৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

০৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ এই দিনে

এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বেতার ভাষণে বলেন, 'ঢাকা হানাদার মুক্ত হতে আর সময়ের প্রয়োজন হবে না। খুব শিগগির ঢাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসবে। বাংলাদেশ এখন দিবালোকের মতোই সত্য। আমাদের প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধুও খুব শিগগির বাংলার বুকে ফিরে আসবেন।'

৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদে আর্জেন্টিনার দেওয়া এক প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। আর্জেন্টিনা প্রস্তাবে বলে, 'সংঘাত নিরসনে দুই দেশকেই আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে আসতে হবে। এবং অতিসত্বর সীমান্তে মোতায়েনকৃত সৈন্য সরাতে হবে। একই প্রস্তাব জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও তোলা হয়। এই প্রস্তাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দিলে তা বাতিল হয়ে যায়।

৭ ডিসেম্বর মুজিবনগরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, 'ভারতের স্বীকৃতির পর বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকে ঠিক হয়েছে, ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই মুজিবনগর থেকে বাংলাদেশ সরকারের দপ্তর ঢাকায় স্থানান্তর করা হবে।'

ভারতে এদিন

৭ ডিসেম্বর রাত ১০টায় রেডিও আকাশবাণী থেকে হিন্দি, উর্দু ও পশতু ভাষায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'পাকিস্তানি সেনাদের বাঁচার কোনো পথ নেই। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য চতুর্দিক থেকে ঘিরে রেখেছে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এদেশের মানুষের উপর যে পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়েছে তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তারা প্রস্তুত হচ্ছে। এখন পাকিস্তানি বাহিনীর সামনে একটি মাত্র পথ খোলা রয়েছে। সেটি হলো আত্মসমর্পণ করা।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

এদিন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ এক বিবৃতিতে বলেন, 'ভারত এবং পাকিস্তানের উচিত শান্তিপূর্ণ সমাধানে আসা। যুদ্ধ কেবল প্রাণঘাতই বয়ে আনছে। এতে কোনো সুষ্ঠু সমাধান আশা করা যায় না। আলোচনা ছাড়া যুদ্ধের অবসান ও অনুকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি আনা সম্ভব না।

৭ ডিসেম্বর মার্কিন সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন 'যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে দেওয়া অর্থনৈতিক সাহায্য বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

৭ ডিসেম্বর কুমিল্লায় মুক্তিযোদ্ধাদের ৩টি দল বিবির বাজার, ভাটপাড়া এবং বাঘেরচর দিয়ে এসে কুমিল্লা বিমানবন্দরের হানাদার ঘাঁটিতে ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় মুক্তিবাহিনীর। এরপর দুপুরের দিকে এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে হানাদার সেনারা বিমানবন্দরের অবস্থান ছেড়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে পালিয়ে যায়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী কুমিল্লা দখলের লক্ষ্যে কুমিল্লা শহরের দিকে এগিয়ে যায়।

৭ ডিসেম্বর সিলেটে মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে ৩য় বেঙ্গলের দুটি কোম্পানি ও ডাউকি সাব-সেক্টর ট্রুপসসহ রাধানগর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এনে গোয়াইনঘাট হয়ে সালুটিকরে সিলেট বিমানবন্দরের দিকে অগ্রসর হন। এদিন ভোরে সিলেট বিমানবন্দরে ছত্রীসেনা অবতরণ করায় ভারতীয় মিত্রবাহিনী। এর ফলে সিলেট বিমানবন্দর ও তৎসংলগ্ন স্থান যৌথ বাহিনীর দখলে চলে আসায় এই অঞ্চল হানাদারমুক্ত হয়।

৭ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শাহবাজপুরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এসময় হানাদার বাহিনী পিছু হটে।

৭ ডিসেম্বর ময়মনসিংহে আফসার বাহিনীর বড় একটি দল তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে ভালুকা থানার উপর ত্রিমুখী আক্রমণ গড়ে তোলে। এসময় হানাদারদের সঙ্গে আফসার বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পরে এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে হানাদারেরা ভালুকা থানার অবস্থান ত্যাগ করে পালিয়ে যায়।

৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে ভারতীয় বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার যোশির নির্দেশে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনী যৌথভাবে কুড়িগ্রাম শহরে হানাদার বাহিনীর অবস্থানের উপর ব্যাপক আর্টিলারি হামলা চালায়। এরপর হানাদার বাহিনী কুড়িগ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়।

৭ ডিসেম্বর নোয়াখালী হানাদার মুক্ত হয়। নোয়াখালী হানাদার মুক্ত হলে বাড়ি বাড়ি অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজন রাজাকারকে আটক করে মুক্তিযোদ্ধারা।

৭ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ হানাদার মুক্ত হয়। এদিন রাতে গোপালগঞ্জ সদর থানার পাশের অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায় হানাদার বাহিনী। ৭ ডিসেম্বর ভোরে গোপালগঞ্জ শহরে ঢুকে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে মুক্তিযোদ্ধা।

৭ ডিসেম্বর বিকেলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও যৌথ বাহিনীর মধ্যে বগুড়া ও রংপুর সড়কের করতোয়া সেতুর দখল নিয়ে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে হানাদার বাহিনীর ৩৫ জনের মতো সৈন্য হতাহত হয়।

৭ ডিসেম্বর শেরপুর হানাদার মুক্ত হয়।

৭ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা হানাদার মুক্ত হয়৷ এদিন দর্শনার দিক থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী সাথে মুক্তিবাহিনী যোগ দিয়ে চুয়াডাঙ্গার দিকে এগিয়ে যায়। এদিন মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর আগমনের খবর শুনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর চলাচল বন্ধ করার জন্য আগেরদিন সন্ধ্যায় মাথাভাঙ্গা নদীর উপরের ব্রিজ বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। এরপর দর্শনার দিক থেকে মিত্রবাহিনী চুয়াডাঙ্গায় এসে পৌঁছালে এদিন সন্ধ্যার মধ্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গা শহর ও আলমডাঙ্গা ছেড়ে কুষ্টিয়ার দিকে চলে যায়।

৭ ডিসেম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল ও সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ৯ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা মংলা ও সুন্দরবনের বিশাল এলাকা হানাদার মুক্ত করে।

 

আজ ৭ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ হানাদার মুক্ত দিবস

 

 

 ১৯৭১ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জ পাক হানাদার মুক্ত হয়। এই দিনে দলে দলে মুক্তিযোদ্ধাসহ সর্বস্তরের মানুষ মেতে উঠে আনন্দ উল্লাসে। যা গোপালগঞ্জবাসীর কাছে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রতি বছরের মতো এবারও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করা হচ্ছে দিবসটি।

গোপালগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কামান্ডার বদরুজ্জামান বদর জানান, দিবসটি পালনে র‌্যালি ও আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এসব কর্মসূচিতে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি অংশ নেবে।

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ থেকে গোপালগঞ্জে শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার টেলিগ্রাম ম্যাসেজ গোপালগঞ্জে পৌঁছানোর পরই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের লড়াই। তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মহকুমা কর্মকর্তা আব্দুল মজিদের সহযোগীতায় ট্রেজারি থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ (তৎকালীন কায়েদে আযম মেমোরিয়াল কলেজ) মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ট্রেনিং ক্যাম্প চালু হয়। ২৫ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত গোপালগঞ্জ মুক্তিবাহিনীর দখলে ছিল। ৩০ এপ্রিল পাকহানাদার বাহিনী শহরে ঢুকতে শুরু করে। শুরু হয় জ্বালাও-পোড়াও-ধর্ষণ আর হত্যাযজ্ঞ। কর্নেল তারেক ও মেজর ঘুরির নেতৃত্বে পাকসেনারা স্থানীয় মুসলিমলীগ নেতাদের কাছ থেকে গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির অবস্থান জেনে জ্বালিয়ে দেয়।

এছাড়া সদর উপজেলার কাঠি ইউনিয়নের মানিকহার গ্রামের হাফিজুর রহমান বাদশা মিয়ার পরিবারের বড় ছেলেসহ একই পরিবারে ৮ জনকে গুলি করে হত্যা এবং ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় পাক হানাদার বাহিনী। পরে পাকবাহিনী গোপালগঞ্জ সদর থানা পরিষদ সংলগ্ন ‘জয় বাংলা পুকুর’ পাড়ে একটি মিনি-ক্যান্টনমেন্ট (বর্তমানে উপজেলা পরিষ) স্থাপন করে কর্মকান্ড পরিচালনা শুরু করে। সেখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে শত শত মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ নারী-পুরুষ ধরে এনে ধর্ষণ ও নির্যাতন করে নির্মমভাবে হত্যা করে। ফলে এটি পরিণত হয় একটি বধ্যভূমিতে।

৫ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্তলগ্নে মিত্র দেশ ভারত প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের সরকার স্বীকৃতি দেওযায় এখানকার পাক হানাদার বাহিনীর মনোবল ভেঙ পড়ে। এ দিন সূর্য উঠার সাথে সাথে বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা গোপালগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে। চারিদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনের খবর পেয়ে পাক সেনারা গোপালগঞ্জের মিনি ক্যান্টমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে যায়। মেজর সেলিমের অধিনে পাকহানাদার বাহিনীর একটি দল চলে যায় রাজধানী ঢাকায়। আর অন্য একটি দল চলে যায় ভাটিয়াপাড়ার ওয়ারলেস ক্যাম্পে। অবশেষে ৭ ডিসেম্বর ভোর থেকে গোপালগঞ্জের আকাশে উড়তে থাকে স্বাধীন বাংলার বিজয় পতাকা।

মুক্তিযোদ্ধা সিকদার নূর মোহাম্মদ দুলু বলেন, ‘গোপালগঞ্জ মিনি ক্যান্টনমেন্টের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন ফয়েজ মোহাম্মদ ও ক্যাপ্টেন সেলিমের নেতৃত্বে পাক জল্লাদরা এখানে কসাইখানা তৈরি করেছিলে। দেশ স্বাধীনের পর সেখানে ইটের স্তুপে, সামনের খোলা জায়গায় অসংখ্য মানুষের মাথার খুলি, হাড়, ও মহিলাদের মাথার চুল পড়ে ছিল। ক্যাস্পের পাশ দিয়ে প্রবাহিত মধুমতি নদীতে জাল ফেললেই জেলেদের জালে দীর্ঘদিন মানুষের মাথার খুলি ও কঙ্কাল জড়িয়ে পড়ত। পাকবাহিনী এখানে মুক্তিযোদ্ধা গোলাজার চৌধূরীসহ শত শত মানুষকে ধরে এনে অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে  হত্যা করে।