৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২৫ নভেম্বর ১৯৭১ এই দিনে

১৯৭১ সালের এই দিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের এক মুখপাত্র এক বিবৃতিতে পাকিস্তানকে সংযত আচরণ করার আহ্বান জানায়। এই বিবৃতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের মুখপাত্র বলেন, 'উপমহাদেশের অস্থিরতা বৃদ্ধি ও যুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরির জন্য পাকিস্তানই দায়ী। এরই মধ্যে দেশগুলো সমস্যা নিরসনে পাকিস্তানকে যে পরামর্শ দিয়েছে পাকিস্তান তা পালন করেনি উল্টো সংকট আরো বৃদ্ধি করেছে। পাকিস্তান তার যুদ্ধংদেহী মনোভাব বজায় রেখেছে। এর ফল পাকিস্তানের জন্য শুভও হবে না।'

২৫ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তানে নিযুক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত রোজিনোভ। এসময় তারা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সমস্যা নিরসন ও উত্তেজনা নিরসন, উদ্বাস্তু সংকটসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন।

এদিন রাওয়ালপিন্ডিতে বার্তা সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, 'আগামী দশ দিন পর আমাকে এই রাওয়ালপিন্ডিতে বসে থাকতে দেখবেন না। আমি তখন সীমান্তে যুদ্ধ করবো। ভারত যে ধরনের আচরণ করছে তাতে সার্বভৌমত্বের প্রশ্নের মুখে পড়েছি আমরা।'

এদিন লন্ডনে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত জেনারেল মহম্মদ ইউসুফ জরুরি বৈঠকের জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সাক্ষাৎ চেয়ে আবেদন করেন। বৈঠকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মহম্মদ ইউসুফ ইয়াহিয়া খানের দেয়া একটি বার্তা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে দেন। এই বার্তায় ইয়াহিয়া খান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে ভারতকে সংযত হওয়ার আহবান জানিয়ে সচেষ্ট হওয়ার আবেদন জানান।

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

১৯৭১ সালের এই দিনে নিউইয়র্ক টাইমস একটি প্রতিবেদনে বলে, পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক অবস্থা শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য এবং সংকট দূরীকরণে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়ার বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি ব্যক্তিগত আবেদন করবেন বলে জানা গেছে। এছাড়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উপমহাদেশের সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য ইয়াহিয়া খানের অনুরোধটিও মার্কিন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে।'

২৫ নভেম্বর বিবিসির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিটিশ সরকার সমস্ত ব্রিটিশ নাগরিকদের অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য একটি নোটিশ জারি করে। পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা ক্রমাগত অবনতির দিকে যাওয়ায় এই নির্দেশ জারি করা হয়। একই সঙ্গে নোটিশে বলা হয়, 'যারা স্বদেশে ফিরতে যাচ্ছেন তাদের অতিসত্বর ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। যেন তারা দ্রুত এখান থেকে চলে যেতে পারেন।'

২৫ নভেম্বর টোকিওতে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইসাকু সাতো ভারতের প্রেসিডেন্ট ভি ভি গিরি ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে পৃথক তারবার্তায় নিজেদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ বৈঠকের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির আহবান জানান। এদিন টোকিওতে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাকিও ফুকুদা সাংবাদিকদের বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর বার্তা পাঠানোর আগে বিষয়বস্তু এবং উপমহাদেশের শান্তি ফিরিয়ে আনার বিষয়ে জাপানের মন্ত্রিসভায় এই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।'

২৫ নভেম্বর ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স এক জরুরি স্বল্প সময়ের নোটিশে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত কৃষ্ণরাজ গোত্র এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা মোহাম্মদ রাজাকে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠান। এরপর তিনি রাষ্ট্রদূতদ্বয়ের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন। এসময় তিনি পাকিস্তান বা ভারতের দূতদের সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তেজনা নিরসনে সৈন্য অপসারণ আবশ্যক বলে মন্তব্য করেন।

২৫ নভেম্বর মার্কিন সিনেটে ডেমোক্রেট পার্টির সিনেটর মাইক ম্যান্স ফিল্ড ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্ভাব্য যুদ্ধে জড়ানোর বিরুদ্ধে বলেন, 'আমি আশা করি আমরা আর কখনোই কোনো স্থানে ভিয়েতনামের মতো সমস্যায় জড়াবো না। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত অন্য দেশের বিষয়ে নিজেকে না জড়ানো।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

২৫ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর একটি দল ফেনীর ফুলগাজি, আনন্দপুর, চাঁদগাজি বাজার এবং পরশুরাম থানা পাকিস্তানই হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করে।

২৫ নভেম্বর বগুড়ার গাবতলীতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল জয়ভোগ গ্রামের রেলওয়ে ব্রিজে পাকিস্তানই বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। দুইপক্ষের মধ্যে গোলাগুলির এক পর্যায়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পিছু হটে পালিয়ে যায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পালিয়ে যাওয়ার এক পর্যায়ে ট্রেনের বগি বোঝাই হানাদার সৈন্য গাবতলীর জয়ভোগা ও বইগুনী গ্রামের দিকে এগিয়ে নিরীহ গ্রামবাসীর উপর গুলিবর্ষণ করে। এসময় বেশ কয়েকজন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হয়। পরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল হামলার খবরে এগিয়ে এসে হানাদার বাহিনীর উপর হামলা করতে এলে হানাদার সেনারা গাবতলীর হানাদার ঘাঁটির দিকে পালিয়ে যায়।

২৫ নভেম্বর সিলেটের কানাইঘাটে পাক ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে পরাভূত করার পর মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা আরেকটি প্রচন্ড যুদ্ধের পর ডাউকারগাল এবং লাউয়াছড়া হানাদার মুক্ত করে নিজেদের দখলে নেয়।

২৫ নভেম্বর খুলনার চালনা বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের এক অপারেশনে ১০ জন রাজাকার নিহত হয়।

২৫ নভেম্বর ঢাকা টাঙ্গাইল সড়ক নিজেদের দখলে নেয় কাদেরিয়া বাহিনী।

২৫ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মধ্যে মেহেরপুর শহর দখল নিয়ে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। এসময় বেশ কয়েকজন হানাদার সৈন্য হতাহত হয়।

২৫ নভেম্বর টানা কয়েকদিন প্রচন্ড যুদ্ধের পর রংপুর এবং দিনাজপুর জেলার বিশাল এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।

২৫ নভেম্বর যশোরে মুক্তিবাহিনী ঝিকরগাছা থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের উৎপাটন করে হানাদার সৈন্যদের ঘাঁটি নিজেদের দখলে নেয়। ঝিকরগাছার বেশ কয়েকটি জায়গায় এদিন বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখা যায়।

২৫ নভেম্বর রাঙ্গামাটিতে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে হানাদার ও রাজাকারদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। হামলার এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী পালিয়ে গেলে ১৩ রাজাকার রাইফেল ও গোলাবারুদসহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

২৫ নভেম্বর ১৯৭১: পাকসেনা ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে মেহেরপুর শহর দখল নিয়ে জোড় লড়াই

 

পাকসেনা ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে মেহেরপুর শহর দখল নিয়ে জোড় লড়াই। ফাইল ছবি

পাকসেনা ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে মেহেরপুর শহর দখল নিয়ে জোড় লড়াই। ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। এই দিন লাহোরে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর গোলাম আজম এক বক্তৃতায় ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করার আহবান জানিয়ে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্বের প্রতি একটি ভয়ানক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

মরণপণ লড়াই করে মুক্তিবাহিনী ফুলগাজি, আনন্দপুর আর চাঁদগাছি বাজার থেকে পাকিস্তানিদের হটিয়ে দিয়েছে। শুধু তিনমাইল দূরের পথ ‘ফেনী’এলাকার দখল নেয়া বাকি। এছাড়া পরশুরাম থানা এলাকায় মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ কতৃত্ব রয়েছে।

আনন্দবাজার পত্রিকার রিপোর্ট: 

মুক্তিবাহিনীর সূত্রে ঘোষণা করা হয় যে সাতক্ষীরা মহকুমার প্রতিটি থানা মুক্ত হয়েছে। মুক্তিবাহিনী এখন খুলনার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

এদিকে পাকসেনা ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে মেহেরপুর শহর দখল নিয়ে জোড় লড়াই চলছে। দিনাজপুর শহরের আমবাগান ছেড়ে পাবাহিনী সৈয়দপুরের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে।

সন্ধ্যায় মুক্তিবাহিনী যশোরের ঝিকরগাছা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের ঘাঁটিগুলো দখল করেছে। এখন ঝিকরগাছার সব জায়গায় বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। শত্রু পালিয়ে যাবার সময় বহু অস্ত্রশস্ত্র ফেলে গিয়েছে। উল্লেখ্য, ঝিকরগাছা গত ৮ এপ্রিল মুক্তিবাহিনীর হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিলো।

প্রচন্ড যুদ্ধ চলার পর রংপুর এবং দিনাজপুর জেলার প্রায় ৪৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা মুক্তিবাহিনী দখল করে রয়েছে। এদিকে রাঙ্গামাটিতে লড়াই চলছে। পাকসেনা-মুক্তিযোদ্ধা মুখোমুখি। সেখানে ১৩ জন রাজাকার রাইফেল ও গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করেছে।