৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

১৮ অক্টোবর ১৯৭১ এই দিনে

এদিন দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে বাংলাদেশে সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। পাকিস্তানি সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীতে কর্মরত পূর্ব বাংলার প্রায় ৫০ হাজার সৈনিক চাকরি ছেড়ে মাতৃভূমির পক্ষে লড়াই করতে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছে। এছাড়া আরও ১ লাখ যুবকসহ মোট দেড় লাখের বেশি মুক্তিযোদ্ধা রণাঙ্গনে তাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধে জড়িয়েছে বলে পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন যে অভিযোগ করেছে তা নিতান্তই হাস্যকর।'

ঢাকায় এদিন

১৮ অক্টোবর হলি ফ্যামিলি হাসপাতালকে রেডক্রসের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রেডক্রস এখানে তাদের একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল স্থাপন করবে। এদিন রেডক্রসের কাছে হাসপাতাল হস্তান্তর অনুষ্ঠানে গভর্নর ডা. এ এম মালিক তার বক্তব্যে বলেন, 'আমরা পাকিস্তানের জন্য সবসময়ই ঐক্যবদ্ধ থাকবো।'

পাকিস্তানে এদিন

১৮ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এক বিবৃতিতে বলেন, 'পাকিস্তান পিপলস পার্টি জোট গঠনের জন্য যে কোনো দলের সঙ্গে আলোচনা করতে প্রস্তুত আছে।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

১৮ অক্টোবর ফরাসি সংবাদপত্র 'লা মঁদ' এ পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত এই সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান বলেন, 'পাকিস্তানের জনগণ এখন আওয়ামী লীগ আর শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে নেই। তিনি বা তার দল দুটোই এখন দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত। শিগগির তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হবে। একজন চিহ্নিত দেশদ্রোহীর সঙ্গে কোনোরূপ আলচনায় আমরা বসতে পারি না।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

১৮ অক্টোবর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার সুবেদার ইসহাকের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল শামসুন্নাহার হাই স্কুলে অবস্থানরত রাজাকার ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা চালায়। এই হামলায় বেশ কয়েকজন রাজাকার হতাহত হয় এবং রাজাকারদের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ৫টি রাইফেল উদ্ধার করেন। একই দিন নোয়াখালীর দালাল বাজারে নায়েক সুবেদার ওয়ালীউল্লাহর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে। এসময় কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়, বাকিরা পালিয়ে যায়। এদিন নোয়াখালীর মীরগঞ্জে সুবেদার ওয়ালীউল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে ৩৭ রাজাকার ও ২৭ জন হানাদার পুলিশ।

১৮ অক্টোবর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বাতিসায় সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার দিকে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল মর্টার এবং রিকয়েললেস রাইফেল সহযোগে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বাতিসা ঘাঁটির উপর দুর্ধর্ষ আক্রমণ গড়ে তুলে। এসময় দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। প্রায় দেড় ঘণ্টা ব্যাপী চলা দুই পক্ষের মধ্যে এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ৬ সৈন্য নিহত সহ মোট ২০ হানাদার হতাহত হয়। এদিকে বাতিসায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের হামলার কথা শুনে হানাদার বাহিনীর একটি দল হামলার শিকার দলের সঙ্গে যোগ দিতে কয়েকটি গাড়িতে করে আসছিল। পূর্বেই খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দল সেই পথে মাইন পেতে রেখেছিল। হানাদার বাহিনী সেই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথেই মাইন বিস্ফোরণে হানাদার বাহিনীর একটি জিপ ও একটি ট্রাক উড়ে যায়। এসময় গাড়িতে থাকা ১৮ হানাদার সৈন্য নিহত হয়। জিপে থাকা ২ হানাদার অফিসারসহ মোট পাঁচ জন আহত হয়।

১৮ অক্টোবর সুনামগঞ্জে লেফটেন্যান্ট তাহেরউদ্দিন আখঞ্জির নেতৃত্বে দুই কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা ২৫টি নৌকায় করে ভোলাগঞ্জ সাব-সেক্টর থেকে গৌরীনগর গ্রামে যাওয়ার পথে গৌরীনগরের কাছাকাছি এলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নদীর তীর থেকে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনীর এই হামলায় এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হন।

১৮ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার মুরাদনগরে নায়েক সুবেদার শিকদার আফজাল হোসেনের নেতৃত্বে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা চাপিতলায় প্রবেশ করে হানাদার বাহিনীর উপর অ্যামবুশ করে। এদিন ভোর পাঁচটার সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দুই কোম্পানি সৈন্য এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশের আওতায় চলে আসে। এসময় মুক্তিবাহিনী অতর্কিত হামলা চালায়।

১৮ অক্টোবর কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ায় সুবেদার আবদুল ওয়াহাবের নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা মন্দভাগ বাজারের পশ্চিম দিকে দেউস গ্রামে এক কোম্পানী হানাদার সৈন্যের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এক মেজর, একজন লেফটেন্যান্টসহ ১০০ জনের বেশি হানাদার সৈন্য নিহত হয়।

