স্বাধীনতার আগাছা

মোসাম্মৎ নাজমা সুলতানা

ঘাস কাটার নিড়ানি দিয়ে ক্ষেতের দুব্বা ঘাস আর আগাছা নিড়িয়ে যাচ্ছে আমজাদ একমনে। একটু তাড়াও আছে। রৌদ্রের তাপ একটু প্রখর হলে। কাজ করা কষ্ট দায়ক হয়। তাই, ফজরের নামাজ পড়ে কালো আঁধারের বুকে। সকালের স্নিগ্ধতা এসে যখন শান্তির সুবাতাস ছড়ায়। তখনই গরু আর লাঙ্গল কাঁধে নিয়ে। ক্ষেতের পানে ছুটেছিল মাটির আর ঘাসের সনে খেলা করতে। কি যে নেশা এই খেলায়! তা শুধু আমজাদের মতো কৃষকরাই অনুভব করে। ধানের চারা অংকুরিত হওয়ার পর হতে শুরু হয়। এই খেলার মাদকতা।

সকালবেলা পাঁচ -দশ বছরের শিশুদের স্কুলের হতে জিলাপি হাতে ফিরতে দেখে। আধো মাখো চেহারায় সারল্যের সুর্যের হাসিতে মন ভরে গেল। মনে পড়ে গেল, আজ হতে তিপ্পান্ন বছর আগের দিনগুলির কথা। বয়স তখন কতই বা! এই আট কি নয় হবে। একাত্তর সালের সংগ্রামের বছর। চারিদিকে গোলাবারুদের গন্ধ। মানুষের লাশের উপর লাশ পরে থাকত হেথাহোথা! কি বিভৎস দৃশ্য আর ভয়ংকর দিন ছিল সেই দিন গুলি। বাঁচার জন্য সে কি চেষ্টা! ঘর ছেড়ে মাটির গর্তে লুকোতে হতো মরণের আজরাইলকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য। মা -বোনের ইজ্জত নেয়া ছিল মানুষ রূপি হায়েনাদের কাছে নিত্য সখের খেলা!যুবকের রক্ত ছিল তাদের হোলিখেলার আবীর! শিশুদের কান্না ছিল রক্ত খেকো শেয়ালের উম্মাদনার সুর!

যে বাড়ির পাশ দিয়ে যেত। আগুনের খেলায় মেতে উঠত পাষবিক নৃত্যের সুখে। পূর্ব পাকিস্তান মানে বাঙালিদের মানব দেহ ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানীদের বেয়োনেটের আগায় এফোড় ওফোড় করার পুতুল! কি নিষ্ঠুর ছিল সেই কর্মকাণ্ড গুলো। আজো মনে পড়লে হৃদ-আত্মা কেঁপে ওঠে। ভয় ভর করে চোখের পাতায়।

যখনই পাকিস্তানিরা চার তলা সাদা সীপে করে আসত। জাহাজের ভেপুর আওয়াজে কলিজায় বরফ জমে যেত সবার। কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে ছুটোছুটি করতো। হাতের মুঠোয় ধরা জানটাকে লুকোতে। বিশাল ধান ক্ষেতের আঁড়ালে লুকোত দাদি,মা, ফুফুরা। হাঁটু পরিমাণ পানি তোয়াক্কা করে আমন ক্ষেতে। কারণ, একটা দোষ ছিল ঐ বর্বর পাকিস্তানিদের। এরা পানিতে নামতে ভয় পেত। কখনো কখনো হানাদারদের আগমনের ধ্বনি বুঝতে দেরি হলে। ঘরে পিছনে গোবরের গর্তের পাশে মাটি খঁড়ে রেখেছিল। সেখানে যত জলদি পারতো লুকিয়ে যেত। যেন ধরে প্রাণ ফিরে পাওয়া যায় কোনো রকমে!

