৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

০৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ এই দিনে

১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মিশন প্রধান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বলেন, 'আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই ঢাকা মুক্ত হবে। ঢাকার পতনের মধ্য দিয়ে আমাদের মাতৃভূমি হানাদার শত্রুদের কবল থেকে মুক্ত হবে। বাংলাদেশ মুক্ত হলেই মুক্তিবাহিনী থেমে যাবে না। পাকিস্তান যদি ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ প্রত্যাহার না করে তবে আমাদের মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় জওয়ানেরা পশ্চিম পাকিস্তানেও যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।'

বক্তব্যের এক পর্যায়ে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, 'আজকের এই দিনে আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিও গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আমি বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ জনগণ এবং আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অভিনন্দন জানাই। ইয়াহিয়া খান আমাদের নেতাকে জেলে রাখলে তার মন আমাদের মধ্যে এবং আমাদের মন তার মধ্যে পড়ে রয়েছে। বিশ্বের কোনো শক্তিই তা ধ্বংস করতে পারবে না।'

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারতের পর্যটন মন্ত্রী ড. করণ সিং, শিল্পমন্ত্রী মইনুল হক, ও পররাষ্ট্র সচিব এস কে বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন।

ভারতে এদিন

৯ ডিসেম্বর লোকসভার অধিবেশনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যুদ্ধ বিরতি এবং সৈন্য অপসারণের জন্য জাতিসংঘ যে অবাস্তব প্রস্তাব দিয়েছে ভারত তাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। আমরা জাতীয় উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি। এতদিন আমাদের ওপর আঘাত এসেছে, এবার আমরাও পাল্টা আঘাত করছি।'

দিল্লিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি বলেন, 'উপমহাদেশে শিগগির শান্তি ফিরে আসবে। ভারতের ওপর সশস্ত্র সংঘর্ষ চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন আমরা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের মানবিক মূল্যবোধের জন্য সংগ্রাম করছি। বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আমরা ধৈর্য ধরে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছি। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন একটি নৃশংস আক্রমণ শুরু করে এক কোটির বেশি শরণার্থীকে ভারতে আনতে বাধ্য করেছে।'

দিল্লিতে লোকসভার অধিবেশনে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, 'ভারতীয় বাহিনী যশোর, শ্রীহট্ট, কুমিল্লায় পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যদুস্ত করে পাকিস্তানি বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলছে।'

ভারত সরকার বাংলাদেশকে প্রশাসনিক সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ দিন দিল্লিতে কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্র দপ্তরের অতিরিক্ত সচিব বি আর গুপ্তকে এ জন্য মনোনীত করা হয়। একই সঙ্গে আসাম, বিহার, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গের ১২ জন আইএসসি অফিসার তাকে সাহায্য করেন। ঢাকা মুক্ত হওয়ার মাত্রই বিআর গুপ্তের নেতৃত্বে এই দলটি ঢাকায় রওয়ানা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।

কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা বলেন, 'আমরা এখন বড় ধরনের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। আমাদের পদাতিক সৈন্য ও রসদ পারাপারের ব্যবস্থা হয়েছে। আর আমাদের পিটি-৬৭ জলচর ট্যাঙ্কগুলো সহজেই নদী পেরিয়ে যেতে পারবে।'

কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস কমিটির সাধারণ সম্পাদক অরুণকুমার নেত্র  বলেন, 'পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির পক্ষে থেকে কলকাতা শহর ও শহরতলীতে ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ দিবস পালন করা হবে। ওই উপলক্ষে ওই সব অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে মহাপুরুষদের বাণী সম্বলিত ফেস্টুন টানানো হবে।'

পাকিস্তানে এদিন

৯ ডিসেম্বর রাওয়ালপিণ্ডিতে রেডিও পাকিস্তানে দেওয়া এক ভাষণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন বলেন, 'ভারতীয় বাহিনী ও ভারতীয় চরদের সব আক্রমণ নস্যাৎ করে দিতে হবে। ভারতীয় ষড়যন্ত্রের কারণে আজ পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ জীবন নিয়ে শঙ্কিত। অথচ জাতিসংঘ এখন সার্কাসের পুতুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানকে আজ বাঁচাতে হলে সাধারণ মানুষকে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আজ আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত এসেছে।'

জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেওয়া পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের নেতা মাহমুদ আলী দেশে ফিরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'সোভিয়েত সরকারের উচিৎ ছিল ভারতের সঙ্গে তাল না মেলানো। তারা ভারতের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রই পাকিস্তানের সংকটে বন্ধু হিসেবে হাত মিলিয়েছে। পাকিস্তান চির কৃতজ্ঞ থাকবে এই ২ দেশের প্রতি।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