 

১৮ অক্টোবর ১৯৭১: পাকসেনারা গৌরীনগরে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর প্রচন্ড গুলি চালায়

 

পাকসেনারা গৌরীনগরে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর প্রচন্ড গুলি চালায়। ফাইল ছবি

পাকসেনারা গৌরীনগরে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর প্রচন্ড গুলি চালায়। ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের ১৮ অক্টোবর দিনটি ছিল সোমবার। এই দিন ২ নাম্বার সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর একটি শক্তিশালীদল মর্টার ও আর-আর-এর সহায়তায় পাকসেনাদের বাডিসা ঘাট অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। প্রায় দেড়ঘন্টার এই যুদ্ধে ২০ জন পাকসেনা হতাহত হয়। 

বাডিসা ঘাট আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনাদের রাজাসার দীঘির অবস্থানের ওপরও মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ৬ জন পাকসেনা নিহত ও কয়েকটি বাঙ্কার ধ্বংস হয়। কুমিল্লায় সুবেদার আবদুল ওয়াহাবের নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা মন্দভাগ বাজারের পশ্চিম দিকে দেউশ নামক স্থানে এক কোম্পানী পাকসৈন্যকে আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর একজন মেজর, একজন লেঃ সহ ১০০ জন সৈন্য নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। 

মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের কাছ থেকে ৬টি এম-জি-আই-এ-৩, ৭টি এল-এম-জি, ৭০টি জি-৩ রাইফেল, ৩টি ৮৩ এম-এম-বি-সি, ১টি অয়ারলেস সেট, ৩টি মর্টার ও কয়েকটি ট্রানজিস্টার দখল করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাগান্ধী নয়াদিল্লীতে এক অনুষ্ঠানে সীমান্ত এলাকায় সশস্ত্র বাহিনীর হামলা সম্পর্কিত পাকিস্তানের অভিযোগ খন্ডন করে বলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী নয়, বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত এলাকায় তাদের প্রতিপক্ষ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে। 

মুক্তিবাহিনীতে দেড় লাখ মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে এবং এদের প্রায় ৫০ হাজার পুলিশ, বিডিআর ও সেনাবাহিনী সদস্য। তারা সবাই বাঙালি এবং ২৫ মার্চ রাতে এদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রথম আক্রমণ করার পর এরা প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দেয়। তারা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে। হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল রেডক্রসের হাতে হস্তান্তর করা হয়। হাসপাতাল হস্তান্তর অনুষ্ঠানে গভর্নর ডাঃ এ.এম. মালিক সেবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পাকিস্তানের খেদমতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষণা করেন, তার দল জোট গঠনের জন্য যে কোনো দলের সঙ্গে আলোচনা করতে প্রস্তুত রয়েছে।

৫ নাম্বার সেক্টরে লেঃ তাহেরউদ্দিন আখঞ্জির নেতৃত্বে দুই কোম্পানী মুক্তিযোদ্ধা ২৫টি নৌকায় করে ভোলাগঞ্জ সাব-সেক্টর থেকে গৌরীনগর গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা গৌরীনগরের কাছাকাছি এলে পাকসেনারা গৌরীনগর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর প্রচন্ড গুলি চালায়। পাকসেনাদের অকস্মাৎ আক্রমণে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৬ জন গুরুতর রূপে আহত হন।

পূর্ব পাকিস্তানের সাহায্য ও পুনর্বাসন মন্ত্রী অধ্যাপক শামসুল হক চট্টগ্রামের দালালদের এক সভায় বলেন, ‘বিদ্রোহ কোনোদিন সফল হয়নি। ভারতীয় প্রচারযন্ত্রের মিঠা বুলিতে আকৃষ্ট হয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা ভারতে গিয়ে বিদ্রোহ ছড়াচ্ছে। তারপরও প্রেসিডেন্ট সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে সবাইকে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।’ বিদ্রোহীদের সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, কোনো মতেই কিছু সংখ্যক বিদ্রোহীর কারণে পাকিস্তানের ১৩ কোটি মানুষ দুর্ভোগ পোহাতে পারে না।

পূর্ব পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী আবুল কাসেম বেতার ভাষণে বলেন, যখন দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন জনজীবন বিপর্যস্ত প্রতিটি মানুষ যখন দিশেহারা, তখন নবগঠিত মন্ত্রীসভার একজন সদস্য হিসাবে যোগ দিয়ে জাতির প্রতি কর্তব্য পালনে এগিয়ে এসেছি। বিভ্রান্ত হয়ে যারা এদেশ ছেড়ে শত্রুদেশে আশ্রয় নিয়েছেন, নিজেদের হাতে গড়া পাক ভ’মিতে নির্ভয়ে ফিরে পুনগঠনের কাছে আত্মনিয়োগ করার জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানাই।