৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ এই দিনে

১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর সকাল পৌনে ১১টায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের গলফ মাঠে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ৪৭৮ জন অফিসার অস্ত্র সমর্পণ করেন। একই সঙ্গে ঢাকা সেনানিবাসের বিভিন্ন ইউনিটে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নেতৃত্বে প্রায় ৩০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

এ দিন ব্রিটিশ সংবাদপত্র সানডে টাইমসের সাংবাদিক নিকোলাস ক্যারলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'ভারত তার বিভিন্ন দেশে থাকা দূতাবাসের মাধ্যমে বিশ্বের সব দেশকেই শেখ মুজিবের মুক্তির বিষয়ে এগিয়ে আসার অনুরোধ করেছে। আমরা যথেষ্ট চাপ দিতে পারি বলে আমি মনে করি না। তবে আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি অন্য দেশগুলোও আমাদের মতো শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য আওয়াজ তুলবেন।'

নিকোলাস ক্যারলের 'বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য কবে নাগাদ ফিরিয়ে আনা হবে?' প্রশ্নের জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'আমি বিভিন্ন সভা সমাবেশে দেওয়া বক্তৃতায় স্পষ্টভাবে বলেছি এবং লোকসভায়ও বলেছি, আমাদের সেখানে কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই।'

'পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কি ধরণের হবে?' জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে ভীষণ আগ্রহী। এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তবে এটি খুবই দুঃখজনক যে তাদের পিছনে এমন কিছু সরকার আছে যারা এই বন্ধুত্বের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। তারপরেও আমার এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে পাকিস্তানের জন্য অন্তত একজন হলেও এমন আছেন যিনি আমাদের বন্ধুত্বকে অটুট রাখতে সাহায্য করবেন।'

ঢাকায় এ দিন

১৯ ডিসেম্বর দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় 'মালিককে বাঁচাতে ভারতীয় সেনা' শিরোনামে  একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনে ঢাকায় থাকা পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গভর্নর ডা. এ এম মালিকের অবস্থা ও জন মানুষের রোষ এই প্রতিবেদনে উঠে আসে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ডা. মালিককে বাঁচাতে গিয়ে ভারতীয় সেনারা সাধারণ মানুষের হাতে নাজেহাল হচ্ছেন। মুক্তি ফৌজের ক্রোধ চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে। যার ফলে ভারতীয় সেনাদের গতকাল সেই ক্রোধের হাত থেকে এ এম মালিক ও তার সাবেক সভাসদদের বাঁচাতে চরম বেগ পেতে হয়। শেষ পর্যন্ত ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চল কমান্ডের চিফ অব স্টাফকেও ইন্টারকন্টিনেন্টালে যেতে হয়। গতকাল সন্ধ্যায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে হাজারো মুক্তি ফৌজ এবং সাধারণ মানুষ হোটেলটি ঘিরে ফেলে। এ সময় তারা ডা. মালিক ও তার সাবেক মন্ত্রীসভার সদস্যদের বের করে দেওয়ার দাবি জানায়। তাদের উদ্দেশ্য, তারা তাকে হত্যা করবে। এক পর্যায়ে ভারতীয় বাহিনী ট্যাংক দিয়ে গোটা হোটেল ঘিরে ফেলে। ঘটনাস্থলে হাজির হন পূর্বাঞ্চলের চিফ অব স্টাফ। এ সময় তিনি মুক্তিফৌজের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে সমঝোতায় এসে জনতাকে শান্ত করেন। তবে জনতা যাওয়ার সময়ে বলে গেছে হোটেলটি উড়িয়ে দেবে।

ভারতে এ দিন

১৯ ডিসেম্বর কানপুরে এক বিশাল জনসভায় ভারতের অর্থমন্ত্রী ওয়াই বি চ্যাবন বলেন, 'বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ভারত সর্বপ্রকার সাহায্য দেবে। এই নতুন রাষ্ট্রের জনগণের অর্থনৈতিক উন্নতিই তাদের স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করবে। এই স্বাধীনতার জন্য ভারত প্রায় সব ধরণের ঝুঁকি নিয়েছিল। ভারত কেবল সৈন্যবাহিনীর যুদ্ধে জয়লাভ করেনি, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও ঔপনিবেশিক বিরোধী যুদ্ধেও জয়লাভ করেছে। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের মোহের স্বরূপ এখন প্রকাশ পেয়েছে। বিশ্ব দেখেছে দেশভাগের সময় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন, কালের নিরিখে তা অশান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। ভারত চরম ধৈর্য ও সংযম দেখানোর পর শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদ জানানো এবং বাংলাদেশে মানবিকতার স্বার্থে ঝুঁকি নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলো।'

দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক বুদ্ধিজীবী সম্মেলনে প্রায় ১০০ জন বুদ্ধিজীবী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি চেয়ে দাবি জানান। এক প্রস্তাবে বুদ্ধিজীবীরা বলেন, 'নব অভ্যুদিত বাংলাদেশকে পরিচালনার জন্য পাক কর্তৃপক্ষের উচিৎ দ্রুততার সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়া।' উত্থাপিত এই প্রস্তাবে আরও বলা হয়, 'পাকিস্তানের জনগণের সঙ্গে ভারতের কোনো বিবাদ নেই। তাদের সঙ্গে আমাদের ঐতিহাসিক, ভাষা ও সংস্কৃতিগত যোগসূত্র বর্তমান। আমরা তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে শ্রদ্ধা করি।' প্রস্তাবে আশা প্রকাশ করে বলা হয়, 'বর্তমান যুদ্ধ বিরতি উভয় দেশকে চিরন্তন শান্তির পথে টেনে নেবে। তবেই আমরা বন্ধুত্ব ও সহযোগিতাপূর্ণ পরিবেশে বাস করতে পারবো।'

মুজিবনগর যাওয়ার আগে কলকাতায় দমদম বিমানবন্দরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধর বলেন, 'বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কাজে মন্ত্রীসভার সামনে যে চ্যালেঞ্জ এসেছে তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আশ্বাস ও সহায়তা প্রদান নিয়েই আমি মুজিবনগরে যাচ্ছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা কৃতিত্বের গৌরব অর্জন করেছেন তাদের অভিনন্দন জানাতেই আমার এই যাত্রা।'

পাকিস্তানে এ দিন

১৯ ডিসেম্বর পাকিস্তান রেডিওতে এক ঘোষণায় বলা হয়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। আগামীকাল নতুন সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।

রাওয়ালপিন্ডিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার মার্শাল আসগর খান বলেন, 'প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পুরাদস্তুর আহাম্মক। তার একগুঁয়েমির কারণেই পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের বিচ্ছেদ হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে সে যা করেছে তা কেবল আত্মঘাতীই নয়, বরং মানবতা বিরোধী। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কারণে পাকিস্তানের আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ইয়াহিয়াকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। কেবল ইয়াহিয়াই নয়, তার ৩-৪ জন সর্বোচ্চ সামরিক অফিসারকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো দরকার।'

রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীন বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলে, 'শেখ মুজিবুর রহমানকে শিগগির মুক্তি দেওয়া হতে পাড়ে। শেখ মুজিবুর রহমানকে আটকে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। যদিও আমি এ নিয়ে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে কোনো কথা বলিনি।'

জানা যায় অনির্দিষ্টকালের জন্য তার বিচার স্থগিত—এই খবরের পর থেকেই বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিষয়টি জোরদার হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মহলে এ দিন

১৯ ডিসেম্বর লন্ডনে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, 'পাকিস্তানের পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ খারাপ। আমি এক নতুন জগত, নতুন দেশ গঠনে সাহায্য করার জন্য দেশে ফিরে যাচ্ছি। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে আমার সঙ্গে পাকিস্তান বৈরিতা সুলভ আচরণ করবে বলে আমার মনে হয়।' এ সময় এক সাংবাদিক জানতে চান, ১৪ দিনের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে যেসব ঘটনা ঘটেছে তারপরেও আপনি পূর্ব পাকিস্তানকে নিজের দেশ বলে মনে করেন কি না। প্রশ্নের জবাবে জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, 'অবশ্যই পাকিস্তান এখনো একটি দেশ। সামরিক ব্যাপার স্থায়ী সত্য হতে পারে না।'

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবুর রহমানের ভবিষ্যৎ নিয়ে এ সময় সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে ভুট্টো কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ সময় তিনি বলেন, 'পাকিস্তানে গিয়ে তাদের সম্পর্কে আমি অনেক কথা বলতে পারবো। তবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নিজেকে নিজেই কোণঠাসা মনে করছেন। জনগণই তাকে কোণঠাসা করেছে। জনগণের সমর্থন পেলে আপনারা হিমালয়ের অপর দিকে তাকাতে পারেন।'

পাকিস্তানে পৌঁছে জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রথম কাজ কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'পাকিস্তানে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনাই আমার প্রথম কাজ। আমাদের এক নতুন জগৎ গড়তে হবে। এখন পাকিস্তানে যে রাজনৈতিক শূন্যতা রয়েছে তা পূরণ করা উচিৎ। বহুদিন যাবৎ পাকিস্তানের জনসাধারণকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন আমাদের পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে একটি অপূর্ব মিলন সাধন করতে জনগণের রায় মেনে নিতে হবে।'

১৯ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে লন্ডনে ফিরে প্রভাবশালী ব্রিটিশ এমপি ও হাউস অব কমন্সের সদস্য জন স্টোনহাউস বলেন, 'বাংলাদেশে এখন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নৃশংসতার চিত্র প্রকাশ্যে আসছে। পাকিস্তানি বাহিনীর এক মেজর জেনারেল ও জন পাকিস্তানি অফিসার প্রায় ২০০০ বুদ্ধিজীবীকে হত্যার তালিকা তৈরি করেছিল। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশকে প্রকৃত অর্থেই পঙ্গু করে দেওয়া।

ব্রিটিশ সংবাদপত্র ডেইলি টেলিগ্রাফ এ একটি বিশেষ প্রতিবেদনে সাংবাদিক ক্লেয়ার হলিংওয়ার্থ বলেন, 'যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর ডা. এম এ মালিককে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানেই বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার হবে বলে মনে হচ্ছে।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

১৯ ডিসেম্বর ঈশ্বরদী পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়। এর আগে ঈশ্বরদীতে থাকা বিহারীরা লোকশেড এলাকায় আত্মগোপন করে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলো। বিহারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে এ সময়ে ৩৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।