বীর মুক্তিযোদ্ধা সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার মোঃআহসান আলী খান (যুদ্ধাহত) | mssangsad.com

মুক্তিযোদ্ধার প্রোফাইল

Visitor: 13230

বীর মুক্তিযোদ্ধা সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার মোঃআহসান আলী খান (যুদ্ধাহত)

মুক্তিযোদ্ধা পরিচিতি নম্বর : যুদ্ধাহত গ্যাজেট ১৭
  • পিতার নাম: মৃত সৈয়দ আলী
  • মাতার নাম: মৃত নয়তন বিবি
  • স্ত্রীর নাম: মোছাঃরহিমা খাতুন
  • জম্ন তারিখ: ২২.০২.১৯৫৩ ইং
  • মৃত্যু তারিখ: ***
  • মোবাইল: ০১৭১৯-৯৭০৭৯১
  • গ্রাম: নাজিরাকোনা
  • ইউনিয়ন: বাগোয়ান
  • উপজেলা: মুজিব নগর
  • জেলা: মেহেরপুর

অন্যান্য তথ্য

মুক্তিবার্তা নম্বর ০৪১০০১০৫৫৩
ভারতীয় তালিকা নম্বর ৫১২০৩
মুক্তিবার্তা নম্বর ০৪১০০১০৫৫৩
বাংলাদেশ গেজেট নম্বর সেনা গ্যাজেট ২১০১ ,
মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান কি না? yes

সন্তানদের নাম ও বয়স

নাম বয়স শিক্ষাগত যোগ্যতা
মোঃ রবিউল ইসলাম খান জন্ম ৩১-০৮-১৯৭৮ইং উচ্চ মাধ্যমিক পাশ
মোঃ রাকিব খান জন্ম ১৫-০৭-১৯৮৭ইং মাধ্যমিক পাশ
মোঃ আশরাফুল ইসলাম জন্ম ০২-০৬-১৯৮৯ইং মাস্টার্স ইন ফার্মেসী পাশ
মোঃ রুপম আসিফ খান জন্ম ০২-০১-১৯৯৭ইং ডিপ্লোমা ইন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ

যুদ্ধের ইতিহাস

আমি সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার হাজী মোঃআহসান আলী খান (অবঃ) যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে পাকিস্থান আর্মিতে কোর অব ইঞ্জিনিয়ারে নবীন সৈনিক হিসাবে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে,হোল্ডিং কোম্পানিতে ছিলাম। আমার হোল্ডিং নাম্বার ৪৬১৫,আমরা ৭৫ জন ছিলাম (ইঞ্জিনিয়ার,আর্টিলারী,আরমাড,সিগনাল ও এম ও ডি সি) প্রতিদিন রুটিন অনুসারে সকল কাজে অংশগ্রহন করতাম। হোল্ডিং কোম্পানির হাবিলদার মেজর ছিলো নুর মহাম্মদ(পাঞ্জাবী),প্লাটুন ও সেকশন কমান্ডার ছিল নায়েক রমজান আলী(পাঠান),নায়েক আনারগুল(পাঠান),ল্যান্স নায়েক আব্দুল মালেক(বাঙ্গালী) দেশের অবস্থা ভালো না,সব সময় হরতাল কারফিউ থাকতো।সেনানিবাসে থাকলেও বাহিরের সংবাদ সব সময় রাখতাম। চট্টগ্রাম সেনানিবাসের দক্ষিন পাশে বায়োজিদ বোস্তামী মাজার ও বাজার।আমি জাফর(ফরিদপুর),হারুন(কুমিল্লা),আজিজ(বগুড়া) ও আলী আহম্মেদ(নোয়াখালী) একই সাথে থাকতাম। বাঙ্গালী ওস্তাদ মালেক প্রায় বলতেন দেশের অবস্থা ভালো না তাই আগামী ৭ই মার্চ ১৯৭১ ইং, তারিখ রোজ রবিবার রেসকোর্স ময়দানে, বিশাল জনতার মাঝে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান জাতীর উদ্দেশে ভাষন দেবে। বঙ্গবন্ধুর ভাষন শোনার জন্য অপেক্ষা করি।আমরা বাঙ্গালী সৈনিকরা বেশ বুঝতে পারতাম যে,পশ্চিম পাকিস্থানী সৈন্যরা আমাদের সাথে ভালো আচরন করতো না । প্রায় সময় গন্ডোগল হতো,এমনকি হাতাহাতি পর্যন্ত হত। প্রায় সময় এর জন্য সাজা ভোগ করতাম।বাঙ্গালীদের প্যাক ০৮ সবসময় ইট অথবা বালি ভারা থাকতো। আমাদের ব্যারাকটি ছিল একদম পাহাড় ঘেষা।পাশেই বড় ড্রেন ও কুয়া।এবং একপাশে ফ্যামিলি কোয়াটার। নিত্য প্রয়োজনিয় দ্রব্য দরকার হলে ই বি আর সি অথবা সিনেমা হল ক্যান্টিনে যেতে হত। লাইন এলাকা থেকে বাহির হতে হলে আমাদের জন্য গেইট পাস দরকার হতো।কিন্ত ওদের কিছুই লাগতো না। ৭ই মার্চ রবিবার সকাল হতে পুরো সেনানিবাস জুড়ে কেমন একটা থমথমে ভাব। হঠাৎ নির্দেশ জারি হয় যে, কোন বাঙ্গালি রেডিও বা টেলিভিশন শুনবে না। সৈনিক লাইনে কারো রেডিও থাকার কথা না তবুও জোর করে সকলের কাববোর্ড চেক করা হল। আমরা বিকাল আড়াইটার দিকে লুকিয়ে ই বি আর সি এর ক্যান্টিনে যায়,জানতে পারলাম টেলিভিশন চালানো বন্ধ। চট্টগ্রাম রেডিও বঙ্গবন্ধুর ভাষন ঢাকা রেড়িও হতে রিলে করে শুনাবে।আমরা রেডিও শুনার জন্য অপেক্ষাই থাকলাম। রেডিওতে গানের মাঝে মাঝে কিছুক্ষনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু ভাষন দেবেন।কিন্ত হঠাৎ গান বাজতে বাজতে রেডিও বন্ধ হয়ে গেল। ব্যারাকে ফেরত আসার পথে আরপি চেক পোস্টে আমাদের আটকে দেই।