একবার হয়েছিল কি! এদেশের বিশ্বাস ঘাতকদের দল, যাদের পাকিস্তানি দালাল বলা হয়। তাদের সহযোগিতায় হানাদাররা গ্রামে হামলা চালায়। গ্রামবাসী তো ঘুমের পুরীতে ঢুলতে ছিল। হঠাৎ রাত বারটায় দরজায় চপেটাঘাতের শব্দ। ভীত ও দুরু দুরু বুকে কিছু বুঝার আগেই দরজা ভেঙে ঘরে হানাদার বাহিনী।

হানাদার বাহিনী -" মুক্তি কাহা হ্যায়, বল্, কুত্তাকা বাচ্চা? "

এভাবে বাড়ির সকল ঘরে হামলা করে। এরমধ্যে এক বুড়ি দাদীর ঘরে হামলা করে। কাউকে না পেয়ে দাদীকেই নির্মম ভাবে হত্যা করে। ঘরের দরজায় টেনেহিঁচড়ে ফেলে রেখে যায়। রাজাকাররা জানতে পেরেছিল। দাদীর ঘরে মুক্তিবাহিনীদের খাওয়ানো হয়। বিশ্রাম নিতে থাকতে দেওয়া হয়। আমজাদরা জানত দাদীর ভাইয়ের ছেলে ও নাতিরা বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। এরাই যে মুক্তিযোদ্ধা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারি নি। পুরো বাড়ির কয়েকজন বাদে বাকি সবাই।

রাজাকারের যে শকুনি চোখ আছে, তা এ ক'জন বুঝতে পারে নি। তাই, নির্দয় ভাবে মরতে হলো ফজিলা দাদীকে। দরজায় কড়াঘাত করেই। হানাদার অফিসারের বুটের আঘাতে দরজার ভেঙে যায়। ভিতরে ঢুকেই দেখে ফজিলা দাদী কাঁথা মুড়ে শুয়ে। বুকের ধকধকানি থামানোর জন্য চেষ্টা করছেন কাঁথার নীচে। পাকিস্তানি অফিসারের চিৎকারে সম্বিত ফিরে পান।

হানাদার -" শুয়োর কা বাচ্চা, মুক্তি কাহা হ্যায়, বোল্? "

ফজিলা দাদী -" আমি জানি না। "

অফিসার -"তুম নেহি জানতা? "

ফ -" জানি না " ( এক রোখা জিদ্দি গলায়)

অফিসার -" নেহি জানতে,নেহি জানতে? হামকো এ মূলক ছাড়া করগায়া? শালা, বান্দির বাচ্চা, বোল্,মুক্তি কাহা? মুক্তি কাহা,? "

ফজিলা -" জানি না। তোদের এদেশ ছাড়া করবেই আমাদের ছেলেরা। তোদের দিন শেষ। বহুত জ্বালিয়েছিস। দোয়া করি, তোরা মর্! তোরা মর্! "

অফিসার - " কি বলতা হ্যায়! হামকো মারেগা? হামকো মারেগা। হাম মুক্তি মারেঙা। তুমকো সব জওয়ান মারেঙ্গা। পীপিলিকার মতো মারেঙ্গা। ঐ নদী ভর দেয়েঙ্গা তোমারি জওয়ানদের লিয়ে। বোলো, মুক্তি কাহা হ্যায়? "

ফজিলা -" বলেছি তো, জানি না। জানি না। কতবার বলবো,জানি না। তোরা আমাদের জওয়ানদের মেরে ফেলতে পারলে। নিজের জান বাঁচাতে

ভয় পেয়ে আমার কাছে জানতে আসতি না। তোরা যে কত ভালো মুসলমান! তা আমরা হাড়ে হাড়ে চিনেছি। আমাদের ছেলেরা যে তোদের মারতে বন্ধুক হাতে ধরেছে। এতেই, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া! "

ফজিলা দাদীর কথা শেষ না হতেই। বারুদের গুলি একটা দাদীর কণ্ঠ থামিয়ে দেয়। দাদী গরগর করে গোঙাতে গোঙাতে। বাঙলার স্বাধীনতার আলো দেখতে-দেখতে। চোখ খোলা রেখেই শহীদ হন।

আসলে,সেদিন দাদীর ঘরে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। উনারা লুকিয়ে ছিল পাশের ঘরের চাউলে বড় ঢোলার ভিতর। যা ঘরে চোখ ফেললেই দেখা যায় না। ঢোলাটা দাদী বুদ্ধি খাটিয়ে একটু একটু করে। প্রতি রাতে ঢোলার চেয়ে এক হাত উপরে পর্যন্ত খুঁড়ে। সেই বাঁশের বড় ঢোলা মাটির নীচে লুকিয়ে রাখেন। যে কোনো সময় যেন মুক্তিরা যেন লুকোতে পারে!

