১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ এই দিনে
এদিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত ও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো পোল্যান্ডের দেওয়া আত্মসমর্পণের প্রস্তাবে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখান। এর আগে পোল্যান্ড বাংলাদেশের অবস্থা বিবেচনা করে পাকিস্তানি বাহিনীকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়। একইসঙ্গে, বাংলাদেশ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার কথা বলে।
ভুট্টো এ প্রস্তাবের জবাবে বলেন, 'আমি সারেন্ডার ডকুমেন্ট নিয়ে ফিরতে চাই না। আমি একটি আগ্রাসন সমর্থনের ডকুমেন্টকে বৈধতা দিতে পারি না। নিরাপত্তা পরিষদ সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ৪ দিন ধরে আমরা এখানে কথা বলছি। আর তারা কেবল ঢাকায় আত্মসমর্পণের প্রস্তাব তুলছে। কিন্তু কেন? কারণ তাদের লক্ষ্য ঢাকার পতন হওয়া। কিন্তু ঢাকার পতন হলে কী হবে? যদি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের পতন হয় তবে কী হবে? পশ্চিম পাকিস্তানের পতন হলেও কী হবে? এরকম যদি হয়, আমরা নতুন পাকিস্তান গড়ব। নিরাপত্তা কমিশন সেই অনুযায়ীই এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা কী করব বা নিরাপত্তা কীভাবে ফিরে আসবে, আমাদের এখানে এসে তা বলার কথা ছিল। কিন্তু এই প্রসঙ্গে সবাই চুপ।'
ভুট্টো তার বক্তব্যের শেষ প্রান্তে এসে প্রস্তাবের কাগজ ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলেন, 'আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব। কেন আমি নিরাপত্তা পরিষদে সময় নষ্ট করছি? আমি যাচ্ছি। জাতিসংঘে এটাই আমার শেষ আসা।'
এ সময় তিনি ও পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের সদস্যরা নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করে চলে যান।
১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজী পাকিস্তান দূতাবাসের মাধ্যমে ভারতের কাছে যুদ্ধবিরতির আবেদন জানান। এ সময় ভারতীয় বাহিনীর শ্যাম জেনারেল মানেকশ সন্ধ্যা ৫টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকার ওপর বিমান হামলা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। ভারতীয় বাহিনীর পক্ষ থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজীকে পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়, 'পাকিস্তানি বাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করবে কি না, তা জানানোর জন্য বিশেষ বেতার কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং কোড নম্বর দেওয়া হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে শর্তহীন আত্মসমর্পণ না করা হলে ফের বিমান হামলা শুরু হবে। ভারত বা বাংলাদেশ সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশনের পূর্ণ সুযোগ দেওয়া হবে।'
ঢাকায় এদিন
১৫ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নির্দেশে এবং পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা মওলানা আবদুল মান্নানের সহযোগিতায় আলবদরের বেশ কয়েকজন তরুণ প্রখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরীকে রোগী দেখার কথা বলে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়।
১৫ ডিসেম্বর কারফিউয়ের সময় সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলের ক্লিনিক্যাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বিকে।
১৫ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর কাছে সাভার হারিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গাবতলীর কাছে অবস্থান নেয়। পরে ভারতীয় মিত্রবাহিনী সাভার থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। এ সময় কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনীও মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। এদিন রাত ২টার দিকে গাবতলী ব্রিজের কাছে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ সময় মিত্রবাহিনীর আরেকটি দল যোগ দিলে ২ পক্ষের মধ্যে রাতব্যাপী যুদ্ধ হয়।