এর জন্য হাবিলদার মেজর সাজা দেই। রাতে বি বি সি ও আকাশ বানী কলকাতা হতে ঘোষনা দেয় পাক সরকার বঙ্গবন্ধুর ভাষন শোনানোর জন্য রাজি হয়েছে। আগামী ৮ই মার্চ সকাল ০৮:৩০ ঘটিকার সময় ভাষন প্রচার করা হবে। ভাষন শোনার জন্য আমরা বাঙ্গালীরা অপেক্ষা করছিলাম। আল্লাহর মেহেরবানীতে আমরা বাঙ্গালী ও পাকিস্থানী সৈনিক মিলে ৫০ জন ই বি আর সি গ্যারিসন মসজিদ এলাকাই মাটি কাটার কাজে যায়। কাজের মাঝে বায়োজিদ বোস্তামি বাজার হতে মাইকে ঘোষনা দেই যে এখন বঙ্গবন্ধু ভাষন দেবেন। ভাষন শুরু হলে আমরা বাঙ্গালীরা কাজ বন্ধ করে দাড়িয়ে যায়।এমন সময় ওস্তাদ আনারগুল তেড়ে আসে। যখন বঙ্গবন্ধু বলেন যে "এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম,যার যা আছে তাই নিয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো" তখন আমরা সবাই এক সাথে গেতি বেলচা উঠিয়ে "জয় বাংলা" বলে স্লোগান দিই। পাঞ্জাবী ওস্তাদ যারা ছিলো সবাই তেড়ে আসে এবং উর্দুতে বলে "তুম লোক শেখ বনগিয়া,জয় বাংলা মাত বলো পাকিস্থান জিন্দাবাদ বাতাও,তুম লোক হুসমে আজাও" কাজের শেষে ব্যারাকে আসার পর দেখি যত পাঞ্জাবী সৈনিক ছিল সকলে জেন আমাদের নতুন ভাবে দেখছে। বুঝতে পারলাম যে তাদের কাছে অপরাধী। ৭ই মার্চ ভাষনের পর হতে আমরা নতুন জীবনের খোজ পাই। যে সকল বাঙ্গালী সৈনিকরা ফ্যামিলি সহ সেনানিবাসের বাহিরে বসবাস করতেন তারা সেনানিবাসে এসে বলে যে বাহিরের অবস্থা মোটেও ভালো না। টাইগার পাস ,নিউ মার্কেট সহ শহরের বিভিন্ন এলাকাই বাঙ্গালীরা কারফিউ না মেনে মিছিল সমাবেশ করছে। পাঞ্জাবীরা তাদের উপর গুলি বর্ষন করে ,অনেক বাঙ্গালীদের তারা মেরে ফেলে। এই অবস্থাই আমাদের করার কিছুই ছিলনা ।কারন বাঙ্গালী সৈনিকরা বাহিরে ডিউটিতে জেতে পারতো না। ২৩ই মার্চ হঠাৎ তিনটি হেলিকাপ্টার ই বি আর সি ট্রেনিং গ্রাউন্ডে নামে। পরে জানতে পারি যে ই বি আর সি সেন্টার কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে এরেস্ট করে ঢাকাতে নেওয়া হয়। ২৫ শে মার্চ সেনানিবাসের সব উচু পাহাড়ের উপর ভারি অস্ত্র বসানো হয়। প্রতিটি অস্ত্রের লক্ষবস্তু ছিল ই বি আর সি ট্রেনিংরত বাঙ্গালী সৈনিক ব্যারাক,হোল্ডিং কোম্পানির ও ফ্যামিলি কোয়াটার এর দিকে। অবস্থা দেখে আমাদের দম বন্ধ হওয়ার পথে।সকল গেইট বন্ধ।তখন আমরা আল্লাহকে স্মরণ করছি। আমরা বাঙ্গালীরা মনে মনে চিন্তা করলাম যে সুযোগ পেলে ব্যারাক ছেড়ে পাহাড় এর ঐপারে চলে যাবো। ২৫ শে মার্চ সন্ধ্যা বেলা রোল কল প্যারেডে রেজিস্টার অনু্যায়ী নাম ডাকা হয়। সকল সৈনিক উপস্থিত হওয়াতে কোন প্রকার সমস্যা হয় নাই। সি এইচ এম প্রতিদিনের ন্যায় অর্ডার শুনাই। হটাৎ কোম্পানী কমান্ডার ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূইয়া প্যারেডে উপস্থিত হওয়াই সি এইচ এম একটু ঘাবড়াই যাই। কোম্পানি কমান্ডার কে প্যারেড হ্যান্ডওভার করার পর একপাশে সরে দাড়াই। ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূইয়া সকলের মনের অবস্থা জানতে চাই। আমরা একসাথে আওয়াজ করে বলি যে,"ভালো আছি স্যার" । তিনি বলেন যে "খুব মন দিয়ে শুনবে গত ৭ই মার্চ হতে আমরা বাঙালিরা কিন্ত সব চোখে চখে আছি। সেনানিবাসের সব উচু পাহাড়ে ভারি অস্ত্র লে আউট আছে ,অতএব সর্তক্য থাকবে,খোদা হাফেজ"। এবং প্যারেড শেষ করার আদেশ দিয়ে চলে জান। পরে সি এইচ এম বেশ কড়া ভাষাই বলে যে, "ক্যাপ্টেন সাব যো কুছ বাতাইয়া মুঝে মালুম নেহি,মেরি বাথ ধ্যানসে শুনলো প্যারেড খতমছে কোই আদমি বাহার নেহি জাওগি,আপনা বেডপর যা কর আরাম কর গি, আপনা কামরামে কোই বাতি নেহি জালেগি,মেরি বাথ বর খেলাপ হোনেসে সারেকো বহুত সাজা মিলেগি"। আমরা লক্ষ করি যে সি এইচ এম এর চোখে মুখে কেমন যেন ভয়ের ছাপ ফুটে উঠে। প্যারেড শেষে যে যার রুমে চলে যাই।বার বার ভূইয়া সাহেবের কথা মনে পরছিল। ভারি অস্ত্রের কথা কি বুঝাতে চেয়েছিল! অন্যদিন আমাদের সৈনিক লাইনে বাঙ্গালী পাঞ্জাবী মিলে ডিউটি পড়তো,কিন্ত আজ উলটা। রাত আনুমানিক এগারোটার দিকে দেখি যে, সি এইচ এম ও লাইন ডিউটির পাঞ্জাবী সৈনিকরা অস্ত্র হতে ডিউটি করছে। আমরা কিন্ত তখন কোন কিছুই অনুভব করতে পারি না ,শুধু মনে হচ্ছিলো বাঙ্গালী সৈনিকদের বাদ দিয়ে এসব করার কারন কি? একসময় বুঝতে পারলাম যে লাইন ডিউটি প্রহরি বাহির হতে সব দরজার সিটকিন আটকিয়ে দেয়। তখন মোটামুটি বন্দি বলে সবাই ধরে নিলাম আমরা।