারি। উনি বললেন গ্রামের থানা ও ব্যাংক লুট করো। বললাম, গ্রামে কেন শহরে লুট করা তো ইজি। উনি বললেন, না, শহরে করলে বদনাম হবে, তারা বলবে যে আমরা দস্যু। কারণ শহরে অনেক দেশী বিদেশী সাংবাদিক আছে। গ্রামে নাই। আমি আমার স্থানীয় কয়েকজন বন্ধু আশরাফ, হানিফ, খগেন্দ্র, বুলু মিলে আমি লক্ষর, লেবু মিয়া ও কবির ভূঁইয়ার সহযোগিতায় সোহরা থানা সকালে রেকি করে দুপুরে আক্রমণ করি। তখন থানার অদূরে পদ্মা নদীতে আর্মির একটি ট্রলার ছিল। আমরা থানায় যারা ছিল ওসি থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত সবাইকে সারেন্ডার করাই। এদিকে থানায় ঢুকেই ভুল আমার আনুমতি না নিয়েই রেজাউল করিম আঙ্গুর নামে এক দারোগাকে গুলি করে আহত করে। আমি ভুলুকে ধমক দেই এবং তার কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে নেই। রেজাউলকে এলাকার লোকজন হাসপাতালে পাঠায়। আমরা বাকি পুলিশদের থানার হাজতে ঢুকিয়ে তালা মেওে দেই। ওদের কাছ থেকে মালখানার চাবি নিয়ে মাল খানায় যত রাইফেল ও গুলি আছে সব লুট করি। এত অস্ত্র নিয়ে নিলাম যে, নৌকার আর জায়গা ছিল না। তাই আমরা ভাল অস্ত্র গুলো রেখে পুরাতন রাইফেলগুলো ভেঙ্গে ফেলে দেই। যেন এসব খারাপ লোক বা শত্রুর কাছে না যায় সে জন্য এ গুলো ভেঙ্গে ফেলেছিলাম। আমরা নৌকায় না উঠে অস্ত্র সহ নৌকা ছোট খাল দিয়ে টেনে এবং সাতরিয়ে নিয়ে যাই হাবিব ব্যাংক পর্যন্ত।থানা লুটের পর আমরা অদূরে হাবিব ব্যাংকে যাই। সেখানে অনেক উঁচু একটা টাওয়ার ছিল সেটি এক্সপ্লোসিভ এর সাহায্যে ফেলে দেই । পরে ব্যাংকে ঢুকি। টাওয়ার পড়ার শব্দে এবং আমাদের দেখে ব্যাংকের দারোরান সহ ব্যাংকের অন্যান্যরা পালিয়ে যায়। সেদিন ছিল রোববার ব্যাংকে খুব বেশি টাকা পাই নি, ব্যাংকের মেইন লকার ভাগতে পারিনি। ব্যাংকে যে টাকা পেয়েছিলাম তা দিয়ে ১৭/১৮ জন ছেলেকে জামিন আনতে পেরেছিলাম। এই অপারেশনে স্থানীয় এলকাবাসী আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছে। তাদের কাছে আমরা আজও কৃতজ্ঞ। পরে রাত সাড়ে ১২ টার অস্ত্র বোঝাই নৌকা নিয়ে আমরা কেরাণীগঞ্জের হাসনাবাদে দৌহি। সেখানে এসে আমি একা হাসনাবাদে কিছু লোক নগা দেখতে পাই । তারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলছিল। এ সময় তাদের বলি । আপনারা আমাদের একটি নৌকা দেন আমরা বুড়ি গঙ্গা পাড় হবো। বা পয়সা লাগে আমরা দেব । তারা আমার কথায় খুশী হন এবং তারা একটি নৌকা দিয়ে আমাদের পাড় করে দিতে আসে । তারা এসে নৌকায় অস্ত্র দেখে এবং খুশী বলে, আজ মুক্তিযোদ্ধাদের দেখলাম। তারা সানন্দে তাদের নৌকায় আমাদের অস্ত্র গুলো তুলে দেয় । আমাদের শ্যামপুর বালুর মাঠে পৌছে দেয় এবং তারা টাকা পয়লা কিছুই নেয়নি। থানা লুটের পরের দিন রাতে আর্মিরা আমাকে যাত্রাবাড়ি থেকে আটক করে। আমার ক্লাসমেট প্রিয় বন্ধু আহসান সূত্রাপুরে ধরা পড়ে, টর্চার সহ্য করতে না পেরে সে আমাদের অনেকের নাম বলে দিয়েছিল। তাই আমি ধরা পড়ে যাই, অন্যরা ধরা পড়েনি। আমাকে কোতোয়ালী সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার সাথে এলাকার পিস কমিটির কনভেনার আব্বাস সাহেবকেও ধরে নিয় যাওয়া হয়। তিনি পিস কমিটির হলেও তিনি আমার গ্রুপকে অনেক সহায়তা করতেন, তার বাড়িতে আমার গ্রুপের একটা ক্যাম্প ছিল। এ বাড়িতে আমাদের অস্ত্রও রাখতাম । আমাদের ধরার সময় কোন অস্ত্র খুঁজে নাই ও তল্লাশী করে নাই, এ জন্য আমাদের অস্ত্র গুলো সেভ হয়ে যায়। সেনা ক্যাম্পে গিয়ে সেখানে আটক দবির সহ বংশাল ও সুরিটোলার অনেকের সাথে দেখা হয়। সেনারা সবাইকে টর্চার করে মারাত্মক আহত করে রেখেছে। সেনারা প্রতিরাতে ১০ থেকে ১২ টা পর্যন্ত আটককৃতদের টর্চার করতো। এদের মধ্যে দবির একজন, তাকে অনেক টর্চার করে আর্মিরা। ওর শরীরে এমন কোন জায়গা বাকি ছিল না ক্ষত ছাড়া। ওর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পোকা হয়ে গিয়েছিল। ওয়াপদাতে চাকুরী করতো চাটগাওয়ের বাচ্চু মিয়া দবিরের কাছে একটি গ্রেনেড চেয়ে বলেছিল, ওয়াপদার চার তলার ওপর থেকে সেনাদের গাড়িতে গ্রেনেড মারবে। দবির আমার অনুমতি নিয়ে একটি গ্রেনেড দেয়, বাচ্চু মিয়া এই গ্রেনেডটি চারতলা থেকে সেনাদের ট্রাকের উপর মারে । কিন্তু সেটি ট্রাকে না পড়ে ট্রাকের ১০/১২ হাত পিছনে পড়ে । পরে বাচ্চু মিয়াকে তার অফিসের লোকজন সেনাদের হাতে তুলে দেয়। বাচ্চু মিয়া সেনা টর্চারে দবিরের নাম, দবিরের ভাই মোনায়েমের নাম বলে দেয়, তাই সেনারা দবিরকে ও মোনায়েম মনাকে আটক করে। ৩ দিন পর মোনায়েমকে অনেক টর্চার করে ছেড়ে দেয়। দবিরকে ছাড়েনি। সেনা ক্যাম্পে ৩৬ দিন আমাকে অনেক টর্চার করে, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল আমি ৩ টি স্কুলে মেট্রিক পরীক্ষা বন্ধ করার জন্য গ্রেনেড মেরেছি। আসলে আমি কোনই স্কুলেই কোন অপারেশন করি নাই। আর্মিরা আমার কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে চায়, কিন্তু আমি মুখ খুলিনি। তারা আমার কাছ থেকে কোন ইনফরমেশনও পারনি। আমি বলেছি আমার বন্ধু পার্সোনাল আক্রোশে আমার নাম বলেছে, সে আমার বই চুরি করেছিল, আমি প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ দেয়ায় সে শত্রুতা করে আমার নাম বলেছে। পরে আর্মিরা প্রমাণ আছে কিনা জানতে চাইলে, আমি প্রিनিশাল কী স্যারের নাম বলি। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের লোক, আমি জানতাম ফাতমী স্যার দেশে নাই। আর্মিরা উনাকে খোঁজ করতে কলেজে যায় এসে আমার উপর টর্চার কিছুটা কমিয়ে দেয়। আমাকে ও স্কুলের দারোয়ান দিয়ে টিআই প্যারেড করায়। ফায়ার সার্ভিসের একজন প্লেয়ার ছিলেন আলতাফ ভাই। এ এলাকার আর্মির কমান্ডিং অফিসার কর্ণেল খোরশেদ এর সাথে তার সম্পর্ক ছিল, তারা দুজন ফুটবল খেলোয়ার ছিলেন। তিনি তার সাথে যোগাযোগ করে আমাদের মামলা গুলো পুলিশের কাছে দিয়ে দেয়। আলতাফ ভাই সিও খোরশেদের কাছে বলেন, নজরুল ভাল ছেলে । এছাড়া আমাদের কাছে কোন অস্ত্র পায় নাই ও কোন প্রমাণ পায় নাই। তখন তারা আমার মামলা পুলিশের কাছে দেয় এবং আমাকে পুলিশে সোপর্দ করে। আমার বিরুদ্ধে ৩ টি মামলার আইও ছিলো ডিএসপি সামাদ তালুকদার। এ সময়ে রাজশাহীতে ডিএসপি সামাদ তালুকদারের বাবাকে মুক্তি বাহিনী মেরে ফেলে, এই খবর পেয়ে আমিও ভয় পেয়ে যাই, এই ভেবে সামাদ তালুকদার আমাকে মেরে ফেলবে। কিন্তু উল্টা সামাদ তালুকদার বাঙ্গালী এরশাদ নামক কনস্টেবলের মাধ্যমে গোপনে তিনবেলা ওষুধ এনে আমাকে খাওয়াতেন । এবং চুপচাপ বলতেন, যুখ খুলবি না। পুলিশ আমাকে সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয় সেখান থেকে ২৪ দিন পর আমার জামিন হয়। আমি জামিনে মুক্তি পেয়ে বাড়িতে যাই, মার সাথে আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা করি । বাড়িতে মাত্র ২ ঘন্টা সময় কাটিয়ে আমার ক্যাম্পে চলে যাই। আবার অপারেশন পরিচালনা শুরু করি। এসময়ে একবার ইন্ডিয়া যাই । সেখানে খালেদ মোশাররফ সাহেব বাদল ভাইয়ের মাধ্যমে খবর দিয়ে আমাকে ডেকে নেন। সাথে ছিলেন এটিএম হায়দার সাহেব। উনারা তখন নির্দেশ দেন হামিদুল হক চৌধুরী প্রেস আমাদের বিরুদ্ধে অনেক অবিচার পাচেছ, এটাকে জড়িয়ে দিতে হবে। তোমার কয় দিন সময় লাগবে। আমি বল্লাম লাগবে। কিন্তু আমাকে এক্সপ্লোসিভ এবং আনুসাঙ্গিক বা আছে তা বেশী বেশী দিতে হবে। তখন তারা নহেন, তোমার যা লাগে নিয়ে যাও। হামিদুল হক চৌধুরী ভাষাপ্রেলে আমরা তিনবার অপারেশন করেছি, দুবার লব্দ করার জন্য। ওটা বন্ধ রাখার জন্য বাইরে থেকে গেলেও মারতাম। এই প্রেসের মালিক ছিলেন হামিদুল হক চৌধুরী, সেসময় পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন। এবং এই প্রেস থেকে অবজারভার পত্রিকা প্রকাশ হতো। তারা মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন । প্রেসটিতে তৃতীয় বার নির্দেশ পেয়ে আক্রমণ করি এবং পুরা প্রেস বসে ও গুড়িয়ে বন্ধ করে দেই। ধ্বংস করায় এ এলাকার নাম ভাষাপ্রেস হয়ে যায়। আমার নেতৃত্বে এই হামিদুল হক প্রেস অপারেশনে যারা ছিলো তারা হচ্ছে আব্দুল মতিন, মোঃ সিরাজ, আশরাফ, মোঃ সামসু, মোঃ মোজাফ্ফর,মোঃ ইব্রাহিম, মোঃ নবু, বাবুল, সামু, সামসু, নুর ইসলাম, মানিক, জয়ধর আলী, হিন্দু রতন, মোঃ দবির, মোঃ এনামুল, মোঃ সালাউদ্দিন, মোঃ মোবারক, মোঃ হারুন, মোঃ সোলায়মান, মধু মেম্বার, মোঃ শাহজাহান, ইঞ্জিনিয়ার বাশার, রূপ গঞ্জের আহসানউল্লাহ, আব্দুস সালাম। জামরা প্রথমে খোঁজ নিলাম প্রেসে কারা কাজ করে। ওখানে কাজ করে এমন দুজন পেলাম, তাদের নাম শামসুদ্দিন ও মোজাফফর। তারা কোথায় কি আছে, কয়জন লোক আছে, কয়টি অস্ত্র আছে এগুলো জানায়। তারা আরও জানালো দিনের বেলায় পাঞ্জাবীরা টহল দেয় এবং লোক থাকে। কিন্তু রাত্রে যাত্র ২৫ জন থাকে এবং তাদের অস্ত্র হলো বহুম টেটা লাঠি। কোন আগ্নেয়াস্ত্র তাদের কাছে থাকে না। তাই আমরা খুব সহজ মনে করলাম এবং রাতে ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা অপারেশনে গেলাম। সেদিন বাহিরে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল, আমরা মেইন রোড দিয়ে না গিয়ে, রোডের নীচ দিয়ে গেলাম। আমাদের কাছে বিভিন্ন অস্ত্র ছিল। অনেক এক্সপ্লোসিভও নিয়ে যাই। আমরা প্রথমে যে সব দারোয়ানরা পাহারা দিচ্ছিল তাদের সারেন্ডার করালাম, আর কয়েকজন যারা ঘুমিয়ে ছিল ওদের উঠানো হলো, আর চতুর্দিকে যারা ছিল তাদেরকে ডেকে আনল। আমি বললাম তোমরা