৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ এই দিনে

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৫ ডিসেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক পোস্ট এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, 'গত ৩ ডিসেম্বর ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধে জড়ানোর ৫ দিন আগেও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে বাংলাদেশে যুদ্ধ চালানোর জন্য অস্ত্র সহায়তা দিয়েছে।'

নিউইয়র্ক পোস্টের প্রতিবেদক জ্যাক অ্যান্ডারসন এই প্রতিবেদনে বলেন, 'গত ৮ ডিসেম্বর ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল  শ্যাম মানেকশ মার্কিন মিলিটারি অ্যাটাচে কর্নেল উইলিয়াম কিংকে তার বাসভবনে জরুরিভাবে ডেকে গত ২৯ নভেম্বর করাচি বিমানবন্দরে অবতরণকারী সি-১৪১ মার্কিন মিলিটারি কার্গো বিমানের বিষয়ে প্রশ্ন করেন। জবাবে মার্কিন মিলিটারি অ্যাটাচে উইলিয়াম কিং এই ব্যাপারে কিছু জানেন না বলে ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধানকে জানান। জেনারেল মানেকশ এসময় অভিযোগ করে বলেন, ''পাকিস্তানি বাহিনীকে সামরিক  সাহায্য করার জন্যই এই বিমান পাঠানো হয়েছে। অথচ মার্কিন প্রশাসন বলছে পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দেয়া হবেনা। তারা তো নিজেদের নিষেধাজ্ঞা নিজেরাই ভঙ্গ করছে। নাকি এটি কেবলই লোক দেখানো নিষেধাজ্ঞা ছিল?"' 

 পরে নিউইয়র্ক পোস্টের প্রতিবেদক উইলিয়াম কিংয়ের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এই রহস্যজনক অস্ত্র সরবরাহের কোন খোঁজ আমরা পাচ্ছি না। মার্কিন সরকার নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কেন পাকিস্তানকে অস্ত্র সহায়তা দিবে?' 

অন্যদিকে ৮ ডিসেম্বর দিল্লিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং দিল্লি থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে একটি জরুরি বার্তা পাঠান। দিল্লি থেকে কেনেথ কিটিংয়ের পাঠানো এই বার্তা ২৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত  নিউইয়র্ক পোস্টের প্রতিবেদনে তুলে ধরেন নিউইয়র্ক পোস্টের প্রতিবেদক জ্যাক অ্যান্ডারসন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো এই বার্তায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং অভিযোগ করে বলেছিলেন  'জেনারেল মানেকশকে আমি অত্যন্ত সৎ ও স্পষ্টভাষী হিসেবেই জানি। আমি জানি জেনারেল মানেকশ খুব ভালোভাবে জেনেই এই অভিযোগ করেছেন। আর পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র যদি এই সামরিক সাহায্য দিয়ে থাকে তবে প্রকাশ্যেই আমাদের ঘোষিত নীতি লঙ্ঘিত হয়েছে। আমরা নিজেরাই নিজেদের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেছি। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চরম লজ্জার।' 

নিউইয়র্ক পোস্টের এই প্রতিবেদনে প্রতিবেদক জ্যাক অ্যান্ডারসন আরও কিছু বিষয় আলোচনা করেন। তিনি লেখেন, 'হোয়াইট হাউজের আড়ালে অন্য খেলা চলেছিল তখন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সহকারী হেনরি কিসিঞ্জার যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে বলেছিলেন, "ভারত পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার মধ্য দিয়ে তাদের তাঁবেদারি রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। রাশিয়া যেখানে ভারতকে অস্ত্র সরবরাহ করছে সেখানে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে পরাজয় স্বীকারের কথা বলতে পারে না। পাকিস্তানকে দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা না হলে যুক্তরাষ্ট্রের উপর মিত্র দেশগুলো আর আস্থা রাখতে পারবে না।"  অন্যদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেস ডিরেক্টরের ভারত সম্পর্কিত মন্তব্যে হেনরি কিসিঞ্জার চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। একই সঙ্গে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কঠোরতম নীতি গ্রহণ করার আদেশ দেন। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেন এটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনেরই   আদেশ। যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপকভাবে বাংলাদেশ বিদ্বেষী মনোভাব জারি রাখে।' 

ঢাকায় এদিন 

২৫ ডিসেম্বর  বঙ্গভবনে সাংবাদিকদের করা নানা প্রশ্নের জবাবে  প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'বাংলাদেশ সবার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ অবস্থান চায়। কোনো দেশের সঙ্গে আমাদের  শত্রুতার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে, এই বাস্তব সত্যটিকে মেনে নিতে হবে সবাইকে।'  

মুক্তিযুদ্ধে চীনের বিরোধিতা সম্পর্কে সাংবাদিকরা তাজউদ্দীন আহমদকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন,  'চীন একটি মহান জাতি এবং সব সময় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। কিন্তু  বাংলাদেশের প্রশ্নে দৃর্ষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার ব্যাপারে তাদের নেতৃবৃন্দের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে তাদের জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে।' 

বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন,  'শীঘ্রই দেশকে শাসনতন্ত্র দেওয়া হবে এবং ভবিষ্যতে শাসনতন্ত্রে অবশ্যই জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটতে হবে।  শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত যেসব পুরাতন আইন দেশের স্বার্থবিরোধী নয় তা বলবৎ থাকবে। এখন জাতির সামনে প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে, দেশের বিপর্যস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন এবং ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের শরণার্থীদের পূনর্বাসন।' 