কিছুক্ষন পরে ইলেকট্রিক মেন সুইচ অফ হয়ে যাই। তখন মনে হয় এবার বুঝি আমাদের উপর কোন বিপদ নেমে আসবে। ২৫ শে মার্চ রাত বারোটা বাজার কয়েক সেকেন্ড পরই, ই বি আর সি কোয়াটার গার্ড রুম হতে হোল্ড হ্যান্ডস আপ আওয়াজ আসে এবং সাথে সাথে গুলির আওয়াজ আসে। তখন "বাবাগো মাগো চিৎচার" করে উঠে বাঙ্গালীরা।পাহাড়ে উপর রাখা অস্ত্রগুলোর ফায়ার শুরু হয়। তখন আমরা ঝটপট যার যার রুমের পিছনের জানালার কাচ ভেঙ্গে গ্রিল টেনে বাকা করে রুম হতে বাহির হয়ে মৃত্যুকে ভয় না করে গুলাগুলির ভিতরেই পাহাড়ের ঐপারে চলে যাই। তখন সি এইচ এম নুর মোহাম্মদ চিৎকার করে বলে "ইন্ডিয়ানে এটাককিয়া শের মাত উঠাও,সো জাও"। পাহাড় এর উপর হতে যতদুর নজর যাই বন্দুকের ব্যারেলের আগুনের ফুলকি আর ফুলকি। আমাদের ব্যারাক সহ সব বাঙ্গালী ব্যারাকগুলি আগুন ধরে যাই ,ধারনা করি যে যারা বাহির হতে পারেনাই সবাই পুড়ে মারা গেছে। ব্যারাক হতে বহির হওয়ার সময় আমরা পরনে হাফ প্যান্ট ও গেঞ্জি পরে খালি পায়ে পাহাড়ের নিচে একটু আড়ে সবাই একত্রিত হয়। ওস্তাদ মালেক একটা হিসাব করে হোল্ডিং কোম্পানির অর্ধেক বাহির হতে পারেনি। মর্টার গোলা পাহাড় এর মধ্যে পড়তে শুরু করে ।আমর অন্ধকারে পাহাড় এর কোন দিকে যাচ্ছি বুঝতে পারছিলাম না। অনেক দূর হতে ফজরের আযান শোনা যাচ্ছিলো।রাস্তাই অনেক ই বি আর সি অনেক বঙ্গালী আহত সৈনিকদের সাথে দেখা হয়। অনেকেই আহত শরীর থেকে রক্ত ঝরছে।পাহাড়ী কাঁটা লতা পাতাই আমাদের শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়। আযানের পরেই মাইকে প্রচার হয় যে , সেনানিবাস হতে যে সকল বাঙ্গালী সৈনিক ভাইরা বাহির হয়ে পাহাড় এর ভিতর পথ হারিয়ে ঘুরাঘুরি করছেন সবাই ভাটিয়ারী দিকে চলে আসেন। ২৬শে মার্চ পূর্ব আকাশ পরিষ্কার হলে দিক ঠিক করে হাটা শুরু করি।রস্তাই আওয়ামীলিগ এর উদ্ধার কর্মীর সাহায্যে সমতাল ভূমিতে আসি। সেখানে প্রথমিক চিকিৎসা ব্যাবস্থা থাকাই আমরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়। উপস্থিত আওয়ামীলিগ নেতা কর্মীরা যথেষ্ট সাহায্য করে এবং বলে যে ,আপনারা আল্লাহর মেহেরবানীতে মৃত্যুর হাত থেকে ফেরত এসেছেন। তখনো পাক বাহিনী সেনানিবাস এলাকা হতে বাহির হয়ে অন্য জাইগায় যাইনি। জানতে পারলাম অপারেশন সার্চ লাইট ঘোষনা করে সারাদেশে নিরঅস্ত্র জনগনকে হত্যা করেছে। পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষাই আমি,জাফর ও আজিজ সহ ভাটিয়ারী বাজার থেকে সাগরের দিকে একটা পুকুর পাড়ে যাই। উভয়ের মধ্যে আলোচনা করি দেশের যে অবস্থা আমরা দেশের বাড়ি যেতে পারবো না ,তাই সিদ্ধান্ত নিয় যে,দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমরা বাড়ি যাবো না। পাড়ার লোক জন জানতে চাই ,আপনারা কিভাবে সেনানিবাস হতে বাহিরে আসলেন? যারা আসতে পারেনাই তাদের কি অবস্থা ? আমরা যতটুকু জানি যে, বাঙ্গালীদের ব্যারাক গুলোতে গুলি করে ঘুমন্ত অবস্থাই মেরে ফেলে। হঠাৎ মাইকে ঘোষনা হয় যে , যে সকল সৈনিক ভাইয়েরা সেনানিবাস হতে এসেছেন সবাই রাস্তার পাশে অপেক্ষা করেন। আওয়ামীলিগের সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা বাস ট্রাক নিয়ে সকলকে একত্র করার ব্যাবস্থা নিয়েছে। মনে অনেক সাহস পেলাম ।এমন সময় একটি দশ বারো বছরের ছেলে ছুটে আসে এবং বলে "কাকু আপনাদের সারাদিন খাওয়া হয়নাই,আমরা হিন্দু যদি ইচ্ছা করেন আসেন আমাদের বাড়িতে খাবেন"। সত্যি বলতে কি সারাদিন না খাওয়া,ভাত সামনে পেয়ে আনন্দে চোখ বেয়ে পানি পড়ে এবং আত্মীয় স্বজন এর চেহারা ভেষে ওঠে। খাওয়ার পর রাস্তার ধারে আসি,বাংলাদেশ এর মানচিত্র খচিত পতাকা লাগানো তিনটি মানুষ ভর্তি ট্রাক আসে। ট্রাকে উঠে বসার পর কোথাই যে গেলাম আমি জানি না ।মাইক এ ঘোষনা আসে যে,কুমিল্লা সেনানিবাস হতে পাক আর্মি আসছে চিটাগাং ধংস করার জন্য। ২৬শে মার্চ শুক্রবার বিকালে ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূইয়ার নেতৃত্ব এ কুমিরা টিবি হাসপাতালে যাই। সেখানে তিনি ব্রিফং দেই যে,কুমিল্লা সেনানিবাস হতে ৫৩ ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ইকাবাল সফি মুভ করেছে সাথে আছে ২৪ ফ্রন্টিয়ার ইঞ্জিনিয়ার ডিটাচমেন্ট,৮৮ মর্টার ব্যাটারী সাথে আসছে। পাকিস্থানী বাহিনীকে বাধা দেওয়ার জন্য ক্যাপ্টেন সুবিদের অধিনে কুমিরায় ফাঁদ পাতা হয়। স্থানীয় জনগন,সেনাবাহিনী সদস্য,ই পি আর,পুলিশ,ছাত্রজনতা, নিয়ে বাম দিকে সুমুদ্র ডানদিকে পাহাড় ও ঘন গাছ ,মাঝখানে চট্টগ্রাম এর রাস্তা। নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১০০ জন। জনগন ছিল কয়েক শত। অপেক্ষাই থাকি সন্ধ্যা ৭ ঘটিকার দিকে পাক আর্মীর কনভয় আমাদের ফাঁদ এলাকাই আসে। তারা গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার ব্যারিকেট সরাতে থাকে ।