১৯ অক্টোবর ১৯৭১ এই দিনে
১৯৭১ সালের ১৯ অক্টোবর সকাল ১১টার দিকে মতিঝিলের হাবিব ব্যাংক ও ইপিআইডিসি ভবনের সামনে ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা দুর্ধর্ষ এক অপারেশন চালায়। গাড়িবোমা বিস্ফোরণে এদিন ৭ জন নিহত ও ১২ জন আহত হয়। একই সঙ্গে ৯টি গাড়ি বিধ্বস্ত হয়। এর আগে ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা মাহবুব আহমদ শহীদ সকাল সাড়ে ১০টায় টাইমারযুক্ত বিস্ফোরকসহ একটি গাড়ি হাবিব ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে রেখে ৩০ মিনিটব্যাপী বোমার টাইমার রেখে সরে যান। সময়ের প্রায় তিন মিনিট আগে এই গাড়িটি বিস্ফোরিত হয়। এটিই ছিল প্রথম কোনো গাড়িবোমা বিস্ফোরণ।
১৯ অক্টোবর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সদ্য কমিশন পাওয়া সেনাবাহিনীর অফিসারদের উদ্দেশ্যে বলেন, 'ইয়াহিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ প্রশ্নে কোনো প্রকার মীমাংসায় আমরা আসতে পারবো না। একজন বাংলাদেশিও যদি জীবিত থাকে তবেও মুক্তিযুদ্ধ চলবে। বাংলাদেশের জনগণই মুক্তিযুদ্ধ করছে। আমরাই আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবো।'
ভারতে এদিন
১৯ অক্টোবর দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভারতের সঙ্গে আলোচনার জন্য বারবার ধর্ণা করছেন। আমরা স্পষ্টতই বলেছি ভারতের সঙ্গে আলোচনা করে কখনোই বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান হবে না। যদি তারা সত্যিই আলোচনায় আসতে চায় তবে বাংলাদেশের সঙ্গেই আলোচনা হতে পারে। ভারতের এখানে কোনো কিছুর ভূমিকা নেই। অথচ ভারত কিন্তু এতেও ৯০ লাখের বেশি শরণার্থীর বোঝা বহন করছে। মুক্তিবাহিনীর কাছে হয়তো আধুনিক সমরাস্ত্র নেই, কিন্তু তাদের আছে দেশপ্রেম, তাদের আছে নিজের মাতৃভূমির জন্য প্রাণ উৎসর্গের মানসিকতা। এটিই তাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ।'
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
১৯ অক্টোবর বিবিসিতে প্রচারিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'জাতিসংঘ মহাসচিব উ' থান্ট ভারত উপমহাদেশের অবস্থা নিয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক মীমাংসা ব্যতিত পূর্ব পাকিস্তানের মৌলিক সমস্যা সমাধান হবে না। এসময় তিনি বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্য প্রদানের আহ্বান জানান।'
১৯ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামীর আমীর মওলানা আবুল আ'লা মওদুদী এক বিবৃতিতে বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানে দুষ্কৃতকারী ও দেশদ্রোহীদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নিরীহ সাধারণ মানুষ। আমি তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে বিত্তবানদের প্রতি আহবান জানাই। এই মুহূর্তে তাদের ভীষণ সাহায্যের প্রয়োজন।'
১৯ অক্টোবর এএফপিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী বলেন, 'মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান গেরিলা আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা নাজেহাল হয়ে পড়েছে। গত জুন-জুলাইয়ের তুলনায় এখন নাশকতার ঘটনা অনেক বেড়েছে। এসব কারণে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। প্রথম দিকে গেরিলা আক্রমণ সীমাবদ্ধ ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র, সীমান্তবর্তী অঞ্চল ও চা-বাগানগুলোতে। এরপর পাকিস্তানি সেনারা নিরাপত্তা জোরদার করলে তারা ব্যক্তিগত হামলায় নামে এবং পাটের সরবরাহে আক্রমণ চালায়। উত্তরের তুলনায় দক্ষিণের জেলাগুলোতে গেরিলা নাশকতার পরিমাণ বেশি।'
দেশব্যাপী এদিন
১৯ অক্টোবর পাবনায় পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল নিয়াজী রাজাকার ট্রেনিং সেন্টার পরিদর্শন করেন। একই সঙ্গে তিনি প্রশিক্ষণরত রাজাকারদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
এদিন অক্টোবর পাকিস্তান সরকার এক বিজ্ঞপ্তিতে বলে, 'পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল এ রহিম ভারতীয় বিমান বাহিনী প্রধানের কাছে ভারতীয় বিমান হামলার অভিযোগ এনে প্রতিবাদ করেছেন। প্রতিবাদ লিপিতে তিনি হুমকি দিয়ে জানিয়েছেন, পাকিস্তানের উপর হামলা হলে আমরাও বসে থাকব না। পাকিস্তান পাল্টা আক্রমণ করতে প্রস্তুত।'
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
১৯ অক্টোবর কুমিল্লায় লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বাতিসা ও গোবিন্দমানিক্যের দিঘি অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। এসময় গোবিন্দমানিক্যের দিঘির পাশে হানাদার বাহিনীর দুটি বাঙ্কার ধ্বংস হয় এবং ৬ হানাদার সেনা নিহত হয়। পাশাপাশি মুক্তিবাহিনী হানাদারদের বাতিসা ক্যাম্পও গুঁড়িয়ে দেয়। প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ২০ সৈন্য নিহত হয় এবং ১২ সৈন্য আহত হয়।
১৯ অক্টোবর সুনামগঞ্জের নিকলীতে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে হানাদার সেনারা নিকলী ছেড়ে সুনামগঞ্জের দিকে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। যুদ্ধ শেষে হানাদার বাহিনী ২৫টি ৩০৩ রাইফেল ও প্রচুর গোলাবারুদ হানাদার বাহিনীর দখলে আসে।
১৯ অক্টোবর ২ নম্বর সেক্টরের কামালপুরে মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত হামলায় ৪ হানাদার সেনা নিহত হয়।
এদিন, ২ নম্বর সেক্টরের মালোচিন বাজারে মুক্তিবাহিনীর একটি দল অবস্থানরত হানাদার পুলিশের একটি দলকে আক্রমণ করে। এই হামলায় ১৯ জন হানাদার নিহত ও ৩ জন আহত হয়।
১৯ অক্টোবর সিলেটের পাল্লাথাল চা বাগানে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে ২ হানাদার সেনা নিহত হয়।
১৯ অক্টোবর চট্টগ্রামে মেজর হাফিজউদ্দিনের নেতৃত্বে ব্রাভো কোম্পানি চম্পারায় চা ফ্যাক্টরির উপর রেইড করে ধ্বংস করে দেয়। এদিন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আনিসুর রহমান ও সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ওয়াকার হাসান নতুন কমিশনপ্রাপ্তির পর জেড ফোর্সের প্রথম ব্যাটালিয়নে যোগ দেন।
১৯ অক্টোবর ৮ নম্বর সেক্টরের গোজাডাঙ্গা সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মোহাম্মদপুর অবস্থানের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এই হামলায় হানাদার বাহিনীর এক মেজরসহ ৬ সৈন্য নিহত হয়।
১৯ অক্টোবর ১৯৭১: ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে
ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ছবি: সংগৃহীত
১৯৭১ সালের ১৯ অক্টোবর দিনটি ছিল মঙ্গলবার। এই দিন হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৫০ জন যোদ্ধার একটি দল সুনামগঞ্জ মহকুমার নিকলি থানায় পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদেও তীব্র আক্রমণের মুখে পাকসেনারা নিকলি ছেড়ে সুনামগঞ্জ পালিয়ে যায়।
এই যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের কাছ থেকে ২৫টি ৩০৩ রাইফেল ও প্রচুর গোলাবারুদ দখল করে। ২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী কামালপুরে অবস্থানরত পাকসেনাদের বিরুদ্ধে দু:সাহসিক অভিযান চালায়। এই অভিযানে পাকবাহিনীর ৪ জন সৈন্য নিহত হয়।
সিলেটে ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে ‘জেড’ ফোর্সে ও ‘বি’ কোম্পানী পাকসেনাদের চম্পারান চা ফ্যাক্টরী ঘাঁটি আক্রমন করে। এই অভিযানে পাকসেনাদের চম্পারান চা ফ্যাক্টরী ঘাঁটি ধ্বংস হয়। ১১ টায় ঢাকার মতিঝিলস্থ ইপিআইডিসি ভবনের সামনে টাইম বোমা বিস্ফোরণে ৭ জন নিহত, ১২ জন আহত ও ৯টি গাড়ী বিধ্বস্ত হয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লীতে বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ভারত যুদ্ধ এড়িয়ে যাবার জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, মূল সমস্যা বিদ্যমান ইসলামাবাদের সামরিক শাসকবর্গ ও বাংলাদেশের জনগনের মধ্যে- যার পরিণতি ভোগ করছে ভারত।
রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, আমরা ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ চাই না। তবে ভারত যদি বাঙালি গেরিলাদের পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ ঘটানোর কাজ অব্যাহত রাখে এবং আক্রমন কওে তাহলে আমরা তার প্রতিশোধ নেব। আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের হস্তক্ষেপ আমরা আর সহ্য করতে রাজি নই।
লে: জেনারেল নিয়াজী পাবনায় রাজাকার ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণরত রাজাকারদের পরিদর্শন করেন। তিনি রাজাকারদের উদ্দেশে বলেন, ‘মানুষের মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু রাজাকাররা যদি শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে, তবে তারা নি:সন্দেহে আল্লাহর রহমত পাবে।’
সরকারী ঘোষনায় জানা যায়, পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল এ. রহিম ভারতীয় বিমান বাহিনী প্রধানের কাছে ভারতীয় বিমান হামলার অভিযোগ এনে প্রতিবাদ করেছেন, তিনি হুমকি দেন এরপর আমরাও পাল্টা আক্রমণ করবো।
জামায়াতে ইসলামীর আমীর মওলানা মওদুদী এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানে দুস্কৃতকারীদের (মুক্তিযোদ্ধা) হাতে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করার জন্যে বিত্তশালীদের প্রতি আহ্বান জানান।