৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২৪ নভেম্বর ১৯৭১ এই দিনে

এদিন পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার যুদ্ধ পরিস্থিতির তীব্র সম্ভাবনায় পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা শুরু করে। অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ভারত ও পাকিস্তানকে উত্তেজনা নিরসনে সংযমী হওয়ার আহবান জানান। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে এদিন বলা হয়, 'ওয়াশিংটন এই ব্যাপারে মস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে। আমরা আশাবাদী খুব শিগগির যুদ্ধের সম্ভাবনা কমে আসবে।'

২৪ নভেম্বর ফরাসি সরকার ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্তে তীব্র উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধ সম্ভাবনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। এসময় ফ্রান্স সরকার এই উত্তেজনা নিরসনে জাতিসংঘকে জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নে্ওয়ার আহবান জানায়। এদিন ফরাসি প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদু এক বিবৃতিতে বলেন, ফ্রান্স যুদ্ধ পরিস্থিতির অবসান চায়। এর ফলে সংকট আরও বাড়বে। পূর্ব বাংলার সমস্যার মীমাংসা  একমাত্র রাজনৈতিক উপায়েই করতে হবে। এদিন ফরাসি সরকারের মুখপাত্র বলেন, ফ্রান্সের মন্ত্রিসভায়ও এই নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এবং মন্ত্রিসভার সদস্যরা সংকট পরিস্থিতিতে উভয়পক্ষকে ধৈর্যধারণের অনুরোধ করেছেন।'  

ভারতে এদিন

এদিন লোকসভার অধিবেশনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'ভারত সরকার জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করবে না। পাকিস্তানের সাথে ভারতের অঘোষিত যুদ্ধ সম্পর্কিত পাকিস্তানের অভিযোগ সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মিথ্যা। পাকিস্তান যুদ্ধ লাগাতে ক্রমাগত উসকানি দিয়েই যাচ্ছে।' 

২৪ নভেম্বর দিল্লিতে ভারত সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, সেনাবাহিনীর প্রতি পূর্বের নির্দেশ পরিবর্তন করা হয়েছে। আত্মরক্ষার্থে সেনাবাহিনীকে সীমান্ত অতিক্রমণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি আরও সংকটজনক করার কোনো ইচ্ছে আমাদের ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ জোতদার করায় পশ্চিমাঞ্চলের চেয়ে পূর্বাঞ্চলে পরিস্থিতি এখন গুরুতর আকার ধারণ করেছে।' 

ঢাকায় এদিন

এদিন কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ঢাকায় কারফিউ জারির আদেশ দেওয়া হয়। তবে কারফিউ কতক্ষণ বলবৎ থাকবে সে ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। এর আগে ১৭ নভেম্বর সারাদিন ঢাকায় কারফিউ জারি করা করা হয়েছিল। 

পাকিস্তানে এদিন 

২৪ নভেম্বর করাচিতে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এম এ মালিক এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানে আইন শৃঙ্খলা স্বাভাবিক রয়েছে। ভারতীয় হামলার ফলেই পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনতে দেরি হচ্ছে। তবে আমরা ভারতের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছি।' এসময় তিনি রাজাকারদের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, 'রাজাকারদের দেশরক্ষার পদক্ষেপ ইতিহাসে জায়গা করে নেবে।'

২৪ নভেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ভবনে সফররত ১২ সদস্যের চীনা প্রতিনিধি দল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করে। এদিন রাতে ইসলামাবাদে চীনা প্রতিনিধি দলের সম্মানে দেওয়া এক ভোজসভায় চীনা প্রতিনিধি দলের নেতা লি সুই চিং বলেন, 'চীন সরকার পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের প্রতি সবসময়ই সমর্থন বলবৎ রাখবে। এবং পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে হৃদতাপূর্ণ সম্পর্ক অটুট থাকবে।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ 

২৪ নভেম্বর সিলেটে বৈয়ামপুর দখলে আনার জন্য মুক্তিবাহিনীর অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপর পাকিস্তানি বাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের আক্রমণ করলে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এসময় বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয় এবং ১২ জন পাকিস্তানি সৈন্য মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। বাকি হানাদার সৈন্যরা বৈয়ামপুর ছেড়ে পালিয়ে যায়। যার ফলে বৈয়ামপুর নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় মুক্তিবাহিনী।

২৪ নভেম্বর সিলেটে মুক্তিবাহিনীর একটি দল জকিগঞ্জ-আটগ্রাম সড়ক ধরে গৌরীপুরে নিজেদের অবস্থান নেয়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দল কানাইঘাটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের শক্তিশালী ঘাঁটির উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুললে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এসময় ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর সারোয়ার সহ বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয় এবং ৬ জন সৈন্য মুক্তিবাহিনীর হাতে আটক হয়। এসময় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এই ঘাঁটি থেকে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে। 

২৪ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার পানিয়ারূপে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিয়মিত যাতায়াতের খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনীর একটি দল অ্যামবুশের পরিকল্পনা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর যাতায়াতের সময় তাদের উপর অ্যামবুশ করে। এসময় মুক্তিবাহিনীর হামলায় ১০ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।

২৪ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা এবং ক্যাপ্টেন এমএ মঞ্জুরের নেতৃত্বে প্রায় ৪৫ ঘণ্টার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর যশোরের চৌগাছা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।

২৪ নভেম্বর রাত থেকে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা ধানুয়া কামালপুর অবরোধ করে। এসময় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর অন্যতম শক্তিশালী ঘাঁটি কামালপুরকে মূল বাহিনী থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রসদ সরবরাহের যাবতীয় পথ বন্ধ করে দেয়। 

২৪ নভেম্বর কুড়িগ্রামে মুক্তিবাহিনীর একটি দল নাগেশ্বরী থানা ও পাটেশ্বরিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সৈন্যদের উপর আক্রমণের লক্ষ্যে ঘেরাও করে। এসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীও মুক্তিবাহিনীর উপর পাল্টা আঘাত হানে। এসময় মুক্তিযোদ্ধা সাইদুর রহমান, সেরাজুল হক এবং সোহরাব আলী শহীদ হন।

২৪ নভেম্বর কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারিতে সাহেবগঞ্জ সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল ভুরুঙ্গামারি দখলের পর নাগেশ্বরী ও পাটেশ্বরীর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থান দখলের জন্য হানাদার বাহিনীর চতুর্দিক ঘেরাও করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর প্রচণ্ড আক্রমণ গড়ে তোলে। এসময় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ৩ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অন্যদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ২০ জনের বেশি সৈন্য নিহত হয়।