৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ এই দিনে

বাংলাদেশের বিজয় আসন্ন জেনে এদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও আলবদর বাহিনী যৌথভাবে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তাদের বাসা থেকে একে একে তুলে নিয়ে পৈশাচিক নির্যাতনের পর হত্যা করে। 

এদিন দুপুর ১২টার দিকে সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকার বাসা থেকে আলবদর বাহিনীর 'চিফ এক্সিকিউটর' আশরাফুজ্জামান খান এবং 'অপারেশন ইনচার্জ' চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের উপস্থিতিতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে। এরপর দুপুর ১টার দিকে সেন্ট্রাল রোডের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক নাট্যকার মুনীর চৌধুরীকে। 

একই দিন সন্ধ্যায় কায়েতটুলির বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারকে। এদিন একে একে বহু বুদ্ধিজীবী নিজ নিজ বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় অজ্ঞাত স্থানে।  

১৪ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মানেকশ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উদ্দেশে এক বার্তায় বলেন, 'আমার সৈন্যরা এখন ঢাকাকে ঘিরে ধরেছে এবং ঢাকার ক্যান্টনমেন্টও এখন কামানের গোলার আওতায়। সুতরাং আপনারা আত্মসমর্পণ করুন। আত্মসমর্পণ না করলে নিশ্চিত মৃত্যু। যারা আত্মসমর্পণ করবে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে এবং তাদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করা হবে।' 

১৪ ডিসেম্বর, ঢাকার পরিস্থিতি 

গভর্নর হাউসে গভর্নর ডা. এম এ মালিকের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রিসভার সদস্যরা ১৪ ডিসেম্বর বৈঠকে বসেন। এ সময় বৈঠকের খবর শুনে ভারতীয় মিত্র বাহিনী সকাল সোয়া ১১টার দিকে গভর্নর হাউসে বিমান হামলা চালায়। এসময় গভর্নর হাউস বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্রাণ বাঁচাতে গভর্নর এম এ মালিক দৌঁড়ে গিয়ে এয়ার রেইড শেল্টারে গিয়ে আশ্রয় নেন। এসময় তিনি পদত্যাগ পত্র লিখে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পালিয়ে যান। 

১৪ ডিসেম্বর বিকেলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজী  যুদ্ধবিরতির জন্য প্রস্তাব অনুমোদন করেন। এরপর ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব পাঠায়। 

১৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামান ও দুই ভাই যথাক্রমে  শাহজাহান ও করিমুজ্জামানকে ঢাকার গোপীবাগের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনী। 

ভারতে এদিন 

১৪ ডিসেম্বর দিল্লিতে লোকসভার অধিবেশনে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, 'পাকিস্তান আগেভাগে আক্রমণ করে যে ফায়দা লুটবে বলে আমরা আশা করেছিলাম তা হয়নি। ওদের সমস্ত মতলব ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে বিজয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বিজয় এখন হাতের মুঠোয়। কাশ্মীরেও ভারতীয় বাহিনী বহু পাকিস্তানিদের ঘাঁটি দখল করেছে। পাকিস্তানি বাহিনী দুই রণাঙ্গনেই চরমভাবে মার খাচ্ছে।' 

পাকিস্তানে এদিন  

১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র নিশ্চিত করে, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজী যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মানতে  প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ করেছেন। মূলত এর আগে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও জেনারেল নিয়াজি অপেক্ষায় ছিলেন কয়েকদিনের মধ্যেই মার্কিন সপ্তম নৌবছর বঙ্গোপসাগরে এসে উপস্থিত হবে।  

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন 

১৪ ডিসেম্বর মস্কোতে আফগানিস্তানের বাদশা মুহাম্মদ জহির শাহের সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায় সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট  এন ভি পদগোর্নি বলেন, 'এশীয় উপমহাদেশে সাম্প্রতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় জনসাধারণ অতিমাত্রায় আতঙ্কিত। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্মমভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনসমষ্টির মৌলিক অধিকারসমূহের ও সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত ইচ্ছার দমন দেশের সেই অংশে পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটিয়েছে। প্রায় ১ কোটি শরণার্থীকে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এশিয়ার দুটি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সংঘর্ষ দানা বেঁধে উঠেছে। এ অঞ্চলে রক্তপাত বন্ধ করার পক্ষে, বাইরের শক্তিগুলোর কোনরূপ হস্তক্ষেপ ছাড়াই জনসাধারণের আইনসম্মত অধিকারসমূহ বিবেচনার মধ্যে রেখে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক মীমাংসার পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন অবিচলভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সেই এলাকায় স্থায়ী ও ন্যায়সঙ্গত শান্তি প্রতিষ্ঠার উপযোগী অবস্থা সৃষ্টির জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন চাপ দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, যে সব কারণে ভারতীয় উপমহাদেশে পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে সেগুলো দূর করার বৈপ্লবিক উপায় হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক মীমাংসার প্রশ্ন থেকে যুদ্ধবিরতির প্রশ্নটিকে বিচ্ছিন্ন করা চলে না।'

