অন্যান্য তথ্য
মুক্তিবার্তা নম্বর | লাল মুক্তিবার্তা ০১০৮০১০০৭৭ |
---|---|
ভারতীয় তালিকা নম্বর | -- |
মুক্তিবার্তা নম্বর | লাল মুক্তিবার্তা ০১০৮০১০০৭৭ |
বাংলাদেশ গেজেট নম্বর | বেসামরিক গেজেট ২৫০ |
মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান কি না? | yes |
মুক্তিবার্তা নম্বর | লাল মুক্তিবার্তা ০১০৮০১০০৭৭ |
---|---|
ভারতীয় তালিকা নম্বর | -- |
মুক্তিবার্তা নম্বর | লাল মুক্তিবার্তা ০১০৮০১০০৭৭ |
বাংলাদেশ গেজেট নম্বর | বেসামরিক গেজেট ২৫০ |
মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান কি না? | yes |
নাম | বয়স | শিক্ষাগত যোগ্যতা |
---|---|---|
আব্দুল্যাহ আল মামুন | ০২-০২-১৯৮২ | |
আইরিন আক্তার সাথী | ০১-১১-১৯৮৫ |
"সবেমাত্র ফরিদপুর ইয়াছিন কলেজে ভর্তি হয়েছি। ১৯৬৯ সালে অসহযোগ আন্দোলনের ফলে আইয়ুব খানের পতন হয়েছে। ইয়াহিয়া সরকার ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষনা দেন। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ অংশ নেয়। বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে প্রচারণার জন্য বরিশাল থেকে পথসভা করতে করতে ফরিদপুর হয়ে ঢাকা রওনা দেন। বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখবো বলে ফরিদপুর পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে আমার আব্বা আঃ জব্বার মোল্যা ও আমি উপস্থিত ছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে দেখে আমার অনুপ্রেরণা আরও বেড়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষন শুনে মনে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর কন্ঠে জাদু আছে।
আমি ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে নগরকান্দা থানার কিছু অংশ ও বোয়ালমারী থানার কিছু অংশ নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করি। গ্রামের স্কুলের কিছু ছেলে নিয়ে ৮/১০ জনের একটি দল তৈরি করে এ অঞ্চলের প্রতিটি হাটে টিনের চোং দিয়ে ৬-দফা ও ১১-দফার আলোকে প্রচার করি ও পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য তুলে ধরি। নৌকা মার্কায় ভোট দেয়ার জন্য অনুরোধ করি ও জয়বাংলা শ্লোগান সহ অন্যান্য শ্লোগান দেই। প্রথমদিকে তেমন কোন সাড়া না দিলেও পরবর্তীতে আমাদের সাথে অন্যান্যরাও সাড়া দেয়। এতে বুঝতে পারলাম মানুষ বঙ্গবন্ধুর কথা শুনতে ও দেখতে চায় (তখন দেখার কোন মাধ্যম ছিল না)। সন্ধ্যায় গ্রামে এই ছেলেগুলোকে নিয়ে নৌকা মার্কায় ভোট চাই। গ্রামের সাধারণ মানুষ আমাদের সাথে যোগ দেয়। কিন্তু মৌলভীর দল বাড়িতে এসে বাবা ও বড় ভাই এর কাছে নালিশ দেয়, বলে এদেশকে কী আপনারা হিন্দুস্থান করতে চান। আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত, তাই কোন কর্ণপাত করেন না। বড়ভাই রাজেন্দ্র কলেজে জাফর ভাই এর সাথে ছাত্রলীগ করেন। প্রতিদিন আমার পরিবার আমাকে আর্থিকভাবে এ কাজে সাহায্য করতো ও উৎসাহ দিতো। মৌলভী সাহেবরা বলাবলি করতো এরা নাস্তিক, পাকিস্তানের বিপক্ষে কাজ করে।
নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮টি আসন লাভ করে ও জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে। ইয়াহিয়া খান ১০ জানুয়ারী ঘোষনা করেন ৩ মার্চ ঢাকায় প্রথম অধিবেশন বসবে। কিন্তু ১ মার্চ এক ঘোষনায় অধিবেশন স্থগিত ঘোষনা করা হয়। আমাদের ফরিদপুরের তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডভোকেট শামসুদ্দিন মোল্যা, কে.এম ওবায়দুর রহমান, ইমামউদ্দিন আহমেদ, এডভোকেট মোশারফ হোসেন, এডভোকেট হায়দার হোসেন, এডভোকেট আঃ ছালাম, গৌর চন্দ্র বালা, অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন, নূরনবী ভাই এবং ছাত্রনেতা শাহ মোঃ আবু জাফর, সৈয়দ কবিরুল আলম, সালাউদ্দিন আহম্মেদ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের পরামর্শে ২ ও ৩ মার্চ হরতাল পালনসহ ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে মহাসমাবেশের বঙ্গবন্ধুর ভাষনের অপেক্ষায় থাকি।
পূর্ব ঘোষনা অনুযায়ী ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক এক জ্বালাময়ী ভাষন দেন। তিনি উদাত্ত কন্ঠে আহবান জানান, “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দিব। দেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশা-ল্লাহ।” তিনি আরও বলেন, “ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।” বঙ্গবন্ধুর ভাষনে সকলে অনুপ্রণিত হয়ে অসহযোগ আন্দোলনের প্রতিদিনই মিটিং মিছিল সহ বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।
২৫শে মার্চ গভীর রাতে খবর পেলাম পাকবাহিনী রাজারবাগ, পিলখানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন স্থানে বর্বরোচিত হামলা করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারের পূর্বেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়েছেন। যা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে চট্টগ্রামের কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ নেতা আঃ হান্নান ঘোষনা দেন। এরই ধারাবাহিকতায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্র নেতাদের নির্দেশে ফরিদপুর স্টেডিয়াম ও রাজেন্দ্র কলেজে ট্রেনিং ক্যাম্প করা হয়। ফরিদপুর স্টেডিয়ামে আবু সাঈদ ইউসুফ, ছত্তার মন্ডলসহ আরও কয়েকজন ট্রেনিং দেয়। অপরদিকে রাজেন্দ্র কলেজের মাঠে ইউ.ও.টি.সি রাইফেল দিয়ে মোঃ মোকাররম হোসেন, মোঃ আবুল ফয়েজ সহ কয়েকজন ট্রেনিং দিতে থাকেন। আমি স্টেডিয়ামে ট্রেনিং গ্রহন করি। অনেকেই ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয়ে গোয়ালন্দ ঘাট, সিএন্ডবি ঘাট প্রতিরোধ ব্যবস্থায় অংশ নেন। আমরা গ্রাম থেকে অবসরপ্রাপ্ত আর্মি, পুলিশ, চৌকিদারদেরকে এনে দেই। তাদেরকেও প্রতিরক্ষার কাজে লাগানো হয়।
২১শে এপ্রিল ১৯৭১ পাক আর্মি ফরিদপুর আক্রমন করে, গোয়ালন্দ হয়ে ফরিদপুর এসে সার্কিট হাউসে অবস্থান নেয়। আমি গ্রামের বাড়ি নগরকান্দার বিভাগদী (বর্তমান সালথা থানা) চলে যাই। খাড়দিয়ার আবুল কালাম আজাদ (বাচ্চু রাজাকার) ১০-১২ জন সহযোগী নিয়ে আমাদের পাশে হিন্দু অধ্যুষিত নতুবদয়িা গ্রামে ব্যাপক লুটপাট ও অগ্নি-সংযোগ করে । পারিবারিক ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো ভারতে যাওয়ার জন্য। একই পাড়ার আবু সাইদ খান রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র । তার সাথে পরামর্শ করি। বোয়ালমারীর জাফর ভাই এর সাথে আমরা ভারতে যাব। তার পরেরদিন বোয়ালমারী গিয়ে আমরা জানতে পারি জাফর ভাই ভারত চলে গেছেন। বিকেল হয়ে যাওয়ায় সাঈদ ভাই বাইখির গ্রামে তার আত্মীয়ের বাড়িতে গেলেন, আমি বাড়ি চলে এলাম। পরেরদিন বাইখির গিয়ে শুনতে পাই সাঈদ ভাই বাড়ির লোকদের না বলে চলে গেছেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি বাড়ি এসে গ্রামের ৬/৭ জন ছেলে নিয়ে বাড়ির ভিতরেই লাঠিসোঠা দিয়ে নিজেরাই ট্রেনিং দিতে শুরু করি। সিদ্ধান্ত হলো প্রথমে আমি, ওহাব ও জাফর ভারত যাব। পরবর্তীতে আমার বড় ভাই আবু বকর রাজেন্দ্র কলেজের ডিগ্রী ছাত্র (সবাই তাকে বাকা ভাই বলে সম্বোধন করতো) কয়েকজনকে নিয়ে ভারত যাবে। নৌকাই তখন ছিল একমাত্র যানবাহন।
পরের দিন আমার বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা মাঠিআদা নদীর পাড়ে অপেক্ষায় ছিলাম। তখন জানতে পারি নৌকায় ভাংগার রাজেস্বর রায়ের পরিবার ভারতে যাচ্ছে, আমরা তাঁদের নৌকায় উঠে পরলাম। আরও ৬/৭টি নৌকা আমাদের নৌবহরে যুক্ত হলো। বোয়ালমারী থানার সাতৈর ইউনিয়নের ঘোড়াখালী রেলওয়ে ব্রীজ। ৬/৭ জন রাজাকার যারা এই ব্রীজটি পাহারা দিচ্ছিল তারা আমাদের নৌকাগুলিকে আটকায় এবং আমাদের নৌকা থেকে নামিয়ে গাছের সাথে বেঁধে ফেলে। আমরা ভয় পেয়ে যাই, কারণ যেকোন সময় ট্রেনে পাক আর্মি চলে আসলে আমাদের মেরে ফেলবে। ভাংগার ভারতগামী পরিবারগুলোকে বললাম, কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে তাদের কাছ থেকে মুক্ত হওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য। প্রায় এক ঘন্টা পার হয়ে গেল। একজন রাজাকার আমার সামনে এসে বলে, তোমার বাড়িতো বিভাগদী। আমার লোকটিকে দেখে চেনা চেনা মনে হলো। কারণ আমি কাদেরদি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে যে বাড়িতে লজিং থাকতাম, লোকটি ঐ বাড়ির রাখাল ছিল। তাকে বললাম যেভাবে হোক আমাদের বাঁচান। তুমি কোথায় যাবে? আমি বললাম, মধুমতি নদীর ঐ পাড়ে আমার মামা বাড়িতে যাব। তোমাদের নৌকা কোনটি? আমি দেখিয়ে দিলে আমাদের নৌকাটি ছেড়ে দিল। আমার সহযাত্রী পরিবারটি আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো।
আমাদের নৌকাটি যশোর আড়পাড়া যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আড়পাড়ায় অপেক্ষারত অনেক শরণার্থীদের সাথে আমরাও আড়পাড়া স্কুলে থেকে গেলাম। রাতেই স্কুলে কয়েকজন লোক এসে প্রস্তাব দিলো, কিছু টাকা-পয়সা দিলে আমাদের রাস্তা পার করে দিবে। আমরা ভোর রাতেই রওনা হলাম। রোড পার হয়ে ঐ’পাড় যেতেই দুই দিক থেকে ফায়ার শুরু হলো। যার কাছে যা ছিল ফেলে দিয়ে আমরা দৌড়ানো শুরু করলাম। কিন্তু পথ এতো কর্দমাক্ত ছিল যে দৌড়ানো যাচ্ছিল না। হঠাৎ একটি গাছের শিকড়ে বেঁধে আমি পড়ে গেলাম। উঠে আবার দৌড় শুরু করতেই টের পেলাম আমার পায়ে কিছু হয়েছে, দেখি! পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলীর নখটা উঠে গেছে। ব্যথায় হাঁটতে কষ্ট হলেও গন্তব্যে পৌছাতে হবে। বড় একটি বিল এর পাড় দিয়ে ভারতের বাঘদা বর্ডারে পৌছলাম। বর্ডার পার হয়ে ঐ’পাড়ে যেয়ে মাঠের মধ্যে শুয়ে পড়লাম আর দাড়াতে পারছি না। আধা ঘন্টা পরে লাইনে দাড়িয়ে চিড়া ও গুড় নিলাম। চিড়া-গুড় খেয়ে সবাই বনগ্রামের দিকে রওনা হলাম।