মরতে চাও, না বাঁচতে চাও? তারা বলল, দেখেন আমাদের পাঁচ মাস যাবত বেতন দেয় না, খোঁড়াকের অল্প টাকা দেয় । আমরা বড় কস্টে আছি, আমাদের মাইরেন না, আমরা চলে যান। তখন তাদের আমরা এক জায়গায় লাইন করে বসিয়ে 8 न যাদ্ধা তাদের পাহাড়ায় ছিল। আমি সহ যতিস, সিরাজ, দবির, শামসুদ্দিন, মোজাফফর প্রেসে ঢুকি । গিয়ে দেখি কোন কোন মেশিন গুলো বেশী পাখি। সেখানে অনেক বড় একটা ক্যামেরা ছিল, প্রত্যেকটা মেশিনের আমরা এক্সপ্লোসিভ লাগালাম। বিল্ডিংএর ভাটিটি পিলারে এক্সপ্লোসিভ লাগালাম এবং চিকন ইলেকট্রিক তার যুক্ত করে আমরা নিজেরা ফ্যাক্টরীর বাইরে নিরাপদ। জায়গায় গেলাম । সেখানে সাইকেলের পাম্পারের মতো এক্সপ্লোসিভ বিষ্ফোরণ ঘটানোর যন্ত্র দিয়ে। বিস্ফোরণ ঘটালাম। বিকট শব্দে ফ্যাক্টরী গুড়িয়ে গেল। সেদিন আমার গায়ে জ্বর তবু বৃষ্টিতে ভিজেছি। ব্রাস্ট করার জন্য পাম্পারে কে চাপ দিবে ? বলতেই, সবাই বন্ধু, তুমি নেতা, তুমিই চাপ দাও। আমি চাপ দিলাম, চাপ দেওয়ার সাথে সাথে বিষ্ফোরণ সফল হলো। অপারেশন শেষ করে আমরা সবাই ফিরে এলাম, ফ্যাক্টরীর গরীব দারোয়ানদের কিছু টাকা গাড়ি ভাড়া বাবদ দিয়ে বিদেয় করে দিলাম। পরদিন সকালে খবর পেলাম মোজাফফরের লাশ ফ্যাক্টরীর কাছে পাওয়া গেছে । এই অপারেশনে মোজাফফর রাতে ই শহীদ হয় পোস্তগোলা থেকে একটু সামনে শ্যামপুরের দিকে, বর্তমানে যেখানে চীন মৈত্রী সেতু/বুড়িগঙ্গা ব্রিজ তার বাম দিকে ইগল বন্ধু এ কার্টুন ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানী ছিল। যেটার মালিক ছিল পাকিস্তানীরা। এটা ছিল তখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি। ঈগল বক্স ফ্যাক্টরি থেকে সরকারি অনেক কিছু ছাপানো হত। রাতের বেলা আমিরা তাদের ক্যাম্প ছাড়া অন্য কোথাও থাকত না। ভয় পেত। তাই রাতে আমরা ঈগল বক্স ফ্যাকটরীতে অপারেশন চালাই এবং গান পাউডার ও পেট্রোল দিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলি। স্বাধীনতার পর এটা জাতীয়করণ করা হয় এবং পরবর্তীকালে এটা বেসরকারি মালিকানায় বিক্রি করে দেওয়া হয়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এর দিকে আমরা আমিন ম্যাচ ফ্যাক্টরীতে অপারেশন চালাই। সেখানে গিয়ে দারোয়ানদের বেঁধে ফেলি। ওখানে কাজ করে এমন দু-একজনকে সাথে নিয়ে ফ্যাক্টরীতে ঢুকি। ম্যাচ ফ্যাক্টরীতে ছিল অনেক বারুদের ড্রাম এবং কাঠের ছোট ছোট টুকরা। আমাদের সাথে যাদের নিয়ে ছিলাম তাদের একজন বস্ত্র, এই মেশিনটার দাম বেশী। এটা অনেক কাজের। আমরা সেটিতে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে দেই। এছাড়া প্রতিটা মেশিন নিচে আমরা এক্সপ্রোসিত লাগিয়ে দিয়েছিলাম। একটা মেশিন থেকে অন্যটির যুক্ত করে প্রাইয়ায় লাগিয়ে দিলাম। একটা মেশিনে যে সময়ে ব্লাস্ট হবে, সেই একই সময় আরেকটা মেশিনটাও ব্লাস্ট হবে। প্রাইমাকড়ের এতো গুণ। একটা সেফটি ফিট থাকবে। তারপর সেফটি ফিউজ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলাম এবং মেশিনগুলো কলাপ করে দিলাম। আমিন ম্যাচ ফ্যাক্টরি মেশিন গুলো ঠিক একইভাবে ফলান্স করে ধ্বংস করে দিলাম । এই অপারেশনে আমাদের সহযোগী ছিল মতিন, সিরাজ, পনির, বাবুল (যাবুল পরবর্তীতে জার্মানিতে চলে যার এবং সেখানে মারা যায়) নবু সালাম, হিন্দু রতন, আশরাফ, জিন্নাহ, হানিফ। হানিফ আমাদের খুব ভালো ও সাহসী যোদ্ধা ছিল। ও একা একটা অপারেশন করেছিল। বর্তমানে যেখানে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল তার পূর্ব দিক দিয়ে গর্ত ছিল ওখানে ঢাকা শহরের সব আবর্ণনা ফেলা হতো। এর আশেপাশে কিছু সমতলভূমি ছিল, যেখানে ঘাস হতো এবং মানুষ এগুলো কেটে নিয়ে গরুকে খাওয়াতো । এখানে এক মহিলা খারাপ কাজের উদ্দেশ্যে দুইটা ঘর তুলল। এখানে অনেক মহিলা ছিল এবং আর্মি অফিসাররা এখানে আসতো। একদিন দুপুর বেলা এয়ার ফোর্সের দুজন অফিসার মাতাল অবস্থায় ওখানে গিয়ে স্ফূর্তি করছিল, একজন বয়স্ক লোক (বশীরের বাবা) এগুলো দেখে যাস না কেটে চলে আসে। এমন সময় হানিফের সাথে দেখা। হানিফ আমার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে একটি স্টেনগান সহ তার মার সাথে দেখা করতে এসেছিল। আসার পথে ঐ মুরুব্বী বললেন, হানিফরে দেখ শালারা মদ খেয়ে ওখানে কি করছে।" হানিক খুব জেদি ছিল। সে বস্তা কাঁধে নিয়ে, মাথায় গামছা পেঁচিয়ে রাখাল সাজে এবং ঐ ঘরের কাছাকাছি যায়। একপর্যায়ে স্টেনগান দিয়ে একা ঐ দুই অফিসারকে হত্যা করে। ওদের পোশাক খুলে এবং ওদের কাছে থাকা দুটি পিস্তল নিয়ে এসে আমার কাছে জমা দেয়। আমাদের সাথে ট্রেনিংপ্রাপ্ত সবাই এই ঘটনা জানে। গাজী ভাই, ফতেহ ভাই আবু সাঈদ ভাই, মায়াভাই, সিরাজ ভাই, মোজাম্মেল, আনোয়ার, গিয়াস