৯ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন বলেন, 'উপমহাদেশের আজকের পরিস্থিতির জন্য ভারত দায়ী নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারতকে দায়ী করে দেওয়া অভিমত সম্পূর্ণ মিথ্যা। পূর্ব বাংলার আজকের পরিস্থিতির জন্য পাকিস্তানই দায়ী। তারাই বৈষম্য, নিপীড়নের মাধ্যমে আজকের পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

৯ ডিসেম্বর গাইবান্ধা, নেত্রকোনা, খুলনার কপিলমুনি, কুষ্টিয়ার কুমারখালী, কুমিল্লার দাউদকান্দি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস, গাজীপুরের শ্রীপুর, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ, গফরগাঁও, ত্রিশাল, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার পাকিস্তানি হানাদারদের কবল থেকে মুক্ত করে মুক্তিবাহিনী।

টানা ৪ দিন যুদ্ধের পর অবশেষে মুক্ত হয় খুলনার কপিলমুনি। এর আগে ৫ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর দক্ষিণ খুলনার সব ক্যাম্প কমান্ডারদের একত্রিত করে তাদের মতামত ও যুদ্ধের কলাকৌশল নির্ধারণ করে পুনরায় শুরু হয় যুদ্ধ। ৬ ডিসেম্বর রাতে আক্রমণ করা হয় কপিলমুনি রাজাকার ঘাঁটি। এরপর ৭ ও ৮ ডিসেম্বর একটানা যুদ্ধের পর ৯ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় ১৫৫ জন রাজাকার কপিলমুনি হাইস্কুল মাঠে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। রাজাকারদের আত্মসমর্পণের খবর শুনে চারদিক থেকে মানুষ স্রোতের মতো আসতে শুরু করে। পরে উপস্থিত জনতার রায়ে গঠিত গণআদালতের মাধ্যমে ১৫৫ জন রাজাকারকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর দুপুর ২টার দিকে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

এ দিন হানাদার মুক্ত হয় পাবনার সাঁথিয়া। এর আগে ৮ ডিসেম্বর সাঁথিয়ার নন্দনপুরে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় মুক্তিবাহিনীর। এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে হানাদারেরা পালিয়ে যায়।

এ দিন মুক্ত হয় কুষ্টিয়ার কুমারখালী। এর আগে মুক্তিযোদ্ধারা বেলা ১১টার দিকে কুমারখালী শহরের চারদিক ঘিরে ফেলে। এরপর পৌর এলাকার কুণ্ডুপাড়ায় রাজাকার ফিরোজ বাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক যুদ্ধ হয় মুক্তিবাহিনীর। এ সময় হানাদার বাহিনী শহরে ঢুকে গণহত্যা চালায়। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী হানাদার বাহিনীর ওপর তীব্র আক্রমণ চালালে তারা কুমারখালী ছেড়ে পালিয়ে যায়।

এ দিন নেত্রকোনা শহরের নাগড়ায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর চতুর্মুখী হামলা চালায় মুক্তিবাহিনী। এ সময় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এই যুদ্ধে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে হানাদার বাহিনী পালিয়ে যায়। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় নেত্রকোনায়।

১১ নম্বর সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার আবদুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রায় ১৫০ মুক্তিযোদ্ধা শেরপুরের নকলা মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।

জামালপুরে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর অনুরোধে কাদেরিয়া বাহিনীর কমান্ডার কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ব্রহ্মপুত্র নদী অতিক্রম করে। এরপর ভারতীয় বাহিনী আকাশ থেকে হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর বোমা হামলা চালায়।

৮ ডিসেম্বর আফসার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার আনছারউদ্দিন ও আব্দুল বারীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা নওধার হয়ে সুতিয়া নদী পার হয়ে ত্রিশালে ঢুকে হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের অবস্থানের ওপর ভয়াবহ আক্রমণ করে। এ সময় হানাদার বাহিনী পালিয়ে গেলেও ভোরের দিকে রাজাকারেরা আফসার বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

৫ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মীর শওকত আলীর নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে আক্রমণ করেন। এ সময় হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর হামলার মুখে টিকতে না পেরে গোবিন্দগঞ্জ থেকে পালিয়ে লামাকাজীতে অবস্থান গড়ে তোলে। এরপর সেক্টর কমান্ডার শওকত আলী মিত্রবাহিনীর কাছে বিমান হামলার জন্য সাহায্য চেয়ে পাঠান।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে বেলা ৩টার দিকে সম্মিলিতভাবে 'এস' ফোর্স ও মিত্রবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে আশুগঞ্জে অবস্থানরত হানাদার বাহিনীও পাল্টা আক্রমণ গড়ে তুলে। এ সময় ২ পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্র আর গোলাবারুদের চরম আক্রমণের মুখে এক পর্যায়ে কিছুটা পিছু হটে যৌথ বাহিনী। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ১৪০ জন সেনা নিহত হয়। অন্যদিকে মিত্রবাহিনীর ৪০ জনের মতো সৈন্য শহীদ হন।

এ দিন চট্টগ্রামের নাজিরহাটে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর অতর্কিত হামলা করা হলে মুক্তিবাহিনীর বেশ ক্ষতি হয়। এরপর লেফটেন্যান্ট শওকতের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারাও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর পাল্টা আক্রমন চালালে ২ পক্ষের মধ্যে ব্যাপক যুদ্ধ শুরু হয়। এ সময় ফটিকছড়িসহ বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা খবর পেয়ে নাজিরহাটে সম্মুখযুদ্ধে অবস্থান নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেয়। হানাদার বাহিনীর ২০ জন সৈন্য নিহত হয়। অন্যদিকে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ৩ জন আহত হন।

এ দিন রংপুর ও দিনাজপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনী। এ সময় ২ পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।

৯ ডিসেম্বর : সাঁথিয়া ও দাউদকান্দি মুক্ত দিবস

 

 

 

আজ ৯ ডিসেম্বর। পাবনার সাঁথিয়া ও কুমিল্লার দাউদকান্দি মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে এ দুই এলাকা মুক্ত হয়েছিল। ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে সে দিন এ অঞ্চলসমূহকে মুখরিত করেছিলেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা।

এদিনে আরও শত্রুমুক্ত হয় খুলনার ঐতিহ্যবাহী কপিলমুনি, পাইকগাছা, কুমারখালী, নকলা, অভয়নগর, ত্রিশাল, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ, নেত্রকোনা, গাজীপুরের শ্রীপুর, পূর্বধলাসহ বিভিন্ন এলাকা।

সাঁথিয়া
১৯৭১ সালের এই দিনে সাঁথিয়া হানাদার মুক্ত হয়। এদিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদরদের পরাজিত করে সাঁথিয়ায় স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজ পতাকা উড়ান বীর মুক্তিযোদ্ধারা। 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক আবু সাইয়িদ মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। তার নির্দেশে সাঁথিয়া হাই স্কুলের তৎকালীন শিক্ষক রুস্তম আলী, তোফাজ্জল হোসেন, কাশীনাথপুর হাইস্কুলের শিক্ষক আয়েজ উদ্দিন সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এলাকার ছাত্র সমাজ ও তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেন। যুদ্ধ অনিবার্য এটা বুঝতের পেরে সাঁথিয়া হাইস্কুল মাঠে তারা প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। সেনাসদস্য কাজী মোসলেম উদ্দিন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন। ওই বছর মার্চে পশু হাসপাতাল প্রাঙ্গনে যুদ্ধকালীন কমান্ডার নিজাম উদ্দিন, রাবি’র ছাত্র নেতা ফজলুল হক, মকবুল হোসেন মুকুল, লোকমান হোসেন, রেজাউল করিম, আলতাব হোসেন, আবু মুসা, আবু হানিফ, মোসলেম উদ্দিন, তোফাজ্জল হোসেন, আব্দুল ওহাব, সোহরাব, রউফ, মতিনসহ যুব তরুণ’রা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

দীর্ঘ ৯ মাস সাঁথিয়ার বিভিন্ন স্থানে পাকসেনাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে বীরমুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক, নজরুল ইসলাম (চাদু), আব্দুস সামাদ, দারা হোসেন, শাহজাহান আলীসহ অসংখ্য নিরীহ মানুষ শহীদ হন।

সাঁথিয়ার সংগ্রামী জনতা ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সাঁথিয়া থানা আক্রমণ করে অস্ত্র লুট করে নেয় এবং পশু হাসপাতাল চত্বরে আমগাছ তলায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। ১৯ এপ্রিল সাঁথিয়ার পাইকরহাটির ডাব বাগন (শহীদ নগর) যুদ্ধে পাক বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয় মুক্তিযোদ্ধা, পুলিশ ও বিডিআর। ওই যুদ্ধে ২০জন মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় দু’শ নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন।

২৬ সেপ্টেম্বর সাঁথিয়ার মুক্তিযোদ্ধারা সাঁথিয়া হাইস্কুলে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে ৯ জন রাজাকারকে হত্যা করে এবং অনেক অস্ত্র উদ্ধার করে। সাঁথিয়ার গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ হয় ৯ নভেম্বর, পার্শ্ববর্তী ফরিদপুর উপজেলার কালিয়ানী গ্রামে। ওই যুদ্ধে সাঁথিয়ার ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সাঁথিয়ায় সবচেয়ে নারকীয় ও বেদনাদায়ক হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয় ২৭ নভেম্বর ধুলাউড়ীতে। ওই দিন পাকসেনারা বাড়ি-ঘর জ্বালানো ছাড়াও রাতের অন্ধকারে পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলে মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় ১০০ জন গ্রামবাসীকে পুড়িয়ে, গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।

ডিসেম্বরের ৭ তারিখে মুক্তিযোদ্ধারা সাঁথিয়ায় প্রবেশের তিনটি ব্রিজ ও কালভার্ট বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। যাতে পাক সেনারা গাড়িবহর নিয়ে সাঁথিয়ায় প্রবেশ করতে না পারে।

অন্যদিকে, মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজের নিচে বাঙ্কার তৈরি করে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে চরম প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক আক্রমণে পাক সেনারা ক্ষতিগ্রস্ত দুটি গাড়ি ফেলে পিছু হটে ।

৮ ডিসেম্বর সাঁথিয়ার সব মুক্তিযোদ্ধা থানা সদর থেকে ২ কি. মি. পশ্চিমে নন্দনপুরে পাক হানাদারদের সঙ্গে চূড়ান্ত যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরদিন ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে পাকহানাদার বাহিনীদের আক্রমণের চেষ্টা চালালে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র বাধার মুখে পড়ে। ৯ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা সাঁথিয়া থানাকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা দেন।

দাউদকান্দি
একাত্তরের এই দিনে যেসব অঞ্চল শত্রুমুক্ত হয় সেগুলোর অন্যতম ছিল দাউদকান্দি। দাউদকান্দি জয়ের মধ্য দিয়ে একাত্তরের ৯ ডিসেম্বর মেঘনার পুরো পূর্বাঞ্চল মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। 

একাত্তরের এ সময়টায় দ্রুত পাল্টে যাওয়া দৃশ্যপট এটাই স্পষ্ট করে দেয় যে, খুব শিগগিরই অবসান হতে যাচ্ছে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পিছু হটার মধ্য দিয়ে প্রতিদিনই তখন দেশের একাধিক এলাকা শত্রুমুক্ত হচ্ছিল। তবে এর মধ্যেই মুক্তিপাগল অকুতোভয় বাংলার দামাল ছেলেদের মনোবল ভেঙে দিতে পাকিস্তান আর তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  ষড়যন্ত্র করছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন যুদ্ধের শেষ সময়ে এসে পাকিস্তানকে সহযোগিতার পদক্ষেপ নেন।

একাত্তরের এ দিনে সপ্তম নৌবহরকে তিনি বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি ভেবেছিলেন এর মাধ্যমে অন্তত বাঙালির মনোবল ভেঙে দেয়া যাবে। কিন্তু সে ধারণা সঠিক হয়নি। রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা পলিমাটির সন্তানদের দৃঢ় মনোবল তো আর এত সহজে ভেঙে দেয়া যায় না!

৯ ডিসেম্বর কপিলমুনির মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আনন্দের দিন। এদিনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় সুনিশ্চিত হতে থাকলে হানাদার পাকসেনারা বিভিন্ন স্থান থেকে পিছু হটে। 

এদিন কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা বেলা ১১টায় শহরের চারদিক ঘিরে ফেললে পৌর এলাকার কুণ্ডুপাড়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর দেশীয় সহযোগী আল-বদর কমান্ডার ফিরোজ বাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয়। এ সংবাদে জেলা শহরে অবস্থানরত পাকসেনারা দ্রুত এসে শহর ঘিরে শুরু করে গণহত্যা। ৯ ডিসেম্বর পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা শহর ঘিরে রাজাকার-পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা চালালে তারা পালিয়ে যায়। ৪ থেকে ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্ত হয় গাইবান্ধার সব থানা।

১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর ১১নং সাব-সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার আবদুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে টুআইসি আবদুর রশীদ ও সিকিউরিটি অফিসার একলিম শাহসহ ১৫০ বীর মুক্তিযোদ্ধা নকলাকে পাকহানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করেন। এরপর তারা স্থানীয় নকলা পাইলট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।

এদিন মুক্ত হয় তিতাস। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিতাসের বাতাকান্দি এবং কড়িকান্দিতে মুখোমুখি যুদ্ধে ৩৫ পাকসেনা নিহত হয়। ১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে পাক হানাদারদের হটিয়ে অভয়নগরকে শত্রুমুক্ত করেন।