যুদ্ধের ইতিহাস
বর্তমান স্থায়ী ঠিকানা-৭ নং সেক্টর রাজশাহী। সেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন
১।আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ওমর আলী। পিতা-মৃত রাহাত আলী সরদার। গ্রামঃ আহম্মদপুর, ডাকঘরঃ রাকসা, উপজেলাঃ লালপুর, জেলাঃ নাটোর। আমার এক স্ত্রী। ছেলে ৪ জন, মেয়ে ১ জন মোট ছেলে মেয়ে পাঁচজন।
প্রশ্নঃ আমি কেন মুক্তিযোদ্ধে অংশগ্রহন করলাম।
উত্তরঃ ১৯৭১ সালে আমি একজন এসএসসি পরীক্ষাথী। ১৬ এপ্রিল আমার পরীক্ষার তারিখ। ১৭৭১ সালে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান ভাষণ দিলেন.................. তিনি বন্দী হইয়া পাকিস্থানে চলিয়া গেলেন। আমার মনের অবস্থা খুবই খারাপ হইয়া গেল। পড়া লেখার প্রতি মন উড়িয়া গেল। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ সকাল বেলা গোপালপুর দের দের টেউ টের ভমভম হঠাৎ আওয়াজ শুরু হল। গোপালপুর নথ বেঙ্গল সুগার মেলে পাকিস্থান সেনাবাহিনী আছিয়াছে। দেখে মানুষ দলে দলে লাঠি বললভ যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে গোপালপুর দৌড়াইতেছে। আমি ও লাঠি নিয়ে দোড়াইলাম। গোপালপুর দেখি লক্ষ লক্ষ মানুষ পাকিস্থান সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত। সারা দিন সারা রাত যুদ্ধ হল। সেটার নাম ময়নার যুদ্ধ নামে খ্যাত। সে যুদ্ধে পাকিস্থানী সেনা একটাও ফেরত যাইতে পারে নাই। দেশের পরিস্থিতি অত্যান্ত ভয়াবহ রুপ ধারণ করল। সারা দেশে যুদ্ধ অার যুদ্ধ। বাঙ্গালী ইজিতার পুলিশ কয়েক দিন যুদ্ধ করার পর আর কুলাইতে পারে নাই। এই ভয়াবহ অবস্থায় ভারত বডার খুলিয়া দিল। বাংলার হিন্দু, খ্রীষ্টান বাড়ী দরে ত্যাগ যাইতে শুরু করল। দেশে লূটপাট রাহাজানী শুরু হইয়া গেল। মানুষের ভিতর আতংক শুরু হইয়া গেল। কে কোথায় যাবে কোথায় পালাবে অশান্তি সৃষ্টি হইয়া গেল। ১৯১৭ সালের মে মাসের দিকে আমার পিতা আমাকে বলল হে ওমর বাপ চল পালপাড়া থেকে হিন্দুরা সত ছার বাড়ী ছেড়ে চলে গেছে মরা বাঁশ খুড়ির জন্য কেটে নিয়া আসি। আমি বললাম বাবা চল যাই। বাপ বেটা দাও নিয়ে গেলাম বাঁশের খড়ি কাটতে। বাঁশ ঝাড়ের ভিতর যাইতেই বাবা বলল যে পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর গাড়ি। পুরুষ মহিলা ছেলে মেয়ে যে যেখানে পারছে পালাইতেছে। অামরাও পালাইলাম। সেই গাড়ি ঈশ্বরদী বিমান বন্দর হইতে আশিয়া ছিল। আমি লুখ করে উকি মেরে দেখি যে, গাড়িটা থামলো। পাশে এক খাদে কয়েক জন মেয়ে মানুষ লুকাইয়া ছিল। তাদেরকে ধরে ধরে বাড়ির ঘরের ভিতরে নিয়ে যাইতেছে। মহিলারা ওদের কাছে অনেক অনুনয় বিনয় জানাইতেছে। না শুনিয়া জোর করে নিরজাতন করে। ঘন্টা খানেক পর পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী গাড়ি নিয়ে