৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২৫ অক্টোবর ১৯৭১ এই দিনে

বেলজিয়ামের পক্ষ থেকে সেখানে সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ২৫ অক্টোবর জানানো হয়, সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কোনো সামরিক সরঞ্জাম পাকিস্তানকে সরবরাহ করা হয়নি। ন্যাটোর উদ্বৃত্ত অস্ত্রও পাকিস্তানে পাঠানো হয়নি। বাংলাদেশ ও ভারতের জনসাধারণের প্রতি বেলজিয়ামের সহানুভূতি রয়েছে। ব্রাসেলসে বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী গ্যাসটন ইসকেনসের সঙ্গে ইন্দিরার আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গই প্রাধান্য পায়।


বেলজিয়াম সরকার ভারতের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয় যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানই 
করতে হবে এবং শরণার্থীদের দেশে ফেরার নিরাপত্তা দিতে হবে। দুই প্রধানমন্ত্রীর আলাপের পর বাংলাদেশের ব্যাপারে বেলজিয়ামের মনোভাব আগের তুলনায় অনেক অনুকূল হয়।


ইন্দিরা গান্ধী এই দিন ব্রাসেলসে রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস ভবনে বক্তৃতায় বলেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক অভিযান চালাচ্ছে। এটি নিছক গৃহযুদ্ধ নয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোট দেওয়ার কারণে নিরীহ জনগণকে নির্বিচার হত্যা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সমস্যার গভীরে আছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া এ সমস্যা মিটবে না। সমাধান ফলপ্রসূ হতে হলে সেটি বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গ্রহণযোগ্য হতে হবে।


মিসরের রাজধানী কায়রোয় পাকিস্তানি দূতাবাসের বাঙালি প্রধান ফজলুল করিম ২৫ অক্টোবর পদত্যাগ করেন। তিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে রওনা দেন। লন্ডনে পৌঁছে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য জানাবেন।


পাকিস্তানি পক্ষত্যাগী বাঙালি কূটনীতিক হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এই দিন দিল্লির বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। দিল্লির বাংলাদেশ মিশনের কে এম শেহাবুদ্দিন ও আমজাদুল হক তাঁকে সহায়তা করবেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনে উপদেষ্টা ছিলেন। অক্টোবর মাসের প্রথমার্ধে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করেন।


ফ্রান্সের বাংলাদেশ সহায়ক কমিটি এ দিন একটি ইশতেহার প্রকাশ করে। ইশতেহারে বিগত নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণের রায়কে মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানানো হয়। ইশতেহারে চারটি প্রস্তাব রাখা হয়: ১. জনগণের জন্য আন্তর্জাতিক ত্রাণ সাহায্য পাঠানো, ২. রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা, ৩. পাকিস্তানকে অস্ত্র দেওয়া বন্ধ করা, এবং ৪. পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করা।


ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম দিল্লিতে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে বক্তৃতাকালে বলেন, ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এমন কোনো ব্যবস্থা নেবে না, যাকে আক্রমণাত্মক কাজ বলা যেতে পারে। তবে ভারতের বিরুদ্ধে যেকোনো আক্রমণ পূর্ণ শক্তি দিয়ে প্রতিহত করা হবে।


ভারত সফররত সোভিয়েত ইউনিয়নের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফিরুবিন দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের সঙ্গে ভারত উপমহাদেশের উত্তেজনা নিয়ে আলোচনা করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গেও তিনি এ নিয়ে আলোচনা করেন।


২ নম্বর সেক্টরের একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা নারায়ণগঞ্জ সদর পোস্ট অফিসের সামনে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলের ওপর বোমা নিক্ষেপ করেন। গেরিলাদের ছোড়া বোমা বিস্ফোরণে রাজাকারসহ বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। হতাহতদের মধ্যে সাধারণ নাগরিকও ছিলেন।


এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কাজলায় একটি কারখানায় অবস্থানরত রাজাকারদের লক্ষ্য করে বোমা ছোড়েন। বোমা বিস্ফোরণে কয়েকজন রাজাকার আহত হয়।


৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে সাবদালপুর ও আনসারবাড়ী স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে মাইন পুঁতে পাকিস্তানি বাহিনীর সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকারবাহী একটি ট্রেন অ্যামবুশ করেন। পাকিস্তানি বাহিনী প্রায়ই ওই রেলপথে চলাচল করত। মুক্তিযোদ্ধারা আগের দিন গুপ্তচর মারফত সংবাদ পেয়েছিলেন, ওই দিন ট্রেনযোগে পাকিস্তানিদের একটি বহর যাবে। খবর পেয়ে তাঁরা দুই স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে মাইন পুঁতে রাখেন। ট্রেনটি মাইনের ওপর আসামাত্র বিস্ফোরণ ঘটে এবং তিনটি বগি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকার হতাহত হয়।


১১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল জামালপুরের বকশীগঞ্জের অন্তর্গত কামালপুর সীমান্ত ফাঁড়ির কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করেন।

২৫ অক্টোবর ১৯৭১: ফুলবাড়িয়া থানায় মুক্তিবাহিনীরা আক্রমণে ৩০ জন রাজাকার নিহত হয়

 
ফুলবাড়িয়া থানায় মুক্তিবাহিনীরা আক্রমণে ৩০ জন রাজাকার নিহত ও ২৫ জন আহত হয়। ফাইল ছবি

ফুলবাড়িয়া থানায় মুক্তিবাহিনীরা আক্রমণে ৩০ জন রাজাকার নিহত ও ২৫ জন আহত হয়। ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের ২৫ অক্টোবর দিনটি ছিল সোমবার। এই দিন ফুলবাড়িয়া থানায় মুক্তিবাহিনীর একদল যোদ্ধা কালীগঞ্জ বাজারে অবস্থানরত রাজাকারদের ওপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ৩০ জন রাজাকার নিহত ও ২৫ জন আহত হয়।

ময়মনসিংহে মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর কমলপুর সীমান্ত ফাঁড়ির ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমান অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে।

২নম্বর সেক্টরে পাকহানাদার বাহিনীর এফ-৮৬ জঙ্গী বিমান মুক্তিবাহিনীর মন্দভাগ, মঙ্গলপুর ও শ্রীপুরস্থ অবস্থানগুলোর ওপর প্রবলভাবে হামলা চালায়। সেই সঙ্গে গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় পাকসৈন্যরাও মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। 

পাকসেনাদের এই সম্মিলিত আক্রমণকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিহত করে। প্রায় তিনঘন্টা স্থায়ী এই সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ৫৮ জন সৈন্য হতাহত হয়। মুক্তিবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে পাকসেনাদের আক্রমণ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বাধ্য হয়ে পিছু হটে। এই যুদ্ধে ২ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৯ জন আহত হন।

সিলেটে মুক্তিবাহিনীর একদল যোদ্ধা পাকসেনাদের শাহবাজপুর ঘাঁটির ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে তিন জন রাজাকার নিহত ও আট জন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অক্ষত অবস্থায় নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে আসে।
৫ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর এক প্লাটুন যোদ্ধা সারিগোয়াইন রাস্তার ১ নম্বর সেতুতে অবস্থানরত পাকবাহিনীর ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। এতে পাঁচ জন রাজাকার নিহত হয় এবং অন্যান্যরা একটি ৩০৩ রাইফেল ও গোলাবারুদ ফেলে পালিয়ে যায়।

নেপালে পাকিস্তানি দূতাবাসের কুটনীতিক মোস্তাফিজুর রহমান স্বপক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন।

কুষ্টিয়া ও দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক যথাক্রমে মোঃ শামসুল হক ও ফারাশউদ্দিন আহম্মদ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করায় পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক কর্তৃক বরখাস্ত হন।

টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সামনের দিনে যুদ্ধ আরো তীব্র হবে। ৮০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ভারতীয় সীমান্তসহ অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। পাশাপিাশি ৬০ হাজার মুক্তিবাহিনী ও গেরিলাদের দলটিও তা প্রতিরোধের অপেক্ষায় আছে।