আমাদের ফায়ার রেঞ্জে আসলেই ফায়ার শুরু করি। তারা এদিক ওদিক পালানর চেষ্টা করে।যেদিকে যাই সেইদিকেই জনগন এর কাছে বাধা পাই এবং যার কাছে যা ছিলো তাই দিয়ে আঘাত করে। শেষে পাক বাহিনী পালাতে বাধ্য হয়।পাক বাহিনীর প্রাই ১৫০ জন মারা যাই।আমাদের শহীদ হয় ১৪ জন। বিরাট এই শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়েছিল এই কারনে যে আমাদের মনে ছিল খোভ ও আবেগ। আপারেশন শেষে আমরা গাড়িতে চট্টগ্রামের দিকে যাই এবং হাজী ক্যম্পে বাকি রাতটুকু কাটাই। সারারাত বিভিন্ন প্রকার অস্ত্রের ফায়ারের শব্দ আসে।সকাল বেলা হাজী ক্যাম্পে একজন বিহারীকে পাওয়া যাই। পাবলিকে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। ২৭শে মার্চ সকালে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম ই পি আর (সাবেক সরাষ্ট মন্ত্রী) নিজের পরিচয় দিয়ে সবার সাথে কথা বলেন। তিনি বলেন যে,জাতি আজ বিপদের মধ্যে ।পাক বাহিনী আপারেশন সার্চ লাইট ঘোষনা দিয়ে নিরস্ত্র জনগনের উপর আক্রমন করে। আপনারা এখানে যারা আছেন সবার বাড়ি নিশ্চয় নদীর ওপারে। গকালের প্রতিরোধ আমাদের মনে অনেক সাহস যোগাই,আমরা কোন অস্ত্র নিয়ে আসতে পারি নাই। ই পি আর এর কিছু অস্ত্র আছে তাই দিয়ে তাই দিয়ে আমাদের পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে হবে। আমাদের কয়েকটি প্লাটুনে ভাগ করা হয়।আমি ১ নং প্লাটুনে পড়ি।অস্ত্র সংগ্রহ করার পর গাড়িতে করে সিতাকুন্ডে আসি। ১ নং প্লাটুনের ৩ নং সেকশন আমি,জাফর,আজিজ ও আরো সাত জন ছিলাম। আমরা রেল লাইন ছেড়ে সাগরের কিনারা দিয়ে হাটা শুরু করি এবং হঠাৎ ফায়ারের আওয়াজ শুনি,দেখি যে চারিকদিকে জনগন ছুটাছুটি করছে। সেই সাথে আমরাও সাগরের দিকে দৌড়ে পানির কিনারাই আসি এবং হাত দিয়ে বালি সরাইয়ে গর্ত করে পজিশনে যাই। কিছুক্ষন পরেই জোয়ার শুরু হলে পানির ধাক্কাই কিনারের দিকে ভেষে কিনারার দিকে যাই। ভাসতে ভাসতে অনেক দূর যাই,এবং কতক্ষন এই অবস্থা ছিলাম বলতে পারবো না। চরে মরা গাছে আটকানো অবস্থাই গ্রামের লোকজন আমাদের সাহায্য করে ।রত্রিতে একটা প্রাইমারী স্কুলে আমরা অবস্থান করি । ২৮শে মার্চ গাড়ীতে অস্ত্র সহ মিরেশরাই চেকপোস্টে আসলে আর্মি ও পুলিশের কিছু সদস্য আমাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে রাখে। এবং রেজিস্টারে নাম লেখাই।অল্প সময়ে অনেক সৈনিক উপস্থিত হয়। ঘোষনা হয় যে,শুভপুর ব্রিজ মুক্ত করার জন্য ,আমাদের করেরহাট দারোগা বাজার পাঠানো হয়। সেখানে সেনা,পুলিশ,মুজাহিদ,ছাত্র,ই পি আর ও সাধারন জনগন একত্রিত হয়। ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূইয়া সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং এ বলেন যে , আজ বিকাল ৩ ঘটিকার সময় ই পি এর মর্টার প্লাটুন হতে ফেনীর দিকে শুভপুর ব্রিজে এক রাউন্ড গোলা ফায়ার করা হবে। তখন সবাই আল্লাহ আকবর জয় বাংলা বলে ফায়ার করতে করতে উপরের দিকে অগ্রসর হবে । আমরা ব্রিজের এর দারগা বাজার সাইডে সুবেদার মেজর ফকর উদ্দিন ই পি আর এর নির্দেশ অনুযায়ী আমরা পজিশন নিয়। যথা সময়ে মর্টার এর এক রাউন্ড গোলা ফায়ার হয়।সাথে সাথে আল্লাহ আকবর ও জয় বাংলা আওয়াজ দিয়ে ফায়ার করতে করতে সামনে অগ্রসর হয়। পাক সেনারা ব্রিজের এভাটমেন্ট এ পজিশন এবং আমরা নিচে পজিশন নিয়। শত্রুর গুলি কানের পাশ দিয়ে মাথার চুল টাস করে শো শো করে চলে যাই। আল্লাহ এর ইচ্ছাই শরীরে লাগে নাই।আল্লাহ যেন গুলির গতি অন্য দিকে ঘুরাই দেন। মৃত্যু,বড়ই ভয়ংকর খুব কাছে থেকে দেখেছি,অনুভব করেছি,সব যুদ্ধই ছিলো ভয়াবহ। সময় না হলে মৃত্যু হয় না । এই যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর ৭ জন ধরা পড়ে।জনগন তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলে। আমাদের দুই জন মারা যাই।