যায়। মা-বোনদের এই অত্যাচার আমার মনে অত্যান্ত খারাপ লাগল। মনে এই ঘৃণা ঘোষণা করলাম। মনে মনে স্থির করলাম। আমাকে এর প্রতিশোধ নিয়ার চিন্তা ভাবনা করতে হবে। বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র হইতে মুক্তিযুদ্ধের কথা গেরিলা যুদ্ধের কথা শুনতে পাইলাম। আমার মনে সদা সবদা উত্তাল পাত্তাল হয়ে যাচ্ছে। আমি পাক হানাদার বাহিনীর সাথে গেরিলা যুদ্ধ করতে পারতাম। আমার মা-বোনদের নিজাতন থেকে বাঁচায়তে পারতাম এবং দেশ স্বাধীন করতে পারতাম আমার মনে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। আমার চাচাত ভাই ঈশ্বরদী বিমানে চাকরী করতেন। ভাইয়ের বন্ধু সেও বিমানে চাকরী করতেন। সেই ব্যক্তি বিনিময় করে এ দেশে আসেন। ভারতে আত্মীয়-স্বজন ছিল। ভাইয়ের বন্ধু আমার চাচাত ভাইকে বললেন বাংলাদেশে আর থাকা যাইবে না। চল ভারতে যাই। আমি সুযোগ পাইলাম তাদের সাথে ভারতে যাইবার। আমি ভারত গেলাম। সেখানে তাদের সাথেই রেশম কাড পাইলাম এবং থাকার জায়গাও পাইলাম। খাই আর জলংগি বডারে দূরে বেড়াই। আমার সাথে চাচাত ভাই শামসুল হক ছিল। একদিন আমরা দুই জলংগি বাজারে ঘুরছি। হঠাৎ দেখি যে, আব্দুর রাজ্জাক ভাই, রহমান ভাই, আবুল কাশেম, আসমত আলী, রব্বেল ভাই ও আব্দুল মজিদ ভাই এদেদের সাথে দেখা হইল। আব্দুর রাজ্জাক ভাই বলল তোরা এখানে কি করছিস। আমি বললাম আমরা দুই ভাই রেশম কাড করছি। ঘুরি বেড়াই আর খায়। রাজ্জাক ভাই বলল আমাদের এস.পি জিল্লুর ভাইকে চিনিস। আমি বললাম নাতো। আমাদের এস.পি জিল্লুর রহমানের খোজ করে। বাসায় পাইলাম এস,পি সাহেবকে বললাম। মুক্তি যুদ্ধের ট্রেনিং কোথায় হচ্ছে। আপনার জানা আছে কি ? আমরা মুক্তি যুদ্ধের ট্রেনিং করব এবং দেশ স্বাধীন করব। তিনি বললেন হা জানা আছে। আমরা বললাম আর এক মূহুত দেরি না করে তাড়াতাড়ি বলুন আমরা এখই চলে যাব। এস,পি সাহেব আমাদের লিষ্ট বানালো এবং তার সীল মোহর মেরে সাইন করল ক্যাম্পের নাম লিখ দিল। ননদি ভিটা ,সোহা পাড়া, পানিপিয়া এই তিন ক্যাম্পের কথা লিখি দিল আমরা ক্যাম্পে চলে গেলাম। মুক্তি যুদ্ধের ট্রেনিং শুরু করলাম। আমার মনের আসা পূরণ হইল। পানিপিয়া ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন ক্যাপ্টেন শরমা ভারতীয় সেনাবাহিনী অসিমার। আমাদের বাংলার ওস্তাদ ছিলেন ই,পি আরের নায়েক এমদাদ, হাবিলদার গুনজুর নায়েক রফিজ। ২ মাস বাশের লাঠি সোটা দিয়ে ব্যাছিক ট্রেনিং হইল।
