৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ এই দিনে

ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ উড়োজাহাজে ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর বিকেল পৌনে ৫টার দিকে কলকাতার দমদম বিমানবন্দর থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছান বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান, অর্থ ও শিল্পমন্ত্রী এম মনসুর আলী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকসহ মন্ত্রীসভার ৭ সদস্য।

২২ ডিসেম্বর ১৯৭১: ঢাকায় ফিরে পুষ্পবৃষ্টি ও অশ্রুজলে সিক্ত জাতীয় নেতারা

তেজগাঁও বিমানবন্দরে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ মন্ত্রীসভার সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত

 

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীদের পদার্পণের মধ্য দিয়ে ঢাকা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানীতে রূপান্তরিত হয়। এ সময়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরে তাদের দেখতে সাধারণ মানুষের ঢল নামে। উড়োজাহাজ থেকে নামার সময় লাখো জনতা জয় বাংলা স্লোগান দিতে থাকে। বিমানবন্দরে তাদের গণ সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বিমানবন্দরে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীসভার সদস্যদের গার্ড অব অনার প্রদান করে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ভারতীয় বাহিনীর সৈন্যরা।

এ দিন সকালে বাংলাদেশ বেতারে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী আসার ঘোষণার পর থেকেই তেজগাঁও বিমানবন্দরে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। ঢাকা ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে অগণিত মিছিল হাতে প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন নিয়ে বিমানবন্দরের দিকে আসতে থাকে মানুষ।

বিমানবন্দরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, 'গত ৯ মাসে হাজারো বাঙালির রক্ত বাংলাদেশের মাটিতে ঝরেছে। তবুও এই নবজাত রাষ্ট্র গড়ার জন্য আমরা আরও রক্ত দিতে প্রস্তুত। বাংলাদেশ আজ বাস্তব সত্য এবং পৃথিবীর কোনো শক্তিই এই বাস্তবকে অস্বীকার করতে পারে না। আজকের এই দিনেও সমস্ত জাতির বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে নেই। তিনি শত্রুর কারাগারে বন্দি। তবে আমরা শীঘ্রই তাকে মুক্ত করে আনবো।'

তিনি আরও বলেন, 'এই মুহূর্তটি আমার কাছে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। আমরা যে এভাবে ফিরে আসতে পারবো কখনো ভাবিনি।'

 

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যেসব শক্তি ষড়যন্ত্র করছে তাদের সতর্ক করে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বলেন, 'কোনো জাতিরই বাংলাদেশের ক্ষতি করার সাহস থাকা উচিৎ নয়। ইয়াহিয়া যেমন আজ ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে ঠিক তেমনই শত্রুদের অবস্থাও এমন হবে।'

ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, 'ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব পরস্পরের সার্বভৌমত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই বন্ধুত্বের মধ্যে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই ভারতের জনগণ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি। ভারত এক মহান জাতি। তারা তাদের নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত থাকা সত্ত্বেও আমাদের মুক্তি সংগ্রামে সহায়তা করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পোল্যান্ড, ভুটানসহ যেসব বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো আমাদের সমর্থন এবং স্বীকৃতি দিয়েছে তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা থাকবে।'

তিনি আরও বলেন, 'সকল কৃতিত্বের অধিকারী বাংলার মানুষ। যেসব বাঙালি যুবক অস্ত্র ধারণ করেছে, প্রাণ দিয়েছে তারা প্রমাণ করেছে যে বাঙালি যুদ্ধ করতে জানে, অকাতরে প্রাণ দিতে জানে। সাড়া পৃথিবীর কাছে তারা বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করেছে, ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।'

বক্তব্যের শেষ দিকে তিনি বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য সবাইকে শপথ নেওয়ার আহ্বান জানান।

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তার বক্তব্যে  প্রথমে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, 'শহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে তারা প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।'

তাজউদ্দীন আহমদ আরও বলেন, 'বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্য যে গণবিপ্লবে মেতে উঠেছিলেন, সেই বিপ্লব থেমে গেলে চলবে না, বরং বিপ্লবকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে গঠনমূলক কাজে।'

তিনি বলেন, 'সাম্যবাদী অর্থনীতি, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ কায়েম করা যখন সম্ভব হবে, তখনই বিপ্লব সম্পূর্ণ হবে। শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা কায়েমে কাউকে বাধা সৃষ্টি করতে দেওয়া হবে না। আমরা বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে বিস্ময়ের সঙ্গে উপস্থাপন করবো। শহীদের রক্তে গড়া এই বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে সমুজ্জ্বল হয়ে টিকে থাকবে।'

এরপর একে একে মন্ত্রীসভার সদস্যরাও বিমানবন্দরে বক্তব্য দেন। বাংলাদেশ বেতার সরাসরি বিমানবন্দর থেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীসভার সদস্যদের ঢাকায় ফিরে আসা উপলক্ষে সরাসরি ধারা বর্ণনা দেয়।

বিমানবন্দর থেকে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীসভার সদস্যরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ধানমন্ডিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

এর আগে তারা কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে এলে হাজারো মানুষ তাদের দেখতে আসেন। এ সময় তাদের বিদায়ী সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, 'ঠিক এই মুহূর্তে আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর কথা। জানি না তিনি কেমন আছেন, কি অবস্থার মধ্যে আছেন, তবে তার স্মৃতি কেমন করে ভুলি?'

