৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ এই দিনে

এদিন পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর ডা. এ এম মালিক, মন্ত্রিসভার ৮ সদস্য, আমলা ও পুলিশের নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তাসহ মোট ৩০ জনকে আটক করে বাংলাদেশ পুলিশ।

আটকরা হলেন-গভর্নর ডা. এ এম মালিক, মন্ত্রী আবুল কাসেম, মন্ত্রী নওয়াজেশ আহমদ, মন্ত্রী আব্বাস আলী খান, মন্ত্রী আখতার উদ্দীন আহমদ, মন্ত্রী মোহাম্মদ ইসহাক, মন্ত্রী জসিমুদ্দিন, মন্ত্রী এ কে এম ইউসুফ, মন্ত্রী সোলায়মান, চিফ সেক্রেটারি মোজাফফর হোসেন, স্বরাষ্ট্র সচিব এম এম কাজিম, কমিশনার এস এ রেজা, আইজিপি এম এ কে চৌধুরী, এআইজিপি এম এ আর আরিফ, ডিআইজি এম এম হাসান, বিডিএলজি সেক্রেটারি মোজাফফর আহমদ, শিক্ষা সেক্রেটারি মুফতি মাসুদুর রহমান, তথ্য সেক্রেটারি হুমায়ুন ফয়েজ রওশন, পরিকল্পনা বোর্ড সদস্য হাসান জহির, জয়েন্ট সেক্রেটারি তথ্য আসলাম ইকবাল, স্বরাষ্ট্র ক্যাপ্টেন খালেদ আহমদ, এসএনজিএ ক্যাপ্টেন আফতাব উদ্দীন আহমদ, লে. কমান্ডার এ এ নাসিম, মো. আশরাফ, মহিবুল্লাহ শাহ, এস কে মাহমুদ, এ এরফান মান্নী, সালমান খালেক, আব্বাস খান ও পাঞ্জাব কন্টিনজেন্ট রানা মুশতাক।

২৪ ডিসেম্বর পুলিশ সদর দপ্তর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলে, '২৫ মার্চ পরবর্তী সময়ে দখলদার পাক বাহিনীর বর্বরতার দোসর শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।'

গ্রেপ্তারদের কয়েকজন হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী, পুলিশের ডিআইজি এস এম নওয়াব, ফজলুল হক এমএনএ, ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম আহমদ চৌধুরী, সাবেক পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি মেজর আফসার উদ্দিন, রাজাকারের ডিপুটি ডিরেক্টর জহুরুল হক, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডা. এ এম বাসেত, আলবদর নেতা এ বি এম আব্দুল খালেক মজুমদার, মিরপুর মুজাহিদ পার্টির কমান্ডার মোক্তার, আলবদর সদস্য আশরাফ আলী, কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সদস্য হাকিম ইনতাজুর রহমান আখুনজাদা, ফরিদাবাদ মাদ্রাসার মাওলানা বজলুর রহমান।

২৪ ডিসেম্বর ৫৪ জন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী এক যুক্ত বিবৃতিতে ঢাকা শহরে নৃশংস গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার চেয়ে পূর্ণ তদন্ত সাপেক্ষে প্রতিবেদন করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।

তারা বলেন, 'যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও নৃশংস বর্বরতার সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদেরকে কোনোমতেই জেনেভা কনভেনশনের ছত্রছায়ায় থাকতে দেওয়া যেতে পারে না '

যুক্ত বিবৃতিতে সই করেন কবি সুফিয়া কামাল, সৈয়দ আলী আহসান, জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, সমর দাস, এ.বি.এম. মুসা, কামাল লোহানী, ফয়েজ আহমদসহ অন্য বুদ্ধিজীবীরা। একইসঙ্গে তারা বিচারের জন্য একটি আন্তর্জাতিক কমিশন গঠনের আবেদন জানান।

তারা বলেন, 'ইয়াহিয়া খানের বর্বর সামরিক জান্তা ও জেড এ ভুট্টো ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। সাড়ে ৭ কোটি বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য তারা এক জঘন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে হাত দেয়, যা ছিল সুপরিকল্পিত গণহত্যার ষড়যন্ত্র। নৃশংসতার সঙ্গে এটি কার্যকর হচ্ছিল। ইসলামের নামে এবং আলবদর, আলশামস, রাজাকার, মুজাহিদ, জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পি.ডি.পি ও অন্যান্যদের সহযোগিতায় চালানো হয় সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য ও লোমহর্ষক গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ। তাদের কুকীর্তির বিস্তারিত বিবরণ বিশ্ববাসী এখনও সর্ম্পূণভাবে জানতে পারেনি। এ বিষয়ে সব তথ্য এখনও সংগৃহীত হয়নি।'

ঢাকায় এদিন

২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ব্যাংকগুলোকে কয়েকটি নির্দেশনা দেয়। এর মধ্যে একটি হলো—১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানে পাঠানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন ব্যাংক যেসব ব্যাংক ড্রাফট, মেইল ট্রান্সফার, টেলিগ্রাফিক ট্রান্সফার ইস্যু করেছিল, সেসব টাকা পাঠানো বাতিল করতে হবে।