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠনের জন্য ন্যাপ প্রধান যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সে সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'জাতীয় সরকার সব সময় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয়। বিগত বছরের নির্বাচন বিশ্বের কাছে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এবং সরকার গঠনের জন্য আওয়ামী লীগকে রায় দিয়েছে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে জনসাধারণ শুধু আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচির প্রতিই ভোট দেয়নি। ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের প্রতিও ভোট দিয়েছে।  যারা দখলদার বাহিনীর হাত থেকে দেশের মুক্তির জন্য অস্ত্র ধারণ করেছে, তারা সাধারণ লোক নন বরং তারা অসাধারণ লোক। তারা জানে কখন অস্ত্রধারণ করতে হয় এবং কখন গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করতে হয়। তাদের জাতীয় মিলিশিয়া এবং অন্যান্য জাতি গঠনমূলক কাজে নিয়োগ করা হবে।' 

এ ছাড়া স্বাধীনতার পূর্বে বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে গঠিত পরামর্শ কমিটির কথা উল্লেখ করে তাজউদ্দীন আহমদ আরও বলেন, 'এই কমিটি বহাল থাকবে। বাংলাদেশের মন্ত্রীসভা ও কমিটির সাধারণ মতের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির কোন কারণ থাকতে পারে না।' 

এদিন বঙ্গভবনে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধর।  এ সময়  ২ জনের মধ্যে বৈঠকে ঠিক হয়, বাংলাদেশের জরুরি প্রয়োজন মেটানোর জন্যে ভারত বাংলাদেশকে অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করবে।

২৫ ডিসেম্বর  আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির ওষুধপত্র ও চিকিৎসকবাহী একটি বিমান সংস্থাটির স্বেচ্ছাসেবকদের  নিয়ে ঢাকা পৌঁছায়।   

২৫ ডিসেম্বর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, 'ঢাকার বাইরে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকজন নেতা ও শিক্ষককে আটক করেছে পুলিশ।  এদের মধ্যে কয়েকজন হচ্ছেন, পিডিবি'র সহ সভাপতি  এম এন এ মওলানা মোসলেহ উদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মুস্তাফিজুর রহমান, সাবেক মন্ত্রী ও ময়মনসিংহ জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি ফখরুদ্দিন, ময়মনসিংহ জেলা মুসলিম লীগের সম্পাদক খোরশেদ আহমদ খান, ময়মনসিংহ জেলা মুসলিম লীগের কোষাধ্যক্ষ ডা. এ হামিদ, ময়মনসিংহ জেলা পিডিপির সভাপতি মওলানা আলতাফ হোসেন এবং ময়মনসিংহ জেলার নেজামে ইসলামের সভাপতি মওলানা ফয়জুর রহমান।'

২৫ ডিসেম্বর  ঢাকায় এসে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি যাত্রীবাহী বিমান পৌঁছায়। ওই বিমানে ভারতের বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ  সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন।  
এদিনে বাংলাদেশ সরকার পয়লা জানুয়ারি থেকে সব ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু করার নির্দেশ দেয়।

ভারতে এদিন 

২৫ ডিসেম্বর দিল্লিতে  ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বলেন, 'বাংলাদেশ যে এখন বাস্তব সত্য, তা বিশ্বের বহু দেশ অনুধাবন করেছে। অনেক দেশ বাংলাদেশকে কার্যত স্বীকৃতি দেয়ার কার্যক্রম শুরু করেছে। এর ফলে বাংলাদেশের আইনগত স্বীকৃতির পথ প্রশস্ত হবে।'

এর আগে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ থেকে দিল্লিতে ফিরে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'ঢাকার পতন এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের সংবাদে জাতিসংঘে চাপা স্বস্তির আবহাওয়া বিরাজ করেছিল। যারা পশ্চিম পাকিস্তানের ভারত আক্রমণের ঘটনাকে উপেক্ষা করে ভারতকে আক্রমণকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলো তারা আজ সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে।  পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো যদি বাংলাদেশকে এখনো পাকিস্তানের অঙ্গ হিসেবে ভেবে থাকেন তবে তিনি চরম ভুল করছেন। এটি উপমহাদেশের নিরাপত্তাও চরমভাবে বিঘ্নিত করবে।' এসময় সাংবাদিকেরা

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন 

২৫ ডিসেম্বর প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসে 'একটি নতুন জাতির জন্ম' শিরোনামে একটি বিশেষ সম্পাদকীয়  প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত ওই সম্পাদকীয়তে বলা হয়, 'পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর উচিৎ শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়ার ব্যবস্থা করা। দুই দেশের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনা শুরু করা। ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য। বাংলাদেশের নেতাদেরও ভবিষ্যতের প্রয়োজনে  মর্যাদা ও কিছু বিশ্বাস বজায় রেখে ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা উচিৎ। বিক্ষোভের যত কারণই থাকুক না কেন, যত মতপার্থক্যই থাকুক না কেন, তা নিশ্চয়ই একটা সময় এসে সময়ের স্বার্থেই পথ চলতে বাধ্য করবে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টেরই সর্বপ্রথম উচিৎ পূর্ব বিরোধ ও ঘৃণা ভুলে পরিস্থিতি উপলব্ধি করে  বাংলাদেশকে স্বীকার করে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করা। আর এজন্য প্রথম পদক্ষেপ হবে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া।' 

২৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র প্রাভদা'য় 'বাংলাদেশের পরিস্থিতি' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়, 'বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় এই নতুন রাষ্ট্রের বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। এ যাবৎকালে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশ পূর্ব পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলা হিসেবে সম্বোধন করা হলেও এখন বাংলাদেশ নামেই সম্বোধন করা হচ্ছে। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সম্বোধনকৃত চিঠিই যার স্পষ্ট প্রমাণ। চিঠিতে ঢাকাকে বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।