বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল | mssangsad.com

মুক্তিযোদ্ধার প্রোফাইল

Visitor: 690

বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল

মুক্তিযোদ্ধা পরিচিতি নম্বর : ম-২১৪৭৭ (স্মারক নং- মু বি ম /সা:/সিরাজগঞ্জ/প্রঃ৩/২০০২/৪১০, তারিখ ২৫.০৫.২০০৩খ্রিঃ
  • পিতার নাম: দ্বিজেন্দ্র নাথ সান্যাল
  • মাতার নাম: নীলিমা রানী সান্যাল
  • স্ত্রীর নাম: নিভা রানী সান্যাল
  • জম্ন তারিখ: 26/09/1958
  • মৃত্যু তারিখ:
  • মোবাইল: 01713741686
  • গ্রাম: রতনকান্দি
  • ইউনিয়ন: হাবিবুল্লাহ নগর
  • উপজেলা: শাহজাদপুর
  • জেলা: সিরাজগঞ্জ

অন্যান্য তথ্য

মুক্তিবার্তা নম্বর 0312040006
ভারতীয় তালিকা নম্বর FF4742, Sector No.-7
মুক্তিবার্তা নম্বর 0312040006
বাংলাদেশ গেজেট নম্বর 1679
মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান কি না? yes

সন্তানদের নাম ও বয়স

নাম বয়স শিক্ষাগত যোগ্যতা
উত্তম কুমার সান্যাল 27-12-1986 ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার
চন্দ্রনা সান্যাল 08-12-1984 এম কম (মাস্টার্স)
বন্দনা সান্যাল 27-03-1992 এম কম (মাস্টার্স)

যুদ্ধের ইতিহাস

আমি মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল, মোবাইল- ০১৭১৩৭৪১৬৮৬, পিতা-দ্বিজেন্দ্র নাথ সান্যাল, মাতৃদেবী- নীলিমা সান্যাল, গ্রাম ও ডাকঘর: রতনকান্দি, ইউনিয়ন পরিষদ-হাবিবুল্লাহ নগর, উপজেলা: শাহজাদপুর, জেলা: সিরাজগঞ্জ। ১৯৭১ সালে আমাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়। তখন আমি আমার গ্রামের রতনকান্দি আদর্শ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। ১৯৭০ সালের ৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা দেন, পূর্ব পাকিস্তানের নাম হবে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পরিবার পরিজনের মায়া ত্যাগ করে জীবন পণ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি জাতীয় পরিষদের ১৬০টি-তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বিজয় লাভ করে। ৭টি মহিলা আসন সহ আওয়ামী লীগ মোট ১৬৭টি জাতীয় পরিষদের আসনের অধিকারী হয়। সংসদে একক সংখ্যা গড়িষ্ঠতা লাভ করে। তখন পাকিস্তান ছিল ৩১৩ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় পরিষদের। তখন দেশে সামরিক শাসন চল ছিল। দেশের সামরিক প্রেসিডেন্ট ছিলেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান। প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের ২৮৮টি-তে বিজয় লাভ করেছিল। গণতন্ত্রের নিয়মানুসারে দেশের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ছিল গণ ভোটে নিরঙ্কুশ বিজয়ী হওয়া আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের জন্য আহবান জানানো। কিন্তু পাকিস্তানের বিহারী শাসক এই গণ ভোটের রায়ে সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি বাঙালিদের হাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা দিতে নারাজ। তিনি ষড়যন্ত্র শুরু করলেন। এই সাধারণ নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পিপলস পার্টি ৫টি মহিলা আসন সহ ৮৮টি আসনের অধিকারী হয়েছিল। অন্যান্য সব দল মিলে পেয়েছিল বাকি ৫৬টি আসন। ১১ জানুয়ারী ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা শুরু করেন।প্রেসিডেন্ট বাঙালিদের হত্যা করে হলেও সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল বাতিলের ষড়যন্ত্র করতে থাকলেন। ২২ ফেব্রæয়ারী’৭১ পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেলরা আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থকদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেনা বৈঠকে ইয়া হিয়া খান গোপন নির্দেশ দেন, “ওদের ৩ মিলিয়ন খতম করে দাও”। তাঁর ধারণা ছিল নির্যাতন করে লাখ দুয়েক বাঙালি হত্যা করলেই আন্দোলন থেমে যাবে। ১৩ ফেব্রæয়ারী’৭১ ইয়াহিয়া মিথ্যা আশ্বাস দিলেন ৩ মার্চ’৭১ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হবে। ১৬ ফেব্রæয়ারী বঙ্গবন্ধুকে পার্লামেন্টারী নেতা নির্বাচন করা হয়। ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান দুপুর ১২টায় জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া বেতার ভাষনে ৩ মার্চে আহুত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বে-আইনী ভাবে অনির্দ্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলেন। বেতার ভাষণ শুনে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দিলেন। সারা দেশের অধিকাংশ লোক রাস্তায় নেমে এলেন। গোটা দেশ অচল হয়ে যায়। পাকিস্তানী পতাকা পোড়ান শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু ৩ মার্চ কে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালনের নির্দেশ দিলেন। ছাত্রলীগ ও ডাকসু নিয়ে “স্বাধীন বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদ” গঠন করা হলো। বঙ্গবন্ধু ঢাকা এবং বাংলাদেশে ৫ দিনের জন্য হরতাল ও অনির্দিষ্ট কালের জন্য অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। তাঁর মুখের একটি কথায় সারা পূর্ব পাকিস্তান অচল হয়ে গেল। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বট তলায় ছাত্রলীগ উক্ত সভায় পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই পতাকাটি অনুষ্ঠানে উত্তোলণ করেন। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় জাতীয় সংগীত হিসেবে বিশ্ব কবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের “আমার সোনার বাংলা....” গানটি নির্বাচিত হলো। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও জাতির পিতা ঘোষণা দেয়া হলো। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের ইশতেহার পাঠ এবং কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হলো। পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত সভায় জাতীয় পতাকা উড়ানো হয়। ৩ মার্চ থেকে অফিস আদালত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে থাকে। ৬ মার্চ’৭১ বঙ্গবন্ধু সহ বাঙালিদের সবাইকে শান্ত করার কুট কৌশল হিসেবে ইয়াহিয়া খান পুনরায় ২৫ মার্চ’৭১ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকলেন। তিনি বেতারে ভাষণ দেন। ঐ দিন তিনি বেলুচিস্তানের কসাই হিসেবে পরিচিত পাকিস্তানী আর্মিদের সব চেয়ে অমানবীয় নিষ্ঠুর লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভণর নিযুক্ত করলেন ৭ মার্চ’৭১ তৎকালীণ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) রেস কোর্সের প্রান্ত দেশে ওয়ারলেস হাতে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর আঞ্চলিক প্রধান জেনারেল আব্দুল হামিদ খানের উপস্থিতিতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৮ মিনিট বাঙালিকে অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করতে ঐতিহাসিক এক ভাষণ দিলেন এই ভাষণে তিনি বললেন- ....তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রæর মোকাবেলা করতে হবে......রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দিব এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ্।” আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তবে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু বন্ধ করে দিবে। আমরা ভাতে মারবো আমরা পানিতে মারবো। সাতকোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবানা। প্রত্যেক গ্রাম, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করো। আপনাদের যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন..... এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা”। এই জনসভায় ঢাকা সহ সারা দেশের দশ লক্ষাধিক আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী ও অন্যান্য ছাত্র জনতা উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশের মানুষের ঢল থেকে বার বার শ্লোগান উচ্চারিত হচ্ছিল - “ জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু”। আমার নেতা তোমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব। বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো। তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ। আপোষ না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম....। এই দিন টেক্কা খান ঢাকায় আসেন। ৮ মার্চ সকালে রেডিও ও টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার করা হলো। ঘরে ঘরে কালো পতাকা উড়ানো হলো। সারা দেশের মানুষ ৭ মার্চের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরোক্ষ স্বাধীনতা ঘোষণার কথা বুঝতে পারলো। গোটা জাতি বাংলা দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হতে থাকলো। নিরুপায় হয়ে ইয়া হিয়া খান জেনারেল টিক্কা খানকে তখন পূর্বাঞ্চলের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দান করলেন। এই দিন শাহজাদপুরে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ও স্বাধীন বাংলাছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হলো। সারা উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও ছাত্র-জনতা খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে শাহজাদপুরে জমায়েত হলো। এই দিন বিকাল ৩টায় বরীন্দ্র কাচারী বাড়ির ঐতিহাসিক বকুল তলায় এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় পরিষদ সদস্য থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক সৈয়দ হোসেন মনছুর। সভায় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জনাব মোঃ আব্দুর রহমান, ছাত্রনেতা শাহিদুজ্জামান হেলাল, মোঃ হাসিবুর রহমান স্বপন, মোঃ আজাদ রহমান, শাহজাহান কোরবান আলী, বাকী মির্জা, আব্দুল গফুর সরবত ও শ্রমিক নেতা বিনোদ বিহারী জোয়ার্দ্দার প্রমুখসহ সবাই উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য বিভিন্ন সাবকমিটি করা হয়। এই দিনে পাক ছাত্র লীগের নাম বদলিয়ে শুধু ছাত্রলীগ রাখা হয়। ১৫ মার্চ নতুন কুট কর্ম-কৌশল নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন। ১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সাথে প্রহসন মূলক আলোচনা শুরু করেন। অন্য দিকে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য বিমানে ও জাহাজে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আনতে থাকে এবং যুদ্ধ জাহাজে করে অস্ত্র চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বন্দরে নঙ্গর করে। এ দিকে ইয়াহিয়ার পরামর্শে জেনারেল টিক্কা খান, মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন ও রাও ফরমান আলী অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা চ‚ড়ান্ত করেন। অপারেশন সার্চ লাইটের পরিকল্পনা ছিল নির্যাতন, জ্বালাও পোড়াও ও গণহত্যা করে লাখ দুয়েক বাঙালি হত্যা করে আন্দোলন থামিয়ে দিয়ে নির্বাচনী ফলাফল বাতিল করা। ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিন। এই দিন বিকালে রতনকান্দি হাট খোলা মাঠে শাহজাদপুরের আওয়ামী লীগ নেতারা এসে ডা: মো: খলিলুর রহমানকে আহবায়ক করে ১১ সদস্যের রতনকান্দি সংগ্রাম পরিষদের কমিটি গঠন করেদেন। অ্যাসেম্বলি স্থগিতের পর থেকে সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে বাঙালি - অবাঙালি দাঙ্গা চলছিল। ১৯ মার্চ বিকাল থেকে রতনকান্দি হাটখোলা মাঠে ডামি রাইফেল ও লাঠি দিয়ে ভোলা সরকারেরতত্ত¡াবধানে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ২২ মার্চ ২৫ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পুনরায় স্থগিত করেন। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়। জয় বাংলা বাহিনী পাঁচশতের অধিক সদস্য সামরিক কায়দায় মিছিল করে পল্টনে জমায়েত হয়। তাঁরা সামরিক কায়দায় বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানায় এবং বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত একটি পতাকা উপহার দেয়। সব সরকারি অফিস ও বিদেশি দূতাবাস সমূহে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়। বেতার ও টেলিভিশনে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়। জাতির জনকের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে জাতীয় সংগীতের সাথে সাথে বাংলাদেশের পতাকা তোলা হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ বিকাল পৌনে ৬টায় আলোচনা শেষ না করেই ভুট্টোকে রেখেই বিশেষ বিমানযোগে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেলেন। তিনি ঢাকা ত্যাগ করার পূর্বে অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা অনুমোদন দিয়ে বাস্তবায়ন করার নির্দেশ দিয়ে গেলেন। রাত সাড়ে ১১টায় টিক্কা খান মর্টারশেল কামান যান ও অন্যান্য ভারী অস্ত্র নিয়ে অপারেশন সার্চ লাইট শুরু করে। তারা একযোগে পিলখানা, ইপিআর ক্যাম্প, রাজারবাগ, পুলিশ লাইন, জগন্নাথ হল, ইকবাল হলে অক্রমণ করে এবং ঢাকায় সর্বত্র গণহত্যা শুরু করে। নিরীহ মানুষের উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা, ইপিআর, আনসার ও ছাত্র-জনতা প্রতিরোধের চেষ্টা করে। পাকিস্তানী সৈনিকরা ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বরোচিত জ্বালাও পোড়াও গণহত্যা চালায়। পাকি হানাদারেরা বস্তিতে আগুন ধরিয়ে দেয় পালায়নরত মানুষকে নির্বিচারে হত্যা শুরু করে বাঙালি জাতির উপর মুক্তিযুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। জাতির পিতা ইতিহাসের জঘন্যতম বাঙালি নিধন অপারেশন সার্চ লাইটের ভয়াবহতা দেখে ও শুনে পাকিস্তানিদের হানাদার হিসেবে আখ্যা দিয়ে রাত ১২:২০ মি: এ ধানমন্ডিস্থ ৩২ নম্বর নিজ বাড়িতে উপস্থিত নেতা কর্মীদের সম্মুখে আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও শেষ বার্তা প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বাধীনতা ঘোষণা ও শেষ বার্তায় বলেন “.....