২৬ অক্টোবর ১৯৭১ এই দিনে
এদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কানাডার মধ্যকার একটি যুক্ত বিবৃতি প্রকাশিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন ৮ দিনের কানাডা সফর শেষে ২৬ অক্টোবর প্রকাশিত দুই দেশের যুক্ত বিবৃতিতে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বিষয়ের সঙ্গেও বাংলাদেশ প্রসঙ্গও উঠে আসে। দ্বিপক্ষীয় এই বিবৃতিতে বলা হয়, 'বাংলাদেশের অধিবাসীদের অধিকার ও ন্যায়সংগত স্বার্থ এবং শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনে সুযোগ দেওয়ার প্রশ্নটি সামনে রেখে সমস্যার সমাধান করতে হবে। অন্যথায় এই সমস্যার সমাধান হবে না।'
২৬ অক্টোবর মুজিবনগরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের অধিবেশনে সুস্পষ্টভাবে বাংলাদেশ প্রশ্নের সমাধানের লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণায় বলা হয়, 'বাংলাদেশ প্রশ্নের একমাত্র সমাধান হচ্ছে জনগণের পূর্ণ স্বাধীনতা।'
এছাড়া বিশ্বের স্বাধীনতাপ্রিয় ও গণতান্ত্রিক দেশগুলোর কাছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। কার্যনির্বাহী পরিষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য বিশ্বের সব দেশ ও জাতিসংঘকে সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করার আহ্বান জানায়। বিশ্বের জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর জন্য ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশে উপনির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে যে ধৃষ্টতার পরিচয় দিয়েছে তার সমুচিত জবাব দেওয়ার শপথ নিয়ে এই পরিষদ স্পষ্টভাবে জানিয়ে বলে, 'নির্বাচন তো দূরের কথা স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে তথাকথিত পাকিস্তানিদের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বাঙালি জাতি ও আওয়ামী লীগ কিছুতেই সহ্য করবে না। হানাদার বাহিনী যে গণহত্যা, পাশবিক অত্যাচার ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছে পরিষদ বিশ্ব মানবতার কাছে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আবেদন জানান হয়। অন্যদিকে কার্যনির্বাহী পরিষদ বলে, শরণার্থীদের নিজগৃহে ফিরিয়ে নিতে আমরা বদ্ধপরিকর।
ভারতে এদিন
২৬ অক্টোবর আসামের মুখ্যমন্ত্রী মহেন্দ্র চৌধুরী রাজ্যের বিধানসভার অধিবেশনে বলেন, 'পাকিস্তান আরও বেশি জোরালো অবস্থান সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু আমাদেরও সাহস ও আস্থার সঙ্গে পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তান যে যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখাচ্ছে আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনী তার মোকাবিলা করতে প্রস্তুত আছে।'
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ইউরোপ সফরের অংশ হিসেবে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস থেকে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় এসে পৌঁছান।
এর আগে ব্রাসেলসে এক টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'ভারতে আগত শরণার্থীরা হয়তো ভারতের ভূখণ্ডেই মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের ট্রেনিং দিচ্ছে। এই বিষয়ে ভারতের কিছুই করার নেই। ভারত কিছু করবেও না। ভারতের বিরাট খোলা সীমানা রয়েছে। এই খোলা সীমানা থাকার জন্য লক্ষ লক্ষ শরণার্থী সীমানা পেরিয়ে সহজেই ভারতে চলে আসতে পেরেছে। বাংলাদেশের জনগণ তাদের সমস্যা নিয়ে তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবেন।'
২৬ অক্টোবর মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের কাছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাণী পৌঁছে দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত।
এদিন নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আলফ্রে কাস্তোলে ও অঁদ্রে লফের আহ্বানে ফ্রান্সের ৮৪ বিশিষ্ট ব্যক্তি পাকিস্তানকে দেয়া ফ্রান্সের সব সামরিক সাহায্য ও অন্যান্য সহায়তা বন্ধের দাবি জানান।
১৯৭১ সালের এই দিনে লন্ডনে বাংলাদেশ মিশন থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে মিসরের কায়রোর পাকিস্তান দূতাবাস থেকে সদ্য পদত্যাগকারী বাঙালি কূটনীতিক ফজলুল করিম বলেন, বাংলাদেশ এখন স্বাধীন একটি দেশ। হানাদারদের পৈশাচিকতার শিকার হয়ে লাখ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। পুরো বাংলাদেশকে আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে হানাদারেরা। এই অবস্থায় আমি কোনোভাবেই হানাদারদের পক্ষাবলম্বন করতে পারি না। পাকিস্তান সরকার যে ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তাতে একটি দেশের মানুষের জীবন আজ বিপর্যস্ত।'
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
২৬ অক্টোবর ফেনীর ফুলগাজীতে ভোর ৫টার দিকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের একটি প্লাটুন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর টহলদারী দলের উপর অ্যামবুশ করে। এসময় হানাদার বাহিনীর ৯ জন সেনা নিহত হয় এবং ৬ জন আহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা কুটি মিয়া শহীদ হন। একইদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি শক্তিশালী দল মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ঘাঁটির কাছাকাছি এসে মাইন পোঁতার চেষ্টা করলে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তাদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এসময় ১২ হানাদার সেনা নিহত হয় এবং ৩০ আহত হয়।
২৬ অক্টোবর খুলনার কয়রায় এক অপারেশনে নৌ কমান্ডোরা হানাদার বাহিনীর একটি জাহাজ, একটি বার্জ ডুবিয়ে দেয়।
এদিন জামালপুরের বক্সিগঞ্জের ধানুয়া কামালপুরে সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরের নির্দেশে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার বেলাল একটি দল নিয়ে কামালপুরের পেছনে গেদ্দা ও উঠানপুকুরে মাইন পাতে। এসময় মাইন বিস্ফোরণে ও মুক্তিবাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণে হানাদার বাহিনীর ৪৬ সৈন্য নিহত হয়।
২৬ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় মুক্তিবাহিনি ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এছাড়া মুক্তিবাহিনীর একটি দল কসবার শালদানদীতে হানাদার উপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এসময় বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়। একই দিন কায়েমপুর ইউনিয়নে মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদার বাহিনীর উপর হামলা চালায়। এই হামলায় হানাদার বাহিনীর ৩ সেনা আহত হয়। এদিন বিকেলে মুক্তিবাহিনীর একটি দল কসবার নয়নপুর বাজারে হানাদার বাহিনীর উপর হামলা চালায়। এসময় দুই হানাদার সেনা নিহত হয়।
২৬ অক্টোবর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের মিয়াবাজারে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এই হামলায় হানাদার বাহিনীর ১ সৈন্য নিহত হয় এবং ৩ জন আহত হয়।
এদিন যশোরের ঝিকরগাছায় মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে ১৫ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার একটি দল হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে দুর্ধর্ষ আক্রমণ গড়ে তোলে। এসময় হানাদার বাহিনী প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়। গেরিলাদের এই হামলায় হানাদার বাহিনীর ১০ হানাদার নিহত হয়। বাকিরা পালিয়ে যায়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর এক গেরিলা আহত হন।