তারা হলেন নায়েক হাসেম ই পি আর ও লুৎফর ই পি আর। তাদের করের হাট বাজারে করব দেওয়া হয়।সন্ধ্যায় সবাই করের হাট স্কুলের মাঠে (দারোগা বাজার ও রামগড় রাস্তার মাঝে) একত্রিত হয়। রাত্রিতে খাবার পর সুবিদ আলী ভূইয়া বলন যে,এই স্থান নিরাপদ না।যেকোন সময় আক্রমন হতে পারে তাই আমরা রাতটুকু অন্য জায়গাই কাটাবো। আমরা কয়েকজন একটা ট্রাকে করে রামগড় রোডে গেলাম ।যাওয়ার কিছুক্ষন পরেই ই পি আর চেকপোস্টে গাড়ি থামাই। এবং বলে যে, সামনে আর গাড়ি যাবে না।সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়ি এবং বাকি রাত ওই ক্যাম্পেই থাকি। রামগড় ই পি আর ক্যাম্প কমান্ডার ওয়ারলেস এর মাধ্যমে সিনিয়রকে আমাদের কথা জানায় পরবর্তী আদেশ এর জন্য। ২৯ মার্চ সকালের নাস্তার পর পরই করের হাটের দিক হতে ৭/৮ টা চাঁদের গাড়ী আসে।ওই গাড়ীতে আমরা বসি। লেঃঅলি আহমেদ এর নির্দেশে রামগড় চা বাগানে কিছুক্ষন গাড়ী অপেক্ষা করার পর রামগড় থানা মাঠে এসে থামে। ওইখানে সমস্থ সৈনিক ফলিন হই।তালিকা সহ অস্ত্র গোলাবারুদের হিসাব করা হয়। মোট জনবলকে তিনটি প্লাটুনে ভাগ করা হয়।আমি ১ নং প্লাটুনে পড়ি।প্লাটুন কমান্ডার ছিল বাহাদুর। আমাদের সেকশনের ডিউটি পড়ে রামগড় হতে হেকো,কয়লা শহীদ বাজার,দাত মারা বাজার পর্যন্ত। গাড়িতে করে টহল দিয়।যে সকল জনগন বাড়ি ঘর ছেড়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার জন্য তাদের মালামাল জেন সন্ত্রাসীরা কেড়ে নিতে না পারে তার জন্য আমরা ডিউটি করতাম। আমি ওই সেকশনে টু আই সির দায়িত্ব পালন করি। দুইদিন টহল ডিউটি করার পর আমরা চেঞ্জ হয়।পরবর্তিতে আমাদের দায়িত্ব পড়ে রামগড় থানার নিচে ফেনী নদীতে জনগন কে পারাপারে সাহায্য করা। এইরকম চলতে থাকে ...... ৫ এপ্রিল সকালে মাঠে মেজের জিয়ার নির্দেশে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান অস্টম ব্যাটেলিয়ান এর একটি কোম্পানী নিয়ে পানি পথ মহালছড়ি-রাঙ্গামাটি নিরাপদ রাখার জন্য। বিকাল বেলা অস্ত্র ও গোলাবারুদ সহ ৭-৮ টা চাঁদ এর গাড়ী করে রামগড় থেকে পাতাছড়া,গুইমারা,বড় পিলাক,সিন্ধুকছড়ি,ধুমনিঘাট ও পংক্ষিমুড়া হয়ে মহালছড়ি থানাই আসি। মাহালছড়ি থানাই আসার পর আমরা আদেশ পেলাম এলএমজি ও এমজির গুলি বেল্টে লোড করার জন্য। রাতের খাওয়ার কোন ব্যাবস্থা হলো না কোন রকম রাত কাটায়। ৬ এপ্রিল সকালে থানাতে রান্নার ব্যাবস্থা হয়।খাওয়ার পর নদী ঘাটে কয়েকটি লঞ্চ ও দেশী ইঞ্জিনচালিত বোট এ করে মহালছড়ি ও রাঙ্গামাটি পানি পথ নিরাপদ রাখার জন্য বাহির হয়। অনেক রাত্রিতে হটাৎ লঞ্চ থেমে যাই।সারেং বলে যে সামনে রাঙ্গামাটি জলজান ঘাট পাক সেনারা ডিউটিতে আছে । তখন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান এর নির্দেশে লঞ্চ পিছনে ঘুরিয়ে চাকমা রাজার ঘাটে থামে। নিরাপত্তার জন্য ডিউটি দিয়ে বাকিরা রেস্ট করে। ৭ শনিবার ভোরবেলা সবাই জেগে লঞ্চে বসে হাত মুখ ধুই। আমার পাশেই ই পি আর এর একজন সৈনিক ব্রিটিশ এল এম জি নিয়ে বসা ছিল,লক্ষ করলাম হাত মুখ ধোলাই করলো না । লঞ্চে বসেই বা হাত দিয়ে পানি নাড়া চাড়া করছিল।এবং মাঝে মাঝে হাত ভিজিয়ে চখে মুখে পানি দিচ্ছিল। এবং তাকে দেখে মনে হচ্ছিল খুব চিন্তিত।এমন সময় বেশ দূরে ইঞ্জিনের শব্দ ভেষে আসে। প্রথমে মনে হল ইঞ্জিনচালিত বোট। ক্যাপ্টেন সাহেব ও সারেং ভালো করে দেখে এবং বুঝতে পারে যে পাক বাহিনীর একটা লঞ্চ। সাথে সাথে আমরা লঞ্চ ছেড়ে দিয়ে পাড়ে পজিশনে যাই। পাকিস্থানী লঞ্চটি আমাদের দিকে আসতে আসতে হঠাৎ থেমে যাই। সেখান থেকে আমাদের লঞ্চ লক্ষ করে রকেট ফায়ার দেই। ফলে আমাদের লঞ্চটি ডুবে যাই।কোন প্রতিউত্তর না পাওয়াই পাক সেনারা ফিরে যাই। সবাইকে একত্রিত করার পর ক্যাপ্টেন সাহেব বলেন যে,সেদিন রাত্রিবেলা লঞ্চ নিয়ে ফেরত আসাতে পাক বাহিনী চারিদিকে টহল জোরদার করে। দুপুরের পর দুইটি মাছ ধরা জেলে নৌকা ব্যবস্থা করি।নৌকার মাঝিরা ছিলো সবাই সিলেটি। তাদের মাছ ধরা সাহায্য করি এবং চারিদিকে খেয়াল করে রাঙ্গামাটির দিকে জেতে থাকি। পাক বাহিনীর একটি স্পীড বোর্ড আমাদের নৌকার দিকে আসতে দেখে মাঝি ইশারাই বুঝাই পতাকা দেখিয়ে "পাকিস্থান,পাকিস্থান হয়"। তারা কাছে না এসে অন্য দিকে চলে যাই।