রাত ১২টায় বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা পিলখানা এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন অতর্কিতে হামলা করেছে। লক্ষ লক্ষ বাঙালি শহীদ হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ চলছে। আমি শেখ মুজিবুর রহমান এই পরিস্থিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং সমগ্র বিশ্বের স্বাধীনতাকামী দেশ সমূহের সাহায্য সহযোগিতা কামনা করছি। ...... এই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহবান জানাচ্ছি আপনারা যে যেখানে আছেন এবং আপনাদের যার কাছে যা আছে তাই নিয়েই শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। যত দিন পর্যন্ত শেষ পাকিস্তানি সৈন্য বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত না হয় এবং যতদিন পর্যন্ত চ‚ড়ান্ত বিজয় না আসে তত দিন আপনারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন..... খোদা হাফেজ, জয় বাংলা। বঙ্গবন্ধু রাত ১২:২০ মি: এ সকলের সম্মুখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে শেষ বাণী প্রদান করেন। ২৬ মার্চ’৭১ সকাল ৭:০০ টায় শাহজাদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা বার্তার টেলিগ্রামের একটি কপি হাতে পেয়েছিলেন। তিনি টেলিগ্রামটি থানার সবাইকে দেখান। তারপর টেলিগ্রামটি নিয়ে শাহজাদপুরের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য জনাব মোঃ আব্দুর রহমানের বাসায় যান। এম.পি.এ জনাব মোঃ আব্দুর রহমান ইংরেজি লেখা স্বাধীনতা বার্তার টেলিগ্রামটির বঙ্গানুবাদ করেন। কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকে দিয়ে টেলিগ্রামটি হাতে লেখায়ে বিভিন্ন এলাকায় পাঠান। শাহজাদপুর শহরে ৩টি মাইক নামিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণার বঙ্গানুবাদ প্রচার করেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, জয়দেবপুর সহ বিভিন্ন জায়গা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েগেছে। শাহজাদপুরের সর্বত্র জাতির পিতার আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার ও শেষ বাণীর কথা ছড়িয়ে পড়লো। আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের উদ্যোগে শাহজাদপুরে মিছিল হলো। জাতির পিতার স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ পেয়ে পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান করাচী বেতার কেন্দ্র থেকে এক বেতার ভাষণে শেখ মুজিবকে দেশ দ্রোহী আখ্যায়িত করে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ও শেষ বাণী প্রদানের পর হানাদার বাহিনীর একটি দল লে: কর্ণেল জেড এ খান ও মেজর বিল্লালের নেতৃত্বে কমান্ডো বাহিনী নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাস ভবনে এসে রাত ১:৩০ মি: বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনা নিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। পরের দিন বঙ্গবন্ধুকে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে লাহোর কারাগারে নিয়ে যাওয়া হলো। ২৬ মার্চ দুপুরে আনুমানিক ১:১০ মি: চট্টগামের আগ্রাবাদে অবস্থিত কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি পাঠ করেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম.এ হান্নান। তখন সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েগেছে। জয়দেবপুর সহ সারাদেশের সর্বত্র বাঙালি সেনা ইপিআর আনসার ও আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীরা পাকি হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করছে। তখন জিয়াউর রহমান অষ্টম ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর ও বাঙালি সকল আর্মির সিনিয়র ছিলেন। ২৭ মার্চ বেতারে ভাষণ দেওয়ানোর জন্য পটিয়ার করাইল ডাঙ্গা থেকে মেজর জিয়াকে কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্রে নিয়ে আসেন বেলাল মোহাম্মদ, আব্দুল্লাহ আল ফারুক, আবুল কাসেম সন্দিপ ও অন্যান্যরা। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় জ্যেষ্ঠ সামরিক অফিসার হিসেবে ১০কি: ওয়াট মধ্যম তরঙ্গ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র (কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র) থেকে মেজর জিয়াউর রহমান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার মর্ম কথা নিজের ভাষায় বললেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন- I Major Zia, on behalf of our great National leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman do hereby declare independence of Bangladesh..... তখন উপস্থিত ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ, ক্যাপ্টেন অলি আহম্মদ, অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ ও অন্যান্যরা। ২৮ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি বেতারে পাঠ করেন সামরিক বাহিনীর ক্যাপ্টেন শমসের মবিন চৌধুরী। ১৫ এপ্রিল শাহজাদপুরের আওয়ামী লীগ এম.পি.এ জনাব মোঃ আব্দুর রহমান আমাদের রতনকান্দি গ্রামে তাঁর ভগ্নিপতি জনাব মোঃ নজরুল ইসলাম সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। ১৬ এপ্রিল আমাদের গ্রামের ও আশেপাশের আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী ও অন্যান্য সবাইকে নিয়ে রতনকান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে এক কর্মী সভা করলেন- এই সভায় তিনি ঢাকার গণ হত্যা সহ অপারেশন সার্চ লাইটের নির্মতার কথা বললেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের পরোক্ষ স্বাধীনতার ঘোষণার কথা বললেন। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ স্বাধীনতা ঘোষণা ও শেষ বাণীর কথা বললেন। সভার মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রাপ্ত টেলিগ্রামের মূল কপি দেখালেন। তিনি বললেন ঢাকার অনেক আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী ও হিন্দুরা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। অন্যান্য সার্বিক অবস্থার কথা বললেন। সবাইকে পাকি হানাদারদের থেকে দূরে থাকতে বললেন। তিনি বললেন দেশে বাঙালি সৈন্য ইপিআর আনসার ও অন্যান্য স্বাধীনতাকামীরা প্রতিরোধ যুদ্ধ করছে। দেশে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েগেছে। দেশ স্বাধীন হলে দেশ পরিচালনার মূলনীতি হবে (১) গণতন্ত্র (২) সমাজতন্ত্র (৩) ধর্ম নিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ। তিনি বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ও ১১ দফার কথা বললেন। বাংলাদেশ সরকার গঠণ হয়েছে। ভারত শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্প খুলেছে। বঙ্গবন্ধু সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেছেন। যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রæর মোকাবেলা করতে বলেছেন। সবাইকে বাঁশের ও সুন্দরী কাঠের লাঠি বানাতে বলেছেন। আমি আগ্রহী সবাইকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং দেওয়ানোর জন্য ভারত যাব। কারণ আমাদের কাছে তেমন অস্ত্র নাই। যে অস্ত্র আছে তা দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয়ী হওয়া সম্ভব নয়। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন আমাদের গ্রামের ডা. অয়জুল হক। সভা মধ্যে তিনি প্রকাশ্যে স্বাধীনতার জন্য তাঁর দুই ছেলেকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার ঘোষণা দেন। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার প্রথম প্রহরে সকালে টেলিগ্রাম পেয়ে সিরাজগঞ্জের এসডিও এ.কে শামসুদ্দিন সাহেব পুলিশের সহায়তায় অস্ত্রাগার খুলে দেন সব অস্ত্র সিরাজগঞ্জ সদরের এমএনএ জনাব মোঃ মোতাহার হোসেন তালুকদার, ছাত্রনেতা জনাব আব্দুল লতিফ মির্জা ও অন্যান্যদের দায়িত্বে ছেড়ে দেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। ২৮ মার্চ ঢাকা সহ সারা দেশে আমাদের এলাকার চাকুরীজীবি ও অন্যান্যরা শহর ছেড়ে আমাদের গ্রামে ও আশেপাশের গ্রামে চলে আসেন। সিরাজগঞ্জের এমডিও ও অন্যান্য সকল আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীরা বাঙালি সৈনিক ইপিআর ও আনসারদের নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। ২৮মার্চ পাকিস্তানি হানাদারেরা উত্তর বঙ্গের প্রবেশদ্বার নগর বাড়ি ঘাট হয়ে পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও অন্যান্য শহর দখলে নেয়ার জন্য ফেরিতে আরিচাঘাট হয়ে নগর বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো। আমাদের পাবনা মহকুমার স্বাধীনতা কামীরা প্রতিরোধ করার জন্য নগর বাড়ি ঘাটে বাংকার করে পজিশন নিয়ে গুলি ছুড়লো। পাকি হানাদার সৈন্যরাও ফেরী থেকে গুলি ছুড়তে লাগলো। স্বাধীনতা কামীদের গুলির কাছে হানাদারেরা পরাজিত হয়ে মধ্য নদী থেকে ফেরী ঘুরিয়ে আরিচা ফেরী ঘাটে ফিরে গেল। ১ এপ্রিল দুপুরে পাকি হানাদারেরা পুনরায় আরিচা ঘাট থেকে ফেরী যোগে নগর বাড়ি ঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো। বিমান থেকে নগর বাড়ি ঘাটে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের উপর বোমা ফেলতে শুরু করলো। বোমার আঘাতে প্রতিরোধকারী যোদ্ধাগণ টিকতে পারলো না। তাঁরা নগর বাড়ি ঘাটের পজিশন ছেড়ে দিয়ে ডাব বাগান (বর্তমানে শহীদনগর) নামক স্থানে বিশ্বাস কোম্পানীর বিশ্বাস বাড়িতে বাংকার করে প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য পজিশন নিলেন। সন্ধ্যায় ডাব বাগানে প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি সৈনিকদের ভারী অস্ত্রের কাছে বাঙালি সৈনিক, ইপিআর, আনসার ও অন্যান্যরা টিকতে পারে না। এই প্রতিরোধযুদ্ধে ৮ জন ইপিআর শহীদ হয়েছেন। ২৮ মার্চ পাকি হানাদের প্রতিরোধ করার জন্য সিরাজগঞ্জের এস,ডি,ও এ,কে সামস্ উদ্দিন এর নেতৃত্বে বাঙালি সৈনিক ইপিআর আনসার ও অন্যান্যরা বাঘাবাড়ি ঘাটে পজিশন নেয়। বাঘাবাড়ি ঘাটে পাকি হানাদারদের প্রতিরোধ করার জন্য এস,ডি,ও স্যার, এম,পি,এ জনাব মোঃ আব্দুর রহমান, আব্দুল লতিফ মির্জা, মোঃ হাসিবুর রহমান (স্বপন), মোঃ খালেকুজ্জামান খান, আব্দুল বাকি মির্জা, মোঃ আজাদ রহমান শাহজাহান, মোঃ আব্দুল গফুর সরবত, মোঃ কোরবান আলী, শহিদুজ্জামান হেলাল (পরে শহীদ হন) সহ সিরাজগঞ্জ জেলার সর্বস্তরের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী জমায়েত হয়েছিলেন। বাংকারের মধ্যে পজিশন নিয়েছিলেন বাঙালি সৈনিক ইপিআর আনসার ও মুক্তিযোদ্ধারা। ২ এপ্রিল’৭১ দুপুরে পাকি হানাদারেরা বাঘাবাড়ি ঘাটের দক্ষিণ পাড় এসে এক শক্তিশালী মর্টার শেল ছাড়লো। মর্টারের বিকট শব্দ হলো। এই মর্টার শেলের ভয়ঙ্কর আওয়াজে গোটা এলাকার মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। মর্টার শেলের গুলিটি গিয়ে পড়েছিল বাঘাবাড়ি থেকে ৪ মাইল দূরে পুঠিয়া গ্রামে। এই মর্টার শেলের আঘাতে পুঠিয়া গ্রামের ১ জন মহিলা মারা গিয়াছিল। ট্রেন যোগে উল্লাপাড়া ষ্টেশন হয়ে এবং বগুড়া থেকে সড়ক পথে অনেক পাকি হানাদার সৈন্য বাঘাবাড়ি ঘাটের দিকে মার্চ করলো। সংবাদ পেয়েঅস্ত্র ও যোদ্ধার স্বল্পতা বিবেচনায় বাঘাবাড়ি ফেরী ঘাটে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা পজিশন ছেড়ে দিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিলেন। ৩ এপ্রিল ট্রেনযোগে সিরাজগঞ্জগামী পাকি হানাদারদের সাথে মোঃ আব্দুল লতিফ মির্জার নেতৃত্বে উল্লাপাড়ার ঘাটিনা নামক স্থানে একটি প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ৭ জন স্বাধীনতাকামী শহীদ হন। পোরজনা, চরকৈজুরী ও করশালিকা গ্রামে রাজাকার ক্যাম্প করা হলো। সারা দেশে বাঙালি হত্যা, অগ্নি সংযোগ, ধর্ষন, লুণ্ঠন ও বিভিন্ন প্রকার নির্যাতন শুরু হলো। বেড়া থেকে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য লঞ্চ ভরে গিয়ে ডেমরা গ্রাম ঘিরে নিয়ে গুলি করে পাখির মত মানুষ মারলো। এই গণ হত্যায় আমার চার দাদা সহ আট শতাধিক নারী-পুরুষ হত্যা করা হয়েছিল। জামায়েতে ইসলামী ও অন্যান্য ইসলামী দল গুলোর ধর্মান্ধ মৌলবাদী নেতাদের নির্দেশ পেয়ে পোতাজিয়া গ্রামের মাহতাব আলী সরকার ও অন্যান্য গ্রামের কিছু উশৃঙ্খল যুবক শাহজাদপুর গিয়ে প্রাণ গোপাল সাহা, গৌরকুন্ডু ও অন্যান্য হিন্দুদের দোকানের ও বাড়ির মালামাল প্রকাশ্যে দিবালোকে লুট করে নিলো। আমাদের গ্রামের মুসলমানরা ভাল ও অসাম্প্রদায়িক। আমাদের গ্রামের মুসলমানেরা আওয়ামী লীগ ও হিন্দুদের কোন প্রকার ক্ষতি হতে দিলনা। আমাদের গ্রামের একজন মানুষও পীচ কমিটিতে যোগ দেয় নাই এবং রাজাকার হয় নাই। গ্রামের মুসলমানগণ হিন্দুদের বাড়ি ঘর পাহাড়া দিয়ে রাখলেন। আমাদের গ্রামের মোঃ আব্দুল সরকার মোঃ আকবর আলী প্রাঃ, মোঃ হোসেন আলী ও অন্যান্যরা সবাইকে ডেকে বললেন হিন্দুদের কোন প্রকার ক্ষতি করা যাবে না। তাঁরা আমাদের প্রতিবেশী ও আমানত। ১০ এপ্রিল’৭১ ভারতের পশ্চিম বঙ্গে সভা করে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সাংবিধানিক ঘোষণাপত্র জারি করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠণ করা হলো।