১৫ অক্টোবর ১৯৭১ এই দিনে
এদিন 'যুগান্তর' পত্রিকায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের দেওয়া একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত এই সাক্ষাৎকারে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, 'ইয়াহিয়া খান এখন আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। আন্তর্জাতিক মহলকে তিনি বোঝাচ্ছেন, যা করতে হবে তাকে বুঝিয়েই করতে হবে। তিনি বোঝাতে চাইছেন বঙ্গবন্ধুর প্রাণ এখন তার হাতে সীমাবদ্ধ। আমরা বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছি। আমরা আশা করছি বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষায় বিশ্বনেতারা পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখবেন।'
১৫ অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক সূত্র জানায়, 'পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল নিয়াজী বেশ কয়েকটি জেলা সফর করেছেন। সফরে গিয়ে তিনি সেনাবাহিনীকে সর্বাত্মক সহায়তার জন্য রাজাকার ও দালালদের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি রাজাকারদেরকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে অথবা স্বাধীন সংস্থা হিসেবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন।'
ভারতে এদিন
১৫ অক্টোবর ভারতে নিযুক্ত উত্তর ভিয়েতনামের রাষ্ট্রদূত নুয়েন থাট দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, 'উত্তর ভিয়েতনামের সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেওয়া সাধারণ মানুষের সঙ্গে আছে। তারা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের গণদাবিকে সমর্থন করে।'
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
১৫ অক্টোবর ইরানের তেহরানে ইরানের রাজতন্ত্রের পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সফরে আসা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করেন ইরানের শাহ রেজা পাহলভী। একইসঙ্গে এদিন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি, রুমানিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকোলাই চসেস্কু ও যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর সঙ্গে বৈঠক করেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান।
একই দিনে প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ সাংবাদিকদের বলেন, 'সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির সদস্যরা পাকিস্তানকে দেওয়া সাহায্যের পরিমাণ পুরোপুরি কমিয়ে দিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিনেটররা ভোট দিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানের সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি এবং শরণার্থীদের দেশে ফিরে যাওয়ার কথা যতক্ষণ না প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসের সামনে ঘোষণা করতে পারছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত পাকিস্তানকে দেওয়া সব বিদেশি সাহায্য নিষিদ্ধ করার পক্ষে কমিটি প্রস্তাব করেছে।'
দেশব্যাপী এদিন
১৫ অক্টোবর সিলেটে এক সমাবেশে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এ এম মালিক বলেন, 'এক শ্রেণির মানুষ ভারতীয় প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে পাকিস্তান ধ্বংসের কাজে লিপ্ত রয়েছে।'
মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তিনি বলেন, 'এরা দেশের শত্রু। চরমপন্থী ছাত্ররা দুষ্কৃতকারীদের দলে ভিড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্জন করে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা, উৎপাদন ব্যবস্থাসহ অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। ধ্বংসকারী কখনো দেশের মঙ্গল চাইতে পারে না। সেনাবাহিনীর সামনে দাঁড়াবার সাহস না থাকায় তারা গোপনে লুটপাট করছে। এসব তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছে ভারতীয় সেবাদাস।'
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
১৫ অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর বিমান সেনাদের একটি দল একটি ডি এইচ সি অটার বিমান ও একটি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার নিয়ে রংপুর সীমানা অতিক্রম করে মোগলহাটে হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর ব্যাপক গোলাবর্ষণ করে। এরপর সফল আক্রমণ শেষে বিমান সেনারা নির্বিঘ্নে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে আসেন।
১৫ অক্টোবর বগুড়া ওয়াপদার কাছে কৈচোর রেললাইনের ব্রিজের দুই পাশে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার মাসুদ হোসেন আলমগীরের নেতৃত্বে মাত্র ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা হানাদার বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে ৬ হানাদার সৈন্য ও ১০ রাজাকার নিহত হয়। এরপর হানাদার সৈন্যরা কাহালু থানার দিকে পালিয়ে যায়।
১৫ অক্টোবর ফেনীর পরশুরামের বিলোনিয়া ও চিথলিয়াসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা চালায় ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে ১০ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টের বেশ কয়েকটি দল। এসময় হানাদার বাহিনীর মোট ২৪ সৈন্য নিহত হয় এবং ৩০ জন আহত হয়। এদিন হানাদারদের ৩টি বাঙ্কার ধ্বংস করেন মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা।
১৫ অক্টোবর বরগুনা থেকে আড়াই মাইল দূরে পাকিস্তানি হানাদারদের চেকপোস্টের ওপর মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা হামলা চালায়। এদিন আগে থেকে কৌশলে স্থানীয় জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা ওই চেকপোস্ট ঘিরে ফেলে রাত ১২টার দিকে আচমকা আক্রমণ করে। মাত্র দেড় ঘণ্টার যুদ্ধে ওই চেকপোস্ট মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নেন। পরে এই ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ২২ জন রাজাকার ও ৬ জন হানাদার সৈন্যকে আটক করে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। হানাদার বাহিনীর এই চেক পোস্ট থেকে মুক্তিবাহিনী একটি এলএমজি, ৭টা চাইনিজ ৩০৩ রাইফেল, প্রচুর পরিমাণে গুলি ও হ্যান্ড গ্রেনেড উদ্ধার করে।
১৫ অক্টোবর ছাতক শহর ও আশপাশের এলাকা চতুর্দিক থেকে ঘেরাও করেন মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। এদিন হানাদার বাহিনীর একটি গানবোট নদী পার হবার চেষ্টা করার সময় রকেট লাঞ্চার দিয়ে ডুবিয়ে দেয় গেরিলারা। এ সময় পানিতে ডুবে ৩ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।
১৫ অক্টোবর বগুড়ার গাবতলী মুক্তিবাহিনীর একটি দল জয়ভোগা গ্রামের কাছে সারিয়াকান্দি রোডের ওপর মাইন পুঁতে রেখে যায়। এসময় মাইন বিস্ফোরণে ৩ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয় এবং ২ জন আহত হয়।
১৫ অক্টোবর চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকটি দল বল্লভপুর, দারগাহাট ও ছয়ঘরিয়াতে আক্রমণ চালায়। এসব হামলায় ৬ জন হানাদার সেনাসহ ৮ রাজাকার ও মিলিশিয়া নিহত হয়।
১৫ অক্টোবর কুমিল্লার দক্ষিণে বারচর গ্রামে সকাল ৮টার দিকে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল হানাদারদের হামলার উদ্দেশ্যে অ্যামবুশ বসায়। প্রায় এক ঘণ্টা পর হানাদার বাহিনীর একটি দল তাদের ঘাঁটিতে ফেরার পথে অ্যামবুশের আওতায় এলে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা তীব্র আক্রমণ চালান। এসময় হানাদার বাহিনীর ১২ জন সৈন্য নিহত হয় ও ৩ জন আহত হয়।
১৫ অক্টোবর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এক ব্যাটেলিয়ন সৈন্য সন্ধ্যা ৭টার দিকে মুক্তিবাহিনীর সাহেবনগর, চন্দনা এবং জঙ্গলখোলা অবস্থানের ওপর বিধ্বংসী হামলা চালায় এই সময় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে হানাদার বাহিনী তাদের আর্টিলারির সহায়তা নেয়। প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী চলা এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর আর্টিলারিও এক পর্যায়ে ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে পিছু হটে পালিয়ে যায় হানাদারেরা।
১৫ অক্টোবর বাগেরহাটে ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল পাঁচটি ভাগে বিভক্ত হয়ে মোড়লগঞ্জের রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে। এসময় বেশ কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়।
১৫ অক্টোবর সুন্দরবন অঞ্চলে নিউজপ্রিন্ট মিলের সামনে নদীতে অবস্থানরত পাকিস্তানি হানাদারদের কয়েকটি নৌযান ও 'লালসেরা' নামের একটি জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয় মুক্তিবাহিনীর একটি দল।
১৫ অক্টোবর যশোরের ঝিকরগাছায় মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে একটি দল হানাদার বাহিনীর একটি দলের ওপর অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে হানাদার বাহিনীর ৩০ সৈন্য নিহত হয়। এসময় মুক্তিবাহিনীর দলটি হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে।
১৫ অক্টোবর ৮ নম্বর সেক্টরের ধোপাখালীতে মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল অবস্থানরত হানাদার সেনাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় হানাদার বাহিনীও প্রতিরোধ গড়ে তুললে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ সময় ৭ হানাদার সৈন্য নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীর তিন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।