১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফের ভেটো দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি উপমহাদেশে যুদ্ধ পরিস্থিতির অবসান জানিয়ে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তৃতীয় বারের মতো ভেটো দেয়। এদিন মার্কিন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় ১১টি দেশ। অন্যদিকে পোল্যান্ড ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বিপক্ষে ভোট দেয় আর ভোটদানে বিরত থাকে ব্রিটেন ও ফ্রান্স। 

১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সরদার শরণ সিং  বলেন, 'পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক তৎপরতা বন্ধ করলে এবং বাংলাদেশে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সমাধানের পথের দিকে এগোলে তবেই ভারত নিজেদের সেনা প্রত্যাহার করবে। জাতিসংঘে মার্কিন দূত জর্জ ডব্লিউ বুশের 'এখানে ভারতের গভীর অভিসন্ধি লুকিয়ে আছে। সেই অভিসন্ধি আসলে কি?' প্রশ্নের জবাবে সরদার শরণ সিং বলেন, 'আমি মাননীয় মার্কিন প্রতিনিধির কাছে জানতে চাই, তিনি কী পাকিস্তানের অভিসন্ধি জানতে চেষ্টা করেছেন? পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণা এবং ভারতের আঞ্চলিক সীমানা লঙ্ঘনের পেছনে পাকিস্তানের কী অভিসন্ধি রয়েছে তা কি আপনি বা আপনার সরকার জানার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেছেন?'  

১৪ ডিসেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধের অবসানের জন্য ইতালি ও জাপান নতুন করে একটি প্রস্তাব জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করে। 

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ 

১৪ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের পাশে শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন শহীদ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। এর আগে ১০ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর, লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম, লেফটেন্যান্ট আউয়াল ও ৫০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিমে বারঘরিয়া এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৪ ডিসেম্বর ভোরে মাত্র ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বারঘরিয়া এলাকা থেকে ৩-৪টি দেশি নৌকায় করে রেহাইচর এলাকা থেকে মহানন্দা নদী অতিক্রম করেন তারা। নদী অতিক্রম করার পর উত্তর দিক থেকে একটি একটি করে প্রত্যেকটি শত্রু অবস্থানের দখল নিয়ে দক্ষিণে এগোতে থাকেন। তিনি এমনভাবে আক্রমণ পরিকল্পনা করেছিলেন যেন উত্তর দিক থেকে শত্রু নিপাত করার সময় দক্ষিণ দিক থেকে শত্রু কোনকিছু আঁচ করতে না পারে। এভাবে এগুতে থাকার সময় জয় যখন প্রায় সুনিশ্চিত তখন ঘটে বিপর্যয়। হঠাৎ বাঁধের ওপর থেকে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের ৮-১০ জন সৈন্য দৌড়ে চর এলাকায় এসে যোগ দেয়। এরপরই শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর অবিরাম ধারায় গুলিবর্ষণ। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর জীবনের পরোয়া না করে সামনে এগিয়ে যান। যখন আর একটি মাত্র শত্রু অবস্থান বাকি রইল এমন সময় মুখোমুখি সংঘর্ষে বাংকার চার্জে শত্রুর বুলেটে এসে বিদ্ধ হয় জাহাঙ্গীরের কপালে। শহীদ হন তিনি। 

১৪ ডিসেম্বর ফরিদপুর থেকে ঢাকার পথে মধুমতী নদী পেরিয়ে অনেকদূর এগিয়ে যায় মিত্রবাহিনী। এদিকে ঢাকা পৌঁছানোর জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি ব্রিগেড দ্রুত মধুমতী নদী পেরিয়ে যায়। অন্যদিকে যৌথবাহিনীর আরেকটি অংশ ঢাকার উত্তর দিক থেকে ঢাকায় প্রবেশের পথ টঙ্গীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তুরাগের পাড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মুখোমুখি হয়। এ সময় হানাদার বাহিনী নিজেদের অবস্থান শক্ত করে তোলে। যৌথ বাহিনীর একটি ব্রিগেড চন্দ্রা হয়ে নবীনগর-সাভার দিকে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। যৌথ বাহিনীর সর্বশেষ অংশ ডেমরা দিয়ে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ দখল করে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসে। এদিন ভারতীয় মিত্র বাহিনী হেলিকপ্টারের করে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের বৈদ্যের বাজারে এসে নামে। 