স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করা হলো। ১১ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে এক বেতার ভাষনে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমদ দেশ ও বিশ্ববাসীকে সরকার গঠনের কথা জানান ও সকলের সহযোগিতার আহবান জানান। ১৭ এপ্রিল’৭১ কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার (বর্তমানে জেলা) সীমান্তবর্তী ভবের পাড়ার বৈদ্যনাথ তলার আ¤্র কাননে ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ এম,এন,এ ও এম,পি এদের নিয়ে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে। শপথ গ্রহণের পূর্বেই ঘোষিত হয় নতুন রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্র, যা বাংলাদেশের “স্বাধীনতা সনদ” নামে অভিহিত। বৈদ্যনাথ তলার নামকরণ করা হয় মুজিব নগর। এইজন্য বাংলাদেশের প্রথম সরকারকে বলা হয় মুজিব নগর সরকার। বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগর। তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানীদের হাতে বন্দি হয়ে পাকিস্তানের কারাগারে থাকার কারণে জাতির পিতাকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি, জনাব তাজ উদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী ও ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী (অর্থ ও পরিকল্পনা), এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান (স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন) মন্ত্রী ও আরও ১ জন কে নিয়ে মোট ৬ সদস্যের মন্ত্রী পরিষদ গঠন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের রনাঙ্গনকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে প্রত্যেক সেক্টরে একজন করে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করা হলো।৬৪টি সাব সেক্টর করে সাব সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করা হলো। জাতির পিতার অনুপস্থিত কালীন সময়ের জন্য উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করা হয়। ১২ এপ্রিল’৭১ ৪টি জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত কর্ণেল (অব:) মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানি মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, কর্ণেল (অব:) আব্দুর রব, এম,এন,এ চীফ অব ষ্টাফ ও গ্রæপ কাপ্টেন এ,কে খন্দকার ডেপুটি চীফ অব ষ্টাফ নিযুক্ত হন। মনোনীত হওয়ার পর প্রধান সেনাপতি তাঁর পিস্তল থেকে আকাশ মুখে একটি গুলি করলেন এবং বললেন, “এই মুহুর্ত থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক ভাবে যুদ্ধ শুরু হলো। পাকি হানাদাররা রাজাকার আলবদর, আল শামস ও অন্যান্যদের সহযোগিতায় হিন্দু ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়ি ঘর পোড়ানো, লুটতরাজ, ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতন সহ জঘন্যতম মানবতা বিরোধী কাজ শুরু করলো। রাজাকারেরা গ্রাম থেকে জোর করে মুরগী, খাসি ও যুবতী মেয়েদেরকে ধরে এনে পাকি হানাদার ক্যাম্পে দিত। স্বাধীনতা বিরোধীরা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা দিত। হানাদারদের পথ চিনিয়ে নিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতো। যে কোন পুরুষকে ধরলে পাকি হানাদাররা বলতো “ কাপড়া তোল, চার কলেমা বাতাও, মালাউন কাহা হায়। মুক্তি ফৌজ কাহা হায়। পাকি হানাদার সৈন্যরা পুরুষদের কাপড় খুলে তাদের লিঙ্গ পরীক্ষা করতো। যদি “মুসলমানি” করানো থাকতো তাহলে হয়তো বাঁচা গেলেও বাঁচা যেত তা না হলে অনিবার্য মৃত্যু। “জামায়াত নেতা ব্যারিষ্টার কোরবান আলীর নির্দেশে স্বাধীনতা বিরোধীরা রাত ৩টায় পুঠিয়া গ্রামের অধিবাসী খুকনী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিতেন্দ্র চন্দকে ধরে নিয়ে বর্বরোচিত নির্যাতন করে বাড়ির সামান্য দূরে গুলি করে হত্যা করলো। পোরজনা রাজাকার ক্যাম্পের রাজাকারেরা বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পোরজনা গ্রামের মনীন্দ্রনাথ ঘোষকে গুলি করে নৃশংস ভাবে হত্যা করলো। চরকৈজুরী রাজাকার ক্যাম্প থেকে রাজাকারেরা এসে বেল তৈল গ্রামের অনিল ও সুনিল দুই সহোদর ভাইকে গুলি করে হত্যা করলো। রতনকান্দি হাটের দিনে হাট ভরা লোকের হাট থেকে ধরে নিয়ে কয়েকজন রাজাকার ভৈরব পাড়ার নারায়ন চন্দ্র সরকারকে চোখ বেধে নৃশংস ভাবে নির্যাতন করে দরগার চরে গুলি করে হত্যা করলো। পীচ কমিটি ও পাকি হানাদারদের নির্দেশে রাজাকাররা মাদলা গ্রামের কিছু হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করালো। শাহজাদপুর সাহা পাড়ার একজন হিন্দু যুবতীকে জোর করে একজন রাজাকার ধর্মান্তরিক করিয়ে বিবাহ করে। ২৫ এপ্রিল সকালে চড়িয়া গ্রামে গণহত্যা হয়। পাকি হানাদারেরা নির্বিচারে ১২৯ জনকে হত্যা করে। সিরাজগঞ্জ জেলায় লতিফ মির্জার নেতৃত্বে পলাশ ডাঙ্গা যুব শিবির নামক সবচেয়ে বড় মুক্তিযোদ্ধা দল গঠণ করা হলো। ভারত সরকার মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং প্রায় এক কোটি ভারতে আশ্রয় নেয়া লোকদের জন্য শরণার্থী শিবির স্থাপন করলো। কেহ কেহ ট্রেনিং নেয়ার জন্য ভারত গেলেন। আমাদের জাতীয় পরিষদ সদস্য সৈয়দ হোসেন মনসুর সাহেব মুক্তিযুদ্ধে পক্ষ নিলেন না। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও শুধু দেশ মাতৃকাকে ভালবেসে জাতির পিতার নির্দেশ পালন করতে ১৫ আগস্ট’৭১ আমরা ৭২ জন যুবক একযোগে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এ্যাডভোকেট আব্দুর রহমানের সাথে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেয়ার জন্য ভারত গেলাম। নৌকা পথে রতনকান্দি থেকে যাত্রা করে সাতবাড়িয়া সুজানগর, পদ্মা পার হয়ে কুষ্টিয়া, জলঙ্গী বর্ডার পার হয়ে নদীয়া, নদীয়া থেকে বাসে মালদহ থেকে আমাদের কামারপাড়া যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিয়ে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এ্যাডভোকেট আব্দুর রহমান সাহেব প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সাথে একত্রিত হওয়ার জন্য কলিকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। আমার বয়সের স্বল্পতার কারণে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কর্তৃপক্ষ আমাকে ভর্তি করতে চাইলেন না। আমার সাথি শাহজাদপুরের এরশাদ ও রাজ্জাক ভাইয়ের সহযোগিতায় কামার পাড়া যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালক বেড়া সাঁথিয়ার এম.এন.এ অধ্যাপক আবু সাঈদ স্যারকে অনুরোধ করে ভর্তি হলাম। আমার মুক্তিযুদ্ধে যাবার কারণে রাজাকারদের আলটিমেটামে জীবন বাঁচাতে আমার গোটা পরিবার বাড়ি ঘর সব ফেলে ভারতে যেতে বাধ্য হয়েছিল। কয়েক দিন কামারপাড়া যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আমার মার্চ পাস্ট করানো, জাতীয় সংগীত গাওয়া, অন্যান্য প্রশিক্ষণ হলো। আমাকে কামারপাড়া রিক্রুটিং ক্যাম্প থেকে কুড়মাইল এবং কুড়মাইল থেকে মালঞ্চ ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হলো। মালঞ্চ থেকে পতিরাম যুব ট্রেনিং ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হলো। পতিরাম থেকে ট্রাক যোগে আমাদেরকে শিলিগুড়ি জেলার পানি ঘাটা নামক ইন্ডিয়ান আর্মি ট্রেনিং সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হলো। গাছে ঘেরা জঙ্গলের মধ্যে এই ট্রেনিং সেন্টার। তাবুর মধ্যে থাকা, ঝরনার জলে ¯œান করা, লাইন ধরে খাবার নিয়ে খাওয়া। ট্রেনিং ক্যাম্পের চার দিকে বন। বনের মধ্যে আর বন মানুষের বসবাস। ওরা গুরখা সম্প্রদায়ের মানুষ। ২১ দিন এই ট্রেনিং সেন্টারে ট্রেনিং হলো। এই ক্যাম্পে থ্রিনট থ্রি রাইফেল, গ্রেডেট, এল,এম,জি এস,এল,আর ষ্টেনগান, মর্টার ও অন্যান্য আগ্নেয় অস্ত্রের প্রশিক্ষণ হলো। র্ঝনার জল আসা শ্রোতের উত্তর পার্শ্বের মাঠে চানমারী হলো। মর্টার শেল চানমারী হলো ট্রেনিং ক্যাম্পের পূর্ব দিক দিয়ে প্রবাহিত খালের পশ্চিম পার্শ্বের অবস্থান থেকে। ফাষ্ট এইড. ক্রোলিং, রেকি অন্যান্য সকল বিষয়ে জ্ঞান দিলেন। ভারতীয় হিন্দু বিহারী ও শিখ সেনা আমাদেরকে ট্রেনিং দেওয়ালেন। প্রশিক্ষক শিখ সেনা ডি.এস ভিলন জানালেন আমার এফ.এফ নং-৪৭৪২। প্রশিক্ষণ শেষে আমাদেরকে নিয়ে আসা হলো ৭নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার পশ্চিম দিনাজপুরের তরঙ্গপুরে। তখন ৭ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন লে. কর্ণেল কাজী নুরুজ্জামান এবং আমাদের সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী। রাস্তা ঘাট চেনা একই এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে আমাদের ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে একটি গেরিলা গ্রæপ করা হলো। গ্রæপ কমান্ডার নিযুক্ত হলেন বেলকুচি উপজেলার তামাই গ্রামের এম.এ মান্নান। ডেপুটি কমান্ডার নিযুক্ত হলেন জামিরতা গ্রামের রবীন্দ্র নাথ বাগচী। আমাদের নামে অস্ত্র ইস্যু করা হলো। গোলা বারুদ, মাইন ও এক্সপ্লোসিভ সহ সব দেয়া হলো। তরঙ্গপুর বাজার থেকে একটি শ্রী শ্রী চন্ডি গ্রন্থ, ১টি বাংলাদেশের জাতীয় পাতাকা ও ১টি ৪ ব্যান্ডের রেডিও কিনলাম। আমাদের কার্য এলাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হলো সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানা ও আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা। আমরা তরঙ্গপুর থেকে অস্ত্র, গোলা বারুদ ও রেশনিং এ্যালাউন্স ও পকেট মানি নিয়ে বাস যোগে এক রেল স্টেশনে এলাম। সেখান থেকে ট্রেন পথে শিলিগুড়ি ও আসামের ধুপরি হয়ে গৌহাটি এলাম। গৌহাটি সেখান থেকে বাসে মানিকারচর। রাতে মানিকার চর বোডিং এ থাকলাম। পরের দিন সকালে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল রংপুর জেলার রৌমারী মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্পে এলাম। সারা দিন ¯œান, খাওয়া, দাওয়া করে ওখানে থাকলাম। সন্ধ্যায় সিরাজগঞ্জের এম.এন.এ মোতাহার হোসেন তালুকদার ও শাহজাদপুর কলেজের অধ্যাপক সরফুদ্দিন আউয়াল আমাদেরকে হানাদার মুক্ত এলাকা সিরাজগঞ্জের চর সংলগ্ন টাঙ্গাইলের সিংগুলির চড়ে পৌছানোর জন্য একটি বড় ছইওয়ালা নৌকা রিজার্ভ করে দিলেন। আমরা রাতে নৌকার ডওরার মধ্যে পজিশন অবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ বাহাদুরাবাদ ঘাটের সম্মুখ দিয়ে কাজিপুর হয়ে টাঙ্গাইলের সিংগুলির চড়ে পৌছালাম। পরের রাতে যমুনা পার হয়ে বেলকুচি কামার খন্দের এম.এন.এ জনাব মোঃ আব্দুল মোমিন তালুকদারের বাড়ি এলাম। এম,এন,এ স্যারের ভাই জনাব মোঃ আব্দুর রশিদ তালুকদার আমাদের থাকা খাওযার ব্যবস্থা করে দিলেন। আমরা বেলকুচি থানার বিভিন্ন গ্রামে থাকতে থাকলাম। আজ এ শেল্টার কাল সে শেল্টারে থাকতে থাকলাম। রাতেআমরা শেল্টার পরিবর্তন করতাম। প্রতি রাতে কমান্ডার স্যার আমাদেরকে পাশ ওয়ার্ড দিতেন। স্থানীয় ভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে কিছু যুবককে আমাদের গ্রæপে নিলাম। দিনের বেলা স্থানীয় আওয়ামী লীগদের সহযোগিতা নিয়ে বিভিন্ন থানা ও রাজাকার ক্যাম্প রেকি করতাম। প্রথম দিকে পাকি হানাদারদের আতঙ্কিত করার জন্য সম্মুখ যুদ্ধ নয় হিট এন্ড রান পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গেরিলা আক্রমণ করতাম। হানাদারদের আতংকিত ও পর্যুদস্ত করা ছিল আমাদের লক্ষ্য। জয় বাংলা, ছিল আমাদের রনাঙ্গনের ধ্বণী। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলতে বলতে হানাদারদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তাম। জয় বাংলা, বাংলার জয় গানটি ছিল আমাদের প্রিয় গান। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রচারিত “বজ্রকণ্ঠ অনুষ্ঠানটি আমাদের উজ্জীবিত করেছে। আমরা নিয়মিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সুনতাম। দেশের অবস্থা বুঝে পরে সম্মুখ যুদ্ধ শুরু করলাম। রাজাকারদের বাড়িতে বাড়ির লোকদের স্বাধীনতার পক্ষে আনার জন্য বুঝাতাম। আমাদের আশেপাশের গ্রামেই অবস্থান করতো জনাব মোঃ আমির হোসেন ভুলুর মুক্তিযোদ্ধা গ্রæপ। তাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল। আমরা যৌথ ভাবে আমার ও অন্যান্যদের রেকিতে একযোগে বেলকুচি থানা এবং মুসলিমলীগ নেতা মতিন সাহেবের বাড়ি আক্রমণ করে বিজয়ী হয়ে ছিলাম। থানার অন্যান্য পুলিশ ও রাজাকাররা যমুনা নদীতে থাকা লঞ্চ নিয়ে পালিয়েছিল। বেলকুচি থানা আক্রমণ যুদ্ধে ৩ জন পুলিশ ও ২ জন রাজাকার মারা গিয়াছিল। ২ জন রাজাকারকে ধরে এনে ছিলাম, মতিন সাহেব পালিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের গ্রæপের ঝাঐলের মাহমুদা কোলা গ্রামের মোঃ আব্দুল হামিদের রেকিতে কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ষ্টেশন সংলগ্ন ব্রীজ পাহাড়ারত রাজাকার ক্যাম্প এ্যাম্বুস করেছিলাম। ট্রেন লাইনে ক্রোলিং করে মাইন বসিয়ে আসলাম। পাকি হানাদার মিলেশিয়া ও রাজাকারদের টহলের সময় ওদের নজরে মাইন পড়লো। ওরা টর্চলাইট মেরে মেরে উর্দ্ধতে বকাবকি করতে থাকলো এমন সময় ট্রেন ভর্তি মিলিটারী এসে পড়ায় যুদ্ধ করা সম্ভব হলো না। কমান্ডার স্যারের কমান্ডে তামাই সেল্টারে ফিরে আসি। পরের দিন হানাদারেরা এসে কালিয়া হরিপুর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছিল। কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ব্রীজ সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্প অ্যাম্বুসের পর গ্রæপের সদস্য সংখ্যা বেশী হওয়াতে কমান্ডার স্যার আমাদের গ্রæপকে দুইটি ভাগ করে অবস্থান করার নির্দেশ দিলেন। ডেপুটি কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগ্চীর কমান্ডাধীনে একটি গ্রæপ করে দেয়া হলো। আমি পড়লাম রবীন্দ্র নাথ বাগ্চীর গ্রæপে। কমান্ডারের অনুমতি নিয়ে আমরা চলে এলাম কল্যানপুর গ্রামে। সারারাত পায়ে হেটে কল্যাণপুরে এলাম। কল্যাণপুরে সকালে প্রকাশ্যে পিটি প্যারেড করলাম। অস্ত্রে ফুলতরী মারলাম। দুই জন পাকিস্তানী দালাল বেলকুচি থানায় সংবাদ দিয়ে আমাদের আক্রমণ করার জন্য পাকিস্তানী সৈন্য ও রাজাকারদের নিয়ে এলো। বওড়া গ্রাম হয়ে পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের দোসররা যখন আসতে ছিল আমরা তখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিলাম। আমরা কল্যানপুর গ্রামের রাস্তার দক্ষিণ পার্শ্বে বাঁশের ঝাড়ে ব্যাংকারের মত জায়গায় পজিশন নিলাম। পাকি হানাদার ও তাদের দোসররা রাস্তা দিয়ে আমাদের পজিশনের কাছে আসতেই আমাদের কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগ্চীর কমান্ডে ফায়ার শুরু করলাম। পাকি হানাদারেরা এক লাফে রাস্তার উত্তর পার্শ্বে পজিশন নিয়ে ফায়ার শুরু করলো। এক ঘন্টার মত যুদ্ধ হলো। পাকি হানাদারেরা ফায়ার করতে করতে পিছু হটলো। এই যুদ্ধে ৩ জন পাকি মিলেশিয়া ও ১ জন রাজাকার মারা গিয়েছিল। এই যুদ্ধে আমরা বিজয়ী হলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য পাকি হানাদার সরকার পুরষ্কার ঘোষণা করলো। দেশের গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ জনগণ ছিল আওয়ামী লীগের পক্ষে। আমরা একেক দিন একেক বাড়ি থাকতাম। দিনের বেলা তারা আমাদের গোপন করে রেখে খাওযা দাওযার ব্যবস্থা করতেন। রাতে আমরা পর্যায়ক্রমে দু’ঘন্টা করে করে আমাদের অবস্থান ডিউটি দিতাম। স্বাধীনতাকামী জন সাধারণ আমাদের পাকি হানাদারদের অবস্থান, রেকিতে সহযোগিতা, তথ্য সংগ্রহ সহ বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করতেন। তখন ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান ছিলেন জেনারেল মানেকস।আমরা কয়েক দিন দৌলতপুর টেংগাশিয়া. খুকনি, বাজিয়ারপাড়া, দরগারচর থেকে ২৩ নভেম্বর ৭১ সৈয়দপুরের কালাচক্রবর্তীর বাড়ীতে সেল্টার নিলাম। ২৫ নভেম্বর ৭১ টাংগাইল যুদ্ধে পরজিত হয়ে পাকি হানাদারেরা ২ জন রাজাকারকে পথ চেনানোর জন্য সাথে নিয়ে পালাচ্ছিল। ওরা যমুনা পার হয়ে মালিপাড়া এলো। মালিপাড়া থেকে পায়ে হেটে চর কৈজুরি, কৈজুরি হয়ে ওয়াবদা বাধ দিয়ে বেড়ানদী পাড় হয়ে ঢাকায় যাবে। আমাদের গ্রæপে ঐ দিন অবস্থান ছিলো সৈয়দপুর গ্রামে। আমরা খবর পেলাম পাকি হানাদারদের আক্রমন করার জন্য পিছু নিলাম। চর কৈজুরী এসে খিদায় ওরা একজনের মুলা খেতের মুলা তুলে কিছুটা খেল। ওরা হয়তো জানতো না মুলা এমনি খাওয়া যাবে না। তারপর মার্চ করলো। আমাদের গ্রæপ নিরাপদ দূরত্বে থেকে ওদের ফলো করতে থাকলাম। পাকিস্তানী হানাদার ও রাজাকাররা ওয়াপদা বাধ দিয়ে বেড়ার দিকে পায়ে হেটে অগ্রসর হচ্ছিলো। আমরাও পিছু পিছু হাটছিলাম। ওরা খুব ক্রোধি এবং ভয়ংকর। ওরা ক্রোধ সামাল দিতে না পেরে ধীতপুর নামক স্থানে গিয়ে ওয়াপদার পূর্ব পাশে পজিশন নিয়ে আমাদের ওপর গুলি চালালো। আমরা ও সাথে সাথে ওয়াপদার পশ্চিম পাশে পজিশন নিয়ে পাল্টা গুলি চালালাম। আনুমানিক বিকাল ৫ টার দিকে সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো। প্রায় ২ ঘন্টা ব্যাপি যুদ্ধ হলো। এর মধ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। ওরা গোলাগুলি বন্ধ করলো। আমরা ও গুলি করা বন্ধ করলাম। শাহজাদপুর উপজেলা ও আশে পাশে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা দল গুলো আমাদের সাথে ধীতপুর যুদ্ধে এসে যোগ দিলো। সারারাত আমরা ওয়াপদা বাধের পশ্চিম পাশে পজিশন অবস্থায় থাকলাম। রাতে ধীতপুর সারগুদাম থেকে মাঝে মধ্যে দুই একটা করে রাইফেলের গুলি আসছিলো। আমরাও মাঝে মধ্যে ২/১টা গুলি ছুড়ছিলাম। সকালে পজিশন অবস্থায় আমাদের কমান্ডার রবীন্দ্রনাথ বাগচী, বেড়ার কমান্ডার মোঃ আমির হোসেন ও আরো কয়েকজন ক্রোলিং করে ধীতপুর সার গুদামে গেলেন। গিয়ে দেখলেন দুইজন রাজাকার আছে। তাদেরকে কমান্ড করে সারেন্ডার করালেন। রাজাকার দু’জনের নাম ছিল লতিফ ও কালাম। রাজাকারদের কাছ থেকে জানা গেল তাদেরকে কভারিং ফায়ার করার নির্দেশ দিয়ে পাকি হানাদাররা পজিশন থেকে ক্রোলিং করে নিরাপদ দূরত্বে এসে পায়ে হেটে রাতেই ভেড়াকোলার ঐ দিকে অগ্রসর হয়েছে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল পাকি হানাদারেরা ভেড়াকোলা গিয়ে জেলেদের ধরে নিয়ে বেড়ার খেয়া ঘাট পার হয়ে নদীর ওপারে গিয়ে নগর বাড়ী হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। এই যুদ্ধে বেড়ার আমীর হোসেনের গ্রæপের বৃ-শালিকা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবদুল খালেক শহীদ হয়েছেন। আর দুই জন পথচারী ওয়াপদা বাধের উপর মারা গেছেন। ৯ ডিসেম্বর,৭১ আমি আমার রনাঙ্গনের সাথীদের নিয়ে বিজয়ীর বেশে আমার গ্রামের স্কুলে গেলাম। আমার স্কুলের সাথীরা আমাকে দেখার জন্য এলো বন্ধু-বান্ধব ও সাথীদের নিয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবু দেবেন্দ্রনাথ সান্যাল এর উপস্থিতিতে জাতীয় পতাকা উড়ালাম এবং জাতীয় সঙ্গীত গাইলাম। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৩ তারিখ বেলা ৪টায় ডা: মালিক পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর হিসেবে শপথ গ্রহণ করে। পাকি হানাদাররা এদেশীয় স্বাধীনতা বিরোধীদের সহযোগিতায় ৩০ লক্ষ লোক হত্যা করেছে এবং দুই লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রম হানি করেছে। স্বাধীনতা বিরোধীদের সহযোগিতা না পেলে পাকিহানাদারেরা এত অল্প এত লোক হত্যা, নারী নির্যাতন ও অন্যান্য ধ্বংস যজ্ঞ চালাতে পারতো না। ২৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের সমস্যা, ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী প্রায় এক কোটি বাংলাদেশী শরনার্থীর সমস্যা, করাচীর মিয়াওয়ালি ইয়াহিয়া কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুর প্রহসন মূলক বিচার ও অন্যান্য গুরুত্ব পূর্ণ আলোচনার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী মস্কো সফর করেন এবং ২০ বছর মেয়াদী ভারত সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি করেন। ভারতীয় মিত্র বাহিনী “অপারেশন জ্যাকপট” নামক আক্রমনে বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করে। ৪ মাস প্রহসন মূলক বিচার কার্য চলার পর পাকিস্তানের সামরিক আদালত ৩ ডিসেম্বর’৭১ বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর মৃত্যু দন্ডের আদেশ দেয়। পাকি বিমান বাহিনী ভারতের বিমান ঘাটিতে বোমা হামলা চালায়। পাকিস্তান যাতে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদন্ড কার্যকরী করতে না পারে সে জন্য ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের পরিকল্পনা করে। পাকিস্তানের সামরিক আদালতে এই রায় ঘোষণার দিনই ভুটান বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেয়। ২১নভেম্ববর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনী নিয়ে যৌথ বাহিনী গঠণ করা হয়। জাতির জনকের মৃত্যুদন্ডের আদেশ কার্যকরী করার পূর্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন করার অঙ্গীকার নিয়ে ভারতীয় সেনা বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে:জে: জগজিৎ সিং আরোরা মুক্তি বাহিনীকে সংগে নিয়ে দূর্বার বেগে পাক হানাদার বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়েন। ৬ ডিসেম্বর’৭১ সোমবার বেলা ১০টায় ভারতীয় লোক ও রাজ্য সভা উভয় সংসদের সম্মতিতে তুমুল করতালির মধ্যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের কথা ঘোষণা করেন। ৮ই ডিসেম্বর যৌথ বাহিনী বিমান আক্রমন শুরু করে। পরাজয় নিশ্চিত জেনে শাহজাদপুর বাঘাবাড়ী ও অন্যান্য জায়গায় রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র সহ আত্ম সমর্পন করতে থাকলো। হিন্দুদের বাড়ী ও দোকান থেকে লুট করা জিনিসগুলো তাঁদের কে ফেরৎ দিয়ে লুটেরাগণ ক্ষমা চাইলো। শাহজাদপুর