বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান তরফদার (আজিজ বাঙ্গাল) এর স্মৃতিচারণা

বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান তরফদার (আজিজ বাঙ্গাল)

আমাদের ইতিহাস একদিনে আসেনি এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ইতিহাসও একদিনে শুরু হয়নি। আমাদের এই দেশটা একসময় যখন স্বাধীন হয় ব্রিটিশ এবং ভারতের কাছ থেকে তখন আমাদের পিতামাতারা তখনকার সময়ে আন্দোলন, যুদ্ধ এবং সংগ্রাম করে পাকিস্তান নামের একটি দেশ সৃষ্টি করেন। আমাদের দেশটি পাকিস্তান থেকে শুরু করে ২৩ বছরের ইতিহাস দেখলে বোঝা যায় আমাদের এই দেশটি ছিলো নিষ্পেষিত, আমাদের দেশের মানুষ ছিলো অধিকারবিহীন। তারই মধ্য থেকে একটি মানুষের জন্ম হয়, সর্বপ্রথম আমার এই বক্তব্য দেওয়ার পূর্বে তাকে স্মরণ না করলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হয়তো বলা হবেনা, লেখা হবেনা, তিনি হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকে আজকের এই দিনে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।

মূলতভাবে যুদ্ধটা শুরু হয় তাকে ঘিরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে নিয়ে এবং বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়েই আমরা তখন যারা ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম এবং সারা বাংলার মানুষ যারা উনার কথা, বক্তব্যে এবং রাজনীতির আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। ২৩ বছর বঙ্গবন্ধু আন্দোলন করে, নিপীড়িত হয়ে, অত্যাচারিত হয়ে, জেল জুলুম সহ্য করে এই বাংলাদেশের জন্যে আন্দোলন করেছেন এবং তারই অনুপ্রেরণায় ৭ই মার্চের ভাষণের পর সারাদেশের মানুষ আমরা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ি। আমরা তখন ছাত্র ছিলাম, বয়স ছিলো খুবই কম। ১৯৫২ সালে আমার জন্ম। আমার পিতা ছিলেন সাখাওয়াত হোসেন তরফদার, একজন স্কুল টিচার। প্রথম আমার স্কুল জীবন শুরু হয় ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী হাই স্কুলে, সেখানেই আমার স্কুলের হাতেখড়ি। পরবর্তীতে আমার বড়ভাই চাকরির সুবাদে যখন ঢাকা ছেড়ে চলে যান কক্সবাজার, তখন আমি চলে যাই ভুয়াপুরে। সেখান থেকে ১৯৬৫ সালে সর্বপ্রথম ছাত্রলীগের পতাকা তলে আসি এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাথে জড়িত হয়ে পড়ি। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে আমার প্রথম অনুভব হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, আমাদের এই বাংলাদেশ কত অসহায়। ভারতের সাথে সেই যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আমাদের পূর্ব পাকিস্তানকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন রেখে, এদেশের মানুষের কথা চিন্তা না করেই জড়িত হয়ে পরেন এবং শুধুমাত্র তাদেরকে নিয়েই চিন্তাভাবনা করতে থাকেন। সে যাই হোক, বাংলাদেশের মূলত স্বাধীনতার আন্দোলনটা ৫২ এর আন্দোলন দিয়েই শুরু। পাকিস্তানের জাতির জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যেদিন বলেছিলেন “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা” তখন একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিবাদ করে বলেছিলেন বাংলাই হবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা, এবং সেখান থেকেই আন্দোলন সংগ্রাম শুরু।

