৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

১৩ নভেম্বর ১৯৭১ এই দিনে

৩ সপ্তাহে ৬টি দেশ সফর করার পর এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে ফিরে এলে বিপুল সংখ্যক জনতা তাকে স্বাগত জানায়।

এ সময় ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'আমরা যেসব দেশ সফর করেছি, সেসব দেশের নেতারা এখন বাংলাদেশ সংকটের গুরুত্ব বিষয়ে সজাগ হয়েছেন। আমরা আশা করি, এসব দেশের ফলপ্রসূ হস্তক্ষেপের ফলে বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের জন্য গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধান আসবে। তারা এখন স্বীকৃত রাষ্ট্র বাংলাদেশের সংকট বিষয়ে বেশি আগ্রহী।' 

বিমানবন্দরে বক্তৃতা শেষে সফর বিষয়ক নানা প্রশ্নের জবাব দেন ইন্দিরা গান্ধী। তিনি বলেন, 'শুধু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই সমাধান গ্রহণ ও বর্জন করার অধিকার রাখেন।'

শেখ মুজিবুর রহমানকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হতে পারেন কি না—এমন  প্রশ্নের জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'নেতা শেখ মুজিবকে ছাড়া আওয়ামী লীগ নেতারা এমন বৈঠকে রাজি হবেন বলে আমি মনে করি না।' ভারত-পাকিস্তানে যুদ্ধের আশঙ্কার বিষয়ে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'বিশ্বনেতারা যুদ্ধ বিষয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন। আমি বিশ্বনেতাদের আশ্বস্ত করেছি, ভারত যুদ্ধের প্ররোচনা দেবে না। তারা আমার বক্তব্যে কিছুটা আশ্বস্ত হলেও, ইয়াহিয়া খান সম্পর্কে নিশ্চিত নন।'

১৩ নভেম্বর মুজিবনগরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, 'পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গোপনে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আলোচনা আহ্বান করেছেন বলে সংবাদপত্রে যে খবর এসেছে, তা নির্জলা মিথ্যা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অভিমত সুস্পষ্ট। বাংলাদেশ সরকার বা বাংলাদেশের কোনো নেতা  বিদেশি সূত্র বা অন্য কোনো মহলের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি নয়। আমরা বাংলাদেশের জনগণ আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থকদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি, আপনারা এ ধরনের চক্রান্তকারীদের কোনো কৌশলে গুরুত্ব দেবেন না।'

ভারতে এদিন

১৩ নভেম্বর দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশন এক বিজ্ঞপ্তিতে বলে, 'পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে জানিয়ে যে পত্র পাঠিয়েছেন, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।'

এদিন কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হোসেন আলী আলোচনার জন্য দিল্লিতে যান।

পাকিস্তানে এদিন

১৩ নভেম্বর  করাচিতে অল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাস্টার খান গুল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'ভুট্টো, খান কাইয়ুম ও ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোই দেশে প্রতিক্রিয়াশীল দুর্ভেদ্য দুর্গ করে পাকিস্তানে একনায়কতন্ত্র চিরস্থায়ী করার ষড়যন্ত্রে মেতেছে। এসব লোকের গণতন্ত্রের প্রতি কোনো আস্থা থাকলে তারা নিশ্চয়ই জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করতেন এবং নির্বাচনে জনগণের রায় মেনে নিতেন।'

আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছেন বলে ভুট্টো, খান আবদুল কাইয়ুম এবং অন্যান্য দক্ষিনপন্থি রাজনীতিবিদরা যে অভিযোগ করেছেন, সে ব্যাপারে প্রশ্ন করলে মাস্টার খান গুল বলেন, 'এ অভিযোগ হলো ননসেন্স! তারা কায়েমি স্বার্থবাদী আমলাতন্ত্র এবং শোষক শ্রেণীর পুতুলে পরিণত হয়েছে। আজকে দেশের এ পরিস্থিতির জন্য ভুট্টো ও খান কাইয়ুম সম্পূর্ণভাবে দায়ী। এখন দেশকে রক্ষার একমাত্র উপায় হলো, জনগণের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে নেওয়া এবং গত বছরের ডিসেম্বরে জনগণ যে রায় দিয়েছে তার ওপর ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এ ছাড়া দেশকে রক্ষা করার আর কোনো উপায় নেই।'      

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

১৩ নভেম্বর প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধে বলা হয়, 'প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবের মধ্যে বোঝাপড়ার জন্য ইসলামাবাদের ওপর মার্কিন সরকারের অধিকতর চাপ প্রয়োজন।' এতে আরও বলা হয়, 'ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আজ যে এমন সাংঘাতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের নীতি অনেকখানি দায়ী। সম্প্রতি পাকিস্তানকে দেওয়া সামরিক সহায়তার পরিমাণ কমানোর জন্য যে আদেশ দেওয়া হয়েছে, তা কেবল একটি ধোঁয়াশা। পূর্ব পাকিস্তানে ভয়াবহ অবস্থা চলমান থাকার পরেও ইসলামাবাদের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তাতে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে।' 

১৩ নভেম্বর ওয়াশিংটনে সোসাইটি অফ প্রফেশনাল জার্নালিস্টসের উদ্যোগে আয়োজিত এক সেমিনারে  মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, 'যে কোনো মুহূর্তে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ লাগতে পারে। যুদ্ধ যেন না লাগে সেজন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আর যুদ্ধ যদি লেগেই যায়, তাহলে আমরা সবভাবে এর বাইরে থাকার চেষ্টা করব। কোনো রকম যুদ্ধে জড়ানোর ইচ্ছে আমাদের নেই।'

ভারত-সোভিয়েত চুক্তির প্রেক্ষিতে ভারতের জোট নিরপেক্ষ নীতিতে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না— এ প্রশ্নের জবাবে উইলিয়াম রজার্স বলেন, 'গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন, এর ফলে জোট নিরপেক্ষ নীতির কোনো পরিবর্তন হবে না। আমরা তার কথা অবিশ্বাস করার কোনো কারণ দেখি না।'

দেশব্যাপী গণহত্যা ও প্রতিরোধ যুদ্ধ

হাতিয়া গণহত্যা

১৩ নভেম্বর কুড়িগ্রামের উলিপুরের হাতিয়া ইউনিয়নে পৈশাচিক গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এ গণহত্যায় ৭টি গ্রামের প্রায় ৭০০ নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন। 

এদিন ছিলো ২৩ রমজান। সেহরির কিছুক্ষণ পরে স্থানীয় মসজিদে নামাজ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বড় একটি দল রাজাকার ও আল শামসের সহযোগিতায় প্রথমে ইউনিয়নের অনন্তপুর বাজারে প্রবেশ করে। এরপর  এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে তারা। মানুষ কিছু বুঝে উঠার আগেই হানাদার বাহিনী দাগারকুটি গ্রামে ঢুকে গান পাউডার ছিটিয়ে বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। কেউ কেউ ঘর থেকে বের হতে পারলেও বহু গ্রামবাসী নিজের ঘরেই আগুনে পুড়ে মারা যায়। একে একে হাতিয়া ইউনিয়নের দাগারকুটি বাগুয়া, অনন্তপুর, রামখানা, নয়াডোরা, নীলকণ্ঠসহ পাশের আরও কয়েকটি গ্রামে থেকে প্রায় ১ হাজার গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে আসে হানাদার বাহিনী। এরপর দাগারকুটি গ্রামে ধরলা নদীর তীরে একটি ডোবার কাছে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে। বেশিরভাগ লাশ ধরলা নদীর পানিতে ভেসে যায়। পরে ৪১৫ জনের নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়।

১৩ নভেম্বর কুড়িগ্রামে মিত্রবাহিনীর সহায়তায় ৬নং সেক্টরের মুক্তিবাহিনী ভূরুঙ্গামারীকে হানাদার মুক্ত করে। এ অপারেশনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ৬নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার এম খাদেমুল বাশার এবং সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর নওয়াজেশ। ভারতীয় বাহিনীর নেতৃত্ব দেন  ব্রিগেডিয়ার যোশী। এ যুদ্ধে বহু হানাদার সেনা নিহত হয়। জীবিত অবস্থায় ৩ জনকে বন্দী করে মুক্তিবাহিনী। ভূরুঙ্গামারী মুক্ত হলে মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় সার্কেল উন্নয়ন অফিসে বন্দী বহু নারীকে উদ্ধার করেন।

১৩ নভেম্বর গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জে কমান্ডার দুলুর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল সুকানপুকুর রেলস্টেশনের পাশে  মিহিরপুরের কাছে রেললাইনে ডিনামাইট লাগিয়ে রাখে। পরে ডিনামাইট বিস্ফোরণে প্রায় ১৫০ হানাদার সেনা নিহত হয়।

১৩ নভেম্বর কোম্পানি কমান্ডার ফজলুল ওয়াহাব ও চাঁন মিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর ২টি দল ময়মনসিংহের ভালুকা থানা ও ভাওয়ালিয়া বাজু এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর হামলা চালায়। এ সময় ৩ হানাদার সেনা ও বেশ কয়েকজন রাজাকার আহত হয়।

১৩ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর সুবেদার মেজর লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে ১ প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা লক্ষ্মীপুর রাজাকার ক্যাম্পে হামলা চালান। এ হামলায় বহু রাজাকার নিহত হয়।

১৩ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী হামজাপুর সাব সেক্টরে ঘনেপুর বিওপি আক্রমণ করে। এতে ৩০ পাকসেনা নিহত হয়।

 

১৩ নভেম্বর ১৯৭১: মিত্রবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনী ভুরঙ্গামারী সম্পূর্ণরূপে হানাদার মুক্ত করে

 

মিত্রবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনী ভুরঙ্গামারী সম্পূর্ণরূপে হানাদার মুক্ত করে। ফাইল ছবি

মিত্রবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনী ভুরঙ্গামারী সম্পূর্ণরূপে হানাদার মুক্ত করে। ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর দিনটি ছিল শনিবার। এই দিন সুবেদার মেজর লুৎফর রহমান নিজ প্লাটুন নিয়ে লক্ষ্মীপুর রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এই আকস্মিক আক্রমণে বহু রাজাকার হতাহত হয়। এখানে সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে।

মহিমাগঞ্জের দুলুর নেতৃত্বে ও মিহিপুরের বাবলু, খালেক, হামিদ, খলিল, নরুল, শুকু, ফিনু, জগলু, হালু, লিটু এবং অন্যান্য গেরিলাদের সহযোগিতায় সুকানপুকুর রেল স্টেশনের ধারে মিহিরপুরের নিকট একটি পাকসৈন্যবাহী স্পেশাল ট্রেন ডিনামাইট দিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়া হয়। ফলে প্রায় দেড়শত পাকসৈন্য মৃত্যুবরণ করে।

মিত্রবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনী ভুরঙ্গামারী সম্পূর্ণরূপে হানাদার মুক্ত করে। এই অভিযানে ভারতীয় বাহিনীর নেতৃত্ব দেন ব্রিগেডিয়ার যোশী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালনা করেন সেক্টর কমান্ডার কে.এম.বাশার ও সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর নওয়াজেশ। এই যুদ্ধে প্রচুর গোলাবারুদ সম্মিলিত বাহিনীর হাতে আসে। এই যুদ্ধে বহু পাকসৈন্য নিহত হয় এবং ৩ জনকে বন্দী করা হয়।

হামজাপুর সাবসেক্টরে ঘনেপুর বি.ও.পি আক্রমণ করে ৩০ জন পাকসেনাকে হত্যা করে। 

লে. কর্নেল তাহের রাত ৩.২০ মিনিটে মুক্তিফৌজ কোম্পানী কমান্ডারদের ডেকে কামালপুর পাকঘাঁটি আক্রমণ করার পরিকল্পনা অবহিত করেন। তিনি কোম্পানী কমান্ডারদের মোট ৮৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কামালপুরের আশেপাশে গ্রামে এ্যামবুশ নিয়ে থাকার নির্দেশ দেন। উল্লেখ্য কর্নেল তাহের ঐ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।