৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২৯ নভেম্বর ১৯৭১ এই দিনে

এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের পাঠানো একটি চিঠি তুলে দেন ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং।

চিঠিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন বলেন, ভারত যেন পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। এতে করে সাম্প্রতিক তীব্র উত্তেজনা হ্রাস পাবে। মার্কিন সরকার ভারতের কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ আশা করে। উপমহাদেশের শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য মার্কিন সরকার সচেষ্ট আছে। যুক্তরাষ্ট্র জানে, ভারত শরণার্থীদের নিয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে। তবে রাজনৈতিক অবস্থার উন্নতি হলে শিগগির শরণার্থী প্রত্যাবাসন শুরু করা যাবে বলে যুক্তরাষ্ট্র আশাবাদী।

ঢাকায় এদিন

২৯ নভেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ  নিয়াজী বিদেশি সাংবাদিকদের বলেন, 'পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমরা এই যুদ্ধ শুরু করতে চাইনি। ভারতীয়দের একের পর এক হামলায় বাধ্য হয়ে শুরু করেছি। দেশের নানা জায়গায় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। দেশদ্রোহী মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীদের পাকিস্তানের ভূখণ্ড থেকে না হটানো পর্যন্ত আমাদের এই যুদ্ধ চলবে।'  

ভারতে এদিন

২৯ নভেম্বর আসামের গৌহাটিতে ছাত্র সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে ভারতের অর্থমন্ত্রী ওয়াই বি চ্যাবন বলেন, 'ইয়াহিয়া খান যদি ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ চালানোর চেষ্টা করেন, তবে তাকে ফল ভোগ করতে হবে। পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা এখন ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর চেষ্টাই করছেন। কিন্তু তারা বুঝতেও পারবেন না তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে।'

পাকিস্তানে এদিন 

২৯ নভেম্বর রাওয়ালপিণ্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক শেষে সম্মিলিত কোয়ালিশন পার্টির নেতা নুরুল আমীন বলেন, 'ভারতের হামলার ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য আমি কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব প্রেসিডেন্টের কাছে দিয়েছি। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আরো কিছু বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

২৯ নভেম্বর আলবেনিয়াতে এক অনুষ্ঠানে চীনের সহকারী প্রধানমন্ত্রী লী শিয়েন লিয়েন বলেন, 'পাক-ভারত সমস্যা সমাধানে মীমাংসা ছাড়া বিকল্প নেই। কেবল ২ পক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমেই শান্তিপূর্ণ সমাধানে আসা সম্ভব। যদি উভয়েই একে অপরকে দোষারোপ করে, তবে উপমহাদেশের পরিস্থিতি এমনই থাকবে।'

২৯ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টের কাছে পাঠানো চিঠিতে পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল মোতায়েন করার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, 'জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল থাকলে তারা বুঝতে পারবে কারা পাকিস্তানের ভূখণ্ডে হামলা করছে।'

দেশব্যাপী এদিন

২৯ নভেম্বর মুজিবনগরে উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে মুক্তিবাহিনীর প্রধান  কর্নেল এম এ জি  ওসমানী বলেন, 'আমার ছেলেরা এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত। মাত্র কয়েক মাসেই তারা পৃথিবীর যে কোনো সেনাবাহিনীর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো দুর্ধর্ষ হয়ে উঠেছে। আর দেরি নয়, এখনই চরম আঘাত হানতে হবে।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

২৯ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণে মুক্ত হয় পঞ্চগড়। ২৮ নভেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে পঞ্চগড়ে অবস্থানরত হানাদার সেনারা ময়দান দিঘিতে অবস্থান নিয়েছিল। নভেম্বর মাসের শুরু থেকেই মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণে এবং শেষদিকে ভারতীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণে অমরখানা ও তালমায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী।

২৯ নভেম্বর সিলেটে ভারতীয় বিএসএফের সহযোগিতায় ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী টোকেরবাজার সেতু উড়িয়ে দেয়। এ সময় সেতুর নিরাপত্তায় থাকা বেশ কয়েকজন রাজাকারকে আটক করে মুক্তিবাহিনী। কিন্তু ফেরার পথে হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর জন্য অ্যামবুশের ফাঁদ পাতে। মুক্তিবাহিনী অ্যামবুশের আওতায় এলে হানাদার বাহিনী তীব্র আক্রমণ শুরু করে। এ সময় মুক্তিবাহিনীও প্রতিরোধ গড়ে তুললে ২ পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ১১ সেনা নিহত হয়। ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর ৩ সেনা শহীদ হন।   

২৯ নভেম্বর খুলনার ৯ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের পরিকল্পনা অনুযায়ী লেফটেন্যান্ট আহসানউল্লাহ'র নেতৃত্বে ২০০ মুক্তিযোদ্ধার একটি দলকে সাতক্ষীরায় পাঠানো হয়। সাতক্ষীরার দৌলতপুর সড়কে অ্যামবুশের জন্য মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার শাহজাহানের নেতৃত্বে ১০০ মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠানো হয়। 

২৯ নভেম্বর সাতক্ষীরার আশাশুনি থানায় আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনী। এ সময় ২ পাকিস্তানি পুলিশ ও ৫৭ রাজাকারকে আটক করে মুক্তিবাহিনী। একই দিনে আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা ৯ নম্বর সেক্টরের আশাশুনি থানা হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করে। সেখান থেকে ১৫০টি রাইফেল উদ্ধার করা হয়। ২ জন পাক পুলিশ এবং ৫৭ জন রাজাকার বন্দী হয়। আশাশুনির  ব্যাঙদোহাতে মুক্তিবাহিনীর  আরেকটি দল আক্রমণ চালায়। সেখান থেকে ৩ হানাদার পুলিশ, ২ মিলিশিয়া ও ১০০ রাজাকারকে আটক করে মুক্তিবাহিনী।

