১২ অক্টোবর ১৯৭১ এই দিনে
১২ অক্টোবর ১৯৭১:
টানা ৯০ ঘণ্টার বেশি সাঁতার কেটে রেকর্ড অরুণ নন্দীর
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তহবিল সংগ্রহে টানা ৯০ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতার কাটেন সাঁতারু অরুণ কুমার নন্দী।
১৯৭১ সালের ১২ অক্টোবর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, 'বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জনমত গঠন, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে গত ৮ই অক্টোবর ৮টা ৩৫ মিনিট থেকে ১২ অক্টোবর দিবাগত রাত ২টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত একটানা ৯০ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতার কেটে বিশ্বরেকর্ড করেছেন চাঁদপুরের কৃতি সন্তান অরুণকুমার নন্দী। গত ৮ অক্টোবর, শুক্রবার, সকাল ৮:৩৫ মিনিটে চাঁদপুর সম্মিলনীর পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বউবাজার ব্যায়াম সমিতির আয়োজনে কলকাতার কলেজ স্কয়ার পুকুরে অরুণ কুমার নন্দী সাঁতার শুরু করেন। এই সাঁতারের উদ্বোধন করেছিলেন কলকাতায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হোসেন আলী।'
এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান বলেন, 'ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের পর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে। ইয়াহিয়া খান যেভাবে বক্তব্য দিয়েছেন তা সম্পূর্ণ অবৈধ। কারণ বাংলাদেশ এখন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র।'
ঢাকায় এদিন
১২ অক্টোবর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রতিনিধি দলের নেতা মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরী, সেক্রেটারি কামাল আজফার, তথ্য সচিব কাওসার নিয়াজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সাবেক প্রাদেশিক প্রধান আব্দুস সালাম খান, মুসলীম লীগ (কাইয়ুম) এর কাজী কাদের, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের প্রাদেশিক প্রধান পীর মোহসীন উদ্দিন দুদু মিয়াসহ বেশ কজন নেতা। এসময় তারা নিজেদের পিপলস পার্টিতে যোগদান ও পিপিপির টিকেটে উপ-নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন এবং এ বিষয়ে তারা একটি সমঝোতায় পৌঁছান। পরে পিপিপি প্রতিনিধিদল আবদুস সালাম খান, কাজী কাদের, পীর মোহসিন উদ্দিন দুদু মিয়া, হালিমুদ্দিনসহ স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে প্রাদেশিক গভর্নর ডা. মালিকের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর গভর্নর এম এ মালিক প্রতিনিধিদলের নেতাদের সঙ্গে দেশের পরিস্থিতি এবং নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করেন। এরপর পিপিপির তথ্য সচিব কাওসার নিয়াজী বলেন, 'উপ- নির্বাচনে পিপিপি প্রতিটি আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। ২২ জন প্রার্থী ইতোমধ্যে পিপিপি থেকে মনোনয়ন চেয়েছে।'
পরে পিপিপির প্রতিনিধি দল পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে দেখা করে। নিয়াজী তাদেরকে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আশ্বাস দেন।
ভারতে এদিন
১২ অক্টোবর শিমলায় এক জনসভায় বক্তৃতাকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'বাংলাদেশ থেকে ভারতে যে শরণার্থী চলে আসছে তাতে এশিয়া মহাদেশে শান্তির ব্যাপার এক বিরাট ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে পাকিস্তান এক মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভারত প্রস্তুত।'
পাকিস্তানে এদিন
১২ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে বলেন, 'পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দেশের প্রতিরক্ষার জন্য পাহাড়ের মতো অটল রয়েছে। তিনি ২৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান ও শাসনতন্ত্র প্রকাশের কথা ঘোষণা করেন। জাতীয় পরিষদের স্পিকার হবেন পরিষদের প্রবীণতম সদস্য। তিনি নিজেই তাকে মনোনয়ন দেবেন। অধিবেশনের পরপরই তিনি কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করবেন এবং পরিষদ খসড়া শাসনতন্ত্র নিয়ে আলোচনা শুরু করবেন। আলোচনা শুরু থেকেই এলএফও এর শাসনতন্ত্র প্রণয়নের মেয়াদ গণনা শুরু হবে। শত্রুভাবাপন্ন শক্তি যখন আমাদের দোরগোড়ায় তখন আমাদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ ভুলে যেতে হবে। ভারতের মতিগতি দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তারা শিগগির পাকিস্তান আক্রমণ করবে। এ ব্যাপারে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এ ব্যাপারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ সজাগ এবং সতর্ক রয়েছে।'