আমাদের বহনকারী নৌকা রাঙ্গামাটির দিকে চলতে থাকে । বিকালে পাক বাহিনীর তিনটি স্পীড বোট আমাদের নৌকা থামাই এবং কাছে এসে চেক করার জন্য একজন পাক সেনা আমাদের নৌকাই আসে। মাঝি তাকে বুঝাই যে "হাম পাকিস্থান হেই" সাথে পাকিস্থানি পতাকা দেখাই। অন্য বোট থেকে একজন হাবিলদার বলে "ঠিক হেই তুম জাও,জয় বাংলা মুক্তি দেখা তো মুঝে বাতাইয়ে,তুম মুসলিম ম্যায় মুসলিম ,তুম মেরা দোস্ত হেই"। আমারা পাটাতনের নিচে থেকে সব কিছু অনুভব করছিলাম এবং প্রস্তুত ছিলাম। সবাই যদি নৌকাই উঠে তাহলে আক্রমন করবো।পাক সেনারা চলে যাওয়ার পর ক্যাপ্টেন সাহেব বলেন যে ,দুইবার বিপদ হতে রক্ষা পেয়েছি এবার আমাদের নৌকা ছেড়ে দিতে হবে। আমরা সন্ধার আগে নানিয়ার চর রাঙ্গামাটি নদীর মাঝপথে অবস্থিত বুড়ির হাট টিলাই অবস্থান নিই। বুড়ির হাট টিলার তিন দিকে পানি একদিকে নালা তারপর হলো জঙ্গল । সারা রাত্রি জোঁক ও মশার সাথে যুদ্ধ করতে হয়। ৮ এপ্রিল ভোরবেলাই ক্যাপ্টেন সাহেব বলেন যে "এই টিলাই থাকতে হবে ,সকলে সতর্ক অবস্থাই থাকবে এবং চারিদিকে লক্ষ রাখবে শত্রু এর চোখ হতে বাঁচার জন্য বেশি চলাফেরা করা যাবে না,গাছের নিতে ঝোপ ঝাড়ের পাশে অবস্থান করবে"। আনুমানিক বেলা দুইটা তিনটার দিকে পাকিস্থান সেনার কমান্ডো ব্যাটেলিয়ান এর দুই কোম্পানী সৈনিক সাতটা স্পীড ও দুইটি লঞ্চ নিয়ে বোট বুড়ির হাট এর দিকে আসতে থাকে। আমাদের অনস্থান টের পেয়ে তারা অতর্কিত আক্রমন করে । পাক সেনাকদের লঞ্চে তিন ইঞ্চি মর্টার বসানো ছিল।এক সময় আমাদের অবস্থানের উপর মর্টার সেল ফেলা শুরু করে । ছোট টিলাই আমাদের অবস্থা হয়েছিল খোই মুড়ি ভাজার মত। শেষে ক্যাপ্টেন অর্ডার দেই পিছনে নিরাপদ এ অবস্থান নিতে ।আমরা জারা রাইফেল ম্যান ছিলাম সবাই নালা পার হয়ে অবস্থান নিয়। ই পি আর এর এল এম জি ম্যান মুন্সি আব্দুর রউফ(বীরশ্রেষ্ট) ফায়ার দিয়ে পাক সেনার সাতটা স্পীড বোর্ড অকেজ করে দেই। তখন বাদ্ধ হয়ে তারা পিছনে চলে যাই এবং পুনরায় মর্টার সেল ফেলা শুরু করে । হঠাৎ একটি সেল মুন্সি আব্দুর রউফ এর গানের উপর পড়ে এবং সাথে সাথে ফায়ার বন্ধ হয়ে যাই। একা কভারিং ফায়ার দিয়ে এবং নিজের জীবন দিয়ে সকলে প্রান রক্ষা করেন। তার দেহের শত শত টুকরাগুলো একত্রিত করে বুড়ির হাটে সমাহিত করা হয়। মুন্সি আব্দুর রউফ আমাদের মঝে স্মরণীয় হয়ে আছেন। আমরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে যার যার অস্ত্র সহ বন,জঙ্গল,পাহাড়,টিলা,ঝরনা পার হয়ে পায়ে হেটে নয়নছড়ি পৌছায়। চাকমাদের সাহায্যে দেশি নৌকা করে মহালছড়ি থানাই পৌছায় ভোর রাতে । ৯ এপ্রিল আমরা কয়েকজন মাহালছড়ি থানার কোত ভেঙ্গে কিছু গুলি নিয়ে রামগড় আসার জন্য প্রস্তুত হয়। ১০ এপ্রিল আমরা রামগড় থানাই পৌছায়।ক্যাম্প কমান্ডার লেঃ অলি আমাদের সব বিষয়ে অবগত হয়ে বলেন যে পরবর্তী আদেশের জন্য অপেক্ষা করতে সন্ধার কিছু আগে ফলিন এর আদেশ আসে সবাই একত্রিত হলে আদেশ শুনানো হয় যে , গত ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাত তলা বিশাল আমবাগানে সৈয়দ নজরুলকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট করে , তাজউদ্দিন ,ক্যাপ্টেন মুনসুর ও কামরুজ্জামান কে নিয়ে অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়েছে। কর্নেল আতাউল গণি উসমানী কে প্রধান সেনাপতি করে যুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য দেশকে এগারোটি সেক্টরে ভাগ করা হয়। চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী নিয়ে এক নম্বর সেক্টর গঠন করে । ১নং সেক্টর কমান্ডার হিসাবে মেজর জিয়াকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়া আদেশ দেন যে ,করের হাট রামগড় সড়কে রোড ব্লকের ব্যবস্থা নিতে হবে এবং সতর্ক ব্যাবস্থা নিতে হবে। ৩নং সেকশন কমান্ডার মোজম্মেলের সাথে আমি সেকশন টু আইসি রামগড় চা বাগানে অবস্থান নিয়। ২৪ এপ্রিল আনুমানিক একটা দেড়টার দিকে চা বাগানের উপর সেলিং শুরু হয়। ভাবগতি দেখে কমান্ডারের নির্দেশ মোতাবেগ পাশে ফেনী নদী পার হয়ে ভারতের সাব্রুম এলাকাই প্রবেশ করার সময় ভারতীয় বাহিনী বাধা দেই। এবং ব্লাংক ফায়ার শুরু করেন।তখন আমরা বাধ্য হয়ে অস্ত্র সহ হাত উঠিয়ে আওয়াজ করতে থাকি , "জয় বাংলা,জয় বাংলা"। শেষে বন্ধু হিসাবে আমাদের গ্রহন করে।প্রচন্ড সেলিং হচ্ছিলো।কিছু কিছু গোলা ভারতের মাটিতেও পরতে থাকে । তখন আমরা ও ভারতীয় বি এস এফ একসাথে ফায়ার করতে থাকি। ফায়ার শেষে আমরা কোন দিকে যাবো কোন নির্দেশনা না পেয়ে সাবরুম বাজারে একটা চায়ের দোকানে বসেছিলাম। আনুমানিক রাত্রি সাত ঘটিকার সময় মাইকে ঘোষনা হয় যে,"সকল বাঙ্গালী সৈনিক বাজারে এদিক ওদিক আসেন সবাই পাকা রাস্তা চলে আসেন" সকলে পাকা রাস্তাই আসার পর ভারতীয় বাহিনীর সেনাবাহিনীর শক্তিমান গাড়ী,লরি,করে প্রাই ত্রিশ মিনিট চলার পর এক জাইগাই গাড়ী থামে। সেখানে অনেক চেনা জানা মানুষের সাথে দেখা হয়।জানতে পারলাম এটি এক নম্বার হেড়কোয়াটার এলাকার নাম হরিণা। ২৫শে এপ্রিল সকালে আমরা সবাই ফলিন হয়। সেক্টর এডজুটেন্ট আদেশ যে,আজ সন্ধার ভিতর নিজেদের থাকার জন্য টিলা কেটে জঙ্গল পরিক্ষার করে ঘর তৈরি করতে হবে। যে কথা সেই কাজ।ভারত সৈনের গেতি বেলচা দিয়ে কাজ শুরু। ২৬শে এপ্রিল সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়া ক্যাম্প এলাকা পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন যে আমার একটি স্পেশাল ভলেন্টিয়ার প্লাটুন দরকার ,এই প্লাটুন ফেনী সোনাপুর যাবে একটি বিশেষ অপারেশনে যাবে। যদি ওই এলাকার কেও থাকে তাহলে ভালো হয়।আমরা কয়েকজন লাইন হতে আগে আসলাম,মেজর জিয়ার নির্দেশ মোতাবেক তালিকা তৈরি করা হয়। অর্ডার হলে এই দল সি টাইপ অস্ত্র সহ রেডি থাকবে।আদেশ পাওয়ার সাথে সাথে জেন এরা মুভ করতে পারে। ২৭এপ্রিল একজন ক্যাপ্টেন(নাম মনে নাই) সাথে মেজর জিয়া সাহেব ব্রিফিং করেন যে,এই দল নোয়াখালী জেলার ছাগল নাইয়া ও ভারতের আমলী ঘাট বি এস এফ বি ও পি তে যাবে। সেখান থেকে গাইড এর সাহয্যে বাংলাদেশে গাইড এর মাধ্যমে প্রবেশ করবে। আদেশ পাওয়ার পর বিকাল বেলা অস্ত্র সহ শক্তিমান লরি তে করে রাত্রি আনুমানিক ৭টার দিকে আমলীঘাট বি ও পি তে পৌছায়। খাওয়ার পরে দেখি যে মেজর জিয়া ও লেঃঅলি আমাদের একজন গাইড দিলেন এবং বললেন যে,এই দল ফেনী সোনাপুর গ্রামে একজন কুমিল্লা সেনানিবাসে বন্দি ডাক্টার ক্যাপ্টেন এর ফ্যামিলি কে উদ্ধার করতে। সেকশন কমান্ডার নায়েক বশির ই পি আর এর নেতৃত্বে চলা শুরু করলাম গাইড এর পিছনে। মেঘলা রাত রাস্তা ঘাট কাদাময় ,চলতে চলতে ভোরের আযান শুরু হয়। আমরা চলা বন্ধ করে নিরাপদ স্থানে অবস্থান নিই।আকাশ পরিষ্কার হলে একটি টিনের খালি বাড়ির ভিতরে আমরা অবস্থান করি। গাইড বলে যে,এই গ্রামে কোন জনগন নেই সবাই ভারতে চলে গিয়েছে । আমরা নিজেদের গোপনীয়তা রক্ষা করে পাহারাই থাকি আনুমানিক আড়াইটার দিকে খাবারের ব্যাবস্থা হয়। সবাই খাবারের জন্য রেডি হয়,এমন সময় সি এন্ড বি রোডের দিক হতে এলোপাতাড়ি ফায়ার শুরু হয়। আমরা খাওয়া ফেলে ওই স্থান ত্যাগ করি।ফেনী নদীর পাড়ে আড় দেখে অবস্থান নিই এবং দশ দিন ওই এলাকাই থাকি। এবং বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করি।কিভাবে টারগেটে পৌছানো যাই। আমাদের গাইড আগেই পালিয়ে গিয়েছিল। ৬মে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা বেলা ওই বাড়িতে পৌছাই এবং বাড়ির মালিক চাচা কে সবকিছু খুলে বলি। তিনি আমাদের খাওয়া থাকার ব্যাবস্থা করে।আমরা ওই রাত্রের মধ্যেই ছাদের উপর এল এম জি পোস্ট সহ নিচে ব্যাংকার তৈরি করি। ৮ মে পাক বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার আমাদের পজিশনের উপর দিয়ে উড়ে যাই। এল এম জি বসানোর আগেই হেলিকপ্টারটি রঞ্জের বাহিরে চলে যাই। পুনরায় আসবে এই আশাই এল এম জি তাক করে বসে থাকি। বিকাল বেলা গ্রামের কয়েকজন মুরুব্বি আসে এবং বাড়ির মালিক চাচার সাথে আলাপ করে , তারা বলে যে, মুক্তিযোদ্ধারা আসার পরেই পাকিস্থানী হেলিকপ্টার আমাদের এলাকাই আসে মনে হয় তারা আবার আসবে। মনে রাখবেন আপনার ব্যাক্তিগত শুবিধার জন্য যেন আমরা অসুবিধাই না পড়ি। মুরুব্বিরা বিদায় হলে চাচা বলেন, "বাবাজিরা হোন হেতারা আইয়া এখখানা অভিযোগ করচে বুজেন্নি, গা গেরামের ব্যাপার বুজেন্নি আন্নারা অ্যার তুন জানগা আল্লাহ ভরসা হেতি যা করেন অ্যাঁয় নো চাই আমার তুন গেরামের ক্ষতি হয়"। তিনি আমাদের উপর ছেড়ে দিলেন যা করার তাই করেন।