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
১৫ ডিসেম্বর ভারতীয় নৌবাহিনীর সহযোগিতায় সোভিয়েত রণতরীর ২০টি জাহাজ ভারত মহাসাগরে অবস্থান নিলে মার্কিন ৭ম নৌবহর দিক পরিবর্তন করে।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
১৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে লেফটেন্যান্ট শওকতের নেতৃত্বে গণবাহিনীর কোম্পানি, ক্যাপ্টেন গফফারের নেতৃত্বে চতুর্থ বেঙ্গলের দল ও ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে ১০ ইস্ট বেঙ্গলের যোদ্ধাদের কাছে মেজর হাদীর নেতৃত্বে হাটহাজারীতে থাকা হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে।
১৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে দশম ইস্ট বেঙ্গলের চার্লি কোম্পানির কমান্ডার লেফটেন্যান্ট দিদারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর কুমিরা ঘাঁটিতে ব্যাপক আক্রমণ চালায়। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ব্যাপক আক্রমণের মুখে এক পর্যায়ে ফৌজদারহাটে গিয়ে পৌঁছায় মুক্তিবাহিনী। এরপর মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিবাহিনী হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণের জন্য এগিয়ে যায়।
১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারীতে মুক্তিবাহিনী হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। এ সময় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হানাদার বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।
১৫ ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনী রংপুর শহর ঘিরে ফেলে। পরদিন মিত্রবাহিনীর রংপুর ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ করার কথা থাকলেও, হানাদার বাহিনী এদিন সন্ধ্যার দিকে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব দেয়।
১৫ ডিসেম্বর গাজীপুর হানাদারমুক্ত হয়। এর আগে ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর গাজীপুর সেনানিবাসে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী সম্মিলিতভাবে আক্রমণ চালালে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি বাহিনী চান্দলা চৌরাস্তায় অবস্থান নেয়। এরপর এদিন সকালে হানাদার বাহিনী জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্ট, সমরাস্ত্র কারখানা ও অর্ডন্যান্স ডিপো থেকে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ও যানবাহন নিয়ে ঢাকায় ফিরতে শুরু করে। খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনী গাজীপুরের ছয়দানা ও টঙ্গীতে অবস্থান নিয়ে হানাদার বাহিনীর ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এক পর্যায়ে কাশিমপুর থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনীও আর্টিলারি হামলা চালায়। এ সময় হানাদার বাহিনীর বহু সেনা নিহত হয়। একইসঙ্গে হানাদার বাহিনীর প্রচুর সমরাস্ত্র ধ্বংস হয়।
১৫ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি হানাদারমুক্ত হয়। এদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে খাগড়াছড়ি শহরের এসডিও বাংলোতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে মুক্তিবাহিনী।
১৫ ডিসেম্বর মেজর আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর কাছে কুমিল্লা ময়নামতি সড়কে অবস্থানরত ১৫০ হানাদার সেনা আত্মসমর্পণ করে।
১৫ ডিসেম্বর খুলনায় মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার এম আরেফিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল নদীপথে হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। এ সময় সড়কপথে মেজর জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে একটি দল খুলনা আক্রমণ করে খুলনার বড় একটি অংশ নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। এক পর্যায়ে মিত্র বাহিনী হানাদার বাহিনীর ফুলতলা অবস্থানের উপর বিমান হামলা চালালে হানাদার বাহিনী পালিয়ে যায়।
