০৩ অক্টোবর ১৯৭১ এই দিনে
এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এক বিবৃতিকে সোভিয়েত ও ভারত সরকারের দেওয়া যুক্ত বিবৃতিতে স্বাগতম জানায়। বিবৃতিতে বলা হয়, 'ক্রেমলিন আন্তরিকভাবে আমাদের সমস্যাটি উপলব্ধি করেছে। বাংলাদেশের মানুষ এখন একটি জিনিসই অনুধাবন করছে তা হলো বিজয়ের পথ। আমরা বিজয় অর্জনের মাধ্যমেই আমাদের নতুন পথের সূচনা করবো।'
ঢাকায় এদিন
৩ অক্টোবর পাকিস্তান সরকার উপনির্বাচন সংক্রান্ত এক প্রেসনোট জারি করে। এই প্রেসনোটে প্রাদেশিক পরিষদের বাকি ৮৮টি শূন্য আসনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। তফসিলে বলা হয়, আগামী ১৮ ডিসেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারির মধ্যে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
৩ অক্টোবর ইস্কাটনে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা নূরুল আমিনের বাসায় পিডিপির কার্যকরী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানকে কেন্দ্রীয় চাকরি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের ফলে প্রদেশে অসন্তোষ বিরাজ করায় তা দূর করার আহ্বান জানানো হয়। উক্ত বৈঠকে দলের সবাইকে দেশ গঠনের কাজে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়। সেই সঙ্গে গোলযোগে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির পুর্নগঠনের দাবি জানানো হয়।
ভারতে এদিন
৩ অক্টোবর কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর পিটার ফ্রেলিং গুসেন বলেন, 'যারা এরই মধ্যে শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন এমন কোনো শরণার্থী বাংলাদেশে ফিরে গেছেন এমন তথ্য আমরা পাইনি। আমি পাকিস্তানের স্থাপিত প্রত্যাবর্তন বুথেও খোঁজ নিয়ে দেখেছি এখনো পর্যন্ত কোনো শরণার্থী বাংলাদেশে ফেরত যাননি। পাকিস্তান সরকার এটি নিয়ে প্রকৃতই ধোঁয়াশার সৃষ্টি করছে। পাকিস্তানের উচিত তথ্য প্রদানে সৎ থাকা।'
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
৩ অক্টোবর মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য পাকিস্তান সরকারকে ১৫ কোটি ডলার অর্থ সাহায্য মঞ্জুরের জন্য মার্কিন কংগ্রেসের কাছে চিঠি পাঠায়।
৩ অক্টোবর নেপালের কাঠমান্ডুতে পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি কূটনীতিবিদ মুস্তাফিজুর রহমান স্বীয় পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এসময় তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি নিজের আনুগত্য প্রকাশ করেন।
৩ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র প্রাভদা পত্রিকায় একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত সেই নিবন্ধে বলা হয়, 'পাকিস্তান সরকার যে ধরনের দমন পীড়ন চালাচ্ছে তাতে কোনো আলোচনা সমস্ত সম্ভাবনা ভেস্তে যাওয়ার পথে। পাকিস্তান সরকারের উচিত সমঝোতার মাধ্যমে আলোচনার পথ তৈরি করা।'
এদিন একই সঙ্গে প্রাভদা পত্রিকায় আফ্রো-এশীয় সংঘ কমিটির পাঠানো একটি প্রতিবাদলিপি ছাপা হয়। এতে অবিলম্বে গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
৩ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার সৈয়দাবাদ থেকে মলুগ্রামে যাওয়ার পথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অস্ত্র ও রসদ বোঝাই একটি লঞ্চে আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনীর একটি দল। এসময় মুক্তিবাহিনীর ছোঁড়া মর্টার শেলে হানাদারদের লঞ্চটি ধ্বংস হয়। এসময় লঞ্চে থাকা ১০ হানাদার সেনা নিহত হয়। অন্যদিকে হানাদারদের গুলিতে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ২ জন আহত হন। লঞ্চে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের খবর পেয়ে এসময় হানাদার বাহিনীর অন্য আরেকটি দল একটি লঞ্চে করে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা চালাতে আসে। এসময় মুক্তিবাহিনী ত্রিমুখী আক্রমণ চালায় হানাদারদের ওপরে। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ৮০ জন সৈন্য নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। একইদিন বিকেল ৫টার দিকে মুক্তিবাহিনীর দুটি দল হানাদার বাহিনীর ৩টি স্পিডবোট ও ২০টি নৌকার উপরে হামলা চালায়। এসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৩টি স্পিডবোট ও বেশ কয়েকটি নৌকা ডুবে দুজন অফিসারসহ ১২ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।
৩ অক্টোবর ২ নম্বর সেক্টরে অনন্তপুর ও ধানীকুণ্ডায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর মর্টার হামলা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এসময় হানাদার বাহিনীর প্রবল গোলাবর্ষণ ও আর্টিলারি হামলায় মুক্তিবাহিনী প্রথমে পিছু হটে, এরপর আরও মুক্তিযোদ্ধা বহরে কিছু মুক্তিযোদ্ধা নতুন করে যোগ দেয়। ঠিক এমন সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর ৫০ গজের মধ্যে চলে আসে। এমন সময় মুক্তিবাহিনী দুর্ধর্ষ আক্রমণ গড়ে তোলে। মুক্তিবাহিনীর হামলায় এসময় ৩০ জনের মতো হানাদার সৈন্য নিহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক শক্তিমত্তা টের পেয়ে শক্তিবৃদ্ধি করে। কিন্তু ভারতীয় আর্টিলারির সামনে টিকতে না পেরে হানাদার বাহিনী পালাতে থাকে। এসময় মুক্তিবাহিনী পলায়নরত হানাদার বাহিনীর উপর হামলা শুরু করে। এই হামলায় পলায়নরত হানাদার বাহিনীর ৪০-৪৫ জন সৈন্য নিহত হয়, অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর এক মুক্তিযোদ্ধা হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন ও ৫ মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
৩ অক্টোবর দিনাজপুরের হামজাপুরে হামজাপুর সাবসেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন ইদ্রিসের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল দিনাজপুর শহরের স্কুলপাড়ার সড়কের আশেপাশে গোপনে অবস্থান নেয়। এসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দুটি ট্রাক যাওয়ার সময় মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের আক্রমণের মুখে পড়ে। এসময় একটি ট্রাকে থাকা তিন জন হানাদার সেনা নিহত হয় এবং অন্য ট্রাকটি পালিয়ে যায়। আক্রমণের শিকার ট্রাকটি থেকে মুক্তিবাহিনী বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে।
৩ অক্টোবর লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এসময় দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হলে ভয়াবহ যুদ্ধের আকার ধারণ করে। প্রায় ৬ ঘণ্টা ব্যাপী এই যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৫০ হানাদার সেনা ও ৭০ জন রাজাকার নিহত হয়, অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর ৭ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। যুদ্ধে এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে ৩৪ রাজাকার এসময় মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
৩ অক্টোবর নোয়াখালীতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল রাজাকার কমান্ডার আবুল বাশারকে রাস্তা থেকে আটক করে।
৩ অক্টোবর টাঙ্গাইলের ধনবাড়িতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়।
৩ অক্টোবর জামালপুরের বকশীগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল কামলাপুর- বকশীগঞ্জ রাস্তার উপরে মাইন পেতে রাখে। কিছুক্ষণ পর হানাদার বাহিনীর একটি ট্রাক রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় মাইন বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হয়। এসময় ৭ হানাদার সেনা নিহত হয় এবং ৬ জন আহত হয়।
৩ অক্টোবর খুলনার দাকোপের খাটালি গ্রামে একদল রাজাকার গ্রামের বাড়িঘরে লুটপাট করতে এলে মুক্তিবাহিনী চারপাশ ঘিরে ফেলে। এসময় অস্ত্রসহ বেশ কয়েকজন রাজাকারকে আটক করে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা।
৩ অক্টোবর ৮ নম্বর সেক্টরের বানপুর সাব-সেক্টরের গয়েশপুরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দলের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় ৫ হানাদার নিহত হয় এবং ৪ জন আহত হয়।