০৪ অক্টোবর ১৯৭১ এই দিনে
যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টি পাকিস্তানের নিন্দা করে দলের জাতীয় সম্মেলনে গ্রহণের জন্য ৪ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে একটি প্রস্তাব পেশ করে। প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলাদেশের জনগণের দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগের কারণে পাকিস্তান নিন্দনীয়। কারণ, তারা পূর্ব বাংলার বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেছে।
প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে দুভাবে। প্রথমত, পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের সেনাদের অত্যাচার বন্ধ করা। দ্বিতীয়ত, শেখ মুজিবুর রহমানসহ বাংলাদেশের সব জনপ্রিয় নেতাকে মুক্তি দেওয়া এবং তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করা। কারণ, শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিপুল জয়লাভ করেছিল। জনগণের ইচ্ছানুযায়ী তাদের গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের ব্যবস্থা করার জন্য জাতিসংঘকে প্রত্যক্ষ উদ্যোগ নিতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনার কারণে এশিয়ায় বিঘ্নিত শান্তি ফিরিয়ে আনতে তিনটি উদ্যোগের কথা বলেন। ১. উপমহাদেশে সংযম রক্ষা করা; ২. দুর্ভিক্ষ নিবারণ ও শরণার্থীদের দেশে ফেরার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক সাহায্য কর্মসূচি প্রসার করা; ৩. কার্যকর রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছাতে সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করা। উপমহাদেশে শান্তি রক্ষার প্রশ্নে পাকিস্তান ও ভারতকে তিনি সমভাবে দায়ী করেন।
ভারতের রাজধানী দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনের জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক বাঙালি হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ৪ অক্টোবর পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করেন। তিনি পাকিস্তান হাইকমিশনের পরামর্শদাতা পদে কর্মরত ছিলেন। এপ্রিল মাসে তাঁকে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা থেকে দিল্লির মিশনে পাঠানো হয়।
দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনের আরেকজন বাঙালি কর্মী এবং হাইকমিশনের একজন পাকিস্তানি কর্মকর্তার ব্যক্তিগত সচিব ফরিদউদ্দীন আহমদ সপরিবার হাইকমিশন ভবন ত্যাগ করে বাংলাদেশ মিশনে যোগ দেন। ফরিদউদ্দীন আহমদ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হাইকমিশনের দেয়াল টপকে একটি ট্যাক্সি নিয়ে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ মিশনে যান। এ সময় পাকিস্তান হাইকমিশনের কয়েকজন তাঁর পেছনে ধাওয়া করে। ট্যাক্সিচালকের দক্ষতায় তাঁরা রক্ষা পান।
মুজিবনগরের একটি সূত্র সাংবাদিকদের এ দিন জানায়, বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছেন যে বাংলাদেশ নিয়ে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ হলে চীন পাকিস্তানকে সেনাসাহায্য করবে না। তবে অস্ত্রসহায়তা দেবে। চীন পাকিস্তানকে এখনো অস্ত্রসহায়তা দিচ্ছে। চীনের সবশেষ মনোভাব জানার জন্য বাংলাদেশ সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে।
১ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা সকাল আনুমানিক ১০টায় ফেনীর অন্তর্গত পরশুরামের বিলোনিয়ার কাছাকাছি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী গুতুমা সীমান্তঘাঁটির কাছে পাকিস্তানি অবস্থানে আক্রমণ করলে দুজন সেনা হতাহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। মুক্তিবাহিনীর হালিম বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা সাদাপুরে একটি গোপন উপক্যাম্পে থাকাকালে খবর আসে, পাশের সমসাবাদ গ্রামে সেনা ও রাজাকার সমন্বয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল এসেছে। মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত ওই গ্রামে গিয়ে তাদের আক্রমণ করেন। তাঁদের আকস্মিক আক্রমণে কয়েকজন সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন আহত হন। প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পরও তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। চিকিত্সার জন্য চিকিত্সকের কাছে পাঠানোর সময় পথেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য স্বাধীনতার পর সরকার তাঁকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করে। এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় পাকিস্তানি বাহিনীর সীমান্তবর্তী অবস্থানে হামলা করলে কয়েকজন হতাহত হয়। তাদের একটি নৌযান ডুবে সমরাস্ত্রেরও ক্ষতি হয়।
ভারতের মধ্যপ্রদেশ বিধানসভায় এক প্রস্তাবে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গণহত্যার নিন্দা এবং বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করা হয়। জনসংঘ ও সোশ্যালিস্ট পার্টির কয়েকটি সংশোধনী প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা হলে বিরোধী দলের সদস্যরা সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। তাদের দাবি ছিল মূল প্রস্তাবে ভারতের অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের কথাটি জুড়ে দেওয়া হোক।
ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জনজীবন রাম দিল্লিতে বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানের মধ্যে বাংলাদেশের নিঃশর্ত স্বাধীনতা অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন।
৪ অক্টোবর ১৯৭১: ঢাকার নৌ বাহিনী সদর দফতরে গেরিলা-পাকসেনা-রাজাকারদের ত্রিমুখী সংঘর্ষ
মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের পরাস্ত করতে থাকে বিভিন্নভাবে।\ ফাইল ছবি
১৯৭১ সালের ৪ অক্টোবর দিনটি ছিল সোমবার। এদিন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। তারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক বেশ কিছু সফল অভিযানের জন্য মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের অভিনন্দন জানান।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের ৫ মাইল উত্তরে হরিসর্দার বাজারে পাক অবস্থানের উপর ১০৬ এমএম আরআর (রিকুয়েললেস রাইফেল) এবং ৮১ এমএম মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধারা। এ আক্রমণে কয়েকটি বাঙ্কার ধ্বংস হয় এবং বেশ কয়েকজন পাকসেনা ও ৭ জন রাজাকার হতাহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের হাকিমপুর সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনী এক প্লাটুন পাকসেনার একটি দলকে কাকডাঙ্গার কাছে অ্যামবুশ করে। দু’পক্ষে প্রচন্ড গোলাবিনিময়ে ৬ জন পাকসেনা নিহত ও ৫ জন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অক্ষত অবস্থায় নিরাপদে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে আসে।
৮ নম্বর সেক্টরের হাকিমপুর সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর একটি অ্যামবুশ দল পাকসেনাদের একটি দলকে সোনাবাড়িয়া-মান্দরা এলাকায় অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। গভীর রাতে নোয়াখালীর চিতলিয়া পাক ঘাঁটির কাছে অবস্থান নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। ভোরে যখন পাকসেনারা বাঙ্কার ছেড়ে বের হয়ে আসে তখন ৩” মর্টারসহ তাদের উপর আক্রমণ করে গেরিলারা। এতে বেশ কিছু পাকসেনা হতাহত হয় এবং তাদের একটি আরআর ধ্বংস হয়ে যায়।
বগুড়ার গাবতলী থানার মিহিরপুর গ্রামের কাছে বেশ কদিন আগেই রেললাইনে মাইন পেতে রাখে গেরিলারা। এদিন রাত ১১টায় পাকসেনাবাহী একটি ট্রেন ঐ স্থান অতিক্রমের সময় মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়। বেশক’জন পাকসেনা ও প্রকৌশলী হতাহত হয়। ঢাকায় বনানীস্থ নৌ-বাহিনীর সদর দফতরের কাছে গলফ্ স্কোয়ারে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাযোদ্ধারা পাকবাহিনীর সহযোগী রাজাকারদের একটি দলকে অতর্কিতে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে ৪ জন রাজাকার নিহত হয়।
গোপালগঞ্জ মহকুমার কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়ায় পাকিস্তানী সৈন্যদের অবস্থানের ওপর মুক্তিবাহিনী ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। এতে পাকবাহিনীর ৩০ জন সৈন্য ও ২০ জন রাজাকার নিহত হয়। এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানীরা হেলিকপ্টারের সাহায্যে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পুনরায় আক্রমণ চালায়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে তারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। যশোরের বেনাপোলে পাকবাহিনীর সহযোগী ২ জন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
গভর্নর ডা. এ এম মালিকের সভাপতিত্বে পুনর্বাসন বোর্ডের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন এবং অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্যে একটি বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। মালিক মন্ত্রীসভার শিক্ষামন্ত্রী জামাত নেতা মাওলানা আব্বাস আলী খান এদিন ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট পরিদর্শন করেন। পরে তিনি পাকিস্তান কাউন্সিল হলে শিশু কল্যাণ পরিষদ ও পাকিস্তান কাউন্সিলের যৌথ উদ্যোগে এক আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন। এরপর তিনি ইসলামিক একাডেমী হলে শাহীন ফৌজ আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য রাখে। শাহীন ফৌজের কর্মীদেরকে তিনি সাচ্চা পাকিস্তানী হিসেবে গড়ে তোলার আহবান জানায়। (‘শাহীন ফৌজ’ মূলত কিশোরদের নিয়ে গঠিত রাজাকার বাহিনী যাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হয়েছিল। ঢাকা স্টেডিয়ামে ‘শাহীন ফৌজ’কে অস্ত্র কাঁধে কুচকাওয়াজে অংশ নিতেও দেখা যায় – সম্পাদক)।
জামাতে ইসলামীর মজলিসে শুরার দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন গোলাম আযম। সভায় জামাতের জেলা প্রতিনিধিরা তাদের নিজ নিজ জেলার কর্মতৎপরতার রিপোর্ট পেশ করেন। সভায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। মুক্তিফৌজের নাম ব্যবহার করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হামলার নিন্দা করা হয়।
ফেনী মহকুমা জামাতের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন জেলা জামাত সেক্রেটারি মকবুল আহমদ। অধ্যাপক মুশফিকুর রহমান এ সভায় কর্মীদের সামনে দেশের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরেন। এ সভায় ইউনিয়নগুলোতে দলীয় কর্মীদের দুষ্কৃতকারী (মুক্তিযোদ্ধা) দমনের দায়িত্ব দেয়া হয়। পিডিপি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উপ-নির্বাচনে অংশ নিতে ইচ্ছুক প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদনপত্র আহ্বান করে।
