২৪ অক্টোবর ১৯৭১ এই দিনে
১৯৭১ সালের ২৪ অক্টোবর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক সরকারি সফরে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের উদ্দেশ্যে দিল্লি ছাড়েন। যাত্রাপথে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে যাত্রা বিরতির সময় লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সায়েব সালাম ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বিমানবন্দরে দেখা করেন। এসময় তাদের মধ্যে আঞ্চলিক শান্তি, উপমহাদেশের অবস্থা, শরণার্থীদের নানা বিষয়ে খোঁজ নেন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়েও আলোচনা হয়। পরে সাংবাদিকদের দেয়া এক সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে ইন্দিরা গান্ধী নানা বিষয় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, 'পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারত হস্তক্ষেপ করছে বলে যে অভিযোগ পাকিস্তান করেছে তা হাস্যকর ও অসঙ্গত।'
জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আগের দিন দেয়া ইয়াহিয়া খানের বক্তব্য সম্পর্কে সাংবাদিকেরা তাকে জিজ্ঞাসা করলে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'যে কেউ সংবাদপত্রের সংবাদ পড়ে অনুধাবন করলেই বুঝতে পারবেন আমরা ঠিক। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের অভিযোগ মিথ্যাচার।'
অন্য আরেকটি প্রশ্নের জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'ভারত পাকিস্তানের মধ্যকার কোনো নতুন সমস্যা নিয়ে আমাদের জাতিসংঘে যাওয়ার ইচ্ছে নেই।'
এদিন বিকেলে ইন্দিরা গান্ধী বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে পৌঁছান। এই সফরে বেলজিয়াম ছাড়াও যুক্তরাজ্য, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানি সফর করবেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। এই সফরে শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উপযুক্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে আনার জন্য বিশ্বমহলে চেষ্টা চালাবেন ইন্দিরা গান্ধী।
ঢাকায় এদিন
২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের সদস্য শাহ আজিজুর রহমান বলেন, 'দেশদ্রোহীদের স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন অবাস্তব। পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি বলবৎ থাকবে।'
তিনি একই সঙ্গে তার বক্তব্যে জাতিসংঘকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানোর আহবান জানান। তিনি বলেন, 'জাতিসংঘ হবে সকল দেশের ঐক্য ও সংহতির প্রতীক। কেউ কারো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।'
ভারতে এদিন
২৪ অক্টোবর কলকাতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে বৈঠক করেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ কমিটির চেয়ারম্যান ডিপি ধর। এসময় বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী মনসুর আলী, ত্রাণমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান। এসময় তাদের মধ্যে শরণার্থী বিষয়ে ভারতের আশানুরূপ সাড়া ও ইন্দিরা গান্ধীর ইউরোপ সফর নিয়ে আলোচনা হয়।
২৪ অক্টোবর দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং জাতিসংঘ দিবস উপলক্ষে দেয়া এক বক্তৃতায় বলেন, 'একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হলো পূর্ব বাংলার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সাথে একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে। শুধুমাত্র তখনই শরণার্থীরা দেশে ফিরে যেতে শুরু করবে। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই সমস্যার উপলব্ধি করতে হবে। এবং একটি সম্মিলিত পদ্ধতিতে কাজ করে এটি সমাধান করতে হবে। আমরা আশা করি খুব শিগগির শরণার্থী সমস্যার সমাধান হবে এবং শরণার্থীরা স্বসম্মানে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করবেন। এই জন্য পাকিস্তানের উপর রাজনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ পাকিস্তান অযথা আক্রমণাত্মকভাবে ভারতের সীমান্তে সৈন্য জড়ো করেছে এবং মূল ঘটনা অন্যদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। শুধুমাত্র একটি সমাধান হলেই বিষয়টির নিষ্পত্তি অনেকাংশেই সম্ভব। আর তা হলো পূর্ব বাংলার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।'
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
২৪ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় সফরে মধ্যপ্রাচ্য সফরের অংশ হিসেবে দুই দিনের সফরে মিশরের রাজধানী কায়রোতে এসে পৌঁছান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূত পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো। এই সফর শেষে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় যাবেন ভুট্টো।
২৪ অক্টোবর ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয় 'সামনের দিনে পূর্ব বাংলায় যুদ্ধ আরো তীব্র হবে। এখন প্রায় ৮০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ভারতীয় সীমান্তসহ অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে ৬০ হাজার মুক্তিবাহিনী ও গেরিলাদের দলও এখনো তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।'
২৪ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র 'প্রাভদা' পত্রিকায় একটি বিশেষ সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত এই নিবন্ধে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরা হয় এবং একই সঙ্গে বলা হয়, পাকিস্তানি প্রশাসন পূর্ব বাংলাকে বিরানভূমিতে পরিণত করার লক্ষ্যে নেমেছে। পূর্ব বাংলা এখন প্রায় হিন্দুশূন্য হয়ে পড়েছে। যেখানে সকল জাতি ও গোত্রের সহাবস্থান ছিল সেখানে এখন নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে বিভেদ তৈরির চেষ্টা চালানো হয়েছে।'