বনগ্রাম ফরিদপুর ক্যাম্প নামে পরিচিত স্থানে পৌছাতে রাত ১১ টা বেজে গেল। একতলা বিল্ডিং কেউ নাই। আমাদের তিনজনের মধ্যে ওহাবের বয়স বেশি ছিল। সে পূর্বেও নতিবদিয়া গ্রামের হিন্দু পরিবারের সাথে ভারতে আসা-যাওয়া করেছে। ক্যাম্পের আশেপাশে পরিচিত কাউকে পেলাম না। আধা মাইল দুরে ইতি পূর্বে ভারতে যাওয়া নতিবদিয়া গ্রামের রখু বিস্বাসের বাড়িতে আমরা আশ্রয় নিলাম। তাঁরা ওহাবের পরিচিত, আমার বাবাকে চিনতেন। পরিবারটি রাতে আমাদেরকে বারান্দায় থাকতে দিল এবং ভাত-ডাল খেতে দিল। প্রায় একদিন না খেয়ে থাকার কারণে, সেই খাবারই আমাদের কাছে অমৃত মনে হচ্ছিল। আমার পা ফুলে যাওয়ায় পরদিন হাঁটতে পারলাম না। ঐখানেই থেকে গেলাম। আমরা যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম তার এক ভাই থাকে রানাঘাট, পেশায় চিকিৎসক। তার কাছে উনার ছেলেসহ আমাদেরকে পাঠিয়ে দিলেন।
যথারীতি ট্রেনে রানাঘাট পৌছলাম। স্টেশনের পাশেই ডাক্তার বাবুর বাড়ী। আমরা সে বাড়িতে উঠলাম। আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল নয়। ঘরের একপাশে চেম্বার করে রোগী দেখেন ও ওষুধ বিক্রী করেন। চারদিন ঐ বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিয়ে পা একটু ভাল হল। রানাঘাট থেকে কল্যাণী আসলাম। কল্যাণী শরণার্থী ক্যাম্পে খাদ্য বিভাগের ইন-চার্জ কানাইপুর এর আলী ভাই। তাঁর সাথে আলাপ করে জানতে পেলাম ট্রেনিং ছাড়া অস্ত্র পাওয়া যাবে না। যথারীতি কল্যাণী যুব ক্যাম্পে ভর্তি হলাম। অনেকেই বললো, তারা বেশ কিছু দিন আছে কিন্তু ট্রেনিং নিতে পারে নাই। তাদের কাছ থেকে জানতে পারি স্থানীয় এম.পির অনুমতিপত্র ছাড়া ট্রেনিং এর লোক নেয়া হয় না। আলী ভাইকে বিষয়টি জানালে তিনি লোক পাঠিয়ে কে.এম ওবায়দুর রহমান ভাইয়ের কাছ থেকে অনুমতিপত্র এনে দিলেন। কিন্তু রিক্রুটিং টিমের লোক আর আসে না। এভাবে প্রায় ১৫দিন কেটে গেল। দুইবেলা পি.টি করি আর কি? একটি রিক্রুটিং এজেন্ট এসে সকলকে লাইনে দাড়াতে বললো। আমাদের তিনজনের মধ্যে আমাকে শিক্ষাগত যোগ্যতায় সিলেক্ট করলো। কিন্তু জাফরকে ও ওহাবকে বাদ দেয়া হলো । কিন্তু আমরা তিনজন একসাথে ট্রেনিং নিতে আগ্রহ প্রকাশ করলাম। এক মাস কেটে গেল।
নতিবদিয়ার রবিন নামের ছেলেটি ব্যবসার কাজে সপ্তাহে ২বার বাংলাদেশ ও ভারত আসা-যাওয়া করে। তার কাছ থেকে আমাদের বাড়ীর খবরাখবর পাই। আমার বড় ভাই রবিনের মাধ্যমে খবর দিয়েছে অস্ত্রের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আমরা যদি ট্রেনিংএ না যেতে পারি তাহলে যেন বাড়ি ফিরে আসি। খবরটা পেয়ে আমরা তিনজন আবার বাড়ি ফিরে আসলাম। এক চেয়ারম্যানের মাধ্যমে ২টি রাইফেল যোগাড় করা হয়েছে। এছাড়া তৎকালীন কায়েদে আজম কলেজের (বর্তমান শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) প্রফেসর আবুল কালাম আজাদ একটি পিস্তল ও স্টেনগানসহ আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী সাঈদ ভাইয়ের বাড়িতে এসেছে। তিনি সাঈদ ভাইয়ের মামাতো