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সাংবাদিকেরা বিদায় মুহূর্তে তার অনুভূতির কথা জানতে চাইলে তার চোখ পানিতে ভরে উঠে। তিনি ধীর গলায় বলেন, 'ভারতের ৬০ কোটি মানুষের জন্য রেখে যাচ্ছি বুক ভরা ভালোবাসা। আর যিনি ভারতের নেতৃত্বও দিচ্ছেন সেই শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি জানাচ্ছি সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির কৃতজ্ঞতা।'

তাজউদ্দীন আহমদের কাছেও বিদায়ী অনুভূতির কথা জানতে চান সাংবাদিকেরা। জবাবে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ হিসেবে আজ আমরা ফিরে যাচ্ছি। নিজেকে ভীষণ হালকা লাগছে। আমাদের এখন লক্ষ্য হবে বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধশীল রাষ্ট্রে পরিণত করা। তাহলেই আমাদের শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানানো হবে।'

ঢাকায় এ দিন

২২ ডিসেম্বর কলকাতায় থেকে ঢাকায় আসেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান ডিপি ধর। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে ঢাকায় 'স্পেশাল এনভয়' পদে নিয়োগ দেয়।

ভারতে এ দিন

২২ ডিসেম্বর দিল্লিতে ভারতের শ্রম ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় আয়োজিত পরামর্শক কমিটির বৈঠকে ভারতের শ্রম ও পুনর্বাসন মন্ত্রী আর কে খাদিলকর বলেন, 'আগামী ১ সপ্তাহের মধ্যেই বাংলাদেশের শরণার্থীরা ফিরতে শুরু করবেন এবং তা শিগগির শেষ হয়ে যাবে। গত এক সপ্তাহে ১ লাখ ৩০ হাজার শরণার্থী শিবির থেকে বাংলাদেশে নিজ ভূমিতে ফিরে গেছেন।'

পাকিস্তানে এ দিন

২২ ডিসেম্বর ইসলামাবাদে সাংবাদিকদের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা সমাধানের পর আমি পিকিং ও মস্কো সফরে যাবো। আমি শেখ মুজিবুর রহমানের মামলার নিষ্পত্তি করতে চাই। সেই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যতোটা সম্ভব মীমাংসা ও ভারতীয় আক্রমণ সম্পর্কেও ফয়সালা করতে চাই। যেন পিকিং বা মস্কোতে একটি পূর্ব আলোচনা হতে পারে।' ভুট্টো এ সময়ে সাংবাদিকদের ভারতীয় আক্রমণ বন্ধ না হওয়ার পর্যন্ত কোনো মীমাংসাই কার্যকর হবে না বলে মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে সুষ্ঠু আলোচনাই কেবল পরিস্থিতিকে আমাদের অনুকূলে আনতে পারে। আমরা যে শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগার থেকে মুক্ত করে গৃহবন্দি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা প্রকৃত মীমাংসার দিকেই এগিয়ে যাওয়া।'

আন্তর্জাতিক মহলে এ দিন

২২ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতীয় উপমহাদেশে অস্ত্রসংবরণ ও সৈন্য প্রত্যাহার নিয়ে প্রস্তাব সর্ব সম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, 'যতদিন ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশ অধিকৃত ভূমি থেকে সৈন্য প্রত্যাহার না করবে ততদিন এই অস্ত্রসংবরণ এবং যুদ্ধ বিরতি কার্যকর থাকবে। আর যতো দ্রুত সম্ভব ২ পক্ষের সশস্ত্র বাহিনীকেই নিজেদের ভূমিতে ফেরত নিয়ে যেতে হবে।' যৌথভাবে এই প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেছিল জাপান, আর্জেন্টিনা, নিকারাগুয়া, বারমুডা, সিয়েরা লিওন এবং সোমালিয়া।

২২ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র 'প্রাভদা'তে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত এই সম্পাদকীয়তে সাংবাদিক ভিক্টর মায়েকোভস্কি বলেন, 'সাম্প্রতিক ভারত ও পাকিস্তান সংঘর্ষে চীন  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ চেয়েছিল। ভারত মহাসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহর আগমনের অন্যতম কারণ হলো চীনের ভূমিকা। সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহের ঘটনাবলিতে চীনা নেতাদের ষড়যন্ত্র উদঘটিত হয়েছে।' সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয়, 'বিশ্বের স্বাধীনতা ও প্রগতিকামী মানুষদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে  সাম্রাজ্যবাদীদের সাহায্য দানের জঘন্যতম উদাহরণ হলো এই। এরা জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতক।'