উপরে বাঁশের ঢাকনায় মাটির লেপ। কারো বুঝার উপায় নেই, নীচে মাটির বিশাল গুহা!যেখানে অনায়াসে পাঁচ -সাত জন মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে।

আমজাদদের ঘরে এসে পুরুষ কাউকে না পেয়ে। আমজাদের বড় বোন আসমা। যে উঠতি বয়সী। তাকে পেয়ে সারা বাড়িতে মুক্তি না পেয়ে। মনের ব্যর্থতা মিটায়। তার মায়ের সামনে মা-মেয়েকে একসাথে ধর্ষণ করে। এমনটা বাড়ির অন্যান্য ঘরেও করেছে। যে সব উঠতি বয়সী ছেলে ছিল। তাদের ধরে নিয়ে যেয়ে। নদীর পাড়ে দাঁড় করায়। তাদের কাছেও জানতে চায়, কোথায় মুক্তিযোদ্ধার আস্তানা!

মূলত, তারা মুক্তিযোদ্ধাদের আস্তানা চিনতো না। গোবেচারা আকৃতির। হানাদাররা বিশ্বাস না করলেও। এদেশের রাজাকাররা নিজেদের কৃতিত্ব বোঝাতে। সেই সাথে পা চেটে নিজেদের ফায়দা লুটতে। নিরপরাধ উঠতি যুবক,বৃদ্ধ -আবালদের মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়।

নদীর উপর দাঁড়িয়ে থাকা চার তলা সাদা জাহাজ থেকে বয়ে আনা হয় এক বড় বাক্স। সেই বাক্স রাখা হয় চোখ বাঁধা অপরাধীদের সামনে। আমজাদদের মতো শিশু বাচ্চাদের সামনে খোলা হয় বাক্সের ঢালা। ভিতর হতে বের হয় লম্বা বাক্স। নীচের যন্ত্রের সাথে সেটা লাগিয়ে দেওয়া হয়।যন্ত্রের এক পার্শ্বে চাপ দিতেই। লম্বা খোলস খুলে বেরিয়ে আসে সাদা ধারালো লম্বা তলোয়ার। আরেক বোতামে চাপ দিতেই লম্বা ছুরি চোখের পলকে সামনে এগিয়ে। নিমিষে কেটে ফেলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গোবেচারাদের মস্তিস্ক। মাথা তিন হাত দূর নদীর কোলে। আর, দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল। শুধু যন্ত্র চালিত করার আগে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুদের দূরে সরে যেতে বলা হয়েছিল। কোন এক অদৃশ্য তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সহযোগিতায়! যেন জীবন্ত রাজ সাক্ষী থেকে যায় এই ঘৃণিত কুকর্মের! যদিও তার প্রয়োজন ছিল না। কেননা, এই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি কর্তা "ছাড় দেন ছেড়ে দেন না!"

তারপরও কিন্তু তো থেকেই যায়।

যারা ইতিহাসে চাক্ষুষ রাজসাক্ষী হিসেবে বেঁচে থাকে।তাদের মাঝে আমজাদ একজন।

যুদ্ধ জয় করে বাংলাদেশ নামে পরিচিত হয় এই মূলক! তার বড় বোন পনের বছর বয়সে এতো গুলো হায়েনার নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে। সপ্তাহ খানেক কাঁতরাতে-কাঁতরাতে মারা যায়।

এতো বছর পরে সেই পুরোনো অতীত ভাবতে-ভাবতে। শরীরে অজানা কষ্টের শক্তি অনুভব করে। সর্বশক্তি প্রয়োগ করে আগাছা দূর করে। যা ক্ষেতের মাটির জন্য ক্ষতিকর। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি পেয়েছে একাত্তর সালে। কিন্তু, দেশ আজো স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। তার বোন, দাদী, যোদ্ধারা শাহীদি মরণে স্বীকৃতি পেয়েছে কাগজে-কলমে। কিন্তু, বাস্তবে, বর্তমানের রাজাকারেরা বৃদ্ধা আঙ্গুলী দেখিয়ে যাচ্ছে প্রতি পরতে-পরতে! উচ্চ হাসিতে প্রমাণ করছে একাত্তরের জীবন দানকারীদের ব্যর্থতা! নিড়ানির আঁচড়ে যা উপরে ফেলতে চাচ্ছে আমজাদ স্বাধীনতার আগাছা।