১৯৬৯ সালে আমি টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের জয়েন্ট সেক্রেটারী ছিলাম এবং কাদের সিদ্দিকী সাহেব ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। ১৯৬৯ সালে ভুয়াপুর কে স্বাধীন করার জন্যে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম রক্ত দিয়েছিলেন তিনি আমার বন্ধু  শহীদ কুদ্দুস, আমার সভাপতি ছিলেন। সম্পূর্ণ ছাত্রলীগের দেখাশুনা করতেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ সিদ্দিকী যাকে ভুয়াপুরের সবাই চিনেন। যিনি পরবর্তীতে পাসপোর্ট বিভাগের ডিজি হয়েছিলেন। তারই নেতৃত্বে এবং আহবানে সেই সময় আমরা ভুয়াপুরের সর্বপ্রথম একটি বৃহৎ সম্মেলন করি এবং সেই সম্মেলন ইসমত কাদির গামা উদ্বোধন করেছিলেন। পরবর্তীতে বীর মুক্তিযোদ্ধা সামসুল হক সেখানের ছাত্রলীগের সভাপতি হন। আমি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রয়ে যাই। মূলত তখন থেকেই আমরা বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি এবং আদর্শের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়ি।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস টাঙ্গাইলের একটি বৃহৎ অংশ স্বাধীন ছিলো যা কখনোই পরাধীন হয়নি। পাকিস্তান আর্মি যখন সারা বাংলাদেশে পাকিস্তানের টাকা বিলুপ্ত করে দিলো কিন্তু আমরা তখন সেই সময়ে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে সারা টাঙ্গাইলে ওই টাকার ব্যবহার করেই লেনদেন করতাম। প্রথম যুদ্ধে যাওয়ার ঘটনাটা হচ্ছে যখন আনোয়ারুল আলম শহিদ (তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের সাধারণ সম্পাদক) যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ঢাকা থেকে আমাদের বাড়িতে চলে আসেন। তখন খবর পেয়ে আমি এবং কুদ্দুস সর্বপ্রথম উনার সাথে আমাদের বাড়িতে যোগাযোগ করি। উনি জানান যে উনি কাদের সিদ্দিকীর অপেক্ষাতে আছেন, প্রশিক্ষণ নিতে পাহাড়ে চলে যাবেন। এই খবর জানার পর আমি, আনোয়ারুল আলম শহিদ এবং কুদ্দুস গভীর রাত্রে ভুয়াপুর থেকে নৌকায় করে সখীপুর পাহাড়ের উদ্দেশ্যে রওনা হই। জীবনের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের যাত্রায় রাত ৩টায় যখন আমরা কালিহাটি ব্রিজ পার হই তখন ওই ব্রিজের উপরে পাহারায় থাকা রাজাকারদের দল আমাদের উপর আক্রমণ করে। কেমন করে বেচে ছিলাম মনে নেই, কিভাবে পাহাড়ে গন্তব্যে পৌছালাম তাও মনে নেই। তবে আমরা মুক্ত এলাকায় গিয়েছিলাম এবং সেখান থেকেই পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। সখিপুরের আন্দি নামক স্থানে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে সেখানে আমরা ট্রেনিং নিতাম। আমাদের ট্রেনিংয়ে বলা হয়েছিলো আমরা কোথাও যুদ্ধ করতে গিয়ে সেখানে স্থায়ী হবো না, শত্রুপক্ষের যতটুকু ক্ষতি করা যায় তা করে সেখান থেকে আমরা চলে আসবো। সেখানে আমাদের প্রধান হাতিয়ারগুলো ছিলো বিভিন্ন রাজাকারদের হত্যা করে এবং বিভিন্ন থানা লুট করে পাওয়া অস্ত্রসমূহ। আমি যতটুকু জানি যে কাদেরা বাহিনী কখনো ভারতে যায়নি এবং কাদেরা বাহিনীর কোনো যোদ্ধা ভারতে গিয়ে কোনো ট্রেনিংও নেয়নি। কেবলমাত্র একবার কাদের সিদ্দিকী যখন হাতে গুলিবিদ্ধ হন তখন তিনি চিকিৎসার জন্যে সেখানে গিয়েছিলেন। এছাড়া আমার জানামতে আর কখনো কেউ ভারতে যাননি। তবে বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী একুশে পদকপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ডঃ নুরুন্নবী সবসময় ভারতে যেতেন এবং আসতেন। আমাদের বাহিনী এবং ভারতের মধ্যকার একমাত্র সংযোগস্থল ছিলেন ডঃ নুরুন্নবী।

আমরা আনোয়ারুল আলম শহীদের নেতৃত্বে সখিপুরের আন্দিতে জনাব ফারুক সাহেব, রফিক আজাদ, মাহাবুব হাসান, নূরনবী, সৈয়দ নুরুল ইসলামসহ আরো কয়েকজন মিলে যুদ্ধের জন্যে বেসরকারী ভাবে একটি হেডকোয়ার্টার অফিস খুলি। সেখান থেকে রণাঙ্গন নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হত। এর সম্পাদনায় ছিলেন রফিক আজাদ, সার্বিক পরিচালনায় ছিলেন আনোয়ারুল আলম শহীদ এবং আমরা বাকিরা লেখালেখি করতাম। একদিন কাদের সিদ্দিকি সাহেব এসে বললেন যেহেতু আমরা মুক্তাঞ্চলে বসবাস করছি সেহেতু আমাদের যোগাযোগের জন্যে একটি দপ্তর থাকা উচিত। উনার নির্দেশেই সেই যোগাযোগ দপ্তরের প্রধান হিসেবে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। সেই থেকে যুদ্ধের সমাপ্তি হওয়া পর্যন্ত আমি সেখানকার একমাত্র যোগাযোগ প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত ছিলাম। সখিপুর থেকে পাহাড়ের ৩ মাইল ভিতরে ইংরেজ নামক এক ভদ্রলোকের বাড়িতে আমাদের ক্যাম্প হয়। হেডকোয়ার্টার থেকে আমাদের ক্যাম্প পর্যন্ত গাছগাছালি ছাড়া কোনো ধরনের পাকা রাস্তা ছিলো না, কখনো যদি হেডকোয়ার্টারেও আক্রমণ হয় এরপরেও যাতে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন না হয় এবং কেউ যেনো চিহ্নিত করতে না পারে। আমি শহিদ কুদ্দুসকে নিয়ে প্রথমে সেখানেই থাকতাম। আমরা মির্জাপুরের আবু বকর সরকার, আব্দুর রাজ্জাক এদের ওয়্যারলেস গুলো সর্বপ্রথম আক্রমণ করে নিয়ে আসি এবং সেগুলো দিয়ে ক্যাম্পে আমরা যোগাযোগের জন্যে প্রথম স্টেশনটি চালু করি। আমি যদিও ওয়্যারলেসের ব্যপারে অজ্ঞ ছিলাম তারপরেও কাদেরা বাহিনীর প্রধান আমাকে বেশ কয়েকদিন হাতে কলমে কিভাবে চালাতে হবে এসকল বিষয়ে ট্রেনিং দিয়েছিলেন এবং আমি সেগুলো চালানোতে আরো ভালোভাবে পারদর্শী হয়ে উঠি।

আমাদের যোগাযোগের ক্যাম্পে দুধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন শামসু, ইংরেজ, সালাম, আবু বকর রাজ্জাক এবং আরো অনেকে। আমাদের এই ক্যাম্প থেকেই একমাত্র দেশের বিভিন্ন জেলা যেমন টাঙ্গাইল, ঢাকা, ময়মনসিংহ, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, পাবনাসহ আরও বিভিন্ন এলাকার আর্মিদের মধ্যে যারা বাংলাদেশি ছিলেন তাদের সাথে গভীর রাতে যোগাযোগ করতাম। এর অনেক ইতিহাস রয়েছে যেমন একবার আমি ব্যক্তিগতভাবে বিপদে পরে গিয়েছিলাম। আমাদের তৎকালীন সিরাজগঞ্জের ডিসি স্যারের সাথে কোনো এক ব্যাপারে সাহায্য নেওয়ার জন্যে এক যোদ্ধাকে তার কাছে পাঠাবো কিনা অনুরোধ করি। তিনি সেই অনুরোধ সাদরে গ্রহণ করে তাকে পাঠাতে বলেন এবং তথ্যগুলো উনি দিবেন বলে আমাকে জানান। এরপর আমি কাদের বাহিনীর প্রধানকে অবগত না করেই এক যোদ্ধাকে পাঠিয়েছিলাম। এবং শেষ পর্যন্ত তৎকালীন সিরাজগঞ্জের এডিসি বেঈমানী করে আমাদের সেই যোদ্ধাকে আটকে দেন। এরপর এই খবর আমি আমাদের হেডকোয়ার্টারে পাঠালে আমাদের কমান্ডার জানতে পারলেন। তিনি জানামাত্রই কিভাবে যেনো সিরাজগঞ্জের এডিসির সাথে যোগাযোগ করে সেই যোদ্ধাকে বাচাঁতে পেরেছিলেন।