১৪ ডিসেম্বর জেড ফোর্সের অধীনে থাকা প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে ৪টি কোম্পানির মধ্যে ব্রাভো ও ডেলটা কোম্পানি সামনের সারিতে এবং আলফা ও চার্লি কোম্পানি দ্বিতীয় সারিতে থেকে এমসি কলেজে থাকা হানাদার বাহিনীর অবস্থানের খুব কাছে উত্তর পাশের টিলায় অবস্থান নেয়। সারাদিন আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর স্বল্প রেঞ্জের আওতার বাইরে পিছিয়ে অবস্থান নেয়।

এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে ব্রাভো ও ডেল্টা কোম্পানির ব্যাপক প্রাণহানি হয়। এই যুদ্ধে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের ২০ জোন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। 

১৪ ডিসেম্বর একাধারে হানাদার মুক্ত হয় কেশবপুর, মোড়েলগঞ্জ, শাহজাদপুর, শেরপুর, শিবগঞ্জ, উল্লাপাড়া, তাড়াইল, আক্কেলপুর, পাঁচবিবি, নবীনগর, সাভার, কালিয়াকৈর, গজারিয়া, মির্জাপুর, কাউখালি, চিলমারী, দোহাজারী, নাজিরহাট ও সান্তাহার রেল জংশন। 

১৪ ডিসেম্বর 'কে' ফোর্সের নবম ও দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং বিভিন্ন কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা নারায়ণগঞ্জের মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে যায়। এরপর তারা বালু নদীর পাড়ে অবস্থান নেন। 

১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনী কুমিরায় হানাদার বাহিনীর অস্থানের ওপর বড় ধরনের আক্রমণ চালিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে এগিয়ে যায়।  

১৪ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন গফফারের নেতৃত্বে চতুর্থ বেঙ্গলের একটি দল চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি রোড ধরে কুমিরা পাহাড় অতিক্রম করে  হাটহাজারির দিকে এগিয়ে যায়। 

১৪ ডিসেম্বর লেফটেন্যান্ট  শওকতের নেতৃত্বে গণবাহিনীর একটি কোম্পানি নাজিরহাট মুক্ত করে একটি ব্রিজ মেরামত শুরু করে।  

১৪ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে দশম ইস্ট বেঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধারা দুপুর ১২টার দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পৌঁছায়। 

১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি ব্রিগেড বার্মায় পালানোর সময়ে মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে।

১৪ ডিসেম্বর সিলেটে চিকনাগুল চা বাগানে যুদ্ধ চলমান থাকে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে হানাদার বাহিনী খাদিমনগরের দিকে পালিয়ে যায়। পরে বহু রাজাকার এসময় মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এ যুদ্ধে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ৪ জন আহত হন।

১৪ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয় বান্দরবান। এর আগে বান্দরবানের কালাঘাটা, ডলুপাড়া, ক্যানাই জ্যু পাড়াসহ কয়েকটি স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক যুদ্ধ হয় মুক্তিবাহিনীর। এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে হানাদার বাহিনী বান্দরবান ছেড়ে পালিয়ে যায়। 

১৪ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ হানাদার মুক্ত হয়। এর আগে ১৩ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার আমির হোসেন ভুলুর নেতৃত্বে শৈলাবাড়ীতে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পরে এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে ঈশ্বরদীর দিকে ট্রেনে করে পালিয়ে যায় হানাদার বাহিনী। পরে ১৪ ডিসেম্বর সকালে সিরাজগঞ্জ শহরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। 

 

 

১৪ ডিসেম্বর ট্র্যাজেডি

১৪ ডিসেম্বর ট্র্যাজেডি

 

 