ভগ্নিপতি আমাদের বাড়িতে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিছুদিন এভাবেই চলছিল। আমি ও বন্ধুবর কাজী সালাউদ্দিন ইয়াছিন কলেজের ছাত্র ছিলাম। আমার বাড়ির এলাকা অনেক নিরাপদ, তাই সালাউদ্দিন লোক পাঠিয়েছে, বিস্তারিত জানতে। সালাউদ্দিনকে ঠিকানা দিয়ে আসার জন্য বলা হলো। ইতিমধ্যে শাহ্ মোঃ আবু জাফর ভাই, মধুখালীর কাইয়ুম ভাই, সিংহপ্রতাপের আতিয়ার, বোয়ালমারীর সিদ্দিক ভাই সহ ৬/৭ জন নৌকায় আমাদের বাড়িতে আসে। জাফর ভাই বিস্তারিত আলাপ করার পর নগরকান্দার কিছু অংশের দায়িত্ব বাকা ভাইকে দেন আইন-শৃংখলা ও সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। কারণ ইতিমধ্যে কয়েকটি বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে।
আওয়ামী মনোভাবাপন্ন ও ছাত্রলীগ করে এমন পরিচিতদের ডাকার জন্য লিস্ট করা হলো এবং আমাদেরকে লিস্ট ধরে ডাকার জন্য দায়িত্ব দেয়া হলো। যথারীতি ৪/৫টি নৌকা নিয়ে লিস্ট অনুযায়ী ডাকা হলো। নির্ধারিত রাত্রে আমাদের বাড়িতে যারা উপস্থিত হলেন তারা হলেন, কাকিলাখোলার ওহিদ, রামকান্তপুরের মানিক মিয়া, কোন্দাদিয়ার মোকাদ্দেস, গট্টির মুকুল মিয়া, সালথার ইউনুস মিয়া, নগরকান্দার আজিজ মোল্যা, ভাংগার বড় আবু, সহিদ, তালমার শহিদ, বোয়ালমারীর টোকন, সোনাপুরের বদউিজ্জামান , বাঘারকান্দির মালেক, নকুলহাটির বাদশাহ প্রমুখ সহ প্রায় শতাধিক লোক জমা হলো। জাফর ভাই ও প্রফেসর আবুল কালাম আজাদ তাদের সাথে বিস্তারিত আলাপ করলেন ও পরামর্শ দিলেন, আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্প বাড়ি থেকে সরিয়ে নতুবদিয়া প্রাইমারী স্কুলে নিলেন এবং সেটা উদ্বোধন করলেন। ফরিদপুরের আবুল হোসেন ভাইকে ট্রেনিং দেয়ার জন্য দিলেন। এরপর মিরোজসহ আরও কয়েকজন ক্যাম্পে আসে। এছাড়া ভারত থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয়ে যে মুক্তিযোদ্ধাগণ এ এলাকায় আসেন, তাদেরকে বাড়িতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ট্রেনিং ক্যাম্পে নিয়ে তাঁদেরকে দিয়ে ট্রেনিং করানো হয়।
অক্টোবর মাসের দিকে খবর এলো, একটি ডিম্যুনেশন টিম আমাদের বাড়িতে আসবে, দুপুরে তাঁরা খাবেন। টিম প্রধান মোহাম্মদ আলী দেওয়ান, বাড়ী শরীয়তপুর। বাখুন্ডা ব্রীজ সম্পর্কে তাদেরকে বিস্তারিত ধারণা দেওয়া হলো। প্রায় ১৫০ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ দিয়ে বিস্ফোরক তৈরী করলেন। আমাদের লোকবল কম থাকায় সিদ্ধান্ত হলো, বিকালবেলা কমান্ডার হামিদ ভাইকে একাজে সাহায্য করার জন্য তাদেরকে বিনোকদিয়া পৌছে দেয়া হলো। এভাবেই চলতে থাকে। ইতিমধ্যে কমান্ডার কাজী সালাউদ্দিন, ডেপুটি কমান্ডার মেজবাহ্উদ্দিন নৌফেল, ডাক্তার রুনু ভাই সহ প্রায় ২০-২৫ জন এসে আমাদের বাড়িতে হাজির হন। থাকার সংকুলান না হওয়ায় ৬/৭ জনকে সাঈদ ভাই এর বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করা হলো। পরবর্তীতে তাদেরকে নতিবদিয়া গ্রামের পশ্চিমদিকে সূর্য্য মন্ডলের বাড়িতে দুইটি টিনের ঘরে ক্যাম্প করে দেয়া হলো। আবার আলফাডাঙ্গার কমান্ডার হিমায়েত উদ্দিন তালুকদার তার দলবল নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসলেন। তাদেরকে নতিবদিয়া ক্যাম্পে একসাথে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। আমরা নতিবদিয়া স্কুলের ট্রেনিং ক্যাম্প বন্ধ করে কাজী সালাউদ্দিন বাহিনীর সাথে একত্রিত হয়ে কাজ করার অংগীকার করা হলো।