তারপর পানিপিয়া ক্যাম্প হতে বহরমপুর ট্রেনে রওয়ানা হয়ে যাইতে ছিলাম। কল্যাণপুর ষ্টেশনে ট্টেন থামলো। কল্যানপুর বিমান বন্দরে অামরা একদিন থাকিলাম। পরের দিন আবার ট্রেনে উঠিলাম। এবার বিহার প্রদেশের বিরভম জেলার চাকুলিয়া বিমান বন্দরে ট্রেনিং সেন্টারে পৌছলাম। সেখানে এক মাস অস্ত্র ট্রেনিং করলাম। চাকুলিয়া বিমান বন্দরে অস্ত্র ট্রেনিং শেষ আবার ট্রেন যোগে রওনা হইলাম। লাল গোলা মুক্তি যোদ্ধা অপারেশন ক্যাম্পে মেজর গিয়াজ উদ্দিনের নিকট আসিলাম। সেখানে মেজর গিয়াজ উদ্দিন সাহেব আমাদের অস্ত্র গোলা বারুদ সহ অপারেশন করার জন্য গেরিলা যুদ্ধ যার নাম (হিট এবং রান) যার অথ আঘাত কর এবং জীবন বাঁচাইয়া পলাও। আমাদের নৌকা যোগে পদ্মানদী পার করিয়া দিতেন। এপারে আসিয়া আমরা পাকিস্থান সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে আঘাত হানিতাম কোন কোন সময় রাজাকার মুজাহিদের ক্যাম্পে আঘাত হানিতাম।এভাবে যুদ্ধ করতে করতে আমরা মেজর গিয়াজ সাহেবকে বললাম স্যার এভাবে আমরা যুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করতে পারা যাবে না। তিনি বললেন তাহলে আপনারা বলুন কি ভাবে যুদ্ধ করতে হবে। আমি বললাম স্যার সমস্থ শহরে যুদ্ধ করতে হবে। এতে হয় আমরা জীবন দেব না হয় আমরা জয়লাভ করব। তিনি বললেন ভাই তোমার কথা ঠিক তবে আমার ক্যাম্পে ৬ হাজার লোক পুরো না হওয়া পযন্ত সম্মুখ শহরে যাওয়ার মতো কোন রাস্তা নাই।যখন ৬ হাজারের উপরে লোকজন পুরো হইল। সম্মুখীন যুদ্ধের জন্য আমরা লালগুলা ক্যাম্প ত্যাগ করিলাম। তারিখ আমার মনে নাই নভেম্বর মাস ১৯৭১ সাল। আমরা চাপাইনবাবগঞ্জের হাসেমপুর ক্যাম্প করিলাম। সেখানে পাকিস্থান সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। কয়েক দিন যুদ্ধ করার পর আমরা চাপাইমুক্ত করিলাম। এই যুদ্ধে আমাদের ৬৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয় এবং ক্যাপ্টেন নিহত হয়। চাপাই মুক্ত করার পর আমরা বিরত্বের সাথে রাজশাহীর দিকে সামনে অগ্রসর। এর মাঝে ছোট খাট অনেক অপারেশন হলো। ডিসেম্বরের ১০/১১ তারিখের দিকে আমরা রাজশাহী জোহা হলে অবস্থান করিলাম। জোহা হলে অবস্থান কালে মেজর গিয়াজ সাহেব পুরাতন সেনাবাহিনী ইজি আর পুলিশ যারা ছিল তাদেরকে রাখিয়া দিলেন। আমরা যাহারা ছাত্র,শ্রমিক,মাষ্টার ছিলাম। আমাদের মেজর সাহেব বললেন আপনারা যার যার জায়গাই যাইয়া অপারেশন করেন। তাই আমাদের আব্দুর রউপ ভাইকে পল্টুন কমান্ডার নিযুক্ত করে আমরা জায়গাই আসিলাম।১১ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে আজীমনগর আক্রমণ করলাম। সেখানে বিহারী মুজাহেদের সাথে যুদ্ধ করে অনেক অস্ত্র গুলি সংগ্রহ করলাম এবং পরের দিন ঈশ্বরদীর দিকে রওনা করি।আজীমনগর এবং ঈশ্বরদীর মাঝখানে একটা রাজাকার মুজাহিদের ক্যাম্প অপারেশন করিলাম এবং সেখানে কিছু অস্ত্র গোলাবারুদ সংগ্রহ করিলাম। ১৬ ডিসেম্বর জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করিলাম। ৭নং সেক্টর রাজশাহী। সেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন।
ইতি
মোঃ ওমর আলী
গ্রামঃ আহম্মদপুর
ডাকঘরঃ রাকসা
উপজেলাঃ লালপুর
জেলাঃ নাটোর।