দেশব্যাপী এ দিন

২২ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এক ঘোষণায় বলা হয়, আজ দেশের বিভিন্ন জেল থেকে প্রায় দেড় হাজার রাজবন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৪০০ বন্দিই ঢাকা ও যশোর জেলে আটক ছিলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক এক ঘোষণায় বলে, আগামী সোমবার থেকে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে পুরোদমে কাজ শুরু হবে।

এ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে এক সভায় বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের যারা হত্যা করেছে তাদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে গণ্য করে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গণ্য করার জন্য দাবি জানানো হয়। এ সময় দাবিতে আরও বলা হয়, 'পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং আধা সামরিক বাহিনীর যে সব ব্যক্তি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল তাদের বিচার করতে হবে।'

একই সঙ্গে সভায় বলা হয়, 'পাকিস্তান সরকারের এই পরিকল্পিত গণহত্যার জন্য শাস্তি প্রদান করতে জাতিসংঘকেও এগিয়ে আসতে হবে।' সভায় সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক ড. এম এ লতিফ।

এ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক প্রেসনোটে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নাম তালিকা প্রকাশ তবে। তবে এতে বলা হয় 'সমস্ত শিক্ষক এবং গবেষকদের এখনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আশঙ্কা করা হচ্ছে তারাও হানাদারদের শিকার হয়েছেন।'

 

২২ ডিসেম্বর ১৯৭১: গণহত্যার তদন্ত শুরু করে ভারতীয় সেনাবাহিনী

 

ফাইল ছবি।

ফাইল ছবি।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরিচয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবার চূড়ান্ত বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। সেই অনন্য অর্জন অন্যদিকে এই ডিসেম্বর স্বজন হারানোর মাস। ৩০ লাখ প্রাণ ও অসংখ্য নারীর সম্ভ্রম হারানোর বেদনা মিশে আছে এই বিজয়ের ক্ষণে।

জাতির জীবনে আবারো এসেছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। কোটি মানুষের হৃদয়ে এই ডিসেম্বর আসে প্রেরণা, প্রতিজ্ঞার বার্তা নিয়ে। প্রতিকূল পরিস্থিতিকে পরাজিত করে সুন্দর, সত্যের পথে লড়াইয়ের সঞ্জীবনী শক্তি লুকিয়ে রয়েছে এই ডিসেম্বরে। আজ ২২ ডিসেম্বর।

চলুন দৃষ্টি ফেরাই ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বরের দিনটিতে।

এদিন স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও সরকারের সাত সদস্য ভারতীয় বিমানবাহিনীর ক্যারিবু পরিবহন বিমানে করে অস্থায়ী ঢাকা এসে পৌঁছান। বিমানবন্দরে তাদের বিপুলভাবে সংবর্ধিত করা হয়। বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের আদর্শ বাস্তবায়নে কাজ করতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

এ দিনে পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা বরখাস্ত হন। এর মধ্যে চিফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান ও নিরাপত্তা সচিব মেজর জেনারেল আবু বকর ওসমান মিঠা, মেজর জেনারেল খোদা বখশ, মেজর জেনারেল কায়ানি ও এয়ার মার্শাল রহিমকে সেনাবাহিনী থেকে অবসর দেওয়া হয়। এছাড়া পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো নৌবাহিনীর ছয় কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেন। বেসামরিক উপদেষ্টাদের মধ্যে বরখাস্ত হন এমএম আহমেদ, মোহাম্মদ শফিক ও গিয়াসউদ্দিন আহমেদ।

বাংলাদেশে পাক হানাদার বাহিনী পরিচালিত গণহত্যার জন্য যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। বুদ্ধিজীবী হত্যা ও অন্যান্য অভিযোগে যারা অভিযুক্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন একজন জেনারেল, একজন ব্রিগেডিয়ার, তিনজন কর্নেল, দুজন মেজর ও একজন ক্যাপ্টেন। এ ছাড়া দ্বিতীয় আরেক তালিকায় ১২ অভিযুক্তের নাম রয়েছে। এ তালিকা প্রণয়ন তখনও চলছিল।

রাওয়ালপিন্ডিতে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয় যে, শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে গৃহবন্দি রাখা হয়েছে। এদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টো জানান, তিনি শিগগিরই চীন সফরে যাবেন।

২২ ডিসেম্বর গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া মুক্তি দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে এ দুই থানা হানাদারমুক্ত হয়। ১৬ ডিসেম্বর দেশের বিজয় ঘোষিত হলেও গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া পাক হানাদারমুক্ত হয়েছিল ২২ ডিসেম্বর। টানা ২৮ দিন মুক্তিবাহিনী ও মুজিববাহিনীর আক্রমণের পর গৌরনদী কলেজ ক্যাম্পে অবস্থানরত শতাধিক পাকসেনা মিত্রবাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণ করে। আর এর মধ্য দিয়ে ওইদিন এ দুই থানা হানাদারমুক্ত হয়। তবে এর আগে আগৈলঝাড়ার ছয়টি ও গৌরনদীর চারটি বধ্যভূমিতে নিরীহ বাঙালিদের হত্যা করে গণকবর দেয় পাকিস্তানি সেনারা।