আমরা আমাদের ক্যাম্প থেকে এছাড়াও আর বিভিন্ন রকম কাজ করতাম। আমরা সর্বদা রাজাকারদের অবস্থানের তথ্য নেওয়ার চেস্টা করতাম। যখন আমরা জানতে পারতাম অমুক ব্রিজে অথবা গ্রামে অথবা বাড়িতে আজকে রাজাকার আসতেছে তখন আমরা আমাদের যোগাযোগের বাহিনী নিয়ে সেখানে রাজাকার দমন করতে চলে যেতাম। এমনই এক সন্ধ্যায় খবর পেলাম টাঙ্গাইলের হাঁটুভাঙ্গা গ্রামের আশেপাশে কোনো এক গ্রামে, নামটি এখন আর মনে পরে না, রাজাকার বাহিনী আসবে রাত্রে। আমাদের কমান্ডারকে এই খবর জানানোর পর তার গ্রামের মানুষজনকে রক্ষা করার নির্দেশে ৪জন কে নিয়ে আমরা রওনা দিলাম। প্রায় রাত ১১টার দিকে আমরা সে গ্রামে গিয়ে পৌছাই। গ্রামের পাশেই একটি দিঘি ছিলো। সারারাত আমরা ৪জন সেই দীঘিতে কচুরিপানা মাথায় দিয়ে ডুবে ডুবে রাজাকারদের জন্যে অপেক্ষা করলাম। আমাদের দুর্ভাগ্য এবং তাদের সৌভাগ্য যে তারা সেদিন আসেনি। এভাবেই আরোও অনেকবার আমরা রাজাকারদের সাথে, আল-বদরদের সাথে, সরাসরি পাক আর্মিদের সাথে আমরা যুদ্ধ করেছি। কখনো আমার নেতৃত্বে, কখনো স্যারের নেতৃত্বে, কখনো আনোয়ারুল আলমের সাথে আমরা গিয়েছি এবং সম্মুখযুদ্ধ করেছি। এরকম একটি ঘটনা হলো আমি একদিন রাত ২-৩ টা বাজে বসে আছি ওয়্যারলেসের সামনে, কথা হচ্ছে ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জের কোনো এক আর্মির সাথে। হঠাৎ করে সেখান থেকেই জানতে পারি চোরাই মতিন নামে পরিচিত সিরাজগঞ্জের রাজাকার যার অনেকগুলো জাহাজ ছিলো। তারা ঢাকার সদরঘাট থেকে পাবনার উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিলো এবং সেই খবরটি সর্বপ্রথম আমার কাছেই আসে এবং খবরটি আমি সাথে সাথে হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেই। হেডকোয়ার্টার থেকে সেই খবরটি আমাদের কাদেরী বাহিনীর কমান্ডারের কাছে চলে যায়। এই জাহাজ আটকানোর মিশনটি ছিলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট। যদি জাহাজগুলো পৌছে যেতো তাহলে হয়তো এতো তাড়াতাড়ি নয় মাসের যুদ্ধটা শেষ হতো না। জাহাজগুলো সেদিন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