আব্বাস ওরা সবাই জানে। আমি হানিফকে তখন ভারতে পাঠিয়ে দেই। এবং পিস্তল দুটি এটিএম হায়দার ভাইকে গিফট হিসেবে দেয়ার কথা বলি। এবং সে যায় এবং ক্যাম্পর সবার সামনে পিস্তল দুটি হস্তান্তর করে তখন ক্যাম্পর সবাই হানিফকে নিয়ে বিজয় উল্লাস করে। আমাদের আরও একটা অপারেশন ছিল গেন্ডারিয়া রেল স্টেশনে, ওখানে আমি এজ এ কমান্ডার, কভারিং পার্টি তে ছিলাম। আমরাই রেকি করি এই অপারেশনের। আমাদের ছেলেসের দুটি গ্রুপ এতে অংশ নেয়। তারা অতর্কিত হামলা করে কয়েকজন পাক আর্মি কে গুলি করে আহত করে। আর কয়েকজন অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায় । অপারেশন চলাকালে একটি ট্রেন চলে আসে । আমার সহযোদ্ধা আশরাফ রেগে গিয়ে গুলি করে বলে, আমরা যুদ্ধ করে মরছি, আর তোরা ট্রেন চালাচ্ছিস ? গুলিতে ট্রেনের ড্রাইভার ও সহকারী ড্রাইভার আহত হয়। ট্রেনটি গোপীবাগ রেল গেটে এসে দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে যায়। পরে জানতে পারি ড্রাইভার মারা যায়নি। তার বাড়ি ছিল মাতুরাইল। মাতুয়াইলের ড্রাইভারের বাড়িতে আমার বাবা-মা বোনেরা কিছুদিনের জন্য যুদ্ধের সময় আশ্রয় নিয়েছিল। সে আসলে পেটের দায়ে চাকরি করতো আর স্টেশন মাস্টারকে নন বাঙালি মনে করে আমাদের ছেলেরা ধরে নিয়ে আসে, আসলে সে নন বাঙালি ছিল না, সে ছিল কলকাতা থেকে মাইগ্রেন্ট বাগালী। তারপর তার তিন মেয়ে যখন এসে পরিচয় দিলো, তখন দেখা গেল তার বড় ছেলে আমাদের সাথে পড়তো । মেয়েরা আরও বল্লো আমরা তিন বোন এক ভাই, আমরা বাঙ্গালী, আমাদের এক বোন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে আর দু বোন কলেজে পড়ে। আমাদের বাবাকে মেরে ফেললে, আমরা কিভাবে বাঁচবো? এসব শুনে আমরা তাকে ছেড়ে দেই। তারপর মেয়েরা বলে, আমাদের রাস্তাটা পার করে দেন, তা না হলে, অন্যরা আমাদের ধরতে পারে। আমার সাথে ছিল নাজিম উদ্দিন মাস্টার ও ফারুক। (পরবর্তীতে ফারুক যুদ্ধে শহীদ হন, তার নামেই এখন যাত্রাবাড়ি রোড এর নামকরণ করা হয়েছে শহীদ ফারুক সড়ক) ফারুক আমার ভাতিজা। মেয়ে গুলোকে এবং তাদের বাবাকে পার করে দিতে গিয়ে আমরা আমির ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গেলাম। পুরো স্টেশন রেললাইন সব জায়গা আর্মি ঘেরাও করে রেখেছিল, আমরা গিয়ে চতুর্দিকে উঁচু ও বস্তিভিটায় একটা পুকুরে আশ্রয় নিলাম। কারন আমাদের কাছে যে অস্ত্র আছে তা দিয়ে তাদের মোকাবেলা করতে পারবোনা। উল্টো মারা পড়বো। আমাদের মোশাররফ সাহেবের খুব ভাছা ছিল আমাদের উপর। আমাদের যতগুলো টার্গেট দেওয়া হয়েছিল আমরা কোনটাই মিস করি নাই । আমার নেতৃত্বে আরেকটা অপারেশন ছিল কমান্ডার চুলা ফ্যাক্টরি অপারেশন। এটাও উড়িয়ে দিয়েছিলাম । এটা ছিল ভাঙ্গা প্রেসের উল্টোদিকে, এই অপারেশনে আমার টু- আইসি ছিল ইঞ্জিন ছিল রাজশাহীর ছেলে, হানিফ, গুলু, ভু সবির, সিরাজ, আশরাফ, মতিন, বাবুল, নগ্ন, সালাম, আতাউর রহমান বাবু, সোলায়মান, শামসুদ্দিন, সামিউল্লাহ সামু। আমাদের যাত্রাবাড়ি এলাকার লোকদের মধ্যে আব্বা আम, সামগুলি ট্রাকটার, হাজী চাঁদ মিয়া আমাদের খুব সাহায্য করতেন। আর.কে. চৌধুরী তিনিও সাহায্য করতেন। পরে তিনিও মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন, আমার সাথে তার দেখা হয়েছিল আগরতলায়। আব্বাস সাহেবের বাড়িতে আমাদের ক্যাম্প ছিল। তিনি ছিলেন পিস কমিটির কনভেনার, যদিও তিনি ছিলেন পিস কমিটির কনভেনার, কিন্তু আমাদের কাজই করতেন। আমি বললাম, আপনি পিস কমিটিতে গেলেন কেন? উনি বললেন, তা না হলে তোমাদের সেভ করা যাবে না। আমাদের এখানকার রাজাকাররা আমাদের কোনো ক্ষতি করে নাই। আমাদের সাহায্য করেছে, আব্বাস সাহেব তো আমার জন্য এরেস্ট হয়েছেন এবং পাকিস্তানী সেনাদের হাতে নির্যাতিত হন, উনি আমার বা আমাদের কারোর নাম বলেন নাই। আমাদের কোনো ক্ষতি করে নাই। তাঁর অবদান আমরা সারাজীবন মনে রাখবো, আমাদের সাহায্য করার কারণে তার সরকারী ব্যবসা, রেশন দোকান পারমিট এসব বাতিল করে দিয়েছিল। তার স্ত্রীও বোরকা পরে আমাদের খবরা-খবর নিতেন- আনতেন, আমি একবার ঘেরাও এর মধ্যে পড়ে গেলাম। পালানোর কোন রাস্তা নেই, তিনি কোথা থেকে যেন একটা বোরকা নিয়ে এলেন, আমরা দুজনে বোখরা পরে। নারিন্দার চলে গেলাম, এমনিভাবে দিনের বেলাতে আমাদের পালিয়ে থাকতে হয়েছে, আর রাতের বেলা হলে আমরা অপারেশন করতে বের হতাম। খালেদ মোশাররফ সাহেবের নেতৃত্বে এটিএম হায়দার সাহেব সহ আমরা ১২ জন বেলুনিয়াতে যাই। সম্মুখ যুদ্ধ করার জন্য বেলুনিয়াতে আমাদের দশ জনকে বাছাই করা হয়। ১০ জনের মধ্যে আমি, মায়া (মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বর্তমানে মন্ত্রী), গাজী গোলাম দস্তগীর (বর্তমানে