২৪ অক্টোবর ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, 'বর্তমানে ৯০ লাখ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। ভারত শরণার্থীদের চাপে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে আছে। পাকিস্তান প্রতিনিয়ত ভারতের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ অবস্থায় বিরাজমান। শরণার্থী প্রত্যাবর্তনে ভারত নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করেছে। যদিও ভারত এখন নিজেদের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। যদি এই অবস্থা চলমান থাকে তবে হয়তো ভারতকে বাধ্য হয়েই যুদ্ধে জড়াতে হবে। তবে আশার কথা হলো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জনমত তৈরির লক্ষ্যে, শরণার্থী বিষয়ে নিজেদের অবস্থান জানাতে ইউরোপের দেশগুলো সফর শুরু করছেন।'
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
২৪ অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে পাঠানো এক প্রেস নোটে বলা হয় 'দাউদকান্দি রোডে মুক্তিবাহিনীর পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে হানাদার সামরিক যান বিধ্বস্ত হয় এবং ৬ জন হানাদার মিলিশিয়া নিহত হয়েছে।'
এদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে রাত সাড়ে ৮টার দিকে বিনা উসকানিতে ত্রিপুরার আগরতলা শহরে গোলাবর্ষণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। প্রায় ১০ মিনিট ব্যাপী আগরতলা শহরে হানাদারদের গোলাবর্ষণে নিরীহ ৫ জন নগরবাসী নিহত হন এবং ২০ জন আহত হন।
২৪ অক্টোবর ময়মনসিংহের মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কমলপুর বিওপির উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে বিপুল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর সামনে টিকতে না পেরে হানাদার বাহিনী বিওপি ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ৩ সৈন্য নিহত হয়।
এদিন অক্টোবর ময়মনসিংহের ভালুকার বিরুলিয়া গ্রামে রাজাকারেরা লুটপাট ও গ্রামে আগুন লাগাতে শুরু করলে মুক্তিবাহিনীর একটি দল রাজাকারদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনীর হামলায় ৫ জন রাজাকার নিহত হয়।
২৪ অক্টোবর ৮ নম্বর সেক্টরের সাদীপুরে হানাদার বাহিনীর একটি দল মুক্তিবাহিনীর সাদিপুরের অবস্থানের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনীও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এসময় মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকটি দল পার্শ্ববর্তী বেশ কয়েকটি গ্রাম থেকে এসে হানাদারদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় মুক্তিবাহিনীর। এসময় হানাদার বাহিনীর ৫ সৈন্য নিহত হয় ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং বেশ কয়েকজন আহত হন।
২৪ অক্টোবর চুয়াডাঙ্গার তীতুদহ গ্রামে মুক্তিবাহিনীর একটি গোপন ঘাঁটিতে অতর্কিত হামলা চালায় হানাদার বাহিনীর একটি দল ও সংঘবদ্ধ রাজাকারেরা। এসময় মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ গড়ে তুললে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে হানাদার এক সৈন্য ও বেশ কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়।
২৪ অক্টোবর ১৯৭১: মুক্তিবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে দুই জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৯ জন আহত হন
মুক্তিবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে দুই জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৯ জন আহত হন। ফাইল ছবি
১৯৭১ সালের ২৪ অক্টোবর দিনটি ছিল রবিবার। এই দিন ময়মনসিংহে মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর কমলপুর সীমান্ত ফাঁড়ির ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমান অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে।
২ নম্বর সেক্টরে পাকহানাদার বাহিনীর এফ-৮৬ জঙ্গী বিমান মুক্তিবাহিনীর মন্দভাগ, মঙ্গলপুর ও শ্রীপুরস্থ অবস্থানগুলোর ওপর প্রবলভাবে হামলা চালায়। সেই সঙ্গে গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় পাকসৈন্যরাও মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। পাকসেনাদের এই সম্মিলিত আক্রমণকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিহত করে। প্রায় তিনঘন্টা স্থায়ী এই সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ৫৮ জন সৈন্য হতাহত হয়। মুক্তিবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে পাকসেনাদের আক্রমণ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বাধ্য হয়ে পিছু হটে। এই যুদ্ধে দুই জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৯ জন আহত হন।
সিলেটে মুক্তিবাহিনীর একদল যোদ্ধা পাকসেনাদের শাহবাজপুর ঘাঁটির ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে তিন জন রাজাকার নিহত ও ৮ জন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অক্ষত অবস্থায় নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে আসে।
৫ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর এক প্লাটুন যোদ্ধা সারিগোয়াইন রাস্তার ১ নম্বর সেতুতে অবস্থানরত পাকবাহিনীর ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। এতে পাঁচ জন রাজাকার নিহত হয় এবং অন্যান্যরা ১টি ৩০৩ রাইফেল ও গোলাবারুদ ফেলে পালিয়ে যায়। ফুলবাড়িয়া থানায় মুক্তিবাহিনীর একদল যোদ্ধা কালীগঞ্জ বাজারে অবস্থানরত রাজাকারদের ওপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ৩০ জন রাজাকার নিহত ও ২৫ জন আহত হয়। নেপালে পাকিস্তানি দূতাবাসের কুটনীতিক মোস্তাফিজুর রহমান স্বপক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন।
কুষ্টিয়া ও দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক যথাক্রমে মোঃ শামসুল হক ও ফারাশউদ্দিন আহম্মদ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করায় পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক কর্তৃক বরখাস্ত হন। টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সামনের দিনে যুদ্ধ আরো তীব্র হবে। ৮০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ভারতীয় সীমান্তসহ অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। পাশাপাশি ৬০ হাজার মুক্তিবাহিনী ও গেরিলাদের দলটিও তা প্রতিরোধের অপেক্ষায় আছে।