থানা পীচ কমিটির সভাপতি মাওঃ ছাইফুদ্দিন এহিয়া খান মজলিস, সহঃ সভাপতি ব্যারিষ্টার কোরবান আলী সহ পাকিস্তানী সৈন্যদের পক্ষ অবলম্বন কারীরা পালাতে লাগলো। কেহ কেহ পশ্চিম পাকিস্তানে, অন্যান্য দেশে ও দেশের অভ্যন্তরে অন্যান্য জায়গায় পালালো। ভারতীয় বিমান ও বেতার থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের আত্ম সমর্পনের আহŸান জানানো হলো। বিমান থেকে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের আত্ম সমর্পনের আহŸান জানিয়ে হাতিয়ার ডান দো ---- । প্যাম্পলেট ছাড়লো। মহান মুক্তিযুদ্ধের চুড়ান্ত বিজয়ের মাত্র ২ দিন পূর্বে ১৪ ডিসেম্বর’৭১ আলবদর, আল শামস বাহিনীর সহযোগীতায় জাতিকে মেধাশুন্য করতে পাকিস্তানি হানাদারেরা বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবিদের বাড়ী থেকে ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর ধরে আনা ৩০ এর অধিক বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবিকে ধরে নিয়ে রায়ের বাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে নৃশংস ভাবে হত্যা করলো। ১৪ই ডিসেম্বর শাহজাদপুর হানাদার মুক্ত হলো। সারা দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে গণ কবর ও বধ্যভ‚মি আছে। ১৬ ডিসেম্বর’৭১ ভারতীয় সেনা প্রধান ফিল্ড মার্শাল মানেকস এর নির্দেশে চীফ অব ষ্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব পাক বাহিনীর আত্ম সমর্পনের দলিল নিয়ে দুপুরের পর ঢাকায় আসেন। বাংলাদেশ সেনা বাহিনী প্রধান কর্নেল (অবঃ) এম.এ.জি ওসমানী ও চীপ অব ষ্টাফ মেজর জেনারেল আব্দুর রব তখন সিলেটের রনাঙ্গনে ছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্ম সমর্পন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান গ্রæপ ক্যাপ্টেন এ.কে খন্দকার কে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চীপ অব ষ্টাফ বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান গ্রæপ ক্যাপ্টেন এ.কে খন্দকার, ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার লেফট্যানেন্ট কর্নেল এ.টি.এম. হায়দার (তখন মেজর ছিলেন), ও মুক্তিযুদ্ধের বীর নায়ক কাদের সিদ্দিকী সহ অন্যান্যদের উপস্থিতিতে নৃশংস বর্বরতার সমাপ্তির প্রতীকী হিসাবে ১০০ জন পাকিস্তানি আর্মি অফিসার মাটিতে অস্ত্র রেখে মাথা নিচু করে সোহরোয়ার্দী উদ্যানে দাড়িঁয়ে ছিল। পাক বাহিনী প্রধান আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি ও কিছু সময় মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থেকে রিভালবারটি পূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয় বাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং আরোরার কাছে দিয়ে আত্ম সমর্পন দলিলে স্বাক্ষর করেন। তারপর বিজয়ী বাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে যৌথ বাহিনী প্রধান জগজিৎ সিং অরোরা স্বাক্ষর করেন। সারাদেশে অবস্থানরত ৯৩ হাজারের অধিক পাকিস্তানি হানাদারদের পক্ষে আত্ম সমর্পন করেছিল। ১৭ই ডিসেম্বর ভারতীয় বিমান বিজয় উল্লাসে স্বাধীন বাংলাদেশ সারা দেশ ঘুরে দেখে। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জন হয়। বিজয় অর্জনের পরও কিছুদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে খন্ড খন্ড যুদ্ধ হয়। বিজয় অর্জনের ৮ দিন পর মুজিবনগর সরকার স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে। ধীতপুর যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পর আমাদের গ্রæপ জামিরতা হাইস্কুলে থাকার জন্য ক্যাম্প করি। শাহজাদপুর থানা ও প্রশাসন পরিচালনা করেন মুক্তিযোদ্ধা গন। মোঃ আব্দুল বাকী মির্জা শাহজাদপুর থানার মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন। মোঃ খালেকুজ্জামান খান এর গ্রæপ সহ শাহজাদপুর থানার বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা গ্রæপ দিলরুবা সিনেমা হল, শাহজাদপুর কলেজ, ডাক বাংলো ও শাহজাদপুর হাইস্কুল সহ বিভিন্ন স্থানে থাকার জন্য ক্যাম্প করে। ৮ই জানুয়ারী’৭২ পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন ও নয়াদিল্লিতে সংবর্ধনা নিয়ে ১০ই জানুয়ারী’৭২ বাংলাদেশে আসেন। ১১ই জানুয়ারী অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি করেন, ঐ আদেশের মাধ্যমে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। ১২ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু প্রধান বিচারপতির কাছে প্রথমে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং পদত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১২ই জানুয়ারী’৭২ শুরু হয় জাতির পিতার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের শাসনামাল। যুদ্ধে বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পরিচালনা করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু সরকার ভারত থেকে ফিরে আসা শরনার্থীর মধ্যে চাল, গম ও অন্যান্য সাহায্য সরবরাহ করেন। ভারতীয় সৈন্যদেরকে এ দেশ থেকে চলে যেতে বলেন। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অস্ত্র জমা দিতে বলেন। জাতির পিতার আদেশ পেয়ে আমাদের গ্রæপ ১৯৭২ সালের ২৪শে জানুয়ারী রবিবার সিরাজগঞ্জ ইব্রাহিম বিহারীর বাসায় অস্থায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা নেয়া ক্যাম্পে সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীর সম্মুখে লেঃ সাইফুল্লাহ স্যারের কাছে অস্ত্র জমা দিলাম। প্রত্যেককে অস্ত্র জমা দেয়ার রশিদ নিয়ে আমাদেরকে বাড়ীতে চলে আসতে বললেন। ১৪ই ফেব্রæয়ারী’৭২ সিরাজগঞ্জ মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হলো। আমি সিরাজগঞ্জ এস.ডি.ও অফিসে গেলাম। আমার অস্ত্র জমা রশিদ ফেরৎ নিয়ে আমাকে মহান মুক্তি বাহিনীর সেনা বাহিনী প্রধান মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেট নং-১২৯১৫৮ একটি সাদা কম্বল ও বকেয়া রেশন মানি ও পকেট মানি হিসাবে ২২০ টাকা দেয়া হলো। সরকারী উদ্যোগে মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ের পশ্চিম পাশের্^ মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের জন্য ন্যাশনাল মিলিশিয়া ক্যাম্প স্থাপন করা হলো। এস.ডি.ও অফিস থেকে ইচ্ছুক সব মুক্তিযোদ্ধাকে মিলিশিয়াতে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিলেন। আমি ন্যাশনাল মিলিশিয়ায় ভর্তি হলাম না। আমি বাড়ীতে চলে এলাম। আমি মহান মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব শেষ করে রতনকান্দি আদর্শ নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক দেবেন্দ্র নাথ সান্যালের কাছ থেকে ৮ম শ্রেণির অটোপাশের টি.সি নিয়ে শাহজাদপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেনীতে ভর্তি হয়ে লেখা-পড়া শুরু করলাম। ১২ই মার্চ ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চেলে গেলেন।

আরও ছবি

ভিডিও