আমরা চাচা কে বুঝালাম গ্রামের লোক অনেক কিছু বলবে। চারিদিকে সংবাদ নিই কোন দিকে যাবো। ১২মে সকাল থেকে আকাশ অন্ধকার সাথে বৃষ্টি ।আমরা সবার ঘরে বসা ,এমন সমইয় একটা ছেলে সংবাদ দেয় ফেনী দিক থেকে পাক সেনারা আসছে। আপনারা ঘেরা পড়েছেন।সাথে সাথে আমরা বাড়ির সকল কে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে জাই। হাটতে হাটতে সি এন্ড রোড ক্রস করার সময় আমাদের উপর ফায়ার আসে ।আমাদের জানা ছিল সি এন্ড বি রোড মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। আমরা আওয়াজ করি জয় বাংলা বলে কিন্ত ফায়ার কিছুতেই থামে না । শেষে আমরা সামনে অগ্রসর না হয়ে পিছনে এসে আড় নিয়ে অপেক্ষা করি। কিছুক্ষন পরেই দূর পাল্লার আর্টিলারী ফায়ার শুরু হয় ফেনীর দিক থেকে । তখন আমরা নিরাপদ মনে করে যাত্রা শুরু করি।কিছুক্ষন হাটার পরেই সি এন্ড বি রোড ক্রস করার সময় আমরা ফায়ারের মধ্যে পড়ে যাই। তখন সঙ্গিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই।খুদ্র অস্ত্রের সাথে টু ইঞ্চি মর্টার ফায়ার হচ্ছিলো। এই সময় আমার বাম পায়ে রানে সামনের দিক থেকে আসা গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে পিছন দিয়ে, বার হয়ে যাই সেই সাথে মর্টারের স্প্রিন্টার বা পায়ের গোড়ালী ও পিঠে লাগে । আহত অবস্থা জনগন ও আমার সাথীরা আমাকে আমলীঘাট বি ও পি তে নেয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার পর মেজর জিয়ার আদেশক্রমে আমি সহ কয়েকজন আহতকে আগরতলা জি বি(গোবিন্দ বল্লব)ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাড়িতে হাসপাতালে পাঠাই। রাত বারোটার দিকে পৌছালে ওটি তে নিয়ে ক্ষতস্থান গুলো পরিষ্কার করে ব্যান্ডিজ করার পর ওয়ার্ড এ নেওয়া হয়। আমরা যে ওয়ার্ড এ ছিলাম সেই ওয়ার্ড স্পেশাল মুক্তিযোদ্ধা ওয়ার্ড নামকরন কারা হয়। আমার বেড নম্বার ছিল এক্সট্রা ।জি বি হাসপাতালে একমাস চিকিৎসা নেওয়ার পর ডিসচার্জ করলে এক নং সেক্টর হেড কোয়াটার হরিনায় যাই। সেখানে এক সপ্তাহ থাকার পর পুনরায় ক্ষতস্থানে পুঁজ জমে এবং যত্রনা শুরু হলে আগরতলা হেড কোয়াটার বি ডি এফ আসি। পরেরদিন জি বি হাসপাতালে আউট ডোর রুগী হিসাবে ক্ষতস্থান দেখাই। ডাক্টার ভৌমিক চৌধুরী বলেন যে,দুই দিন পর পর ড্রেসিং করাতে হবে এবং মেডিসিন খেতে হবে। কয়েকবার এইভাবে জি বি হাসপাতালে যায়। ১৫ই মে ভারতের প্রধান মত্রি ইন্দিরা গান্দী আগরতলা শরনার্থী শিবির পরিদর্শন করতে আসলে ওইদিন তিনি, মুক্তিযোদ্ধা স্পেশাল ওয়ার্ড পরিদর্শন করেন।তিনি প্রতিটি রুগীর সাথে দেখা করেন। প্রধান মন্ত্রির সাথে দেশ বিদেশের গন্য মান্য ব্যাক্তিরা ছিলেন।এইটা তখন ভিডিও হচ্ছিল। হেড কোয়াটার বি ডি এফ এর অবস্থা ছিল ৯৩ বি এস এফ হেডকয়াটার এলাকাই(শাল বাগান ও গান্দী গ্রাম) হেড কোয়াটার বি ডি এফ সেনাপতি আতাউল গণি উসমানী থাকতেন। ওইখানে একটি হাসপাতাল ঘঠন হয়।বিভিন্ন সেকটর এর যুদ্ধ ক্ষেত্র হতে নিহত ও আহতদের আনা হত। বি ডি এফ হেড কোয়াটার ট্রানজিট হিসাবে ব্যাবহার হতো।আমরা আহতরা হালকা কাজ করতাম । মাঝে মাঝে খুব ব্যাথা করতো এবং এর ফাঁকেই দুই সপ্তাহ ভারতীয় সেনাবাহিনীর আর্টিলারী রেজিমেন্ট এর, মর্টার প্লাটুনে ৮২ এম এম মর্টার প্রশিক্ষন গ্রহন করি । এক সময় পায়ের অবস্থা খুবই খারাপ হয়। তখন হেড কোয়াটার বি ডি এফ হাসপাতালে ১৮-০৬-১৯৭১ তারিখ হতে ২০-১০-১৯৭১ পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়। বি ডি এফ এডজুটেন্ট রোল কলে বলেন যে,আহতা যারা এইখানে আছে তারা সকলে যে যার সেক্টর তালিকাই নাম থাকবে। এই আদেশ হবার পর আমি আর সেক্টর হেড কোয়াটারে যাইনি। দেশ স্বাধীন হবার পর জেনারেল উসমানী সহ বি ডি এফ হেড কোয়াটার এর সাথে কুমিল্লা হয়ে ঢাকা সেনানিবাসে আসি। কয়দিন থাকার পর আদেশ হয় সবাই এক সপ্তাহের জন্য বাড়ি যেতে পারবে। ঢাকা হতে বাড়ি আসতে তিন দিন সময় লাগে। বাড়ি ফেরার পথে দেখি রাস্তাঘাট,গ্রামগঞ্জ সবকিছুই বিদ্ধস্থ। গ্রামে আসলে সবাই দেখতে আসে এবং সবাই জানতে চাই কিভাবে গুলি লাগে এবং কিভাবে আমার চিকিৎসা হয় আমি কোথাই কিভাবে ছিলাম ইত্যাদি। এরপর আমি ২৯ বছর কোর অফ ইঞ্জিনিয়ারস এ চাকুরীর মেয়াদ শেষ করে সিনিয়ার ওয়ারেন্ট অফিসার পদে অবসর গ্রহন করি।

আরও ছবি

ভিডিও