আমি যখন যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে পড়ি তখন আমার আব্বা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। তখন যুদ্ধচলাকালীন অবস্থায় আমার হাতে গুলিবিদ্ধ হয় সে খবরটি তিনি জানতে পারেন। আমার আব্বা তখন আমার এক ভাগ্নের মাধ্যমে খবর পেয়েছিলেন যে আজিজের হাতে গুলি লেগেছে। যেহেতু তখন আমার সাথে আমার পরিবারের  কোনো যোগাযোগ ছিলোনা তাই আব্বা ধারণা করেছিলেন যে আমি মারা গিয়েছি। আমি মারা যাইনি কিন্তু আমার আব্বা আমার সাথে দেখা করার জন্যে উনি ভুয়াপুর থেকে টাঙ্গাইলে আসেন। সেখানে এসে তিনি আমার একমাত্র মামা (যিনি মুসলিম লীগ করতেন এবং ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন) উনার বাড়িতে উঠেন। মামারও এক ছেলে ছিলেন মিন্টু যিনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন এবং সেখানে শহীদ হন। আমার বাবা সেখানে উঠে আমার খোজ করতে থাকেন। তখন ময়থা নামক এক স্থানে আমি এক মামার সঙ্গে আছি এই খবর পেয়ে রাতে তিনি ময়থা তে আসেন। কিন্তু আমার দূর্ভাগ্য তিনি যখন ময়থাতে আসেন তখন আমি সখিপুর চলে যাই। আমি ময়থাতে যে বাড়িতে ছিলাম তিনি সেখানে এসে জানতে পারেন যে আমি সখিপুরে চলে গিয়েছি তখন তিনি বর্ষাকালের পানি ডিঙ্গিয়ে সখিপুর আসেন। কিন্তু এসে তিনি আমাকে পেলেন না। উনি ফিরে আসার সময় টাঙ্গাইলের কাছাকাছি যায়গা থেকে রাজাকার রফিক আমার জন্যে আমার আব্বাকে ধরে নিয়ে যান এবং তার কাছে আমার খবর জানতে চান। রফিক ছিলো আমার আব্বার ছাত্র তবে আমার চেয়ে একটু সিনিয়র। সে আমার আব্বাকে সারারাত অকথ্যভাবে নির্যাতন করে শুধুমাত্র আমার খবর নেওয়ার জন্যে। কেননা আমি এমন একটি জায়গায় ছিলাম যেখানে কেও খুজে বের করতে পারতো না। সারা পাকিস্তানের আর্মি বিশেষ করে টাঙ্গাইল, ঢাকা, ময়মনসিংহ, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, পাবনার আর্মিরা জানতো যে আজিজ নামে একটি ছেলে কাদের সিদ্দিকী সাহেবের সাথে আছে এবং ওই ছেলেটি আমাদের বিভিন্নভাবে ডিস্টার্ব করছে এবং সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি ডিস্টার্ব করতাম রাতের ১টার সময় ওদের ওয়্যারলেসে আমাদের একটা একব্যান্ডের রেডিও ছিলো যেটাতে সবসময় ভারত থেকে যুদ্ধের গান বাজতো সেটা ছেড়ে দিয়ে রাখতাম। এতে করে ওদের যোগাযোগ মারাত্মক রকম ক্ষতি হতো। এবং তখন থেকেই ওদের টার্গেট ছিলাম আমি। এই কারণেই ভুয়াপুরে এতো অত্যাচার হয়েছে এবং তিনবার হেলিকপ্টার থেকে ফায়ার করে আমার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই কারণেই আমার আব্বার উপর এতো অত্যাচার হয়েছে আজিজকে পেলে, ওই কাজগুলো ওর মতো আর কেউ করতে পারবেনা। সারারাত অত্যাচার করার পর সকালে আমার মামা জানতে পারেন যে তার বোনের জামাইকে সার্কিট হাউজে আমার আব্বাকে মারধর করা হয়েছে। তিনি সেখানে গিয়ে দেখতে পেলেন আব্বা মাটিতে পড়ে আছেন। জ্ঞান আছে, চোখ দিয়ে পানি ঝরছে কিন্তু কথা বলতে পারছেন না। তখন মামা আমার আব্বাকে সেখানে তার বাসায় নিয়ে তারপর গাড়িতে করে ভুয়াপুর পাঠিয়ে দেন কেননা টাঙ্গাইলে কোনো ডাক্তার তার চিকিৎসা করার মতো সাহস পাননি। আব্বা ভুয়াপুরে আসার ৭দিন পরে তিনি মারা যান। স্বাধীনতার এই কথাটা তখন আমাকে কেও বলেনি। অক্টোবরে এই খবরটি আনোয়ারুল আলম শহীদ জানতে পারেন এবং আমাকে ভুয়াপুর পাঠানোর প্রস্তুতি নেন কাদের সিদ্দিকী সাহেবের সাথে। কমান্ডার আমাকে নিয়ে ভুয়াপুর এসে আমার আব্বার কবরটা জিয়ারত করেন। ৩টার সময় ভুয়াপুর পৌছে আব্বার কবরের কাছে দাড়িয়েছি, এর কিছুক্ষণের মধ্যে টাঙ্গাইল আর্মিদের কাছে খবর গিয়েছে কাদের সিদ্দিকী ভুয়াপুর এসেছে আজিজ বাঙ্গালকে নিয়ে। আর্মি ভুয়াপুর এসে পৌছানোর সাথে সাথে তিনি আমাকে নিয়ে কিভাবে যেনো চুন্দিনির চর চলে গেলেন। আমি সেটা আজও এই বয়সে এসে বুঝে উঠতে পারিনা।

শহিদ কুদ্দুস আমার কাছ থেকে যেদিন বিদায় নিয়ে চলে এলেন সেদিন ক্যাম্পে কাদের সিদ্দিকী সাহেব এসেছেন। কুদ্দুস তার কাছে গিয়ে বললেন যে সে ভুয়াপুর যেতে চায়। কাদের সিদ্দিকি সাহেব তাকে নিয়ে ভুয়াপুর আসলেন এবং এর পরদিনই কুদ্দুস নিজের রক্তের বিনিময়ে ভুয়াপুরকে স্বাধীন করে শহিদ হন।