মন্ত্রী), আবুল, জিন্নাহ, আবু সাঈদ খান, হে আनী, আলম ভাই, রূপগঞ্জের আলাস, হানিফ ছিলেন। আমরা যখন বেলুনিয়াতে গেলাম তখন নদী পাড় হতেই দেখি যুদ্ধ থেমে গেছে, এবং পাকিস্তানীরা পিছু হটেছে। সেখানকার সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন বীর যোদ্ধা ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম। বেলুনিয়ার মুক্ত স্থানে মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলো। টার্গেট ছিল বিশ্ববাসীকে দেখানো যে বাংলাদেশে এই অংশটুকু স্বাধীন আমরা সবচেয়ে বেশি পাক আর্মি খতম করেছিলাম দুটার হাউজেও সায়েদাবাদ ব্রীজের এম্বুসে, গোলাপবামে সিটি কর্পোরেশনের কসাইখানা তৈরী করেছিল, এখানে বিরাট আর্মি ক্যাম্প বসে, এখানে সবচেয়ে বেশি আর্মি খতম করি। বর্তমানে যেটা যাত্রাবাড়ি থানা সেটা ছিল পাঞ্জাবীদের কারখানা। এ কারখানাতে আর্মি ক্যাম্প করেছিল। সামাদ সুপার মার্কেট, রহমান ম্যানশন একটা আর্মি ক্যাম্প ছিলো। আমার বাড়ি ২৭২ বাসাবাড়িতে আর্মিরা সব লুট করে নিয়ে আর্মি বসিয়েছিল, আমাদের বাড়ির পাশে মসজিদের মিনারের উপর মেশিনগান বসানো ছিল। পাইলট চুলা ফ্যাক্টরীতে আর্মি ক্যাম্প ছিল। এত ঘনঘন আর্মি ক্যাম্প থাকার কারণ ছিল, যাতে মুক্তিযোদ্ধারা এপার ওপার যেতে না পারে। আব্বাস উদ্দিন সাহেবের বাসা ছিল আমাদের অন্যতম ঘাঁটি। মাতুয়াইলের হাবিবুর রহমান মোল্লা সাহেব আমাদের সংগঠক ছিলেন। ওখানে তিনি আমাদের অনেক সাহায্য করেছেন। আমার সাথে অনেক জায়গায় গিয়েছেন। উনি তখন কন্ট্রাক্টরি করতেন, আমি মনে করি পানি ছাড়া যেমন মাছ বাঁচতে পারে না তেমনি মুক্তিযোদ্ধারাও জনগণের সাহায্য ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ করতে পারত না বা দেশ স্বাধীন হতে পারত না। এদেশের মানুষ বেশির ভাগই আমাদের পক্ষে ছিল। অনেকে নিজেরা প্রাণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সেক করেছেন। আমি মনে করি এ দেশের যুদ্ধ করতে পেরেছি শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের সহযোগিতার কারণেই । সাধারণ মানুষের সহযোগিতা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ সফল হতো না।
জীবনবাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধ করেছি। নানা বিপদ ছিল যুদ্ধকালীন সময়ে মহান সৃষ্টিকর্তা সহায় ছিলেন সবসময়। রণামন থেকে ফিরবো এমন ভাবনা-ই ছিল না। টার্গেট দেশকে মুক্ত করবো। পাকিস্তানীরা যে বর্ষআচরণ, নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে সেটা নিজের চোখে দেখেছি। এই বর্বতার প্রতিবাসে মন সবসময় প্রতিবাদী ছিল। যুদ্ধের শেষের দিকে নভেম্বর মাসের ঘটনা । আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার দয়াগঞ্জ থেকে ২ জন রাজাকারকে ধরে যাত্রাবাড়ি নিয়ে আসে। আমরা তাদের আমাদের ক্যাম্প পাটের বাগে পাঠালাম। সোলায়মান, আশরাফ, আতাউর রহমান ফালু এবং মোবারক তাদেরকে হাত বেঁধে নিয়ে যায়। ঢাকা নারায়ণগঞ্জ রোড দোলাইরপাড় ব্রীজ পাড় হতেই ওরা দেখে দুইজন রাজাকার রাস্তার ঢালে রাইফেল নিয়ে বসে আছে। ওরা আক্রমণ করতে পারে এই ভেবে সোলায়মান এবং আশরাফ ঐ দুই রাজাকারকে ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলে। তখন এলাকার লোকজন দুই রাজাকারের লাশ টেনে হিচড়ে দনিয়ার দিকে নিয়ে যায় । দোলাইপাড় ব্রীজের অদূরে পাইলট চুলা ফ্যাক্টরীতে ছিল পাকিস্তানী আর্মিদের ক্যাম্প। ঘটনার খবর আর্মি ক্যাম্পে পৌঁছে এবং তখন ঐ ক্যাম্প থেকে এবং যাত্রাবাড়ি ক্যাম্প থেকে আর্মিরা ঘটনাস্থলে এসে রক্তের দাগ দেখে ক্ষেপে যায়। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে থাকে। না পেয়ে রাস্তার দুপাশের বাড়িঘরে গান পাউডার নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। সে সময় যাত্রাবাড়ির আর্মিদের সাহায্যকারী হিরণ খন্দকারকে দিয়ে ঘটনাস্থলের আশপাশ সহ পুরো এলাকায় মাইকিং করে। মাইকে বলা হয়। “দুষ্কৃতিকারী নজরুলকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে নিলে ৫ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। ” মুক্তিযোদ্ধা সহ সবাই এ মাইকিং শুনে, আমি নিজেও শুনেছি। পরের দিন হিরণকে মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম দেখতে পায় এবং তাকে সিগারেট খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে কাছে এনে ধরে ফেলে । পরে তাকে গলা চিপে ধরে যে স্থানে আগের দুই রাজাকারকে যারা হয়েছিল সেখানে নিয়ে যায় এবং মেরে ফেলে। মজার ব্যাপার হলো আমি এলকায়ই ছিলাম অথচ মাইকিং শুনে কেউ আমাকে ধরিয়ে দেয় নি, উল্টো আমাকে উৎসাহ দিয়েছে। বলেছে, “তুমি তোমার কাজ চালিয়ে যাও। আমাদের যা হয় হবে।” তখন মানুষের মাঝে মুক্তির একটা ব্যাপক চাহিদা ছিল।