৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

১১ অক্টোবর ১৯৭১ এই দিনে

এদিন আর্জেন্টিনায় নিযুক্ত পাকিস্তানের বাঙালি রাষ্ট্রদূত আবদুল মোমিন রাষ্ট্রদূতের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। একই সঙ্গে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।

এদিন আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে এক সংবাদ সম্মেলনে আবদুল মোমিন বলেন, বাংলাদেশে কী ঘটছে তা বিশ্ববাসী দেখছে। তা নিয়ে খোলাসা করে বলার মতো কিছুই নেই। বাংলাদেশ আজ এক বিধ্বস্ত জনপদ। দেশের প্রতিটি অঞ্চল সাক্ষ্য দেবে কতোটা নির্মমতা চালিয়েছে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। এই অবস্থায় কোনো ন্যূনতম বিবেকসম্পন্ন মানুষ পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করতে পারে না। আমাদের সংগ্রাম সফল হবেই। আমরা বিজয়ী হবো।'

১১ অক্টোবর মুজিবনগরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের এক মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য, উপদেষ্টারা এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মুক্তাঞ্চল সফর করছেন। এদিন কোনো এক মুক্তাঞ্চলে সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে মন্ত্রিসভার সদস্য ছাড়াও মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানী উপস্থিত ছিলেন।

ঢাকায় এদিন

১১ অক্টোবর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) তথ্যসচিব মওলানা কাওসার নিয়াজী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি ফ্যাসিবাদী ধর্মীয় দলকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা হচ্ছে। এই দলটি পাকিস্তানকে আরেক ইন্দোনেশিয়ায় পরিণত করতে চাইছে। দলটি সম্পর্কে এখন জনমনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।' এর আগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ভাসানীপন্থী পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান যাদু মিয়া ও যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ার জাহিদ এক আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন মওলানা কাওসার নিয়াজী।

ভারতে এদিন

১১ অক্টোবর দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে শরণার্থী বোঝা দীর্ঘদিন বহন করা সম্ভব না শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত প্রতিবেদনে ভিক্টর রিভল্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, 'প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক শরণার্থী ভারতে চলে আসায় যে গুরুতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে এশিয়ার শান্তি বিপন্ন হয়ে পড়েছে'। তিনি আরও বলেন যে, পৃথিবীর প্রত্যেকটি রাষ্ট্রেরই উচিত এটা বিশেষভাবে উপলব্ধি করা। এই সমস্যা সমাধানে মাত্র একটি পথই আছে এবং তা হচ্ছে এই যে এই সমস্ত শরণার্থী যাতে পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে নিরাপদে তাদের নিজেদের ঘরে ফিরে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।

তিনি বলেন, 'ভারতের পক্ষেও দীর্ঘদিন এইরূপ বোঝা বহন করা সম্ভব নয়। তবে পাকিস্তানি সৈন্যরা যদি বাংলাদেশে তাদের নির্যাতন, গণহত্যা বন্ধ করে এবং জনগণের অধিকারকে স্বীকার করা হয় কেবলমাত্র তাহলেই শরণার্থীরা তাদের গৃহে ফিরে যেতে পারে।'

১১ অক্টোবর কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে অপারেশন ওমেগা দলের দুই স্বেচ্ছাসেবক জেমস স্কারলেট ও স্টিফেন রিভার মুর বলেন, 'পূর্ব বাংলার মানুষের জন্য ত্রাণ সহায়তা দেয়া হলেও পাকিস্তান সরকার অসহায় মানুষকে বাদ দিয়ে সেই ত্রাণ বিতরণ করছে তাদের একনিষ্ঠ কর্মী রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের মধ্যে। বিশ্ববাসীকে তারা বলছে ত্রাণ সাহায্যের কথা, জরুরি ভিত্তিতে পুনর্বাসনের কথা আদতে তার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। যারা মূলত অসহায় তারা সাহায্য পায়নি। সাহায্য পেয়েছে সামরিক বাহিনীর অনুগতরা। যাদের ন্যূনতম সাহায্যের কোনো প্রয়োজন নেই।'

১১ অক্টোবর কলকাতায় মার্কিন উপ-দূতাবাস থেকে হেনরি কিসিঞ্জারকে দেয়া তারবার্তায় বলা হয়, 'সীমান্তের কোন কোন এলাকা দিয়ে মুসলমানরা ভারতে ঢুকছে। কেবল ভারতে হিন্দু শরণার্থীরাই আশ্রয় নিচ্ছে না বরং মুসলমান শরণার্থীদের সংখ্যাও আশংকাজনক। এখন পর্যন্ত শরণার্থীদের মধ্যে ৯৩ ভাগ হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও বাকি ৭ ভাগ মুসলমান।

পাকিস্তানে এদিন

১১ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের একটি কূটনৈতিক মহল সাংবাদিকদের বলে, 'সামরিক আদালতের বিচার নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের কৌঁসুলি এ কে ব্রোহি বলেছেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উক্তি এই মামলাকে প্রভাবিত করছে। ব্রোহিসহ অন্য কৌঁসুলিরা ঢাকায় শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হওয়ার পর ইয়াহিয়া খান যে বেতার ভাষণ দেন, তা উদ্ধৃত করেন। তাতে বলা হয়েছিল, শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলন বিশ্বাসঘাতকতার কাজ। তার এই অপরাধের শাস্তি হবেই। ব্রোহি বলেন, প্রেসিডেন্টের এই মন্তব্য সামরিক আদালতে মামলাকে প্রভাবিত করছে।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

১১ অক্টোবর ফিনল্যান্ডের হেলসিংকিতে বিশ্ব শান্তি পরিষদ এক বিবৃতিতে বলে, 'পাকিস্তানের কিছু ভুল পদক্ষেপই আজকের অবস্থার জন্য দায়ী। ইয়াহিয়া খানের সরকার যেভাবে সামরিক বাহিনী দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের উপরে অকল্পনীয় গণহত্যা চালিয়েছে তা ইতিহাসে বিরল। অন্যদিকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারে বন্দী করা এই সংকটকে আরো তীব্র করে তুলেছে। মুক্তিযুদ্ধ এদেশের মানুষের গণযুদ্ধ। ভারতের সমর্থন এখানে প্রত্যক্ষ প্রশংসার দাবিদার। ভারত আঞ্চলিক যুদ্ধে জড়াতে চাইছে না। পাকিস্তানের উচিত আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে শেখ মুজিবুর রহমানকে অতিসত্বর মুক্তি দেয়া এবং একটি বাস্তব সমাধানে আসা।'

মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জারকে দেয়া পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের টেলিগ্রাম থেকে জানা যায় ভারত সরকারের হিসেব অনুযায়ী শরণার্থীর সংখ্যা এখন ৯০ লাখ ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে। গত দুই সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে ২১ হাজার শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করেছে।

দেশব্যাপী এদিন

১১ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী আবুল কাসেম বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক অবস্থার দ্রুতই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। দেশপ্রেমিক জনগণ ও রাজাকার বাহিনী দুস্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি অর্পণ করে রুখে দাঁড়াবোই।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

১১ অক্টোবর ফেনীর পরশুরামে মুক্তিবাহিনীর মর্টারের হামলায় ৫ জন হানাদার সেনা নিহত হয়। একই দিন মুক্তিবাহিনী পরশুরামের গুতুমায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এই হামলায় এক হানাদার সৈন্য নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।

১১ অক্টোবর কুমিল্লায় মুক্তিবাহিনীর দুটি দল পৃথকভাবে কান্দিরপাড় ও রাজগঞ্জে পাকিস্তানি হানাদারদের অবস্থানের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এই হামলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ১০ সৈন্য নিহত হয়।

১১ অক্টোবর নোয়াখালীর মজুমদারহাট, অনন্তপুরহাট মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে মর্টার হামলা চালায়। এই হামলায় ৩৭ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।

১১ অক্টোবর খুলনার চুলকাঠি হাইস্কুলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর মুক্তিবাহিনীর হামলায় ১০ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।