২৯ নভেম্বর সিলেটে ক্যাপ্টেন সৈয়দ মুনিবুল হকের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর এক ব্যাটেলিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কৈলাস থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে শমসেরনগর আক্রমণের জন্য শ্রীমঙ্গলে প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তুলে। 

২৯ নভেম্বর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের বগাদিয়ায় হানাদার বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।

২৯ নভেম্বর বগুড়ায় মুক্তিবাহিনী ফের সারিয়াকান্দির থানা দখলের জন্য আক্রমণ শুরু করে। এ সময় হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা প্রতিরোধ গড়ে তুললে ২ পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ২ দিনব্যাপী এই যুদ্ধে ৪৪ জন রাজাকার ও ১৮ হানাদার সেনা নিহত হয়। ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এরপর ৫৩ জন রাজাকার ও ১৯ জন পুলিশ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিবাহিনী বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ দখলে নেয়।   

২৯ নভেম্বর যশোরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হানাদার বাহিনীর সংঘর্ষের পর হানাদার সেনারা কমলপুর ছেড়ে পালিয়ে যায়।

২৯ নভেম্বর গাইবান্ধায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি পুলিশের কালীরবাজার  অবস্থানের ওপর হামলা চালায়। এ সময় হানাদার পুলিশও প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুক্তিবাহিনীর হামলায় ৬ হানাদার পুলিশ নিহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

২৯ নভেম্বর যশোরের মুন্সিগঞ্জের বড়খালীতে মুক্তিবাহিনীর ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি হানাদার  বাহিনী। এ সময় মুক্তিবাহিনীও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ১২ সেনা নিহত হয়। ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।  পরে মুক্তিবাহিনী সেখানকার একটি ব্রিজ ডিনামাইট লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়।

২৯ নভেম্বর কুড়িগ্রামের মোগলপুরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল স্থানীয় রাজাকারদের ক্যাম্পে হামলা চালায়। এ সময় ক্যাম্পে থাকা রাজাকাররা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়ে পালিয়ে যায়।

২৯ নভেম্বর ১৯৭১: যশোরের সীমান্ত ফাঁড়িতে মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ হয়

 
যশোরের সীমান্ত ফাঁড়িতে মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ হয়। ফাইল ছবি

যশোরের সীমান্ত ফাঁড়িতে মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ হয়। ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর দিনটি ছিল সোমবার। এই দিন টেংরাটিলাতে ছিলো পাকিস্তানের একটা বড় ঘাঁটি। মুক্তিবাহিনী টেংরাটিলা আক্রমণ করার জন্য তৃতীয় বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন মহসীন এবং ক্যাপ্টন আকবরের নেতৃত্বে টেংরাটিলার উদ্দেশে রওনা হয়।

ডাউকি সাবসেক্টর ট্রুপস এবং তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট যৌথভাবে মেজর সাফায়াত জামিলের কম্যান্ডে রাধানগর আক্রমণ করে। দীর্ঘ কয়েকঘন্টা ধরে এখানে তীব্র যুদ্ধ চলে।

সারাদিন যশোরের সীমান্ত ফাঁড়িতে মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষের পর রাতে পাকিস্তানীরা তাদের ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে কমলপুর ফাঁড়ি ত্যাগ করে।

ঢাকায় ইস্টার্ণ কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজী বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে বলেন, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এ অঘোষিত যুদ্ধে কেবল মুক্তিবাহিনী নয়, ভারতীয় সেনাবাহিনীও শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হচ্ছে।

জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে পাঠানো এক পত্রে পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট পূর্বাঞ্জলের সীমান্ত এলাকায় জাতিসংঘ পযবেক্ষক মোতায়েনের আবেদন জানান।

মুক্তিবাহিনী গাইবান্ধা মহকুমার কালির বাজারে পাক অবস্থানের ওপর অতর্কিত আক্রমণে ছয়জন পাকপুলিশ এবং রাজাকারকে গ্রেফতার করে। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী শত্রুপক্ষের নয়টি রাইফেল এবং ৪০০ গুলি হস্তগত করে। এখানে মুক্তিবাহিনীর একজন সদস্য শহীদ হন।

কুড়িগ্রামের মোগলপুর অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী রাজাকারের ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়ে পাঁচটি রাইফেল ও দুইশত গুলি অধিকার করে।

মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী মুজিবনগরে বলেন- আমার ছেলেরা এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত। মাত্র কয়েক মাসেই তারা পৃথিবীর যে কোনো সুশিক্ষিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে পাল্টা দেবার মতো দুর্ধর্ষ হয়ে উঠেছে। আর দেরী নয়, এখনই চরম আঘাত হানতে হবে।

যশোরের মুন্সিগঞ্জের বড়খালীতে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর পাকবাহিনী আক্রমণ করলে মুক্তিবাহিনী তা প্রতিহত করে। মুক্তিবাহিনী এখানে একটি সেতু ধ্বংশ করে দিয়ে পাকবাহিনীর সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এই যুদ্ধে ১২ জন পাকহানাদার নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর দুই জন সদস্য শহীদ হন।

যুদ্ধ পরিস্থিতি রিপোর্ট-৮ নম্বর সেক্টরের দলিল পত্র থেকে: G-0656 dt- 29/11/71 Own tps laid ambush at Moheskundi on en ptl 6364 M/S 789/16 on 271400 Nov. En cas 4 dead. Own cas nil.