এখন অস্ত্র-গোলাবারুদে, লোকবলে গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। দ্রত অপারেশন শুরু করা প্রয়োজন। সিদ্ধান্ত হলো কানাইপুর ব্রীজ অপারেশনের জন্য। আমি শুক্রবার রেকি করলাম; ৪ নভেম্বর কানাইপুর ব্রীজ আক্রমণ করা হলো। দুই দলে বিভক্ত হয়ে একদল পূর্ব পাশে কানাইপুর গোরস্থানের পাশ থেকে ও অন্যদল পশ্চিম থেকে ব্রীজ আক্রমণ করা হলো। রাজাকাররা বাংকারের মধ্য থেকে গুলি করতে থাকে। অন্যদিকে পাক আর্মি অনেক দুর থেকে ফায়ার করতে করতে আসতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে ব্যাক করে আমাদের উভয় দল নতিবদিয়া ঘাঁটিতে চলে যাই।
করিমপুর ব্রীজে গ্রেনেড চার্জ ঃ ৭ নভেম্বর রাত্রিতে দুই দিকে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে করিমপুর ব্রীজে আক্রমণ করা হয়। ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক বিধায় বেশি সংখ্যক রাজাকার দল দিনরাত্রি পাহারা দিত। কাজী সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে নওফেল, আবু বকর, খোকন, আলী, সিরাজ, খলিল, শাহাদৎ, ওহাব, আইয়ুব ও আমি সহ ১২/১৩ জনের দল। অন্য দলের নেতৃত্বে ছিল হেমায়েত উদ্দিন তালুকদার। বাদশাহ পাট্টাদার, শামসুদ্দিন, দেলোয়ার, রমেন, মমিন, চাঁন মিয়া, মিরাজ, জাফর, আবুবকর (বাকা ভাই), ইদ্রিস, সোহরাব, বাশার, ফরিদ সহ প্রায় ১৫ জনের দল করিমপুর ব্রীজ আক্রমণ করে। ব্রীজের উত্তর দিক থেকে খোকন গ্রেনেড চার্জ করলে দুইজন রাজাকার নিহত হয়। আমরা দুইটি রাইফেল হস্তগত করি । আক্রমণ শেষে আমরা নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরে আসি।
কামারখালী ঘাটে আক্রমণ ও ফেরি নিমজ্জন ঃ আমি ও ইদ্রিস কামারখালী ঘাটে রেকি করে এসে বিস্তারিত তথ্য ও ম্যাপ আমাদের বাড়িতে অবস্থানরত নৌ-কমান্ডো মোহাম্মদ আলী ও আবুল কাশেমকে রিপোর্ট করি। এই মুক্তিযোদ্ধা দল কৌশলে অপারেশন সম্পূর্ণ করে আমাদের বাড়িতে নিরাপদে ফিরে আসে।
৯ ডিসেম্বর ফরিদপুরের করিমপুরে যুদ্ধ ঃ কমান্ডার হিমায়েত ভাই এর সাথে নতুন করে ২জন ই.পি.আর ও ২জন পুলিশ বাহিনীর সদস্য এলএমজি, ল্যান্ডমাইন, হ্যান্ড গ্রেনেড, অনেক ভারী অস্ত্র-শস্ত্র সহ যোগ দেন। এতে আমাদের মনোবল আরও দ্বিগুন বেড়ে যায়। কাজী সালাউদ্দিনের জীবিত পাক আর্মি ধরা খুব ইচ্ছা। ইতিমধ্যে খবর আসে, করিমপুর ও ধোপাডাঙ্গা-চাঁদপুর রোডে করিমপুর গাড়িয়াল ব্রীজে ১৫/১৬ জন রাজাকার থাকে। তাদের আর্মস এ্যামুনিশন নিয়ে আত্মমর্পন করবে। আপনারা ধোপাডাঙ্গা-চাঁদপুর বাজারে আসেন। খবরটি শুনে খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না। রাত্রে সকলে একত্রিত হলে আমি বললাম, রেকি করে বিষয়টির সত্যতা জানা হোক। কিন্তু সালাউদ্দিন ও আরও কয়েকজন মানতে নারাজ। সকাল ৮ টায় আনুমানিক ৩০/৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে ধোপাডাঙ্গা-চাঁদপুর বাজারে ৯টার দিকে পৌছে যাই। কিন্তু এখানে কোন রাজাকার বা সংবাদদাতাকে খুজে পাওয়া গেল না। স্থানীয় লোকজন জানায়, গতকাল এখানে পাক আর্মি এসেছিল; আজও আসতে পারে। তবে আপনারা সামনে বড়ঘাট নামক স্থানে চলে যান, ঐখানে পজিশন নিতে সুবিধা হবে। দলবলসহ বড়ঘাটে গেলে কাজী সালাউদ্দিন ভাইয়ের নির্দেশে আরও সামনে এগিয়ে যাই (বর্তমানে এ.এইচ জুট মিল অবস্থিত)। যথারীতি তিনভাগে বিভক্ত হয়ে রাস্তার পূর্ব পাশে আতাহার, শরিফ, আলী, বাদশাহ, শামসুদ্দিন, ইদ্রিস, বাকা ভাই, শাহাদত, বাশার, আশরাফ, দেলোয়ার, বক্কার, আইয়ুব পুলিশ ও পশ্চিম পাশে নওফেল, খোকন, ওহাব, মজিবর, শামসুদ্দিন, মঈনুদ্দিন, হামিদ, খলিল, মোমিন ও সিরাজ এ্যামবুশ করে থাকে। হেমায়েত ভাই, জাফর ও আমি রাস্তার উপর ইট উঠায়ে ল্যান্ডমাইন স্থাপনের কাজ করছি। হিমায়েত ভাই ও জাফর মাইন স্থাপনের কাজ করছে, আমি রাইফেল নিয়ে কাভার করে আছি। হঠাৎ করে পাকিস্তান আর্মির একটি জীপ আসতে দেখা যায়। কাজী সালাউদ্দিনের কাছে এলএমজি ও গুলি বহনকারী রমেন। অন্যদের হাতে ছিল এসএলআর, রাইফেল ও হ্যান্ড গ্রেনেড। দুই পাশ থেকে ব্রাশ ফায়ার সহ আমি সামনে থেকে ফায়ার শুরু করলে জীপটি পিছু হটে পালাতে থাকে। জীপে থাকা কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয় তা বুঝা যায় না। যশোহর ক্যান্টেনমেন্ট ফল করার পর পাকিস্তানের আর্মি কামারখালী ঘাট হতে ফরিদপুর পর্যন্ত রাস্তার উপর ফাঁকা জায়গায় অবস্থান করছিল। করিমপুর রাস্তার পার্শ্বেও তাদের অবস্থান ছিল। এই গুলির শব্দে পাকিস্তান আর্মিসহ রাজাকাররা তাদের বাংকার থেকে গুলি বর্ষন করতে থাকে। বৃষ্টির মতো গুলি আসতে থাকে। তারই একটি গুলি হেমায়েত ভাই এর ডান হাতের মধ্যমা আঙ্গুলে লাগে। আমরা দ্রুত রাস্তার খাদে নেমে যাই। মুহূর্ত দেরি করলে আমরা সবাই ব্রাশফায়ারে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যেতাম। রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরুতে থাকলে গেঞ্জী ছিড়ে আঙ্গুল বাঁধলেও রক্তে কাপড় ভিজে যাচ্ছিল। কিছুসময় অপেক্ষার পর দেখি পশ্চিম দিক থেকে গুলি আসছে। অর্থাৎ তিনদিক থেকে পাকবাহিনী আমাদের ঘিরে ফেলেছে। হেমায়েত ভাইকে দ্রুত চিকিৎসা দিতে হবে। আমরা ব্যাক-ফায়ার করতে করতে হেমায়েত ভাইকে নিয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে পিছন দিকে ফিরতে থাকি। তাকে নিয়ে আজলবেড়া গ্রামের একটি বাড়ি থেকে কাপড় এনে আঙ্গুল ব্যান্ডেজ করে সেখানেই থাকতে বলি। আমি আবার ফিরে আসি। এদিকে রাস্তার পূর্ব পাশে যারা ছিল ফাঁকা মাঠ বিধায় তারা শেল্টার না পেয়ে কিছু রাস্তার কালভার্ট দিয়ে পূর্ব পাশ থেকে পশ্চিম পাশে আখক্ষেতের মধ্যে যায়। বাকি কয়েকজন ফিরে আসতে বাধ্য হয় এবং দুরে অবস্থান নেয়। আমাদের বাহিনী মাঝেমধ্যে গুলি ছোড়ে আর পাকিস্তান আর্মি বৃষ্টির মতো ব্রাশ ফায়ার করতে থাকে। বিকাল গড়িয়ে যায়। আমাদের দল অর্থাৎ যারা রাস্তার পশ্চিম পাশে ছিল, স্থানীয় রাজাকাররা (করিমপুর ও কুশাগোপালপুর গ্রামে ১০/১৫ জন রাজাকার) করিমপুর ব্রীজের দক্ষিণ পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা দক্ষিণ দিকে গেছে ঐ রাস্তা দিয়ে পাক হানাদার আর্মিদেরকে পথ দেখিয়ে আমাদেরকে তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলে। কয়েকজন অর্থাৎ খোকন, খলিল, বাদশাহ, সিরাজ, আইয়ুব, শাহাদাৎ সহ ৫/৬ জন ছোন ক্ষেতের ভিতর দিয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে বের হয়ে আসতে সক্ষম হয়। কাজী সালাউদ্দিন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পার্শ্ববর্তী বাকের মন্ডলের বাড়িতে আশ্রয় নিলে সন্ধ্যার দিকে পাকআর্মি ও রাজাকার দল কাজী সালাউদ্দিনসহ ওই বাড়ির ৩ জনকে গুলি করে মেরে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এছাড়া শহীদ মেজবাহ্উদ্দিন নওফেল (ফরিদপুর), শহীদ ওহাব (নিমতলি খানাখানাপুর, রাজবাড়ি), শহীদ মজিবর, শহীদ শামসুদ্দিন, বোয়ালমারীর শহীদ ময়েনউদ্দিন, পাড়াগ্রামের শহীদ হামিদ (খোলাবাড়িয়া, আলফাডাঙ্গা) ৩ জন সালাউদ্দিন কমান্ডের মুক্তিযোদ্ধা ও ৪ জন হেমায়েত কমান্ডের মুক্তিযোদ্ধা মোট ৭ জন শহীদ হয়। আমরা সকলেই কান্নাকাটি করছিলাম। কাজী সালাউদ্দিনের ভাই কাজী ফরিদের কান্না আর থামানো যাচ্ছিল না। সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। পরের দিন সকালে বেশ কিছু লোকজন কাঠের তক্তায় করে মমিন (যার বাড়ি খোলাবাড়িয়া, আলফাডাঙ্গা) তার শরিরে বেয়নেটের খোচায় ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে, বুট দিয়ে মাড়িয়ে তার বুকের পাজর ভেঙ্গে ফেলেছে। তাঁকে নতিবদিয়া ক্যাম্পে নিয়ে আসে এবং ডাক্তার রুনু ভাই চিকিৎসা দয়োর পর তাকে মুক্ত অঞ্চলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ১০ই ডিসেম্বর আমরা বিভাগদী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে গ্রামবাসীদের নিয়ে গায়েবানা জানাজা পড়ি। ১১ ডিসেম্বর শাহ্ মোঃ আবু জাফর ভাই লোক পাঠালে আমরা নতিবদিয়া ঘাঁটি ছেড়ে বোয়ালমারী ডাকবাংলোয় অবস্থান করি। এখানে ৮নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ফ্লাইট লেফঃ জামাল চৌধুরী সহ আরও অন্যান্য কমান্ডারদরে সাথে পরিচিত হই।
১৬ই ডিসেম্বর সকালে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা দুই দলে ভাগ হয়ে এক দল নতিবদিয়া হয়ে ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হই। পথে আমরা পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর পাই। বিজয়ের সংবাদ কানে আসছে, আমরা আনন্দে ফেটে পড়ব নাকি বন্ধু-স্বজন হারানোর দুঃখে ভেঙ্গে পড়ব তা বুঝে উঠতে পারি না। সেই মুহূর্তটি কেমন ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। গট্টির কাছা কাছি আসলে সন্ধা হয়ে যাওয়ায় মুকুল মিয়ার বাড়িতে রাত্রে অবস্থান করে সকালে ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হই। ২য় দল মাঝকান্দি হয়ে ফরিদপুর পৌছায়। উল্লেখ্য যে, ফরিদপুর সদরের করিমপুরে যুদ্ধের মত ভয়াবহ এতবড় যুদ্ধ আর দ্বিতীয়টি হয় নাই। পরে জানা যায় উক্ত যুদ্ধে একজন অফিসার সহ বেশকিছু পাক হানাদার নিহত হয়। আমরা ফরিদপুর এসে করিমপুরে যুদ্ধক্ষেত্রে যাই। সেখানে শহীদ কাজী সালাউদ্দিন, মেজবাহউদ্দিন নওফেল সহ ৭জনের দেহাবশেষ নিয়ে আসি এবং আলীপুর গোরস্থানে যথাযোগ্য মর্যাদায় জানাজাসহ দাফন করি। পরবর্তীতে আমাদের অস্ত্র বায়তুল আমান মিলিশিয়া ক্যাম্পে জমা দেই।