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোকে খুব মনে করি। মনে করি আমার সহযোদ্ধা যাঁরা শহীদ হয়েছেন বিশেষ করে আমার রুপের শহীদ শহীদ ফারুক শহীन আলমাস কাজলার শহীদ আকবর ভাই, আমার খালাতো ভাই শহীদ তাফুল ইসলাম, শহীদ দোলাই চাচার কথা। তাদের কথা মনে হলে চোখ ভিজে যায়, বুকটা খা খা করে। দেশের জন্য প্রাণ দেয়া, সেটা কোন সাধারণ কথা নয়, কত সাহস নিয়ে দেশপ্রেম নিয়ে আমরা যুদ্ধ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় কোন স্বার্থবাদিতা ছিলনা। যাঁরা প্রকৃত মুক্তি আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, কোন স্বার্থ তাঁদের ছিল না। শুধু স্বপ্ন ছিল একটি স্বাধীন দেশ, একটি উন্নত দেশ, যে দেশে মানুষ সুখে শান্তিতে বাস করবে। আগামীর সন্তানরা বেড়ে উঠার সকল অধিকার পাবে। মর্যাদা নিয়ে তারা বলতে পারবে আমাদের পূর্ব পুরুষরা বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের নানা ত্যাগ তিতিক্ষায় যে দেশ দিয়ে গেছেন সে দেশের আমরা গর্বিত সন্তান। তারা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে সারা বিশ্বে বাংলাদেশকে মর্যাদায় পরিচয় ঘটাবে। এতো গেল স্বপ্নের কথা কিন্তু সেই স্বপ্ন সব কি এ জাতি পূরণ করতে পেরেছে এ প্রশ্ন এখন মনে বারবার উকি দেয়। যুদ্ধ শেষ করে আমরা যখন দেশে আসি, তখন থেকেই একটি স্বার্থান্বেষী মহল দেশে লুটতরাজ করেছে। পরের সম্পদ দখল সহ হত্যা নির্যাতন করেছে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ার বদলে স্বার্থবাদীরা তাদের স্বার্থ আদায়ে মরিয়া হয়ে উঠেছিল এ কথা চরম সত্য। যুদ্ধের পর পর আমাদের এলাকায় নানা কিছু ঘটেছে আমরা যতটুকু পেরেছি সে সব বিষয়ে সোচ্চার ভূমিকা রাখি। যুদ্ধের পর রাতারাতি অনেকে দিন বদলে যায় অথচ অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা নানা ভাবে বঞ্চিত হতে থাকে। বিশেষ করে ৭৫ পরবর্তী সময়ে একটি মহল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেই বিকৃত করেছে। এই বিকৃতির কারণে অনেক ইতিহাস পাল্টে গেছে, অমুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীরা ও এদেশে বড় বড় আসন দখল করেছে। এদিকে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনের সর্বস্ব দিয়ে এ জাতির মঙ্গল মুক্তির জন্য অবদান রেখে গেছেন। কিন্তু ১৫ আগস্টে যে ভয়ঙ্কর কলংকজনক অধ্যায় সূচিত হলো, তার ফল স্বরূপ মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত অর্জন আমাদের স্বপ্ন ধারার গতিকে রুদ্ধ করে নিলো। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিভক্তিতে অন্যরা সুবিধা ভোগ করছে, করেছে। অবশেষ জাতির জনকের কন্যা মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসে, মুক্তিচেতনার বিকাশ এবং প্রকৃত ইতিহাস উন্মোচনে নানা পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং আরো অনেক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত এ সরকার বাস্তবায়ন করে ৭৫-এর কালো চক্র স্তব্ধ করে দিয়ে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উন্মুক্ত করে। বর্তমান সরকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নানা মর্যাদা দিচ্ছেন, সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন অনেকে, এইসব কাজকে স্বাগত জানাই। কিন্তু হতাশার বিষয় এই যে, অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা কেউ কেউ এই সব সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সুবিধাবাদীরা এখনও তৎপর রয়েছে। নানা কারসাজীতে অনেকেই স্বার্থ আদায়ে তৎপর। আমরা জীবন পণ লড়াই করে যুদ্ধ করেছি। দেশ স্বাধীন করেছি। আমাদের জীবনের কোন চাওয়া পাওয়া নেই, শুধু মর্যাদার বিষয়টি যেন নিশ্চিত হয়। কোন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যেন তার অধিকার ও সম্মান থেকে বঞ্চিত না হয় সে ব্যাপারে সরকার সহ আগামী প্রজন্ম সচেতন ভূমিকা রাখবেন এটাই কামনা। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম, কোনো কিছুর বিনিময়ে যাই নাই। না চাকরি, না বেতন, না খেতাব, শুধু দেশ স্বাধীন ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আমরা নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক পরে B.N.P সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের টাকা ৩০০/- দুঃস্থ ভাতা দিত। মুক্তিযুদ্ধ যারা করেছে তারা কেউই দুস্থ না। আমি হলফ করে বলতে পারি সকল মুক্তিযোদ্ধারা যুবক, সামর্থবান, সাহসী তা নাহলে ছোটো খাটো অস্ত্র নিয়ে পৃথিবীর বিখ্যাত এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীকে পর্যদুস্ত ও পরাজিত করে দেশ স্বাধীন করা সম্ভব হতো না। আমি যতদূত জানতে পেরেছি, মজিবুর রহমান নিজামীর পরামর্শে মুক্তিযোচ্চাদেরকে দুই বানানো হয়েছিলো। আমরা সকল মুক্তিযোদ্ধারা “দুঃস্থ” কথা বাতিল করার জন্য আন্দোলন করার পরে, বর্তমান সরকার “সম্মানি ভাতা" হিসেবে ঘোষণা দেন এবং ভাতা বাড়িয়ে বর্তমানে টাকা ১২,০০০/- করেন। এবং এর সাথে ৫টি উৎসব ভাতা যুক্ত হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি এই টাকা যথেষ্ট নয়। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা হয়তো আর ৫ কি ৭ বছর বাঁচবেন। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি “মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর"- "-এ প্রদর্শিত হবে। আর মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র দেখে পরবর্তী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীদের স্মৃতিচারণ করবে। মুখের স্বাদ ঘোলে মিটাবে। যেহেতু আমি “কমান্ডার" ছিলাম, অনেক মুক্তিযোদ্ধার সাথে আমার যোগাযোগ আছে। অনেকেই স্বচ্ছল আছে কিন্তু অধিকাংশই অস্বচ্ছল। তাদের এই শেষ বয়সে জীবন-যাপনের ব্যয়, ঔষধ-পত্র, চিকিৎসা ইত্যাদি মিলে টাকা ৩০/৩৫ হাজার লাগে। অতএব, আমার জন্য নয়, আমারমতো কিছু স্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যও নয়- যারা গরীব, অসুস্থ সেই সব মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতা বাড়ালে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই খুশি হব । আমার অনেক দুঃখ হয়, মনে হয় আমি আত্মহত্যা করি অথবা আমার সোনার বাংলা ছেড়ে পৃথিবীর অন্য কোনো স্বাধীন দেশে চলে যাই। কারণ, পৃথিবীর অনেক দেশে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। যে সব দেশ আমাদের মতো যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে যেমন- দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, চায়না, ভারত আরও অনেক দেশ, সেব দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক সম্মান দেয়া হয়। বিদেশে ভ্রমণের সময় যখন তারা জানতে পারে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, হয়তো কোনো অনুষ্ঠানে বা সেমিনারে তারা তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে আমাকে স্যালুট, কনগ্রাচুলেট করতো। যুদ্ধের সময় আমার গ্রুপ নিয়ে অনেকগুলো অপারেশন আমি করেছি, কিন্তু দুঃখের বিষয় এমন অনেক লোক আছে যারা বর্তমানে অনেক ক্ষমতাধর, আর ক্ষমতার জোরে বলে “ঐ অপারেশন আমি করেছি”-ভূয়া দাবীদার । দুঃখ হয়, অতিকষ্টে রাগ থামিয়ে জিজ্ঞেস করি- কতোজনে করেছেন? কি অস্ত্র দিয়ে করেছেন? কতোগুলো অস্ত্র ব্যবহার করেছেন? ইত্যাদি ইত্যাদি!! কিন্তু এমন উত্তর পাই যে দুঃখে প্রাণ ভেঙে যায়-যেমন “হামিদুল হক চৌধুরীর প্রেস” অপারেশন এর দাবী অনেকে করে। শুধু তাই না, আমার গ্রুপের ৩/৪ জন মুক্তিযোদ্ধাকে লিষ্ট থেকে বাদ দিয়েছে। যারা বাদ দিয়েছে তারা আমার পরিচিত, কাছের লোক, কেউ কেউ আবার আমার আত্মীয়। অথচ তাদের যদি আমি জিজ্ঞেস করি “মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে” ৩টা প্রশ্ন করলে- ১টারও উত্তর দিতে পারবে না। এমন অনেক লোক আছেন, যারা রাষ্ট্রের বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত, তারা উচ্চ শিক্ষিত এবং মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধ করেছে বলে দাবী করে-অথচ তার এলাকার অনেক লোক আমার কাছে বলেছে “সে-তো” রাজাকার ছিলো। আমাদের মহল্লার লোক তাকে রাজাকরের ডিউটি করতে দেখেছি। আমি ঐ লোকটাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে একটা উত্তরও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দিতে পারলো না। অথচ সে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পাচ্ছে, এরকম আরও ১৫/১৬ জনকে জিজেস করলাম আপনাদের কমান্ডার কে? কি কি অস্ত্র চালিয়েছেন? কমান্ডারের নাম বলল। অস্ত্র বলল রাইফেল, স্টেইনগান। অথচ কোন অস্ত্রের ফাটা গুলি কেউই তা বলতে পারলো না। কমান্ডারকে জিজ্ঞেস করলাম “আপনি কয়টা অপারেশন করেছেন? উত্তরে বললো একটাও না। আর জিজ্ঞেস করলাম যারা অমুক্তিযোদ্ধা তাদের কেন মুক্তিযোদ্ধার লিষ্টে নাম দিয়েছেন? উত্তরে বললো ভয়ে। তারা আমার বাড়ী চড়াও হয়ে আমাকে খুন করার হুমকি দেয়। বাধ্য হয়ে তাদের নাম মুক্তিযোদ্ধার লিষ্টে দিয়েছি। জিজ্ঞেস করলাম কত টাকা নিয়েছেন? উত্তরে বললো সামান্য কিছু খরচা-পাতি দিয়েছে। এই রকম অনেক তুরা ব্যক্তিরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পাচ্ছেন। প্রসঙ্গক্রমে