৪ অক্টোবর ১৯৭১ : পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সদরদপ্তর বেদখল ও পুনর্দখলের যুদ্ধ
আমি নিছার আহমদ। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ৫ নং সেক্টরের সাব সেক্টর সুনামগঞ্জের ‘ডি কোম্পানি’র উপ-অধিনায়ক ছিলাম। আমাদের ‘ডি কোম্পানি’র সদরদপ্তর ছিল রতারগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। যা ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বালাট বর্ডার থেকে বাংলাদেশের তিন কিলোমিটার অভ্যন্তরে। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমার্ধে রতারগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমরা ‘ডি কোম্পানি’র সদরদপ্তর স্থাপন করি। তারও দুই কিলোমিটার দক্ষিণে সালবন ও নামা সালবন নামক স্থানে আমরা বাঙ্কার খনন করে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হই।
আমাদের বাঙ্কার হইতে ঝিলের ওপারে ৪০০ গজ দক্ষিণে পাক সেনাদের বাঙ্কার ছিলো। দিনের বেলায় তেমন যুদ্ধ বা গোলাগুলি হতনা। রাত গড়ালেই শুরু হয় যুদ্ধ। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা ৫ টি প্লাটুন ও ১৫ টি সেকশনে বিভক্ত হয়ে মোট ১৫ টি বাঙ্কার তৈরি করি এবং এতে দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়। সন্ধ্যার পূর্বে বাঙ্কারে বসে রাতের খাবার শেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বাঙ্কার হতে ৪-৫ রাউন্ড গুলি পাক সেনাদের অবস্থানের উপর ফায়ার করা হয়। এরপর পাক সেনাদের পালা। আমাদের বাঙ্কারের উপর তারা সারা রাত ব্রাশফায়ার করে। ভোর হলেই যুদ্ধ শেষ হয়। উল্লেখ্য, মুক্তিযোদ্ধাদের খুবই হিসেব করে গুলি খরচ করতে হতো।
৪ঠা অক্টোবর খুব ভোরে আমাদের কোম্পানি কমান্ডার মরহুম হাবিলদার মোঃ জালাল উদ্দিন ভারতের বালাটে যুদ্ধের অগ্রগতি সংক্রান্ত কনফারেন্সে চলে যায়। অপরদিকে আমিও উপ-অধিনায়ক হিসেবে সহযোদ্ধা নাসিরকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধের রণকৌশলের পরবর্তী নির্দেশনা সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের জানাতে সালবন ও নামা সালবনের বাঙ্কারের দিকে রওনা দেই। তখন আমার সাথে একটি সাব মেশিনগান (এস এম জি), কোমরে গামছায় বাঁধা পাঁচটি অতিরিক্ত মেগজিন যার প্রতিটিতে ৩৪ রাউন্ড করে গুলি ভর্তি ও নাসিরের সাথে একটি এসএলআর, এক মেগজিন গুলি এবং অতিরিক্ত ১০০ রাউন্ড গুলি বেল্টে করে কোমরে বাঁধা।
আনুমানিক ভোর সারে ৬ টার দিকে আমাদের বাঙ্কার হইতে ৩০০ গজ দুরে থাকা অবস্থায় দেখি পাক বাহিনী আমাদের বাঙ্কারে আক্রমণ করে দখলের চেষ্টা করছে। আর এদিক থেকে বাঙ্কারে অবস্থানকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বাঙ্কার রক্ষার জন্য প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। অর্থাৎ পাক সেনারা রাতে ঝিল পাড় হয়ে আমাদের বাঙ্কারের কাছাকাছি জায়গায় অবস্থান নেয় এবং সকালে সুপরিকল্পিত ভাবে আমাদের বাঙ্কারের উপরে আক্রমণ করে।
অবশেষে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়ে আত্নরক্ষার্থে গুলি ছুড়তে ছুড়তে ধান খেত ধরে পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং পালিয়ে বর্ডারের দিকে চলে যায়। ইতিমধ্যে পাক সেনারা বাঙ্কার দখলে নিয়ে বাঙ্কারের উপরে উঠতেই আমি এবং আমার সহযোদ্ধাকে দেখে ফেলে। দেখা মাত্রই আমাদের দিকে ব্রশফায়ার ছুরতে থাকে। আমরা তখন ৩০০ গজ অর্থাৎ তাদের কিলিং রেঞ্জের মধ্যে অবস্থান করছি। প্রথমে কয়কটা গুলি আমার পায়ের ফাক দিয়ে চলে যায় এবং ভাগ্যিস প্রাণে বেঁচে যাই। আমরা তাৎক্ষণিক ধান খেতে শুয়ে পরি। তাদের গতি থামানোর জন্য আমার সাব মেশিনগান (এস এম জি) এবং নাসিরের এসএলআর হতে কয়েক রাউন্ড