যুদ্ধের ইতিহাস
আমি দুই নম্বর সেক্টরের একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সরাসরি মুক্তিযোদ্ধে অংশ গ্রহণ করি। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পূর্বে আমার কিছু ইতিহাস না বললেই নয়। ৬৯ এর গণ আন্দোলন থেকে আমি ছাত্র রাজনীতি সাথে জড়িত ছিলাম। আমার ছাত্র রাজনীতির হাতে খড়ি হয় দুজন ছাত্র নেতার হাতে একজন ব্রহ্মণবাড়ীয়া কলেজের তৎকালিন ছাত্র নেতা সাবেক এম.পি আঃ লতিফ ও আরেকজন ছাত্র নেতা সাবেক রাকসুর জি.এস মিজানুর রহমান খান (মিজান ভাই) তিনি ৬৯ এর গণ আন্দোলনের ১১ দফার পক্ষে ছাত্রদের সাথে কাজ করার জন্য এলাকায় তথা নবীনগরে চলে আসেন। আমি তখন পূর্ব পাক ছাত্র লীগের স্কুল শাখার সভাপতি আমাদের এলাকাটি ছিল মুসলিম লীগ প্রভাবিত। এখানে মুসলিম ছাত্রলীগের প্রভাব ছিল অত্যাধিক। গুটি কয়েক ছেলে আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে ছাত্র লীগ করতাম। তার মধ্যে শাহজুল আলম, নারায়ন সাহা, ওয়াদুদ ভাই, হেলাল ভাই, মোতালেব, ইকবাল, বাবুল সহ হাতে গুনা কয়েকজন। ৬৯ সত্তরের আন্দোলনে ছাত্র সমাজের ১১ দফা দাবী নিয়ে যা মিজান ভাইয়ের হাত থেকে প্রাপ্ত লিফলেটটি এখনও আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। আমরা সারিকার আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে উঠি এবং পরবর্তী সময় স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ি। ৭০ এর নির্বাচনে এম.এল. এ দেওয়ান আবুল আব্বাস ও এম.পি কাজী আকবর উদ্দিন সিদ্দিকের নির্বাচনের প্রচার কাজে সরাসরি অংশগ্রহণ করি এরই মধ্যে নির্বাচনী সভায় বঙ্গবন্ধু ব্রাহ্মনবাড়িয়া আসলে সার্কিট হাউজে আমরা সরাসরি দেখা করি যা আমাদের আরও উজ্জিবিত করে। সত্তুরের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ৩০০ আসনের মধ্য ২৮৮ টি আসনে জয়লাভ করেন, যা দেখে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা নানা ছলচাতুরী করে জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত করে দেন। এতে সারা বাংলা গর্জে উঠে তার ঢেউ নবিনগরের মতো একটি মফস্বল শহরেও লাগে। আমরা মিছিল মিটিং করতে থাকি, আমাদের স্লোগান ছিল বীর বাঙ্গালী অস্ত্রধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা। পিন্ডি না ঢাকা ঢাকা এরই মধ্যে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষনে আমরা বুঝে গিয়েছি আমাদের লক্ষ্য স্বাধীনতা। আমরা প্রস্তুত হতে থাকলাম । ইতিমধ্যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ২৩ শে মার্চ সারাদেশে পাতাকা দিবস পালনের ডাক আসলে আমরা নেতৃত্বে অফিস পাড়া ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে নবীনগর পুলিশ ষ্টেশনে (থানা) প্রথম পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে জয় বাংলা বাহীনির যা পরে স্বাধীন বাংলার পতাকা হয় তা উত্তোলন করি। আমার সাথে মিছিলে ছিল শাহানওয়াজ, ইকবাল, মোজাহার, বাকী, দুলাল, রফিক, ফারুক সহ আরো অনেকে। ২৫ শে মার্চ পাক হানাদার বাহিনীর ক্রাক ডাউন শুরু হলে ঢাকা থেকে আনেক স্বরনার্থী ও ই.পি.আর বেঙ্গল রেজিমন্টের সৈনিক পালিয়ে আসতে থাকে। আমরা হাইস্কুলে ক্যাম্প করে তাদেরকে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করি এবং সৈনিকদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্তাঞ্চলে প্রেরণ করি। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া ক্যাপ্টেন মাহাবুব ও আইনুদ্দিন এর নেতৃত্বে মুক্ত এলাকা ঘোষনা করা হয়েছিল মার্চ, এপ্রিল, মে মাস পর্যন্ত ঢাকা থেকে আসতে থাকা যুবকদের সংগঠিত করে ও নিরাপত্তা দিয়ে সি.এন্ড.বি. রোড পার করে আগরতলা পাঠানোর ব্যবস্থা করি। ইতি মধ্যে মে মাসে নবীনগর পাক হানাদার বাহিনী স্থায়ী কাম্প স্থাপন করলে আমরা বিভিন্ন এলাকায় চলে যাই এবং যুবকদের সংগঠিত করে বাড়িখলা মিজান ভাইয়ের বাড়ীতে জড়ো করে ব্রিফিং দিয়ে প্রশিক্ষনের জন্য আগরতলা প্রেরণ করতে থাকি। আমি জুন মাসে মিজান ভাইকে বললাম ভাই আমি প্রশিক্ষনের জন্য আগারতলা চলে যেতে চাই এবং সরাসরি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করব। তিনি দুইটি চিঠি লিখে আমাকে পাঠিয়ে দিল একটি দেওয়া আবুল আব্বাস সাহেরে কাছে আরএকটি ঝুনুদাস এর কাছে লিখা। আমি ৪ঠা জুলাই সকাল ১০টায় বাড়ীখলা থেকে রওনা দিয়ে প্রতিকুলতার মধ্যে দিয়ে মনিঅন্দ চৌধুরি বাড়ী হয়ে শাহনাওয়াজ চৌধুরির সহায়তায় রাত ৮ টায় আগরতলায় পৌঁছি কামান। চৌমুহনী রাস্তায় হাটার পথে ঢাকা ফার্মগেইটের মিলন ও খোকন ভাইয়ের দেখা পাই। যাদের কে জুন মাসে আমরা আগরতলা যেতে সাহায্য করেছিলাম। তারা আমাকে হোটেলে নিয়ে যায় এবং থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে। পরদিন আমাকে কংগ্রেস ভবন থেকে বাংলাদেশের আইডি কার্ড ( যা এখনো আমার কাছে আছে) ( সংগ্রহ করে নরসিংগড় যুবক্যাম্পে যেতে বলেন। আমি সেইভাবে নরসিংগড় ক্যাম্পে গিয়ে ঝুনুদা কে চিঠি দিয়ে উনার তত্ত্বাবধানে ক্যাম্পে অবস্থান করি। ৪/৫ দিন পর আমার ছাত্র নেতা শাহাজুল আলম আমাদের ক্যাম্পে এলে আমি তাকে আমার প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ জানাই তিনি আমাকে ঝুনুদাস থেকে আউট পাশ নিয়ে শহরে যাওয়া কথা বলে কলেজ টিলায় চলে যেতে বলেন। সেখানে ছাত্রলীগের কর্মীদের স্পেশাল ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানান। সেই মোতাবেক আমি ১০ই জুলাই কলেজ টিলায় চলে যাই সেখানে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের (ছাত্রলীগের) বি.এল.এফ এর ট্রেনিং এর জন্য রিক্রট করা হচ্ছে আমি ছোট এবং এস.এস.সি পরিক্ষার্থী ছিলাম বলে রিক্রুট করা হবে না বলে জানিয়ে দেন। এই অবস্থায় আমার কান্নাকাটি দেখে তৎকালীন ছাত্র নেতা আঃ কুদ্দুস মাখন ভায়ের বিশেষ সুপারিশে আমাকে রিক্রুট করা হয়। সেখান থেকে অন্যদের সাথে আমি মেঘালয়ের হাফলং মুজিব বাহিনীর (বি.এল. এফ) ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগদান করি এবং ১২/০৮/১৯৭১ থেকে ১৫/১০/১৯৭১ইং মোট ৬২ দিন ট্রেনিং গ্রহণ করি। আমার অস্ত্র প্রশিক্ষণ ছিল ৩০৩ ও ৭.৬২ রাইফেল এস.এল.আর, এল.এম.জি, ট্রেনইগান, টু ইঞ্চি মটার ও ৩৬ হ্যান্ড গ্রেনেড। প্রশিক্ষণ শেষে আমরা আগতলায় ফিরে আসি। আমি শাহাজুল আলম ভাইয়ের গ্রুপে অন্তভুক্ত হয়ে ২০/১০/১৯৭১ ত্রিপুরার বক্সনগর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি এবং রতনপুর গ্রামে একটি পরিত্যাক্ত বাড়ীতে আমরা ক্যাম্প স্থাপন করি আমাদের গ্রুপে ১৫ ছিল এর মধ্যে টু আই সি ছিল। আব্দুল কুদ্দুস সহযোদ্ধা ছিল আঃ আওয়াল, হুমায়ূন মামা, শাহানেওয়াজ ও আরো অনেকে। আমরা ২টি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি এর মধ্যে একট ইব্রাহীমপুর এলাকা জুগিদ্বারা ও নবীনগর থানা মুক্ত করার যুদ্ধ। জুগিদ্বারার ব্রীজ ভাঙ্গা এবং মুক্তি যোদ্ধাদের পাহাড়া থাকায় পাক বাহিনী নবীনগর থেকে দক্ষিন দিকে যেতে পারে না। তাই তারা যে কোন উপায়ে পারাপাড়ের সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছিল এর মধ্যে নভেম্বর মাসে একদিন ভোর রাতে পাকহানাদার বাহিনী বাড়ীঘর পুড়িয়ে আশে পাশে গুলা গুলি করে ভাঙ্গা ব্রীজ পর্যন্ত মার্চ করে পজিশনের যায় এর মধ্যে সুবেদার গিয়াস উস্তাদের নেতৃত্বে প্রথমে তাদের এবুস করা হয়। আমরা আশে পাশে অবস্থান রত মুক্তিযোদ্ধারা খবর পেয়ে দ্রুত যুদ্ধ ক্ষেত্রে চলে আসি ও ব্রীজের দক্ষিণ পারে বাশ বাজার সহ ইব্রাহিমপুর গ্রামে পজিশন নিয়ে প্রতিরোধ সৃষ্টি করি। সারাদিন প্রচন্ড গোলাগুলির পর পাক হানাদার বাহিনী সন্ধায় পিছু হটে। আমরাও যার যার ক্যাম্পে চলে যাই। সর্বশেষ আমি যে যুদ্ধটা করি সেটা হলো নবীনগর থানা পাকহানদার বাহিনী মুক্ত করণ যুদ্ধ। এর মধ্যে রসুল্লাবাদ বাজার ও শিবপুর বাজারে আশে পাশের বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডারদের নিয়ে ২টি মিটিং হয় নবীনগর আক্রমন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয় দক্ষিণ পশ্চিম এবং উত্তর দিক থেকে মুক্তি বাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপভাগ হয়ে আক্রমন চালাবে। পূর্ব দিকে নদী থাকায় তিন দিক থেকে আক্রমনের সিদ্ধান্ত হয়। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সুবেদার মজিদ ও বি.এল.এফ এর কমান্ডার আব্দুল লতিফ ভাইকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমরা ১০ই ডিসেম্বর দক্ষিণ দিক দিয়ে এসে আলিয়াবাদ গ্রামের তায়েব আলী বেপারী বাড়ীতে সমাবেত হয়ে অন্যান্য গ্রুপের সাথে মাঝিকারার দিক থেকে আক্রমন চালাই। উত্তর ও পশ্চিম দিক থেকে বিভিন্ন গ্রুপ আক্রমন করে পাক হানাদার বাহিনী কে থানা ও ডাকবাংলা মুক্ত করে হাইস্কুলের দুতলায় ব্যাংকারে পাঠানো হয় স্কুলের ছাদে ও দুতলায় পাকহানাদাররা শক্ত ঘাটি ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ১২ই ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর সাথে আমাদের প্রচন্ড যুদ্ধ চলে আমরা মাঝিকারা খালের দক্ষিন পাড় থেকে প্রচন্ড আক্রমন চালাই। আমার অবস্থান ছিল খাদ্য গুদামের পাশে। বিকাল ৪টায় যুদ্ধের গতি কমে আসলে কমান্ডার আলম ভাই আমাকে পজিশন থেকে উঠিয়ে বলে চল আমরা পশ্চিম দিক দিয়ে ঘুরে নবীনগর যাই। আমরা মাঝিকারা গ্রামের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় করিম চেয়ারম্যানের বাড়ীতে এসে শহীদ সালামকে মৃতবস্থায় দেখতে পাই এই যুদ্ধে সেই প্রথম শহীদ। তার সহযোদ্ধা আমাদের কে জানালো সালাম চেয়ারে বসে এল.এম.জি. চালাতে ছিল এক প্রর্যায়ে জানালা ভেদ করে একটি গুলি এসে তার নিন্মাংশে লাগে এবং সে মৃতুর কোলে ঢলে পরে। আমরা তখন মৃতদেহ সরিয়ে নেওয়ার জন্য আলিয়াবাদ খবর দিয়ে কান্দিঘোরে নবীনগের যাই। তখন নবীনগর স্কুল ক্যাম্প ছাড়া সব এলাকা মুক্ত আমার যাওয়ার পথে উচ্চবালিকা বিদ্যালয়ে দেখা পাই জিকরুল ভাইয়ের টু. আই.সি শাহজাহান, আদালত প্রাঙ্গনে বানঞ্চারামপুর বি.এল.এল এর কমান্ডার মনিরুল হক ভেলানগরের মুখলেছ ভাই সিইওর বাংলায় সুবেদার মজিদ ভাই ও কামালউদ্দিন সুধন মিয়াকে, বড় বাজারে যাওয়ার পথে মিজান ভাই, জামিল, মনসুর ভাই, থানার গেইটে আলী আজম গ্রুপের অনেকে সাথে দেখা হয়। ১৩ ই ডিসেম্বর পাক বাহিনী যুদ্ধ বিরতি ঘোষনা করে স্যারেন্ডারে সময় প্রার্থনা করে। ১৪ ডিসেম্বর বিকাল ৪টায় একজন ক্যান্টেন ও মিলিশিয়া সহ ১২ জন পাক হানাদার বাহনী বি.এস.এফ ও মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসম্পর্ণ করেন পরে তাদের কে বি.এস.এফ নিয়ে যায়।