৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২৯ অক্টোবর ১৯৭১ এই দিনে

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধর ২৯ অক্টোবর কলকাতায় সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে আছেন। পাকিস্তান সরকার তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি সামরিক জেলে আটক রেখেছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বৃহৎ শক্তিগুলোকে এ কথা লিখে জানিয়েছেন। ভারত সরকার তাদের কাছ থেকে এ তথ্য পেয়েছে। তিনি বলেন, বৃহৎ শক্তিবর্গসহ কিছু দেশ পাকিস্তানকে শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য চাপ দিচ্ছে।

ডি পি ধর গত তিন দিন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক সেরে এ দিন সন্ধ্যায় দিল্লি রওনা দেন।


ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং দিল্লিতে পররাষ্ট্রসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিকে বলেন, যুদ্ধ পরিস্থিতি হলে সোভিয়েত-ভারত চুক্তির ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা নিতে জরুরি পরামর্শ নেওয়া হবে।


দিল্লিতে এ দিন সরকারি তথ্যে জানানো হয় যে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের শরণার্থীর সংখ্যা ২১ অক্টোবর পর্যন্ত ৯৫ লাখ ৮৭ হাজার ৮৯৭।


বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক শেষে একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া বাংলাদেশ সমস্যার অন্য কোনো সমাধান নেই। মুক্তিবাহিনীকে আরও জোরদার করে তুলতে বৈঠকে একটি প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের কিছু লোক একশ্রেণির বিদেশির সঙ্গে নানা বিষয়ে কথাবার্তা বলায় অনেক ক্ষেত্রে ভুল–বোঝাবুঝি হচ্ছে। কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে ৪৩ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। কমিটির ৪৯ জন সদস্যের মধ্যে ২ জন মৃত। বাকি ৪ জনের অন্যতম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।


কলকাতার বাংলাদেশ হাইকমিশনে এ দিন একটি চুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিবেশক সংস্থা বলাকা পিকচার্স জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্রের ভারতীয় পরিবেশনা স্বত্ব লাভ করে। ভারত সরকার ছবিটির প্রমোদ কর মওকুফ করেছে। এর বিক্রয়লব্ধ অর্থ মুক্তিসংগ্রামে ব্যয় করা হবে। অনুষ্ঠানে জহির রায়হানসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।


ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বোরগেস ২৯ অক্টোবর দেশটির সংসদকে জানান, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এড়াতে এবং শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনে ফ্রান্স প্রভাব বিস্তার করবে। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদু ইয়াহিয়া খানের কাছে এ ব্যাপারে কয়েকটি বার্তা পাঠিয়েছেন।


ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যুক্তরাজ্যের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য এই দিন লন্ডনে আসেন। লন্ডনের দ্য টাইমস পত্রিকায় এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে ইন্দিরার সফরের উল্লেখ করে বলা হয়, তিনি মনে করেন, সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। নিবন্ধে ইন্দিরার প্রতি সমর্থন জানানো হয়।


২ নম্বর সেক্টরে ভোর চারটায় পাকিস্তানি সেনারা শালদার নয়াপুর ও ফুলগাজী থেকে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটিতে প্রচণ্ড কামান আক্রমণ শুরু করে। তারা তিন দিক থেকে আক্রমণ চালায়। প্রায় ৫ ঘণ্টা যুদ্ধের পর তারা পিছু হটে। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।


এই সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার শিমপুরে একটি সড়কে মাইন পেতে রাখে। পাকিস্তানি সেনারা সড়কপথে সেখানে টহল দিতে এলে মাইনটি বিস্ফোরিত হয়ে কয়েকজন হতাহত হয়।


২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা শহরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল দুটি আলাদা স্থানে অভিযান চালায়। একটি দল ডিআইটি (বর্তমানে রাজউক) অ্যাভিনিউতে মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসের কাছে একটি পাকিস্তানি টহল দলের ওপর বোমা ছোড়ে। বোমাটি মর্নিং নিউজ পত্রিকা ভবনের সীমানাদেয়ালের গেটে বিস্ফোরিত হয়। অন্য দলটি খিলগাঁও বাজারে সমবেত শান্তি কমিটির সদস্যদের ওপর হামলা করে। এতে দুজন নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়।


প্রতিরক্ষা বিবেচনায় মৌলভীবাজারের ধলই সীমান্তঘাঁটির পাশে পাত্রখোলা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। স্থানটি দখল করার জন্য বড় একটি পরিকল্পনা করা হয়। অভিযানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় জাঠ ব্যাটালিয়ন মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে। পাত্রখোলা চা–বাগানে অবস্থান নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী এ দিন একের পর এক আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।


মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল পাত্রখোলার দুই মাইল দক্ষিণে কাট-অফ পার্টি হিসেবে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি সেনাদের দুটি দল পাত্রখোলার দিকে এগোতে থাকলে তারা প্রবল বাধা দেয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন নিহত হয়। ৬ জন মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন।


পাকিস্তানি বাহিনীর আরেকটি দল ধলইয়ের প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে পাত্রখোলার দিকে এগিয়ে এলে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ছোট দল ধলই-পাত্রখোলা সড়কের মাঝামাঝি স্থানে অ্যামবুশ করে। সেই ফাঁদে পড়ে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।


৮ সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা এ দিন মেহেরপুরের ষোলটাকা অঞ্চলে হামলা করে বেশ কয়েকজন রাজাকারকে হতাহত করেন। এই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের আরও কয়েকটি দল দর্শনা, কোটচাঁদপুর এবং কামেদবপুরে পাকিস্তানি সেনাকে আক্রমণ করে। এসব যুদ্ধে ১৬ জন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।