তিনি আর ক্যাম্পে ফিরে এলেন না, সেই আমাদের শেষ দেখা। শহিদ কুদ্দুসের নামেই ভুয়াপুরের নামকরন করা হয়েছিলো।  কিছু কুচক্রী মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের কারণে আজকে সেই কুদ্দুস নগরও নেই এবং ভুয়াপুর কুদ্দুস স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ও নেই। আজও আমরা তাকে স্মরণ করি ঠিকই কিন্তু তার নামের কোনো চিহ্নই আমাদের ভুয়াপুরে নেই। এরপর আস্তে আস্তে সবাই যখন চলে যেতে লাগলো আমি, ইংরেজ, শামসু এরা মিলে আকড়ে ধরে থাকলাম আমাদের যোগাযোগের মাধ্যমটিকে। একদিন আমরা খবর পাই হাস্যা নামক স্থানে পাকিস্তান বাহিনী হামলা করেছে, তখন আমরা সেখানে পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিহত করতে যুদ্ধ করতে যাই। আমরা তখন ছিলাম ৬ জন। ২জন করে ৩টা বাঙ্কারে আমরা ছিলাম। আমাদের প্ল্যান ছিলো ওদেরকে যতটুকু প্রতিহত করা যায় আমরা করবো। ওরা যখন চলে আসে তখন বাজে ১২ টা- ১টা এবং আমরা যুদ্ধ শুরু করি। কোনো একটা পর্যায়ে যুদ্ধের তীব্রতায় পাশের বাঙ্কার থেকে বাকিরা পেছনে চলে যায়। আমরা মাঝখানের ৪জন বলতে পারিনি যে দুই পাশ থেকে দুইজন ওরা চলে গিয়েছে। আমরা পাকিস্তানি আর্মিদের মাঝখানে পড়ে গেলাম। হয়তো সেদিনই মারা যেতাম। কিন্তু আমি বেচে আছি। আমাদের যখন বলা হলো সারেন্ডার করার জন্যে তখন আমরা সারেন্ডার করলাম। আমাদের কাছে তখন ছিলো স্টেনগান। আমাদের যুদ্ধের মোটামুটি একটা হাতিয়ার ছিলো স্টেনগান, সেগুলো ভারত থেকে এসেছিলো। সারেন্ডার করার পর আমার মাথার পিছনে ভারি কিছু একটা দিয়ে আঘাত করা হয়, এরপর শরীরের উপর দিয়ে কি গেছে বলতে পারিনা, আমি হুশ হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরার পর আমি দেখতে পাই আমি সখিপুরে রয়েছি। পরে জানতে পারি আমার সাথের ৩জন মারা গিয়েছে, আমি বেচে আছি। কাদের সিদ্দিকী স্যার আমাদের আটকে রাখার খবর পাওয়ার পর উদ্ধার করতে গিয়ে গ্রামবাসীদের কাছে শুনতে পান যে একজন বেচে আছে যে কথা বলতে পারেনা, চলতে পারেনা। সেখান থেকে আমাকে উদ্ধার করে সখিপুরে নিয়ে আসেন। সখিপুরেই বেসরকারি হাসপাতালে আমার প্রথম চিকিৎসা হয়। আমি সেখানের মোটামুটি ভালো চিকিৎসার মাধ্যমে আমি আবার সুস্থ হয়ে উঠি। আজও তাদের কথা মনে পরে। এর কিছুদিন পরেই টাঙ্গাইল মুক্ত হয়। টাঙ্গাইল বিজয়ের পরে ঢাকা বিজয়ের সময় মিরপুরের ব্রিজ দিয়ে আমরা কাদের সিদ্দিকির নেতৃত্বে ঢাকায় প্রবেশ করি। ভারতের এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যিনি দায়িত্বে ছিলেন, মিঃ অরোরা, তিনি যখন ঢাকায় আসেন তখন আমরাও ঢাকায় প্রবেশ করি। কাদের সিদ্দিকী সাহেব পল্টন ময়দানে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম জনসভায় তিনি ঘোষনা দেন যে বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দেওয়া হোক এবং সেটাই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ঘটনা।

যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে প্রথম যখন আমি ঢাকাতে আসি তখন আমি আইএ(ইন্টারমিডিয়েট) পাশ করেছি। ইচ্ছে ছিলো ঢাকা কলেজে আমার পরবর্তী পড়াশুনা শুরু করবো। সেই ইচ্ছা থেকেই ঢাকা কলেজে তখন ভর্তি হতে গেলাম একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কিন্তু ভর্তি হতে পারলাম না। চলে আসলাম। আবুজর গিফারী কলেজে গিয়েছি ভর্তি হতে পারলাম না সেখানেও, চলে আসলাম। ভর্তি হতে পারিনি কারণ ছাত্র খারাপ ছিলাম এজন্যে নয়, অর্থনৈতিক কারণে। মুক্তিযুদ্ধ করেছি বিধায় তখন আমাদের কাছে তেমন টাকা পয়সা ছিলো না। ভর্তি হতে ৪০০-৫০০ টাকা দরকার ছিলো যেটা তখন আমার কাছে ছিলোনা তাই প্রথমবার ভর্তি হতে না পেরে ফিরে আসি। তখন ঢাকা কলেজের ঠিক উল্টোপাশেই ছিলো ছাত্রলীগের অফিস। যেহেতু আমি ছাত্রলীগ করতাম এবং বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসতাম কিন্তু তখন পর্যন্ত উনার সাথে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। ছাত্রলীগের অফিসে গিয়ে প্রথমবারের মতো পরিচয় হয় বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল ভাই এর সাথে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে উনার কাছে অত্যন্ত ঋণী। তিনি আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং স্নেহ করতেন। সেখানে আরোও ছিলেন ইসমত কাদির গামা, মনিরুল হক চৌধুরী সাহেব, শফিউল আলম সাহেব সহ আরও কয়েকজন বসা ছিলেন। আমি যেহেতু টাঙ্গাইলের ছাত্রলীগের জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেম অতএব তারা আমার নাম চিনলেও আমাকে ঐভাবে চিনতেন না। সেদিন সবার সাথে কথা বলে যখন আমি চলে আসবো তখন এক দুর্দান্ত মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম আমাকে অন্য রুমে ডেকে নিয়ে গেলেন এবং সেখানে কামাল ভাইকে ডেকে এনে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সেখানে কামাল ভাইকে নুরুল ইসলাম আমার ব্যাপারে বললেন যে ছেলেটা ভালো মুক্তিযোদ্ধা, কামাল ভাই ওকে ঢাকা কলেজে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে দেন। আমি জীবনে কখনো চিন্তাও করতে পারিনাই যে বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল আমাকে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিবেন। আমার যদ্দুর মনে পরে তিনি কোনো কথা না বলেই ছাত্রলীগের অফিস থেকে বের হয়ে সরাসরি ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে ঢুকলেন। প্রিন্সিপাল স্যার দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানালেন। কামাল ভাই উনাকে বললেন সে আপনার কলেজের ছাত্র হতে চায়, আপনার কলেজে ভর্তি হতে চায়। সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমার এখনও মনে পরে প্রিন্সিপাল স্যার এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন তুমি তো বলনি তুমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, তোমরা পড়বেনা তো কে পড়বে। তিনি আমাকে চেয়ারে বসিয়ে কামাল ভাইকে বিদায় দিলেন এবং সেইদিনই তিনি আমাকে ঢাকা কলেজের ছাত্র হিসেবে ভর্তি করলেন। পরবর্তীতে আমি ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি হলাম। পরপর দুইবার আমি ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগ সভাপতি নির্বাচিত হই। কামাল ভাই বলেছিলো আজিজ বাঙ্গালই থাকবে সভাপতি। আমার নাম যদিও আজিজুর রহমান তরফদার তবে সবাই আমাকে আজিজ বাঙ্গাল নামেই চিনতো কেননা তখন আমার খুব বড় এবং ঝাকড়া দাড়ি ছিলো।

আমার মনে পরে যখন আমি প্রথম ঢাকা কলেজের সভাপতি নির্বাচিত হই তখন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করার জন্যে আমার সেক্রেটারী আব্দুর রউফ সিকদারকে নিয়ে গণভবনে গিয়েছিলাম। তখন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন মনিরুল হক চৌধুরী এবং আমার ঢাকার রাজনীতির প্রথম নেতা ছিলেন শেখ কামাল ভাই। উনি তখন আমাকে নিয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করানোর জন্যে। সেদিন ছিলো গুড়িগুড়ি বৃষ্টি, সবাই আগে চলে গিয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর অফিসে তাই আমি আর রউফ সিকদার দৌড়িয়েই বৃষ্টির মধ্যে উনার অফিসে ঢুকলাম। ঢুকে দেখলাম উনি টেবিলের উপর পা রেখে চেয়ারে বসে আছেন। শেখ কামাল দাঁড়িয়ে আমাদেরকে দেখিয়ে বললেন এই দুটো ছেলেই সভাপতি আজিজ আর সেক্রেটারি রউফ সিকদার। বঙ্গবন্ধু পা টেবিল থেকে নামিয়ে তার চেয়ারে থাকা তোয়ালেটা আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন “তোরা তো বৃষ্টি থামার পরেও আসতে পারতি। মাথাটা মুছে ফেল, ঠান্ডা লাগবে।” উনার হৃদয়ের উদারতা দেখে খুবই অবাক হয়েছিলাম সেদিন। আজকে এমন কোনো নেতা নেই যে একটা কলেজ শাখার ছাত্রলীগের একটা ছেলেকে বলবে যে বৃষ্টিতে ভিজে আসছিস, তোয়ালেটা নে, মাথা মুছে ফেল।

সেদিনই বুঝেছিলাম উনার হৃদয়ের কথা। আমি ছাত্রলীগের সভাপতি থাকাকালে আরোও গভীরভাবে বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার পরিচয় হয়। যেহেতু কামাল ভাই আমাদের ছাত্রলীগ পরিচালনা করতেন এবং আমরাও কামাল ভাই এর নেতৃত্বেই পরিচালিত হতাম। আমার মনে পরে যতদিন আমি ঢাকা কলেজে ছিলাম ৪ বছরের মতো, এর মধ্যে সভাপতি ছিলাম ২ বছর, সপ্তাহের ৭ দিনের মধ্যে ৫দিনই ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধুর বাসার সিড়ির নিচে আমরা ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের ছেলেরা বসে থাকতাম। বঙ্গবন্ধু এসে মাথায় বুলিয়ে যেতেন। একদিনের কথা মনে পরে, আমরা বসে আছি সিঁড়িতে এবং বঙ্গবন্ধু সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে যাচ্ছেন। যেতে যেতেই ডাক দিলেন “এই কে আছিস? তোরা আয়, উপরে চলে আয়।“ আমাদের একজন বলে উঠলো “আমরা আপনার সাথে দেখা করতে আসিনাই, আমরা কামাল ভাই এর সাথে দেখা করতে আসছি।“ কতটুকু হৃদয়ের সম্পর্ক থাকলে আমরা ঢাকা কলেজের ছাত্ররা বলতে পারি যে আমরা আপনার সাথে দেখা করতে আসি নাই আমরা কামাল ভাই এর সাথে দেখা করতে আসছি যদিও আমাদের দেখা করার উদ্দেশ্য ছিলো উনার সাথেই। কামাল ভাই আসলে এরপর আমরা সবাই মিলে উনার কাছে যাই। মাসের পর মাস, দিনের পর দিন আমরা তার কাছে গিয়েছি। প্রথম যখন বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখেছিলেন সেদিন তিনি আমার দাড়ি দেখে বলেছিলেন “তুই তো একটা বাঙ্গাল।“ কি নির্মম পরিহাস আমার, তিনি নেই কিন্তু তার দেওয়া নামটা আমি আজও বহন করি। পরবর্তী জীবনে আমি এই নামেই লেখা শুরু করি এবং আমার গ্রামের মানুষ আমাকে এখনো আজিজ বাঙ্গাল নামেই চিনে।

বঙ্গবন্ধু যখন জানতে পারলেন যে আমিই একমাত্র ঢাকা কলেজের নেতা যার আব্বাকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছে তখন তিনি কামাল ভাইকে ডেকে এনে বললেন “কামাল, তুই বাঙ্গালের বাড়িতে গিয়ে ওর মা আছে, ওর মায়ের সাথে দেখা করে আমার সালামটা দিয়ে আয়।“ পরেরদিনই কামাল ভাই আমাকে বললেন “বাঙ্গাল আমি তোর বাড়িতে যাবো।“ মাত্র একদিনের ব্যবধানেই কামাল ভাই এবং রউফ সিকদার আমার বাড়িতে আসলেন। প্রথমে উনি ভুয়াপুরের ডাক বাংলোতে উঠলেন এবং সেখান থেকে আমার বাড়িতে আসলেন। আমার মা এবং চাচীর সাথে পোড়া বাড়িতে মাটিতে বিছানো মাদুরে বসে ভাত খেলেন। এটাই ছিলো কামাল ভাইয়ের জীবনের প্রথম ঢাকার বাইরের কোনো গ্রামে আসা এবং আমার মায়ের হাতের ভাত খাওয়া। উনি এবং রউফ সিকদার আমার বাড়িতে ভাত খেলেন এবং বিকেলবেলা চলে আসার আগে উনার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ জনসভা আমার ভুয়াপুরে কলেজ মাঠে করে এলেন। হাজার হাজার মানুষের সামনে তিনি বক্তব্য রাখলেন সেখানে, এরপর ফিরে এলেন ঢাকায়। আমার মনে হয় উনার জীবদ্দশায় এতো বড় জনসভা ঢাকার বাইরে উনি কখনো করেননি। উনি জনসভায় বলে এসেছিলেন ভুয়াপুরের দায়িত্ব আমার। কিন্তু দূর্ভাগ্য আমাদের আজ পর্যন্ত কোনো আওয়ামীলীগ নেতা একথাটি স্মরণ করেনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন ভুয়াপুরে গিয়েছিলেন, উনার সাথে অনেক বড় বড় নেতারা ভুয়াপুরে গিয়েছিলেন কেউই শেখ কামাল ভাইয়ের ঘটনাটি প্রধানমন্ত্রীকে জানাননি। যাইহোক, বঙ্গবন্ধু কন্যা ভুয়াপুরকে গড়ে তুলেছেন, তুলছেন।

 

 

https://mssangsad.com/profile_view/906/59510