১৭ অক্টোবর ১৯৭১ এই দিনে
১৯৭১ সালের ১৭ অক্টোবর দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক করেন যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট যোশেফ মার্শাল টিটো। এসময় দুই রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান শরণার্থী সমস্যা, আঞ্চলিক নানা বিষয়, সম্প্রীতি ও পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন। যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো বৈঠকে ইন্দিরা গান্ধীকে বলেন, 'যুগোস্লাভিয়া বাংলাদেশ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। শরণার্থী সমস্যা আজ বিশ্বব্যাপী একটি সমস্যা। বাস্তুচ্যুত মানুষকে আশ্রয় দিয়ে ভারত নিজের উদার মনের পরিচয় দিয়েছে। আশা করি শিগগির এর সমাধান হবে। ভারত যদি শান্তিপূর্ণ সমাধানের মাধ্যমে আলোচনার দাবি জানায় তবে যুগোস্লাভিয়া ভারতকে সমর্থন করবে। আঞ্চলিক শান্তির জন্যই এই সমাধানে পৌঁছানো একান্তই জরুরি।'
ইন্দিরা গান্ধী জবাবে বলেন, 'ভারত সবসময়ই শান্তিপূর্ণ সমাধানে আগ্রহী। ভারত সবসময়ই চায় বিষয়টির সুরাহা হোক। ভারত এমনিতেই দরিদ্র একটি দেশ, নানা অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত। শরণার্থীদের আগমনের ফলে সেই সমস্যা আরো প্রকট হয়েছে। পাকিস্তান আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের নামে মিথ্যাচার রটাচ্ছে, ভারত নাকি শরণার্থী প্রত্যাবর্তনে রাজি নয়। আমরা স্পষ্টতই বলতে চাই এবং পূর্বেও বলেছি, শরণার্থী প্রত্যাবর্তন করে পুরোপুরি প্রস্তুত আমরা। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুকূল না হবে ততোক্ষণ পর্যন্ত আমরা শরণার্থীদের জীবন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারি না।'
১৭ অক্টোবর যুগান্তর পত্রিকায় 'শ্রীহট্টে ছাতক শহরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়, 'মুক্তিবাহিনী ছাতক সিমেন্ট কারখানা ও শহরের ওপর বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছে। শ্রীহট্ট জেলার সুরমা নদীর উত্তর তীরে এই শিল্পনগরীটিকে পুনরায় অধিকার করার পর এই পতাকা উত্তোলন করা হয়। দক্ষিণ তীরে ছাতক বাজারের জন্য তুমুল যুদ্ধ চলছে। সীমান্তের ওপার থেকে এই খবর এসে পৌঁছেছে। মুক্তিবাহিনী ছাতক ও জেলা সদর কার্যালয়ে শহর শ্রীহট্ট টাউনের মধ্যে রেল ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। ছাতক বাজার মুক্তিবাহিনীই দখল করবে বলে মনে হচ্ছে।'
ঢাকায় এদিন
১৭ অক্টোবর ধানমন্ডির মিরপুর রোডে টহলরত হানাদার সেনাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায় গেরিলাদের একটি দল। এসময় ২ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।
ভারতে এদিন
এদিন রাষ্ট্রীয় সফরে ভারত আসা যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর সম্মানে ভোজসভার আয়োজন করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি। ভোজসভায় দেয়া এক বক্তব্যে যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো বলেন, শরণার্থীরা যেন নিরাপদে স্বদেশে ফিরতে পারে সে ব্যাপারে ভারতকে সহযোগিতা করতে আগ্রহী যুগোস্লাভিয়া। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদেও যুগোস্লাভিয়া এই মতামত দিয়েছে। এর জন্য এখন আন্তর্জাতিক মহলে শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযুক্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টির চেষ্টা করা। প্রয়োজন হলে পাকিস্তানের সঙ্গে বারবার আলোচনায় বসা। শরণার্থী সমস্যা এখন আঞ্চলিক শান্তির জন্য ও হুমকি। আমার সঙ্গে গতকাল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বৈঠক হয়েছে। তিনি বলেছেন শরণার্থী ফিরিয়ে নিতে পাকিস্তান রাজি আছে।'
ভোজসভায় ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি বলেন, 'কেবল স্থায়ী ও কার্যকর সমাধানের মাধ্যমেই পূর্ববঙ্গের জনগণের মানবিক অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব। শরণার্থীদের জন্য ভারত সরকার ও সাধারণ মানুষ নিজের সাধ্যের চেয়েও বেশী কিছু করেছে। '
১৭ অক্টোবর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, 'আগামী ২৪শে অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। এই সফরে শেষে একই সঙ্গে তিনি ব্রিটেন, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, বেলজিয়াম ও অস্ট্রিয়া সফর করবেন। এই সফরে শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উপযুক্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে আনার জন্য বিশ্বমহলে চেষ্টা চালাবেন প্রধানমন্ত্রী।'
১৭ অক্টোবর ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম এক সভায় বলেন, 'বাংলাদেশ বিষয়ক সকল সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ভারত সীমান্ত থেকে সৈন্য সরিয়ে নেবে না। পাকিস্তান যদি আমাদের উপর আক্রমণের ধৃষ্টতা দেখায় তবে সমুচিত জবাব দেয়া হবে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক চাপ এলেও ভারত নিজের অবস্থান থেকে বিন্দু পরিমাণও নড়বে না। বিষয়টি ভারতের জন্য নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার। ভারত বহুবার এর জন্য মূল্য চুকিয়েছে।'
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
১৭ অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা সিলেট, কুমিল্লা, যশোর, ময়মনসিংহ ও রংপুর জেলার সীমান্ত অতিক্রম করে ২৩টি গ্রামে রাজাকারদের অবস্থানের ওপর দুর্ধর্ষ আক্রমণ গড়ে তোলে। এসময় রাজাকারদের সঙ্গে বেশ কয়েক জায়গায় মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক যুদ্ধ হয়। এসময় মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকশো রাজাকারকে আটক করে। একই সঙ্গে রাজাকার থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিজেদের দখলে নেয় মুক্তিবাহিনী।
১৭ অক্টোবর চট্টগ্রামের জগন্নাথ সোনাপুর গ্রামের কাছে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ২ ইঞ্চি মর্টার ও এলএমজিসহ হানাদার বাহিনীর একটি দলের উপর অ্যামবুশ করতে ফাঁদ পাতে। এদিন দুপুরে হানাদার বাহিনীর দলটি রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় অ্যামবুশের আওতায় এলে হানাদার বাহিনী অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় ২ হানাদার সেনা, ৩ মিলিশিয়াসহ ৫ হানাদার নিহত হয়। এদিন একইসঙ্গে চট্টগ্রামের দেবপুর বিওপিতে অতর্কিত হামলা চালায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল। এই হামলায় হানাদার বাহিনীর ৩ সৈন্য নিহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর সিপাহী আমজাদ আলী গুরুতর আহত হন।
১৭ অক্টোবর কুমিল্লার রমজানপুরে মুক্তিবাহিনীর একটি অ্যামবুশ দল হানাদার বাহিনীর একটি টহলদার দলের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এই হামলার ফলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীও এসময় পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলে। এই সময় দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক গোলাগুলির এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে হানাদার বাহিনী ও রাজাকারেরা পালিয়ে যায়। এই প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধে ১০ হানাদার সেনা ও ১৮ রাজাকার নিহত হয়। অন্যদিকে এক মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
১৭ অক্টোবর ফেনীর ছাগলনাইয়ার পূর্ব দেবপুরে মুক্তিবাহিনীর একদল যোদ্ধা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অ্যামবুশ করে। এসময় হানাদার সেনারা পাল্টা গুলি চালালে উভয়পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে হানাদার বাহিনীর দুই সেনা নিহত হয় এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতরভাবে আহত হন।
১৭ অক্টোবর যশোরের ঝিকরগাছার দোসহাতিনায় বয়রা সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অ্যামবুশের মধ্যে পড়ে। এসময় হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালালে মুক্তিবাহিনী তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই সময় দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গুলি বিনিময় হয়। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ৩ সৈন্য ও ২ রাজাকার নিহত হয়।