১৫ ডিসেম্বর বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে ১ হাজার ৭০০ সেনা, অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
১৫ ডিসেম্বর ফরিদপুরের মধুখালির কামারখালীতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদার বাহিনীর ঘাঁটির ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। হানাদার বাহিনী ফরিদপুরের দিকে পালাতে শুরু করলে ভারতীয় মিত্রবাহিনী তাদের ধাওয়া করে। এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
১৫ ডিসেম্বর সিলেটের চিকনাগুল চা বাগান থেকে পালিয়ে যাওয়া হানাদার বাহিনীকে ধরতে হানাদার বাহিনীর ঘাঁটি খাদিমগর চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে মুক্তিবাহিনী। এসময় মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার গোলাম রসূল শহীদ হন।
১৫ ডিসেম্বর সিলেটে মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে ৪ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা সালুটিকর বিমান বন্দরের দিকে অগ্রসর হবার পথে গোবিন্দগঞ্জ ও বিশ্বনাথ দখল করে নেন। এ সময় প্রায় ৩০০ মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নিয়ে ক্যাপ্টেন নবী রাধানগর গোয়াইঘাট আর্টিলারি সাপোর্ট ছাড়াই আক্রমণ করে দখল করে নেন। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে হানাদার বাহিনী পালাতে শুরু করে।
১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১, হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের সূচনা
পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় হয়ে উঠেছিল সময়ের ব্যাপার। আর কয়েক দিন যুদ্ধ চালানোর মতো সামর্থ্য হয়তো তাদের ছিল, সে রকম চাপও ছিল পিন্ডির হেডকোয়ার্টারস ও মার্কিনিদের তরফ থেকে; তবে সেই যোগ্যতা ও উদ্যম তাদের ছিল না, দ্রুত ভেঙে পড়ছিল মনোবল। অগ্রসরমাণ ভারতীয় বাহিনীর সামনে দাঁড়ানোর সাহস যেমন তাদের ছিল না, তেমনি ছিল মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার প্রচণ্ড ভয়। ১২ তারিখ পিন্ডির হেডকোয়ার্টারসে বার্তা পাঠিয়েছিল নিয়াজির দপ্তর, ভীতসন্ত্রস্ত সেই বার্তায় লেখা হয়েছিল, আমাদের পক্ষের ধৃত এক কর্মকর্তাকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ফেরত পাঠানো হয়েছে, এ কথা লিখে যে যদি আমরা আত্মসমর্পণ না করি, তবে সব যুদ্ধবন্দীকে মুক্তিফৌজের হাতে তুলে দেওয়া হবে। বার্তায় আবেদন করা হয়েছিল, সরকার যেন দ্রুত আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও ভারতীয় পক্ষের কাছে বিষয়টি তুলে ধরে। নয় মাসজুড়ে ধৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে পাকিস্তানি বাহিনী, সাধারণ বাঙালিদের যে নৃশংসতা নিয়ে নির্বিচারে হত্যা করেছে, তার পরিণামে মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়া নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তার অবধি ছিল না।
১৪ ডিসেম্বরই বোঝা গিয়েছিল, পাকিস্তানি বাহিনীর মরণঘণ্টা বেজে গেছে। ঢাকা থেকে পিন্ডিতে বার্তা পাঠানোর সংখ্যা সেদিন অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এই সব বার্তায় ফুটে উঠছিল চরম হতাশার সুর। সকাল ১০টায় প্রেরিত এক বার্তায় বলা হয়, ‘আমরা আশ্বাসের ওপর বেঁচে আছি।… কিছু ঘটবে কি না অনুগ্রহ করে জানান, যা ঘটবার সেটা অতি দ্রুত হতে হবে।’ আরেক বার্তায় বলা হয়, ‘আমাদের কোনো মিসাইল নেই, আমরা কীভাবে গোলা নিক্ষেপ করব? কোনো বিমানবাহিনী নেই। বিমান হামলা হয়ে উঠেছে দুশ্চিন্তার কারণ।’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা ছিল, ‘আমরা সভা করতে যাচ্ছি গভর্নর হাউসে।’
এই খবর পেয়ে ভারতীয় যুদ্ধবিমান সরাসরি গোলা নিক্ষেপ করে গভর্নর হাউসের দরবার হল লক্ষ্য করে, আয়োজিত সভা পন্ড হয়ে যায় এবং ভয়ে কম্পমান এ এম মালিকের প্রাদেশিক সরকার সদলে পদত্যাগ করে আশ্রয় নেয় ‘নিরাপদ এলাকা’ ঘোষিত হোটেল ইন্টার-কন্টিনেন্টালে। আর তাই ১৫ ডিসেম্বর দিনটি শুরু হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে সরকারবিহীন পরিস্থিতিতে এবং বাতাসে পাওয়া যাচ্ছিল আত্মসমর্পণের আভাস। ভেতরের খবর অবশ্য সবার জানা ছিল না, আগের দিন বিকেলে গভর্নর ও নিয়াজির কাছে প্রেরিত বার্তায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জানান, ‘আপনি এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছেন, যখন আর প্রতিরোধ কোনোভাবেই সম্ভব নয়, সেটা কোনো কাজের কথাও হবে না। এখন যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য সব রকম ব্যবস্থা আপনাদের নেওয়া উচিত।’ তবে সর্বশেষ এই বার্তাতেও আত্মসমর্পণ কথাটা ঊহ্য রাখা হয় এবং দায়দায়িত্ব চাপানো হয় ইস্টার্ন কম্যান্ডের ওপর।
অবরুদ্ধ ঢাকা হয়ে আছে থমথমে শহর, কী ঘটবে অচিরে, আত্মসমর্পণ না চূড়ান্ত যুদ্ধ, সেই ভাবনায় অধীর সবাই। লোকচক্ষুর অন্তরালে ঘটে যাচ্ছে অনেক ঘটনা, নিথর হয়ে থাকা নিষ্ঠুর অনেক বাস্তবতা উন্মোচিত হওয়ার অপেক্ষায়। যেমন পড়েছিল রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের ছড়ানো-ছিটানো লাশ, সেলিনা পারভীনের দুচোখ তখনো বাঁধা, বুকে বুলেটের, বেয়নেটের রক্তদাগ। নাগরিকজনেরা কেউ জানে না এসবের হদিস, জানে না সেনাসদরে চলছে কোন খেলা।
কী ঘটছিল পর্দার অন্তরালে, তার এক বিবরণ দিয়েছেন ঢাকাস্থ জাতিসংঘ উদ্বাস্তুবিষয়ক কর্মকর্তা জন কেলি। মালিক তখন আর গভর্নর নন, প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছেন জাতিসংঘ-ঘোষিত নিরাপদ এলাকায়, প্রেসিডেন্টের বার্তা মোতাবেক যুদ্ধ বন্ধ করতে চান, কিন্তু নিয়াজির সঙ্গে কোনোভাবে যোগাযোগ করতে পারছেন না। এ ক্ষেত্রে গভর্নর সাহায্য চাইলে জন কেলি সেনাবাহিনীর লিয়াজোঁ অফিসার কর্নেল গফুরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। গফুর হোটেলে এসে গভর্নরের সঙ্গে নিয়াজির ফোনে কথা বলিয়ে দেন। সেই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মেজর জেনারেল ফারমান আলী গভর্নর এ এম মালিকের সঙ্গে মিলে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দাঁড় করিয়ে চলে যান ইস্টার্ন কম্যান্ডে।
অন্যদিকে ইস্টার্ন কম্যান্ডের হেডকোয়ার্টারসে জেনারেল নিয়াজি চাইছিলেন রাওয়ালপিন্ডি থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশ আসুক আত্মসমর্পণের জন্য। সকালে তিনি গভর্নর মালিকের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছিলেন ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। গভর্নর লিখেছিলেন, ‘আপনার ও আমার কাছে প্রেসিডেন্ট প্রেরিত বার্তার পরিপ্রেক্ষিতে আপনার দিক থেকে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, সেটা আমি জানতে চাইছি। বার্তায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে আপনি সংঘাত বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিন এবং সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, পশ্চিম পাকিস্তানের ও এখানকার বিশ্বস্তজনদের জীবন রক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। যা দরকার সেটা করার জন্য আপনাকে অনুরোধ করছি।’
এরপর নিয়াজি পিন্ডিতে জেনারেল হামিদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। জেনারেল হামিদ তাঁকে ‘নির্দেশমতো কাজ করতে’ বলেন। নিয়াজি আকুল হয়ে প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে কথা বলতে চান। দেশের এই গুরুতর পরিস্থিতিতে ইয়াহিয়ার তখন অন্য দশা, নিয়াজি লিখেছেন, ‘জেনারেল হামিদ বললেন তিনি (ইয়াহিয়া) বাথরুমে গেছেন। আদতে তিনি বাথরুমে ছিলেন না, অতিরিক্ত মদ্যপানে তার তখন বেসামাল অবস্থা। এরপর এয়ার মার্শাল রহিম খান আমার সঙ্গে কথা বলেন, তাঁকেও মনে হচ্ছিল মাতাল, তিনি চাপ দেন আমি যেন প্রেসিডেন্টের হুকুম তামিল করি।’ এর পরপরই মালিক-ফারমান আলী মুসাবিদা করা লড়াইয়ে ক্ষান্ত দেওয়ার বার্তা ভারতীয়দের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা নেন নিয়াজি।
এদিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আমেরিকার উদ্যোগে চলছিল শেষ খেলা। ১৩ ডিসেম্বর তৃতীয়বারের মতো সোভিয়েত ভেটো নিছক যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের মার্কিন প্রয়াস রুখতে সমর্থ হয়েছিল। পরিষদের জরুরি বৈঠক ডেকে আমেরিকা আবারও নেয় সেই চেষ্টা। আলোচনা দীর্ঘায়িত করার জন্য পোল্যান্ড পেশ করে নতুন প্রস্তাব যেখানে কেবল যুদ্ধ বন্ধ নয়, এর সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রাজনীতিক সমাধান তথা পূর্বাংশে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ও শেখ মুজিবের মুক্তির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকে। নাটকীয়ভাবে প্রস্তাবের কাগজ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে পাকিস্তানি প্রতিনিধি জুলফিকার আলী ভুট্টো পরিষদ কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। ফলে চুকেবুকে যায় সংকটের আন্তর্জাতিকীকরণের সব প্রচেষ্টা। বঙ্গোপসাগরে পৌঁছে যাওয়া মার্কিন সপ্তম নৌবহরের আটটি যুদ্ধজাহাজকেও থমকে যেতে হয়। তাদের মাথার ওপর এমন কোনো ছাতা মেলে ধরার সম্ভাবনা রইল না, যার আড়ালে তারা হতে পারবে সক্রিয়।
নিয়াজির যুদ্ধ বন্ধের বার্তাটি দেওয়া হয়েছিল ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেল স্পিভাকের হাতে, ভারতীয় হাইকম্যান্ডে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। স্পিভাক সেটা সরাসরি দিল্লি না পাঠিয়ে প্রেরণ করেন ওয়াশিংটনে। সেখানে মার্কিন প্রশাসন তখন মরিয়া যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের চেষ্টায়, যেনতেনভাবে হলেও যেন পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করা যায়। কিন্তু তাদের হাতে আর কোনো তাস ছিল না, নিরাপত্তা পরিষদ অকেজো, এদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর সব মুরোদ গেছে ফৌত হয়ে। ফলে খেলায় ক্ষান্ত দিয়ে বার্তাটি তারা পাঠিয়ে দেয় দিল্লিতে। ভারতীয় বাহিনীর প্রধান ফিল্ড মার্শাল মানিকশ জবাবে নিয়াজি প্রদত্ত রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিতে তাঁকে জানান, ‘যেহেতু আপনি যুদ্ধ আর না চালানোর ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন, তাই আমি আশা করি, আপনি বাংলাদেশে আপনার কম্যান্ডের অধীন সব বাহিনীকে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ এবং যারা যেখানে আছে তাদের আমার অগ্রসরমাণ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের জন্য নির্দেশ দেবেন।’ মানেকশ পাকিস্তানি বাহিনীর নিরাপদ হেফাজতের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে আরও জানান, ১৫ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটা থেকে তিনি ঢাকার ওপর বিমান হামলা এবং সব ধরনের আক্রমণ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। সবশেষে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘তবে আমি যা বললাম তা যদি আপনি মান্য না করেন সে ক্ষেত্রে আমার আর অন্য কিছু করবার থাকবে না, ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯-০০ ঘটিকা থেকে সর্বশক্তি নিয়ে আমি আবার আক্রমণ শুরু করব।’
ছত্রখান হয়ে যাওয়া ইস্টার্ন কম্যান্ড ও বিলুপ্ত বেসামরিক শাসন এবং সুরায় ভাসমান রাওয়ালপিন্ডির সমরকর্তা কেউ আর মানেকশর এই চূড়ান্ত হুমকির জবাব দিতে পারঙ্গম ছিল না। কী ঘটতে যাচ্ছে সেটা তারা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল, কিন্তু সেই রাতে তারা ছিল জড়ভরত হয়ে, জবাবদানের মতো কোনো নেতৃত্ব ও ঐক্যবদ্ধতা আর পরাজিত পাকিস্তানি জেনারেলদের ছিল না। পাকিস্তানি ক্ষমতাকেন্দ্রে অধিষ্ঠিত নেতৃত্ব যে কতটা অযোগ্যতা, ভীরুতা, লাম্পট্য ও উদ্যমহীনতায় আক্রান্ত সেটা বাইরে থেকে বোঝা যায়নি। তাই দ্বিধাদ্বন্দ্বে কাটে ১৫ ডিসেম্বর, জবাব আসেনি আলটিমেটামের, জবাবদানের মতো কিছু সময় তখনো পাকিস্তানিদের হাতে ছিল, যৌথ বাহিনীর দয়ার এই দাক্ষিণ্যটুকু শেষ চুমুক পর্যন্ত বুঝি পান করতে চেয়েছিল নিয়াজি গং।
এভাবে পেরিয়ে যায় ১৫ ডিসেম্বরের দিন ও রাত, অমারাত্রির অবসান দৃষ্টিগোচর হলেও তা থেকে যায় দূরের হাতছানি হয়ে। নিষ্ঠুর পাকিস্তানি বাহিনী কীভাবে শেষ কামড় দেয়, আর কত রক্ত ঝরায় তা নিয়ে ছিল শঙ্কা। আশায় উদ্দীপ্ত দেশের মানুষ, তবু থেকে যায় আশঙ্কা, এভাবে কাটে আরও একটি দিন।
১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর নিয়ে কিছু কথা