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
১২ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, 'ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। তারা উদ্বাস্তুদের পুঁজি করে গোটা বিশ্বে পাকিস্তানের নামে বিষোদগার চালাচ্ছে।'
১২ অক্টোবর লন্ডনে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, 'অপারেশন ওমেগা দলের দুজন স্বেচ্ছাসেবক গত ৪ অক্টোবর বাংলাদেশে ঢোকার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী স্বেচ্ছাসেবকদের আটক করে যশোর কারাগারে প্রেরণ করে। পরে পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন তাদের দুই বছরের কারাদণ্ড প্রদান দেয়।'
১২ অক্টোবর বুলগেরিয়ার ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সর্বোচ্চ নেতা মুফতি হাসান আদেমভ ও দক্ষিণ বুলগেরিয়ার স্মলিয়ানের মুফতি ইউসেইন সেফরকভ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ করেন।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
১২ অক্টোবর কুড়িগ্রামের চিলমারীতে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। প্রায় তিন দিন ব্যাপী এই যুদ্ধের মাধ্যমে বলবাড়ী রেলষ্টেশন ও ওয়াপদা ভবন ছাড়া পুরো চিলমারী মুক্তিযোদ্ধাদের আয়ত্বে আসে। এই যুদ্ধে বহু হানাদার সৈন্য ও রাজাকার নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন রাজাকার ও হানাদার সৈন্যকে আটক করে মুক্তিবাহিনীর দলগুলো। পরে তারা মুক্তাঞ্চল রৌমারীতে ফিরে যায়।
১২ অক্টোবর টাঙ্গাইল থেকে হানাদার বাহিনীর একটি দল দেলদুয়ারের এলাসিন হয়ে নাগরপুর যাওয়ার পথে কাদেরিয়া বাহিনীর একটি দল হানাদার বাহিনীর দলটির উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় কাদেরিয়া বাহিনীর হামলায় হানাদারদের সঙ্গী বেশ কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়। অন্যদিকে বেশ কয়েকজন সৈন্য আহত হয়। এসময়ে আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পালাতে গিয়ে হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকজন সৈন্য কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের কাছ থেকে সব রসদ জব্দ করে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে যান।
১২ অক্টোবর খাগড়াছড়ির রামগড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা চালায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল। এসময় হানাদার বাহিনীর দুই সৈন্য নিহত হয়।
১২ অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর ৫ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর মীর শওকত আলীর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা 'জেড ফোর্স' এর সহায়তায় ছাতক সার কারখানায় হামলার জন্য ছাতকের মহড়াটিলা ও জয়নগর টিলাতে অবস্থান নেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান টের পেয়ে হানাদার সেনারা আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করতে গেলে মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। এসময়ে বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে যান।
১২ অক্টোবর ২ নম্বর সেক্টরের কালিরবাজারে মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদার বাহিনীর কালীরবাজার হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দুটি বাঙ্কার সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে। এসময় ১২ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
১২ অক্টোবর ৭ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গড়াগড়ি ও সুলতানপুর অবস্থানের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। এই হামলায় পাকিস্তানী হানাদার ৫০ জন সৈন্য নিহত হয় এবং ৩০ জন সৈন্য আহত হয়। অন্যদিকে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
এদিন সাতক্ষীরার ভেটখালিতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল ভেটখালির রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। এক পর্যায়ে রাজাকারেরা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। পরে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার ক্যাম্পটি পুড়িয়ে দেয়।
১২ অক্টোবর ফেনীর পরশুরামে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় ২ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।