গণহত্যার সময় আলাদা করে বুদ্ধিজীবী হত্যার কথা ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যার আগে কোথাও শোনা যায়নি। বহু দেশে বিভিন্ন সময়ে গণহত্যা হলেও এভাবে বুদ্ধিজীবী বাছাই করে হত্যাকাণ্ড করার চিন্তা পাকিস্তানিদের মাথাতেই এসেছিল। তারা এ কাজ করেছিল মরিয়া হয়ে। পরাজয় নিশ্চিত জেনে এ দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে শেষ ক্ষতি হিসেবে এ কাজ করে বাংলাদেশকে বুদ্ধিজীবীহীন করার এই চেষ্টার মধ্যে শুধু বর্বরতাই নয়, আহাম্মকিরও যথেষ্ট পরিচয় ছিল। কারণ, এভাবে কয়েকজনকে হত্যা করে একটি দেশকে বুদ্ধিজীবীহীন করা যায় না। বাংলাদেশেও সেটা হয়নি।
যাদেরকে ১৪ ডিসেম্বর সামরিক সরকারের ঠ্যাঙাড়ে বদর বাহিনীর লোকেরা অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল, তাদের মধ্যে ছিলেন মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার, ডাক্তার মুর্তজা, ডাক্তার রাব্বী, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সিরাজুদ্দীন হোসেন, ডাক্তার আলীম। তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই আমার পরিচয় ছিল। মুনীর চৌধুরী প্রথম জীবনে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সময় ১৯৫২ সালে তাকে গ্রেফতার করে আটক রাখা হয়েছিল। জেলের মধ্যেই তিনি লিখেছিলেন ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত তার বিখ্যাত নাটক 'কবর'। নাটকটি জেলের মধ্যেই অভিনীত হয়েছিল, যার কথা লিখেছেন রণেশ দাশগুপ্ত। আমার মনে আছে, আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময় একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার কামরায় দেখা করার সময় তিনি বার্নার্ড শর Taming of the shrew িনাটকের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। আমাকে বললেন, তুমি বসো তোমাকে আমার অনুবাদটা পড়ে শোনাই। দীর্ঘক্ষণ ধরে তিনি অনেকটাই আমাকে পড়ে শোনালেন। তার গলার স্বর খসখসে ছিল; কিন্তু তার পাঠ ছিল শ্রোতাকে ধরে রাখার মতো। পরে নাটকটি বাংলাদেশ টেলিভিশনে দেখানো হয়েছিল। খুব প্রশংসিতও হয়েছিল। তিনি ১৯৫৩ সালে জেল থেকে বের হয়ে এসে আর রাজনীতির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখেননি। এ প্রসঙ্গে পরবর্তীকালে তার বিখ্যাত উক্তি ছিল_ 'জীবনের মোহের কাছে আমি পরাজিত হয়েছি।' ১৯৭১ সালে তিনি এমন কোনো কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন না যাতে যুক্তিসঙ্গতভাবে পাকিস্তানিরা তাকে হত্যা করতে পারে। বরং এ সময়ে আলতাফ গওহরসহ উচ্চ পর্যায়ের কিছু পাকিস্তানি আমলার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো ছিল। কিন্তু এককালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি করতেন_ এই 'অপরাধের' কথা চিন্তা করেই পাকিস্তানিরা তাকে হত্যা করেছিল।
শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে আমার বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। ভাষা আন্দোলনের ওপর বইটি লেখার সময় তিনি ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত কমিউনিস্ট পার্টির সার্কুলার, লিফলেট ইত্যাদি দেখার জন্য আমাকে দিয়েছিলেন। তিনি তখন ছিলেন তাদের পার্টি আর্কাইভের দায়িত্বে। ১৯৭১ সালে তিনি পার্টির অন্য লোকদের অনেককে গোপন আশ্রয়ে রাখার ব্যবস্থা করলেও নিজের জন্য সে রকম কিছু ভাবেননি। মুনীর চৌধুরীর মতো তার সঙ্গেও আলতাফ গওহরের মতো পাকিস্তানি আমলাদের বন্ধুত্ব ছিল। সে কারণে তিনি নিজেকে নিরাপদ মনে করেছিলেন এবং আন্ডারগ্রাউন্ডে না গিয়ে প্রকাশ্যেই ছিলেন। এটাতে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। মুনীর চৌধুরীর মতো তাকেও পাকিস্তানিরা ছাড় দেয়নি। কমিউনিস্ট পার্টির লোক এবং একজন বিশিষ্ট লেখক ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে তারা তাকে হত্যা করেছিল।
ডাক্তার মুর্তজা এবং আমি এক পার্টিতেই ছিলাম। তিনি ছিলেন এক ধরনের বেপরোয়া লোক। তিনি প্রকাশ্যে কোনো রাজনীতি করতেন না; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের ডাক্তারখানার কামরায় বসে ছাত্রদের চিকিৎসার সময় প্রকাশ্যেই তিনি পাকিস্তানি সরকার ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলতেন। কাজেই তার খবর পাকিস্তানিদের কাছে ছিল। প্রকাশ্যে রাজনীতি না করার কারণেই তিনি নিজেকে নিরাপদ মনে করে চাকরি বাদ দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকেননি। কিন্তু নিজের কামরায় বসে বেপরোয়াভাবে পাকিস্তানিদের সমালোচনা করতে থাকার কারণে তারা তাকে হত্যা করেছিল।