একদিনের ঘটনা-দুজন পাঞ্জাবীদের সাহায্যকারী এবং মহল্লা থেকে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়কারী ২ জনকে ধরে আশ্রাফ, সুলায়মান, মোবারক ৬ জনকে দিয়ে দুটো ষ্টেইনগান সহ আসামীদের ক্যাম্পে পাঠাই। তারা রাস্তা পার হয়ে দেখে রাস্তার ঢালে দুই জন থাকি পোশাক পরা দুটো রাইফেল নিয়ে বসে আছে। আশ্রাফ ও সুলায়মানের ২ ব্রাশে ২ জন শেষ। ঘটনার ডানে-বাঁয়ে ১ কিলোমিটারের মধ্যে ২টা পাঞ্জাবীদের ক্যাম্প দু'দিক থেকেই আর্থিরা আসে, দেখে ডেড বড়ি টেনে হিচড়ে কোন দিকে গেছে। আশে-পাশের লোকজন সব পালিয়েছে শুধু একজন বুড়ি কানে শুনে না, কথাও ঠিকমতো বলতে পাওে না, সেই বুড়িকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। পাঞ্জাবীরাও তার কোনো কথা বা ইসারা বোঝে না। পাঞ্জাবীদের মধ্যে কয়েকজন বাঙালী পুলিশ ও ছিলো তারা বুড়িকে ছাড়ার জন্য অনুরোধ করলো। পরে বুড়িকে ছেড়ে দেয়। বুড়ির ২ ছেলে মকবুল খান, আলী হোসেন খান এখনও বেঁচে আছে। প্রেস ধ্বংস করতে একটি প্রাণ গেলো । আমার ব্যক্তিগত অনেক দায়িত্ব নিয়ে গ্রেসটি ধ্বংস করলাম, সেখানে অনেক জমিও ছিলো। এখন ঐ এলাকার নাম হলো ভাঙা প্রেস। কোনো মুক্তিযোদ্ধার নামে হলো না, প্রেসের জমিগুলো জাতীয়করণ হ'ল না, কিছু জমি সামান্য দামে হামিদুল হক চৌধুরীর ছেলে, সেও দালাল ছিলো নাম মাত্র মূল্যে বিক্রি করেছে। বাঁকী অনেক পরিমান জমি বহু চিটার বাটপার-রা নানাভাবে ভূয়া কাগজ সৃজন করে ভোগ-দখল করছে। অথচ কারা ভাঙলো জীবনের বাজি রেখে তাদের নাম হ'ল না। একজনের প্রাণ গেলো যার নাম শহীদ মোজাফ্ফর তার নামটাও হলো না। পরে আমার প্রচেষ্টায় একটা রাস্তা মোজাফ্ফরের নামে এমপি হাবিবুর রহমান মোল্লা ভাইকে দিয়ে নামকরণ করাই এবং পরে আমার সভাপতিত্বে এম পি মোন্না ভাই রাস্তাটি উদ্বোধন করেন। তবে এখানে একটা কথা বলতে চাই, যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া আমার পছন্দ হয়নি। কথা ছিল যারা যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন তারাই থাকবে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে একজনও কমান্ডার যাচাই-বাছাই কমিটিতে ছিল না। এমন কি অনেকেই প্রশ্ন করেছে ঐ কমিটিতে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধেই ছিল না। ৫০ বছর পর কেন লিখতে বললাম? কারন যৌবনে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছি স্বাধীনতার জন্য, এরপূর্বে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পাক সরকারকে হটানোর জন্য, আন্দোলন ও যুদ্ধ দু'টোতে সফল হয়েছি বাংলাদেশের জনগণের সাহায্য ও সমর্থনে। বাঁকীজীবন জীবন-যাত্রা নির্বাহের জন্য ব্যবসা করে সেই সঙ্গে সমাজের সেবা করে। এখন এই বৃদ্ধ বয়সে আমাদের অভিজ্ঞতা পরবর্তী প্রজন্মকে যদি না জানাই তাহলে তারা জানবে কি কলে আমরা অনেক রক্ত দিয়েছি, অনেক জেল-জুলাম খেটেছি, অত্যাচার- নির্যাতন ভোগ করেছি। মা, বোনদের ইজ্জত গেছে। অনেক তাই বন্ধু আত্মীয়-স্বজন হারিয়েছি। এখন এই শেষ বয়সে দেশকে দেবার কিছুই নেই। তোমরা যারা পরবর্তী প্রজন্ম আছো, তোমাদের দেশকে দেবার অনেক কিছু আছে। তোমরা সঠিক পথে চলবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে নিজেদের পরিচালিত করবে। তেমাদের ছোট ভাই-বোনদের সঠিক পথে চালিত করবে। আদেশ/উপদেশ দিবে যেন তারা ভুল পথে বা খারাপ পথে পরিচালিত না হয়। এক সময় বাঙালীরা পাক-সেনাবাহিনীতে সব্বোর্চ মেজর পদের উপরে উঠতে পারতোনা-শত যোগ্যতা থাকলেও। একমাত্র কর্ণেল ওসমানী ছাড়া আর কেউই অত উচ্চ পদে যেতে পারে নাই। যদিও তার সর্বোচ জেনারেল পদে যাবার যোগ্যতা থাকলেও তা বন্ধ করে রাখা হয়।
এখন তোমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছো-যোগ্যতা অর্জন কর, উচ্চ শিক্ষা নাও, জীবনের বিভিন্ন কর্মস্তরে, ব্যবসা বাণিজ্যে চরম শিখরে ওঠার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, কোনো বাধাই আর নেই। বড়দের সন্ধান কর, ছোটদের স্নেহ কর-উপদেশ দাও যাতে ওরা ঠিক পথে নিজের এবং দেশের অনেক উন্নতি সাধন করতে পারে। বঙ্গবন্ধু যা চেয়েছিলেন তার বাস্তবায়ন করে যেতে পারেন নাই। অনেক দেরিতে হলেও বঙ্গবন্ধু কন্যা ক্ষমতায় আসার পর দেশের প্রভূত উন্নতি হয়েছে-শিক্ষা, স্ব অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিটা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সমৃদ্ধি হয়েছে যা বিশ্বগিকৃত। প্রধানমন্ত্রীর জন্য আমার আল্লাহর দরবারে একইটাই প্রার্থনা-যেন উনার দীর্ঘজীবন লাভ হয়, উনি যেন একইভাবে বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে পারেন। আর এটাই আমাদের সকলের একান্ত কামনা হওয়া উচিত।