২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকায় পৌঁছান মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানী।

২৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা বলেন, 'জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ছাড়া স্বাধীনতা সম্পূর্ণ হবে না। নেতাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত না করা পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।'

ভারতে এদিন

২৪ ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে বলে, 'এ পর্যন্ত  বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৮৯ হাজার পাকিস্তানি সেনা মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।'

২৪ ডিসেম্বর লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বলেন, 'ভুট্টো যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা পোষণ করেন, তবে অবিলম্বে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়া উচিত।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

২৪ ডিসেম্বর বিবিসির এক খবরে বলা হয়, 'পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো বাংলাদেশে সামরিক বিপর্যয় এবং পশ্চিম পাকিস্তান-ভারত সীমান্ত বরাবর যুদ্ধবিরতি বিষয়ে তদন্তের জন্য বিচারপতি হামুদুর রহমানের (বাঙালি এই বিচারপতি ১৯৬২ সালের শিক্ষানীতি কমিশন প্রধান ছিলেন, যে নীতির বিরুদ্ধে শিক্ষা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল) নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছে। এই কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন— সিন্ধু হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি তোফায়েল এ রহমান, লাহোর হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি আনোয়ারুল হক, লে. জে. আলতাফ কাদির, আইন উপদেষ্টা কর্নেল হাসান। পাকিস্তান সেনাবাহিনীও তাদের লেফটেন্যান্ট জেনারেল আফতাব আহমেদের নেতৃত্বে ৩ জন জেনারেলকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন  করে। 

২৪ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তার এক প্রভাবশালী দৈনিকের সম্পাদকসহ হাজারো মানুষ একটি মিছিল বের করে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে সমাবেশ করে নিজেদের সরকারের কাছে তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানায়।

২৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১-স্বাধীন বাংলাদেশের চিত্র

 

 

১৯৭১ সালের ২৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সংকল্প প্রকাশ করে যে, স্বাধীন বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত হতে মুক্ত না করা পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ জানান তা শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে এদেশের তরুণ সমাজ অস্ত্রধারণ করেছিল। যে নেতার আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য তারা অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন সেই নেতার কাছেই অস্ত্র জমা দেবেন।

ছাত্র নেতৃবৃন্দ বলেন আইন শৃঙ্খলা রক্ষা ও জনসাধারণের নিরাপত্তা বিধানের ব্যাপারে মুজিব বাহিনী সরকারের সাথে সহযোগিতা করবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা বাংলাদেশ ছাত্র লীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি আ.স.ম. আব্দুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন। তারা দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন।

এছাড়া ঐতিহাসিক এই দিনে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৪ জন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী এক যুক্ত বিবৃতিতে ঢাকা নগরীসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তার পূর্ণ তথ্য উদঘাটনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দাবী জানান। তারা বলেন, যারা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে এই ব্যাপক হত্যাকাণ্ড এবং নৃশংস বর্বরতার সাথে জড়িত ছিল তাদেরকে কোনমতেই জেনেভা কনভেনশনের ছত্রছায়ায় থাকতে দেয়া যেতে পারে না। যুক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন: কবি সুফিয়া কামাল, সৈয়দ আলী আহসান, জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, সমর দাস, এ.বি.এম. মুসা, কামাল লোহানী, ফয়েজ আহমদ প্রমুখ।

বুদ্ধিজীবীরা এসব নরপিশাচদের বিচার করার জন্য বিশ্বের প্রখ্যাত আইনবিদ ও মনীষীদের নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক কমিশন গঠনের আবেদন জানান। তারা বলেন, ইয়াহিয়া খানের বর্বর সামরিক জান্তা এবং জেড. এ. ভুট্টো ২৫ মার্চের কালরাতে বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য তারা এক জঘন্য পরিকল্পনার কাজে হাত দেয় যা ছিল সুপরিকল্পিত গণহত্যার ষড়যন্ত্র। ইসলামের নামে এবং আল-বদর, আল-শামস, রাজাকার, মুজাহিদ, জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পি.ডি.পি ও অন্যান্য গুণ্ডাপাণ্ডাদের সহযোগিতায় চালানো হয় সভ্যতার ইতিহাসের সব চাইতে জঘন্য ও লোমহর্ষক গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ। এদের কুকীর্তির বিস্তারিত বিবরণ বিশ্ববাসী এখনও সম্পূর্ণভাবে অবহিত হতে পারেনি এবং এ বিষয়ে সমস্ত তথ্য এখনও সংগৃহীতও হয়নি।

বিবিসি’র এক খবরে বলা হয়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশে সামরিক বিপর্যয় এবং পশ্চিম পাকিস্তান-ভারত সীমান্ত বরাবর যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে তদন্তের জন্য বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেন।