১৩ অক্টোবর ১৯৭১ এই দিনে
এদিন সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক বনানী কবরস্থান দিয়ে বেলুচ রেজিমেন্টের কঠোর পাহারা ডিঙ্গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন গভর্নর, মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল মোনায়েম খানের বাসভবন 'বাগ- এ- মোনায়েমে'র ড্রয়িংরুমে ঢুকে স্টেনগান দিয়ে গুলি করেন।
স্টেনগানের চেম্বার ব্লক হয়ে যাওয়ার কারণে সেদিন মোজাম্মেল হকের স্টেনগান থেকে একটিমাত্র গুলিই বের হয়েছিল। যার ফলে সেখানে উপস্থিত মোনায়েম খানের জামাতা জাহাঙ্গীর আদেল ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী জামাত নেতা মাওলানা আব্বাস আলী খান প্রাণে বেঁচে যান। এদিন রাতে আহত মোনায়েম খান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।
১৩ অক্টোবর দিনাজপুরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিবাহিনীর সদস্যের উদ্দেশ্যে দেওয়া এক ভাষণে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা চূড়ান্ত বিজয় লাভ করছি ততোক্ষণ পর্যন্ত আমরা প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যাবো। আমাদের জাতীয় স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।'
ভারতে এদিন
১৩ অক্টোবর আনন্দবাজার পত্রিকায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্স কোসেগিনের আলজেরিয়া সফরে আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেদিনের সঙ্গে দেয়া যৌথ বিবৃতি নিয়ে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। এই সম্পাদকীয়তে বলা হয়, সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসেগিনের বিবৃতিতে মস্কোও প্রচন্ড আশ্চর্য হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশ বা শরণার্থীদের নিয়ে কোনো বিষয়ই উল্লেখ নেই। অথচ তারা পূর্ব বাংলায় শান্তির প্রশ্নে ঐকমত্য প্রকাশ করছেন।'
পাকিস্তানে এদিন
১৩ অক্টোবর করাচি বিমানবন্দরে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগদান শেষে দেশে ফিরে পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের সদস্য মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের বলেন, 'বিশ্ববাসীর কাছে ভারত ও দালালদের চক্রান্ত ফাঁস হয়ে গেছে।'
১৩ অক্টোবর পাকিস্তানের সংবাদপত্র ডন এ একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, 'পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ যদি কোনো সংবিধান প্রণয়ন করে তা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হবে না। কারণ তাতে পূর্ব পাকিস্তানের কথা তারা ভাববে না। অথচ এই পূর্ব পাকিস্তান থেকেই গত নির্বাচনে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছে আওয়ামী লীগ। মুসলিম লীগ বা পাকিস্তান পিপলস লীগ কি ধারণা করে পূর্ব পাকিস্তানকে এড়িয়ে সবকিছু করবে। তবে তা হবে বড় ভুল। নির্বাচন হলে এই দুটি দলের মধ্যে একটি দলই হয়তো ক্ষমতায় বসবে, তখন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ হয়ে পড়বে সংখ্যালঘু। অথচ মোট পাকিস্তানের জনগণ বা ভোটার হিসেব করলে পূর্ব পাকিস্তানিরাই সংখ্যাগুরু।'
দেশব্যাপী এদিন
১৩ অক্টোবর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী কুমিল্লাসহ পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত এলাকায় সেনাবাহিনী, রাজাকার ও দালালদের কর্মতৎপরতা সরেজমিনে তদারক করেন। এদিন কুমিল্লায় সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের সমাবেশে তিনি বলেন, 'দেশদ্রোহীদের কোনো ধরনের ছাড় দেয়া হবে না।'
গণহত্যা ও প্রতিরোধ যুদ্ধ
বড়ইতলা গণহত্যা
১৩ অক্টোবর স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল ট্রেনে করে কিশোরগঞ্জের যশোদল ও কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের বরইতলা গ্রামের কাছে এসে থামে। রাজাকারেরা বড়ইতলা ও পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে গ্রামবাসীদের ডেকে এনে পাকিস্তানের পক্ষে একটি সভার আয়োজন করেছিল। এরই মধ্যে গ্রামে আসার পথে একজন হানাদার সৈন্য পথভুল করে দলছুট হয়ে যায়। সভায় উপস্থিত হওয়ার পর হানাদার সৈন্যদের একজনের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি নজরে আসে। এদিকে রাজাকারেরা গুজব রটায় গ্রামবাসীরা পাকিস্তানি এই সেনাকে গুম করে হত্যা করেছে। এরপর হানাদারেরা বরইতলা, পার্শ্ববর্তী চিকনিরচর, দামপাড়া, কালিকাবাড়ি, কড়িয়াইল, গোবিন্দপুর, ভূবিরচর, তিলকনাথপুরসহ বিভিন্ন গ্রামের মানুষদের ধরে আনে। প্রায় ৫০০ র মতো নিরীহ সাধারণ মানুষকে কিশোরগঞ্জ ভৈরব রেললাইনে এনে চরম পৈশাচিক কায়দায় রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। এদিন এই গণহত্যায় শহীদ হন ৩৬৫ জন গ্রামবাসী। আহত গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণের বেঁচে যান দেড়শোর মতো গ্রামবাসী।
১৩ অক্টোবর সিলেট অঞ্চলে 'জেড ফোর্স' এর ৩ বেঙ্গলের 'এ' কোম্পানির কামান্ডার ক্যাপ্টেন মো. আতাহার হোসেন এবং 'বি' কোম্পানির কমান্ডার মেজর আখতার হোসেন ছাতক আক্রমণের নির্দেশ পেয়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে ব্যাটেলিয়ন হেডকোয়ার্টারের পেছনে বিজয়নগরে অবস্থান নেন। অন্যদিকে 'এ' ও 'বি' কোম্পানি ছাতকের যাত্রা শুরু করে। এরপর তারা ছাতক সিমেন্ট কারখানার কাছাকাছি এসে কারখানার সীমানা প্রাচীরের খুব কাছে কারখানার পূর্ব পাশের একটি টিলার ঢালে অবস্থান নেয়। এসময় ১০৬ ও ৭৫ এমএম রিকোয়েললেস রাইফেলের সাহায্যে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর ৫ থেকে ৬ টি বাঙ্কার ধ্বংস করেন। এসময় বহু হানাদার সৈন্য নিহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ফলে অস্ত্র ভর্তি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি বোট নদীতে ডুবে যায়। কিন্তু নদীর অপর পাশে থাকা হানাদার সৈন্যরা অবস্থা বেগতিক দেখে তারা সিলেট থেকে অতিরিক্ত সৈন্য ও গোলাবারুদ পাঠানোর অনুরোধ করে। এসময় সিলেট থেকে অতিরিক্ত হানাদার সৈন্য এলে হানাদারেরা কামানের সাহায্যে গেরিলাদের দিকে চতুর্দিক থেকে গোলাবর্ষণ ও বৃষ্টির মতো গুলি শুরু করে। এভাবে টানা ছ য়দিন তীব্র যুদ্ধের পরে মুক্তিবাহিনীর দুটি কোম্পানি শেষমেশ বালিউড়া ফিরে আসে।
১৩ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দুটি বেলুচ কোম্পানি গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনীর ৪র্থ বেঙ্গলের 'ডি' কোম্পানি তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে। প্রায় একঘণ্টা যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী আর্টিলারি বাহিনীর সহায়তা নিয়ে তীব্র পাল্টা আক্রমণের মুখে পাকসেনারা টিকতে না পেরে পিছু হটে। যুদ্ধে প্রায় ৪৫ জন হানাদার সেনা নিহত হয়। এই যুদ্ধে দুই মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং একজন আহত হন।
১২ অক্টোবর ফেনীতে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা লেমুয়ায় এক রাজাকার কমান্ডারকে হত্যা করে। এই সংবাদ পেয়ে পরদিন সকালে পাকিস্তানি হানাদারদের একটি বড় দল ওই এলাকায় এসে স্থানীয় গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে নির্যাতন শুরু করে। এদিকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা এই খবর পেয়ে হানাদার বাহিনীর দলটির উপর আক্রমণ চালালে মুক্তিবাহিনী ও হানাদার বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এসময় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হানাদার বাহিনীর প্রায় চার ঘণ্টা ব্যাপী যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৭ সৈন্য গুরুতর আহত হয়।
১৩ অক্টোবর কুড়িগ্রামের চিলমারী বন্দর যুদ্ধ থেকে যুদ্ধবন্দি, অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে রৌমারী ফিরে আসে মুক্তিযোদ্ধারা। এদিন রৌমারী মুক্তাঞ্চলে যুদ্ধবন্দি কুখ্যাত রাজাকার ওয়ালী মাহমুদ ও পাঁচু মিয়ার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে মুক্তিযোদ্ধারা। পরে যুদ্ধবন্দিদের মাঝ থেকে বেশ কিছু রাজাকার মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করবে বলে শপথ নেয়।
১৩ অক্টোবর ময়মনসিংহের ভালুকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের সমন্বয়ে একটি সম্মিলিত দল মেদুয়ারী গ্রামের সরকার বাড়িতে ক্যাম্প করে। এসময় খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনীর একটি দল সেই ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা চালায়। এই সময় হানাদার বাহিনী ও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে। প্রায় আড়াই ঘন্টা গুলি বিনিময়ের পর হানাদার বাহিনীর ৮ সৈন্য নিহত হয় এবং বাকি সৈন্যরা পালিয়ে যায়।
গেরিলার ডায়েরী থেকে :
১৩ই অক্টোবর ১৯৭১, সেদিন বুধবার। একাত্তরের এই দিন সকাল বেলায় সংঘটিত হয়েছিল আরেকটি হৃদয় বিদারক নৃশংস গণহত্যা। পাকি জল্লাদ বাহিনী কিশোরগঞ্জে অনুপ্রবেশ করেছিল ১৯শে এপ্রিল এবং ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ কিশোরগঞ্জ শহর থেকে বিতাড়িত হয়েছিল।
তাদের নির্মমতার চূড়ান্ত রূপ, এলাকাবাসী প্রত্যক্ষ করেছিল ১৩ই অক্টোবর। এদিন হত্যা করা হয় আনুমানিক ৪০০ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে। তাঁদের হত্যা করা হয় রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি করে। পাকি পশুদের হত্যাযজ্ঞে সেদিন ইন্ধন দিয়েছিল এলাকার রাজাকার ও দালালেরা।
কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে চলে গেছে কিশোরগঞ্জ-নিকলী সড়ক। এ সড়কের পাশেই বড়ইতলা ময়দান। বড়ইতলার পাশেই মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাড়ি। ফলে পাকি হার্মাদ বাহিনী ও রাজাকারদের শ্যেন দৃষ্টি পড়ে এলাকাটির উপর।বড়ইতলা গ্রামটি ভৈরব-ময়মনসিংহ রেললাইনের পূর্ব পাশে অবস্থিত। জোহরের নামাজের সময়, পাকিস্তানী সেনাদের হুকুমে, স্থানীয় কিছু রাজাকার ও দালাল দেশের কথিত অখন্ডতা রক্ষা ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার জন্য ভয়ভীতি দেখিয়ে আশপাশের চিকনিরচর, দামপাড়া, কালিকাবাড়ি, গোবিন্দপুর, তিলকনাথপুর, ডুবিরচর প্রভৃতি গ্রামের প্রায় ৪৫০ লোককে রেললাইনের পাশে খেলার মাঠে জড়ো করেছিল।
মিটিং চলাকালে কয়েকজন পাকি পশু নিকটবর্তী গ্রামে ঢুকে পড়ে। কিছুক্ষণ পর একজন রাজাকার (প্রত্যক্ষদর্শী’রা নিশ্চিত করেছেন চিকনীরচর গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার আবুল হাসিম) এসে সভাস্থলে গুজব ছড়িয়ে দেয় যে, গ্রামবাসীরা দুজন পাকসেনাকে আটক করে গুম করে ফেলেছে। মুহূর্তের মধ্যে পাকসেনারা হিংস্রতায় ফেটে পড়ে এবং উপস্থিত লোকজনদের দড়ি, গামছা, লুঙ্গির সাহায্যে একজনের সাথে আরেকজনকে বেঁধে ফেলা হয়, যাতে তারা পালাতে না পারেন।
ঘটনা আঁচ করতে পেরে প্রায় অর্ধশত লোক পার্শ্ববর্তী মসজিদে গিয়ে আশ্রয় নেন। রেললাইনের দুপাশে দাঁড় করিয়ে অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এরপর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। সেদিনের শহীদ’দের মাঝে ৩৬৫ জন মানুষের নাম জানা যায়। তাঁদের অনেকের লাশের ঠাঁই হয়েছিল গণকবরে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়, গণহত্যায় নিহতদের ভাগ্যে জোটেনি জীবনের শেষ গোসল। তবে দেহ নিঃসৃত উষ্ণ রক্তধারায় হয়েছিল তাঁদের শেষ গোসল। জীবনের শেষ প্রাপ্তি জানাজা ও কবর জোটেনি অনেকের ভাগ্যে। বরং ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল অজানার উদ্দেশ্যে নরসুন্দার পানিতে। প্রত্যক্ষদর্শীরা যাদেরকে এ গণহত্যার সাথে জড়িত বলে জানিয়েছেন, সেই ঘাতকদের আজও কোনো বিচার হয়নি। বরং বীরদর্পে এখনও তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে শহীদনগরে।