গুলি তাদের অবস্থানের উপর নিক্ষেপ করি। তখন পাকিস্তানিদের গতি থেমে যায়। তারা হয়তো ভেবেছে ৪ ফুট উচু ধান খেতে আমরা অনেকেই উৎ পেতে আছি। তখন পাকিস্তানিরা কৌশল পরিবর্তন করে আমাদের জীবিত ধরার চেষ্টা করে। আমরাও কৌশলে ধান খেতে নড়াচড়া না করে আল ঘুরিয়ে ক্রলিং করে পিছু হটতে থাকি। প্রায় ১ কিলোমিটার আসার পর সামনে পাহাড়ী ছড়ার পারে এসে ছরায় ঝাপ দেয়ার আগে দেখতে পাই আমাদের পরনের প্যান্ট সব ভিজা। কিভাবে কখন প্রস্রাব হলো মোটেই টের পেলাম না। এরপর একটু দাড়িয়ে আমরা পাহাড়ী ছরায় ঝাপ দেই। তখন পাক সেনারা আমাদের দেখতে পেয়ে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এতে সামনে থাকা বাশ ঝারটি থেঁতলে যায় এবং তাদের অগ্রগতি থেমে যায়। আমরা এই ছরা ধরে ক্যাম্পের দিকে যেতে থাকি। এমতাবস্থায় পাক বাহিনী আমাদের গতিবিধি বুঝতে পেরে এডভান্স হয়ে গুলি করতে করতে আমাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। আমরাও মাঝেমধ্যে ২-১ টা ফায়ার করে তাদের জবাব দেই। কিন্তু ছরার পাশের আঁখ খেতের শুকনো পাতার সাথে গুলির ঘর্ষণের বিকট শব্দে আমাদের বুক কেপে উঠে। আমরা ৩০ মিনিটের মধ্যে ক্যাম্পে পৌছাই। তখন বুঝতে পারি শতাধিক পাক সেনা আমাদের সদরদপ্তর দখলে নেয়ার জন্য গুলি করতে করতে এদিকে এগিয়ে আসছে। ক্যাম্পে গিয়ে ৩ জন সহযোদ্ধা’সহ আমরা মোট ৫ জন অস্র ও গোলাবারুদ নিয়ে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার জন্য ভারতের বর্ডারের দিকে রওনা দেই। এমন সময় গ্রামের স্থানীয় সুবিধাবাদী কিছু লোক আমাদের গতি রোধ করে। তখন আমি তাদের মাথার উপর দিয়ে ফাকা গুলি নিক্ষেপ করতেই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পরে। ইতিমধ্যে পাক সেনাদের গুলি আমাদের সদরদপ্তরে প্রবেশ করতে থাকে। তখন তাকিয়ে দেখি আমাদের দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার দুপুরের খাবারের ভাত, তরকারীগুলো মনে হচ্ছে অসহায় দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
আমরা পুনরায় সংগঠিত হয়ে আবার আক্রমনের জন্য বর্ডারের দিকে অবস্থান নেই এবং ভারতীয় কমান্ড ও বাংলাদেশের সাব সেক্টর কমান্ড থেকে নির্দেশ আসে আজই যেকোন মূল্যে সদরদপ্তর পুনর্দখল করতে হবে এবং এর পাশাপাশি আমাদের কাছে পর্যাপ্ত গোলাবারুদ সরবরাহ করে।
পরবর্তীতে এইদিন বিকেলে কোম্পানি কমান্ডার সহ আমরা ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা গোলাবারুদ নিয়ে সুসজ্জিত হয়ে আমাদের সদরদপ্তর পুনর্দখলের উদ্দেশ্যে ২ কিলোমিটার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি। মথুরকান্দি নামক বাজার পার হতেই আমরা পাক সেনাদের মুখোমুখি হয়ে যাই। পাক সেনারা আমাদের দেখতে পেয়ে তাৎক্ষণিক ভাবে পাহাড়ি ছরার পারে পজিশন নেয় এবং আমরাও তাদের উল্টো দিকে ছরার অপরপাশে পজিশন নেই। তখন আমাদের দুই বাহিনীর দুরত্ব মাত্র ১০০ ফিট। এরপর শুরু হয় দুপক্ষের অনবরত গুলিবর্ষণ। আমাদের অবস্থান সড়ক থেকে ২ ফিট নিচে আর তাদের অবস্থান ৪ ফিট নিচে থাকায় তাদের গুলিতে মাটির দলা এসে আমাদের শরীরে পরতে থাকে। তাতে আমরা জীবন্ত কবরে যাওয়ার অবস্থা। ১ ঘন্টা গোলাগুলির পর পাক সেনাদের গুলি শেষ হয়ে গেলে তারা পালিয়ে যায়। তখন গ্রামের মানুষ বাঙ্কার থেকে চিৎকার করে আমাদের জানায় পাক সেনারা পালিয়ে যাচ্ছে। ততক্ষণে তারা আমাদের ফায়ারিং রেঞ্জের বাইরে চলে যায়। এভাবেই আমরা মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের সদরদপ্তর পুনরায় দখল করি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা নিছার আহমদ
উপ-অধিনায়ক
ডি কোম্পানি, ৫ নং সাব সেক্টর সুনামগঞ্জ