ডাক্তার রাব্বীও ছিলেন এদিক দিয়ে একই রকম। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই তার সম্পর্ক ছিল না, যদিও কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের লোকদের অনেকের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক এবং যোগাযোগ ছিল। ১৯৭১ সালে আমি তার চেম্বারে দু'বার গিয়েছিলাম। তিনিও ডাক্তার মুর্তজার মতো চেম্বারে বসে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বলতেন। একদিন আমি তাকে বললাম, আপনি এত চেঁচিয়ে এসব কথা বলছেন, পাশেই তো আপনার রোগীরা রয়েছে। তারা সব শুনছে। এটা আপনি করবেন না। কিন্তু তিনি বললেন, এতে কিছু হবে না; কিন্তু হয়েছিল। ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছিল।
অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক। আমি অনার্স পড়তাম দর্শনে; কিন্তু আমার সাবসিডিয়ারি বিষয় ছিল ইতিহাস ও অর্থনীতি। তিনি আমাদের ইউরোপীয় ইতিহাসের ক্লাস নিতেন। আমার এখনও মনে আছে একদিন ফরাসি বিপ্লবের ওপর তার ক্লাসের কথা। রাজশাহীতে একবার পরীক্ষা নেওয়ার জন্য তিনি গিয়েছিলেন। আমি তখন তাকে আমাদের বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম থাকার জন্য। তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। এ ধরনের একজন নিরীহ রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন ও সজ্জন মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যার একমাত্র কারণ ছিল, তিনি হিন্দু। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তারা মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করত। কিন্তু হিন্দুরা ছিলেন তাদের বিশেষ টার্গেট।
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় হয়েছিল তিনি যখন পড়াশোনার জন্য লন্ডনে ছিলেন সপরিবারে। একদিন সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ সাহেব আমাকে নিয়ে গেলেন তার বাসায়। পরে ঢাকাতেও তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হতো। তার সঙ্গেও সরাসরি রাজনীতির কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাছাড়া অতি সজ্জন মানুষ ছিলেন। পাকিস্তানিরা এলোপাতাড়িভাবে কিছু মানুষকে হত্যা করেছিল। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী হয়েছিলেন তারই শিকার।
ডাক্তার আলীমের কাছে আমি যেতাম আমার বোনের চিকিৎসার জন্য। তার সঙ্গে প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত অনেকের যোগাযোগ ছিল। কিন্তু সরাসরি কোনো রাজনীতি তিনি করতেন না। তিনিও ছিলেন অতি সজ্জন মানুষ। কোন হিসাব থেকে আলবদরের লোকেরা পাকিস্তানিদের চাকর হিসেবে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছিল, তারাই জানে!
যাদেরকে এভাবে ১৪ ডিসেম্বর হত্যা করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদই মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন। অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থা থেকে নিয়ে অন্যভাবেও তিনি তাদেরকে সাহায্য করতেন। কোনো ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও তার সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হতো। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন একজন দায়িত্বশীল মানুষ।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে হত্যা করেছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন আমার শিক্ষক ডক্টর গোবিন্দ চন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুজ্জামান।
যে পাকিস্তানি সেনারা এভাবে ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এ দেশের গরিব-কৃষক-শ্রমিক থেকে নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল, তাদের একজনেরও কোনো শাস্তি আজ পর্যন্ত হয়নি। হওয়ার বিন্দুমাত্র কোনো সম্ভাবনা নেই। অনেক লম্বা-চওড়া কথাবার্তা সত্ত্বেও কোনো সরকারই এ বিষয়ে যথার্থ পদক্ষেপ নেয়নি। ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে তৎকালীন সরকারের মুখপাত্ররা 'এ দেশের মাটিতেই পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে' বলে বাতাস অনেক গরম করা সত্ত্বেও তারা তাদেরকে মাফ করেই দিয়েছিলেন। ভারত সরকারও নিজেদের স্বার্থে ১৯৫ জন চিহ্নিত পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী সামরিক অফিসারের বিচার ও শাস্তির ব্যাপারে মোটেই উৎসাহিত ছিল না। কাজেই ভারতে আটক থাকা প্রায় এক লাখ সৈন্যসহ ১৯৫ জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীকেও তারা পাকিস্তানে ফেরত পাঠিয়েছিল। এদিক দিয়ে বলতে গেলে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সরকার ও সেনাবাহিনীর কয়েকজন চাকরবাকর ও দালালের বিচার ও শাস্তি হলেও তাদের হুকুম দেনেওয়ালা ১৯৭১ সালের কোনো প্রকৃত যুদ্ধাপরাধী, কোনো পাকিস্তানি সামরিক অফিসারের বিচার ও শাস্তি হয়নি। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে।