৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

১২ নভেম্বর ১৯৭১ এই দিনে

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি মাওলানা ভাসানী ১২ নভেম্বর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর (যুক্তরাজ্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত) কাছে লেখা এক চিঠিতে ভারত তাঁকে গৃহবন্দী করে রেখেছে বলে যে প্রচার চলছে, তা দুরভিসন্ধিমূলক বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, চলাফেরার পূর্ণ স্বাধীনতা তিনি ভোগ করছেন। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি প্রকাশ্যে চলাফেরা নিরাপদ বলে মনে করছেন না। চিঠিতে বাঙালি শরণার্থীদের জন্য ভারত সরকারের নিঃস্বার্থ সহায়তার জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।


মুক্তিযুদ্ধের এই সময় এসে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামকে সমর্থন করায় চীনের বাংলাদেশবিরোধী নীতির সমর্থক এবং মাওলানা ভাসানীর কিছুসংখ্যক চীনপন্থী অনুসারী ভারতের বিরুদ্ধে নানা প্রচার শুরু করে। তারা বলে, বাংলাদেশকে উপনিবেশে পরিণত করাই ভারতের উদ্দেশ্য। এই প্রচারণায় তারা ভাসানীর নাম ব্যবহার করে বলে, মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি রোধ করতে ভারত ভাসানীকে কার্যত গৃহবন্দী করে রেখেছে। এ পটভূমিতে ভাসানী চিঠিটি লেখেন।


দ্য টাইমসকে উদ্ধৃত করে বিবিসি জানায়, চীন পাকিস্তানকে সংযত থাকার পরামর্শ দিয়েছে। চীন বলেছে, কোনো অবস্থাতেই পাকিস্তানের ভারত আক্রমণ করা উচিত নয়; ব্যাপারটি নিরাপত্তা পরিষদে তোলারও এটা উপযুক্ত সময় নয়।

লন্ডনে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম ম্যাকমোহান এবং যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার ডগলাস হোমের আলোচনায় উপমহাদেশের সমস্যাটি বিশদভাবে আলোচিত হয়।


পশ্চিম জার্মানি সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বনে এই দিন এক ভোজসভায় বলেন, পাকিস্তান এবার ভারত আক্রমণ করলে তাসখন্দ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না। ১৯৬৫ সালে অধিকৃত কাশ্মীর এলাকা থেকে পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলেও তাসখন্দ চুক্তি মেনে ভারত পাল্টা ব্যবস্থা নেয়নি।


পশ্চিম জার্মানির ওয়াকিবহাল মহল জানায়, পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দেশ ভারতের আগে বা অব্যবহিত পরেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পারে। ভারতও যথাসময়ে স্বীকৃতি দেবে।


যুক্তরাষ্ট্রের দ্য টাইমস-এর সংবাদদাতা পিটার হ্যাজেলহার্স্টের পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয় নৌবাহিনী সমুদ্রপথে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করায় পরিকল্পনা নিয়েছে।
নারায়ণগঞ্জে অভিযান চালানোর জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলাদের একটি দল ১২ নভেম্বর রাতে একটি কাপড়ের কল এলাকায় অভিযান চালায়। অভিযানে পাকিস্তানিদের সহযোগী চাঁদ মিয়া সরদার নামে একজন নিহত হয়।


৮ নম্বর সেক্টরে এ দিন বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। বড় একটি যুদ্ধ হয় যশোরের চৌগাছা ও মাসলিয়ার মাঝখানে। বয়রা সাবসেক্টরের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও কর্নেল) নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। ভারতের ১ জম্মু-কাশ্মীর রাইফেলস এতে সহায়তা করে। প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা প্রতিরক্ষা থেকে সরে গেলে এলাকাটি পাকিস্তানি দখলমুক্ত হয়।


দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার কৃষ্ণপুর ঘাটে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে পড়ে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।


প্রতাপপুর ঘাটে তৃতীয় যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।


চতুর্থ যুদ্ধ হয় জীবননগরের ধোপাখালী সীমান্তঘাঁটিতে। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে মুক্তিযোদ্ধারা রাতে আক্রমণ করেন। পরদিন সকাল পর্যন্ত চলা তুমুল যুদ্ধের পর পাকিস্তানিরা পালিয়ে যায়।


মেহেরপুরের ধর্মদহে হয় পঞ্চম যুদ্ধ। পাকিস্তানিদের ধর্মদহ অবস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় প্রায় ৫০ জন হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আহত হন কয়েকজন এবং তিনজন বন্দী হন।


চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় ষষ্ঠ যুদ্ধে গেরিলারা পাকিস্তানিদের অবস্থানে হামলা চালায়। পাকিস্তানি বাহিনীর ১৭ জন হতাহত হয়। যুদ্ধে চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং কয়েকজন আহত হন। আলমডাঙ্গায় আরেক স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় পাকিস্তানি বাহিনীর একজন রেঞ্জার, কয়েকজন রাজাকার এবং একজন পুলিশ নিহত হয়।


বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ দিন জানায়, বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলের অদূরে সিটি অব সেন্ট আলবানস নামে যুক্তরাজ্যের একটি মালবাহী জাহাজ গোলার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পশুর নদে ঢোকার মুখে জাহাজটি গোলার মুখে পড়ে। প্রায় ৪০টি আঘাতের চিহ্ন নিয়ে জাহাজটি কলকাতায় ফিরে যায়।


১০ নভেম্বর ওই জাহাজ কলকাতা থেকে চালনা বন্দরের দিকে রওনা হয়ে সেদিনই বাংলাদেশের জলসীমায় ঢোকে। বন্দরের ছয় মাইল দূরে রাত সাড়ে ১২টায় হঠাৎ দুই দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর দুটি গানবোট এসে গোলাবর্ষণ শুরু করে। জাহাজটি গভীর সমুদ্রের দিকে রওনা দিয়ে আত্মরক্ষা করে।


ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এস এইচ এফ জে মানেকশ এদিন রাজস্থান ও পাঞ্জাবের অগ্রবর্তী গোলন্দাজ ঘাঁটিগুলো পরিদর্শন করেন।


পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে এক জনসভায় বলেন, সংসদের শূন্য আসন পূরণের জন্য উপনির্বাচনের পর পূর্ব পাকিস্তান প্রভাবিত সরকার গঠন করার প্রচেষ্টা তিনি মেনে নেবেন না। এ ধরনের সরকার গঠিত হলে ৪০ দিনের মধ্যে সে সরকারের পতন ঘটানো হবে।

 

১২ নভেম্বর ১৯৭১: কুষ্টিয়ায় মুক্তিবাহিনী আলমডাঙ্গা পাকসেনা ঘাঁটি আক্রমণ করে

 

কুষ্টিয়ায় মুক্তিবাহিনী আলমডাঙ্গা পাকসেনা ঘাঁটি আক্রমণ করে। ফাইল ছবি

কুষ্টিয়ায় মুক্তিবাহিনী আলমডাঙ্গা পাকসেনা ঘাঁটি আক্রমণ করে। ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের ১২ নভেম্বর দিনটি ছিল শুক্রবার। এই দিন কুষ্টিয়ায় মুক্তিবাহিনী আলমডাঙ্গা পাকসেনা ঘাঁটি আক্রমণ করে। পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গুলি বিনিময় হয়। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর ১৭ জন সৈন্য নিহত হয়। অপরদিকে দুই জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

অপর এক ঘটনায় আলমডাঙ্গায় মুক্তিযোদ্ধাদের এক সফল অভিযানে পাকবাহিনীর একজন পশ্চিম পাকিস্তানি রেঞ্জার, ১৯ জন রাজাকার ও একজন পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশ নিহত হয়।

সিলেটে মুক্তিবাহিনীর এ্যামবুশ দল আড়িয়াল নামক স্থানে পাকসেনাদের একটি দলকে এ্যামবুশ করে। এই এ্যামবুশে সাত জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর একজন যোদ্ধা আহত হন।

২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী কর্নেল বাজার এলাকায় পাকসেনাদের এ্যামবুশ করে। এই এ্যামবুশে আট জন পাকসেনা নিহত হয়। অন্যদিকে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। অপর দিকে এক ঘটনায় চাইলাশিয়া এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের এ্যামবুশে পাকবাহিনীর সাত জন সৈন্য নিহত হয় ও পাঁচ জন আহত হয়।

৪ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী জুড়ী-গোয়ালবাড়ী এলাকায় পাকবাহিনীর ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এই সংঘর্ষে পাঁচ জন সৈন্য ও একজন রাজাকার নিহত হয়।

১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর এক প্লাটুন যোদ্ধা পাকবাহিনীর একটি টহলদার দলকে এ্যামবুশ করে। এই এ্যামবুশে সাত জন পাকসেনা নিহত হয় ও আহত হয়।

৭ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর দুই কোম্পানী যোদ্ধা ভারতীয় বিএসএফ বাহিনীর সহায়তায় রাজারামপুর পাকসেনা ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে পাকাবাহিনীর একজন অফিসারসহ ১০ জন সৈন্য ও ৬০ জন রাজাকার নিহত হয় এবং ১২ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী হয়। অপরদিকে সাত জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি সম্পর্কে পাকিস্তানিদের বক্তব্য বহির্বিশ্বকে জানানোর উদ্দেশে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ সফর শেষে ফিরে জামায়াতে ইসলামির সেক্রেটারী জেনারেল চৌধুরী রহমত এলাহী জানান, পাকিস্তান আক্রান্ত হলে বিশ্ব পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াবে। 

তিনি আরো বলেন, ইসলামী রাষ্ট্রগুলো পাকিস্তানকে ইসলামের দুর্গ মনে করে।

ফরাশি প্রেসিডেন্ট র্জজ পম্পিদু ও পশ্চিম জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট পাকিস্তানের জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে জরুরি পত্র পাঠান।

চীন সফর শেষে দেশে ফিরে জুলফিকার আলী ভূট্টো বলেন, পাকিস্তান আর এখন একা নয়। যে কোনো ধরনের আক্রমনে চীন পাকিস্তানকে পূর্ণসমর্থন দেবে।