৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

০৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ এই দিনে

এদিন দিল্লিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব কে বি লাল বলেন, 'বাংলাদেশ এখন সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি দেশ। ভারত খুব শিগগির বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। আমরা এরই মধ্যে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কাজ করে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করব।'

ঢাকায় এদিন

৫ ডিসেম্বর ভারতের বিমানবাহিনী  বিমান থেকে ১২ ঘণ্টাব্যাপী বোমা হামলা চালায়। এ সময়ের মধ্যে তারা তেজগাঁও ও কুর্মিটোলায় ৫০ টনের মত বোমা ফেলে। এতে হানাদারদের ৯০টি অস্ত্রবাহী ট্রাক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

৫ ডিসেম্বর ঢাকাসহ বেশ কয়েকটি শহরে ভারতীয় বিমানবাহিনীর ক্রমাগত বোমা হামলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়। এক পর্যায়ে হানাদারদের সব বিমানঘাঁটির কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশের আকাশ ভারতীয় বিমানবাহিনীর দখলে থাকে। হানাদার মুক্ত হয়ে যায় বাংলাদেশের আকাশ।

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ বিষয়ক প্রশ্নে যুদ্ধ বিরতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ভারত ও পাকিস্তানের সেনা অপসারণ সংক্রান্ত প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। এই প্রস্তাবে নিরাপত্তা পরিষদের প্রভাবশালী সদস্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দেয়। ভেটো দেয় পোল্যান্ডও। অন্যদিকে নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় ১১টি দেশ। তবে ভোটে অংশ নেয়নি চীন। ভোট দেয়নি ব্রিটেন ও ফ্রান্সও।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে ভেটো দেয়ার কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধি ইয়াকুব মালিক বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য। এতদিন পাকিস্তান বাংলাদেশে সামরিক ব্যবস্থার নামে গণহত্যা চললেও যুক্তরাষ্ট্র টুঁ শব্দটুকুও করেনি। যুক্তরাষ্ট্র এখনো বাংলাদেশে নিপীড়ন, গণহত্যা ও নির্যাতন বন্ধে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। অথচ আজকের অবস্থা তৈরি হয়েছে কেবল পাকিস্তানের অপরিণামদর্শী আচরণ ও ধ্বংসযজ্ঞের কারণে।' 

ইয়াকুব মালিক আরও বলেন, 'আমরা বিনীতভাবে বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধিকে নিজেদের অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানাই।'

এ সময় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য চীন তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, জাতিসংঘে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আলোচনা হতে পারে না। পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানের নিজস্ব ব্যাপার।

এ সময় জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, 'ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যাখ্যাকে সমর্থন করছে। পাকিস্তানের কারণেই এই সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন যে প্রস্তাব দিয়েছে, আমরা তা সমর্থন করছি। আমরা চাই বাংলাদেশ প্রশ্নে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রাধান্য পাবে।'

এদিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিতে পারেনি পাকিস্তান। কারণ ভারত ও পাকিস্তান এই বিষয়ে ভোট দিতে পারবে না বলে আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেনের বক্তব্য শেষে পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহী বলেন, 'ভারতই পাকিস্তানকে ভাঙার ষড়যন্ত্রে মেতেছে, যা আজ পরিষ্কারভাবে ফাঁস হয়েছে। ভারত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র ও সামরিক সহায়তা দিয়েছে প্রতিনিয়ত। অথচ ভারত প্রতিবারই তা অস্বীকার করেছে।'

৫ ডিসেম্বর প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদপত্র দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র একটি বিবরণী প্রকাশ করেছে।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ  যুদ্ধ

৫ ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট স্থলপথে এগিয়ে আসে। এদিন  মিত্রবাহিনী বিভিন্ন সেক্টরের প্রধান প্রধান সড়কে অবরোধ সৃষ্টি করে ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, নাটোর, রংপুর, যশোর ও রাজশাহীর সড়কপথের  যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। জায়গায় জায়গায় অবস্থান নেয় তারা।

৫ ডিসেম্বর সিলেটের ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানি কানাইঘাট থেকে বিকাল ৫টায় এমসি কলেজ অভিমুখে যাত্রা করে পরদিন বিকেল ৫টায় কেওয়াছরা চা বাগানে অবস্থান নেয়। কিন্তু এদিন রাতে আলফা কোম্পানির  পেট্রোল পার্টি হানাদারদের অ্যামবুশে পড়ে। একজন নিখোঁজ হয়। পরদিন সকালে হানাদারদের অবস্থান জানার জন্য বের হলেও হানাদারদের বাধার মুখে পড়ে পিছু হটে পেট্রোল পার্টি। ফের সংগঠিত হয়ে হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায় তারা। এ সময় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। সন্ধ্যার পরে মুক্তিযোদ্ধারা এমসি কলেজের দিকে যাত্রা শুরু করেন। 

৫ ডিসেম্বর যশোরের নোয়াপাড়া থেকে লেফটেন্যান্ট এস এম খালেদের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল খাইরাই স্কুলে অবস্থানরত হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালালে তারা পালিয়ে  খাইরাই শহরে প্রবেশ করে। এদিন রাতে মুক্তিযোদ্ধারা যশোর শহরে অবস্থানরত হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ না চালিয়ে বাইরের গেরিলাদের একত্রিত হওয়ার আদেশ দেন।

৫ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়াতে মুক্তিবাহিনী ও ভারতের ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে আত্মসমর্পণ করে হানাদার বাহিনী। পরে হানাদার বাহিনীর কিছু সেনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে পালিয়ে যায়। এদিন আখাউড়া দখলের পর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে এগিয়ে যায়।  

৫ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী সিলেটের করিমগঞ্জ দখল করে মুন্সীনগরের দিকে এগিয়ে যায়। এদিন মুন্সীনগরও দখল করে মুক্তিবাহিনী। তারপর মৌলভীবাজারের দিকে এগিয়ে যায়।

৫ ডিসেম্বর ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে যশোর-কুষ্টিয়া রেলওয়ে জংশন দখল করে রেলওয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে মুক্তিবাহিনী।

৫ডিসেম্বর যশোরের ঝিকরগাছায় মুক্তিবাহিনীর কাছে হানাদারদের পতন হলে ৩ দলে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যশোর আক্রমণ শুরু করেন। উত্তর পাশে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল যশোর-ঝিনাইদহ সড়কে আক্রমণ শুরু করে। আরেকটি দল ধান খেতের মধ্য দিয়ে চিতের বিল অতিক্রম করে। বেনাপোল-যশোর সড়ক দিয়ে আরেকটি দল এগিয়ে যায়।

৫ ডিসেম্বর ঝিনাইদহের উত্তর ও পশ্চিমে অবস্থানরত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায় ভারতীয় চতুর্থ ও নবম ডিভিশন। এক পর্যায়ে ভারতীয় বাহিনীর হামলায় হানাদার বাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে যশোর সড়কের পাশে অবস্থান নেয়।

৫ ডিসেম্বর খুলনার পাইকগাছার রাজাকার ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনীর হামলায় প্রায় ১০০ রাজাকার নিহত হয়।

৫ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে  উইং কমান্ডার এমকে বাশারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর  ৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ধরলা নদী অতিক্রম করে কুড়িগ্রাম দখল করে। এ সময় হানাদার বাহিনী  কুড়িগ্রাম থেকে পালিয়ে লালমনিরহাটের দিকে চলে যায়।