৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২০ নভেম্বর ১৯৭১ এই দিনে

মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে বাংলাদেশে পবিত্র ঈদ-উল- ফিতর পালিত হয়। এদিন কলকাতায় থিয়েটার রোডে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার সদর দপ্তরের সামনে ঈদ জামাতে অংশ নেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মুক্তিবাহিনীর প্রধান ও প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীসহ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। নামাজ শেষে তারা ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। ঈদের আগের দিন ১৯ নভেম্বর কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র সাপ্তাহিক 'জয় বাংলা'। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি বাণী প্রকাশ করে জয় বাংলা পত্রিকা। এই বাণীতে 'এই ঈদে আমাদের প্রার্থনা হোক' শিরোনামে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'আমাদের দেশে এবার ঈদ এসেছে অত্যন্ত মর্মান্তিক পরিবেশে। দখলীকৃত এলাকায় শত্রুসৈন্যের তাণ্ডব চলছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে বিচ্যুত হয়ে শরণার্থী হয়েছেন। মুক্ত এলাকায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি চলছে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য, রক্তের বিনিময়ে মানুষ মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম করছে। এবার ঈদে আনন্দ মুছে গেছে আমাদের জীবন থেকে, আছে শুধু স্বজন হারানোর শোক, দুর্জয় সংগ্রামের প্রতিজ্ঞা ও আত্মত্যাগের প্রবল সংকল্প। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং আমার নিজের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জনসাধারণকে ঈদ উপলক্ষে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ঈদের যে আনন্দ আজ আমরা হারিয়েছি, তা আমাদের জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে সেদিনই, যেদিন আমরা দেশকে সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত করব। আমি আপনাদের আশ্বাস দিচ্ছি যে, যথাসর্বস্ব পণ করে যে স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা লিপ্ত, তার চূড়ান্ত সাফল্যের দিনটি নিকটতর হয়ে এসেছে। সেই মুহূর্তটিকে এগিয়ে আনার সংগ্রামে আমরা সবাই যেন নিঃস্বার্থভাবে নিজেদের নিয়োগ করতে পারি, এই ঈদে তাই হোক আমাদের প্রার্থনা।'

ভারতে এদিন

২০ নভেম্বর দিল্লিতে লোকসভার অধিবেশনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'ভারত আশা করে জাতিসংঘ মহাসচিব পূর্ববঙ্গে গৃহযুদ্ধের অবসানে আত্মনিয়োগ করবেন। বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ভাগ্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সমস্যাকে ধামাচাপা দিয়ে এটিকে পাকিস্তান ও ভারত বিরোধে রূপান্তরিত করলে তা শুধু সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলবে। আমি জাতিসংঘ মহাসচিবকে এই নিশ্চয়তা দিতে চাই পাকিস্তান আক্রমণ করার অথবা পাকিস্তানের সাথে সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার কোনো ইচ্ছেই আমাদের নেই।'

দেশব্যাপী গণহত্যা ও প্রতিরোধ যুদ্ধ

পৈরতলা গণহত্যা

২০ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে রাতে ৩৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শহরের পৈরতলা খাল পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে হানাদারেরা। এর আগে ২৭ অক্টোবর সিরু মিয়া দারোগা, তার ছেলে কামাল ও দাউদকান্দি থানা বিএলএফ কমান্ডার শহিদ নজরুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় আটক করেছিল রাজাকারেরা। এরপর তারা পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে তাদের তুলে দেয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে নিয়ে যাওয়ার পর সেই মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালান হয়েছিলো। এরপর ঈদের দিন রাতে ৩৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে শেষ দফা নির্যাতন চালিয়ে গুলি করে হত্যা করে হানাদারেরা।

২০ নভেম্বর কুড়িগ্রামে ৬নং সেক্টরের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচ এসএস-১ এর কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ আশফাকুস সামাদ এবং লেফটেন্যান্ট আবদুল্লাহ রায়গঞ্জ সি এন্ড বি পুলের দুই পাশে অবস্থানরত হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি দখলের চেষ্টা করার সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ফাঁদে পড়ে যান। এসময় মুক্তিবাহিনী ও হানাদার বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনীর গুলি আশফাকুস সামাদের মাথায় এসে লাগলে শহীদ হন তিনি। একই সঙ্গে শহীদ হন সিপাহী কবীর আহমেদ, আব্দুল আজীজসহ আরও বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা।

২০ নভেম্বর সিলেটের জকিগঞ্জে ভারতীয় বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধারা যৌথ অভিযানে চালিয়ে ৩ জন হানাদার ও ২৩ জন রাজাকারকে আটক করে। এসময় অ্যান্টি মাইন বিস্ফোরণে আহত হন মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ এমদাদুল হক ও মুক্তিযোদ্ধা আলী।

২০ নভেম্বর ঈদের দিন নিয়ে একাত্তরের ঈদের এই দিনে স্মৃতিচারণায় কর্নেল নুরুন্নবি খান বীর বিক্রম লিখেন, '২০ নভেম্বর পবিত্র ঈদের দিনে আমরা আশা করেছিলাম অন্তত এইদিন পাকিস্তানিরা আর্টিলারির গোলা নিক্ষেপ বা সরাসরি আক্রমণ পরিচালনা থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু বাস্তবে ছিল এর বিপরীত দৃশ্য। ঈদের দিন সকাল থেকেই পাকিস্তানিরা আমাদের প্রতিটি অবস্থানেই ব্যাপকভাবে আর্টিলারির গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। আমাদের কোনো অবস্থানেই মুক্তিযোদ্ধারা জামাতের সাহায্যে ঈদের নামায পড়ার সুযোগ পায়নি।'

২০ নভেম্বর দিবাগত রাতে খুলনার কালীগঞ্জ ওয়াপদা কলোনীতে হানাদার সেনাদের একটি কোম্পানি, রেঞ্জার এবং বেশ কিছু রাজাকার অবস্থান করছে খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা হেডকোয়ার্টার ইকসা থেকে রওনা হয়ে লক্ষ্যস্থলের কাছে এসে পৌঁছান। এই সময়ে আরেকটি কলাম নিয়ে লেফটেন্যান্ট আহসানউল্লাহ এবং নায়েক সুবেদার সোবহান হানাদারদের অবস্থানের কাছাকাছি চলে আসেন। এদিন ভোর ৫ টায় মুক্তিবাহিনী ত্রিমুখী আক্রমণ চালায় হানাদারদের উপরে। এসময় হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর টানা দুই ঘণ্টা সংঘর্ষ হয়। পরে ৪০ জন হানাদার সেনাকে আটক করে মুক্তিবাহিনী এবং কালীগঞ্জ নিজেদের দখলে নেয়।

২০ নভেম্বর বরিশালের মুক্তিযোদ্ধাদের ৫০ জনের একটি দল নৌকায় করে মুক্তিযোদ্ধা আলমগীরের নেতৃত্বে বুকাবনিয়া থেকে আমতলী থানা আক্রমণ করার জন্য আমতলী পৌঁছলে আরও ৫০ জন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা যোগ দিয়ে রাত ১ টার সময় আমতলী থানা আক্রমণ করে। আমতলী থানায় পাকসেনা, রাজাকার ও পুলিশ মিলে ছিল ১৫০ জনের মতো। আড়াই ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের ২০ জন নিহত এবং অনেকে আহত হয়। এ যুদ্ধে নারী গেরিলা রাজিনা আনসারী অংশ নেন।

২০ নভেম্বর যশোরের গুলবাগপুরের গোয়ালহাটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি বড় দল মুক্তিবাহিনীর উপর হামলা করে তা দখল করে নেয়। এই সময় ৩ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পরে মুক্তিবাহিনী গোয়ালঘাট এলাকা পুনরুদ্ধার করার জন্য ফের আক্রমণ চালায়। পরে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সাহায্যে ওই এলাকা পুনরায় দখল করে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী টিকতে না পেরে পিছু হটে পালিয়ে যায়।

২০ নভেম্বর খুলনার মুক্তিবাহিনীর একটি মুক্তিযোদ্ধা দল চালনা বাজার আক্রমণ করলে প্রতিরোধের চেষ্টা ছাড়াই চালনায় অবস্থানরত সব রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। পরবর্তীতে চালনা বাজার নিজেদের দখলে নেয় মুক্তিবাহিনী।

 

২০ নভেম্বর ১৯৭১: কালীগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর সংঘর্ষ হয়

 

কালীগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। ফাইল ছবি

কালীগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর দিনটি ছিল শনিবার। এই দিন ভারতীয় পার্লামেন্টে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ভারত আশা করে জাতিসংঘ মহাসচিব পূর্ববঙ্গে গৃহযুদ্ধের অবসানে আত্মনিয়োগ করবেন। 

তিনি বলেন, পূর্ববঙ্গের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভাগ্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সমস্যাকে ধামাচাপা দিয়ে এটিকে পাক-ভারত বিরোধে রূপান্তরিত করলে তা শুধু সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলবে।

তিনি আরো বলেন, আমি মহাসচিবকে এই নিশ্চয়তা দিতে চাই পাকিস্তান আক্রমণ করার অথবা পাকিস্তানের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার কোনো ইচ্ছেই আমাদের নেই।

টেংরাটিলা আক্রমণের পূর্বে সেক্টর কম্যান্ডার মেজর শওকত তার বাঁশতলা সেক্টর হেড কোয়ার্টারে এক সভা আহবান করেন। সভায় টেংরাটিলা আক্রমণের বিষয় নিয়ে মেজর শওকত বিস্তারিত আলোচনা করেন। ঐ সভায় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ক্যাপ্টেন মহসীন, ক্যাপ্টেন আকবর, ক্যাপ্টেন হেলাল, লেঃ মাহবুবার রহমান এবং কয়েকজন এফ.এফ. লিডার।

কালীগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। কালীগঞ্জের ওয়াপদা কলোনীতে পাকসেনাদের একটি কোম্পানী অবস্থান করছিল। তাদের সঙ্গে বেশ কিছু রাজাকারও ছিল। এই যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর তৃতীয় রাজপুত ব্যাটালিয়ন হিঙ্গলগঞ্জ থেকে মুক্তিবাহিনীকে আর্টিলারী সাপোর্ট দেয়। দুঘন্টা স্থায়ী যুদ্ধে পাকবাহিনীর কোনো ক্ষতি না হলেও ৪০ জন পাকসৈন্য মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে।

মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণে পাকবাহিনী নৌকুচি থেকে আহমদনগরে যে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল তা বিপযস্ত হয়ে পড়ে। পাকবাহিনী এখান থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়।

সাহেবগঞ্জ সাবসেক্টর বাহিনী মেজর নওয়াজেশ উদ্দিন-এর কমান্ডের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। প্রচন্ড সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে রায়গঞ্জ মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এলেও তরুণ মুক্তিযোদ্ধা লে. আশফাকুস সামাদ যুদ্ধে শহীদ হন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর বীর উত্তম উপাধি প্রদান করেন। উল্লেখ্য ঐ যুদ্ধে ২০ জন পাকসৈন্য নিহত হয়।

মুক্তিবাহিনী কিশোরগঞ্জের গচিহাটায় সদ্য- নির্মিত রেলওয়ে ব্রীজ ধ্বংস করে দেয়। এর অব্যবহিত পরেই কিশোরগঞ্জে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়। ফলে কিশোরগঞ্জ শহর জনমানব শূন্য হয়ে পড়ে।