০২ অক্টোবর ১৯৭১ এই দিনে
সোভিয়েত সাংবাদিক ইউনিয়ন ২ অক্টোবর এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে পাকিস্তানকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানায়। তারা একই সঙ্গে গণহত্যা বন্ধ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার বন্ধ করার দাবি জানায়। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বিশ্ব জানে যে শেখ মুজিব পাকিস্তানের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। আওয়ামী লীগ বিগত সাধারণ নির্বাচনে বিপুল জয়লাভ করে জাতীয় আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
সিপিএম পলিটব্যুরো এ দিন এক বিবৃতিতে সাম্প্রতিক সোভিয়েত-ভারত যৌথ বিবৃতির সমালোচনা করে বলে, এটি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। আশা করা গিয়েছিল, সোভিয়েত-ভারত চুক্তির পর বাংলাদেশ সরকারকে ভারত স্বীকৃতি দেওয়ার সাহস পাবে। কিন্তু তা হয়নি।
নিখিল ভারত সমাজবাদী দলের চেয়ারম্যান কর্পুরী ঠাকুর এক বিবৃতিতে বলেন, ভারত-সোভিয়েত যৌথ বিবৃতি থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রশ্নটিকে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নে ইন্দিরা গান্ধীর উচ্চপর্যায়ের আলোচনা আবার প্রমাণ করল যে ভারত বিশ্বশক্তির ক্রীড়নক হয়ে দেশের লোকের আস্থার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (দেবেন সিকদার), শ্রমিক-কৃষক কর্মী সংঘ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (হাতিয়ার গোষ্ঠী) এবং অন্য গণসংগঠনের সমন্বয়ে গড়া বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি এক বিবৃতিতে ভারত-সোভিয়েত যুক্ত বিবৃতিকে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ওপর এক প্রচণ্ড ধাক্কা বলে বর্ণনা করে। কমিটি মনে করে, বিবৃতিতে রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌঁছানোর জন্য যে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তা জল্লাদ ইয়াহিয়া খানের কাছে সরাসরি আবেদন ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ধরনের মীমাংসা হতে দিলে বাংলাদেশের মুক্তির মূল উদ্দেশ্যই নষ্ট হয়ে যাবে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার আন্তরিক ইচ্ছা ভারতের নেই।
ভারত পাকিস্তানের বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে সমুদ্রে ভয় দেখাচ্ছে বলে পাকিস্তান ১ অক্টোবর যে অভিযোগ করে, ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ দিন তা অস্বীকার করে।
বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানী বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল সফর করে মুজিবনগরে ফিরে ২ অক্টোবর সাংবাদিকদের বলেন, বাঙালি যুদ্ধ জানে না বলে যে প্রচার ছিল, মুক্তিসেনারা গত ছয় মাসে তাদের সাহসিকতা দিয়ে তা ভুল প্রমাণ করেছে।
বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা এ দিন পররাষ্ট্রসচিব মাহবুবুল আলম চাষীর কাছ থেকে সাম্প্রতিক সোভিয়েত-ভারত আলোচনা সম্পর্কে শোনে।
১ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা এ দিন ফেনী জেলার ছাগলনাইয়ার চম্পকনগর সীমান্তঘাঁটিতে আবার হামলা করলে সেখানে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের কয়েকজন হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন। লক্ষ্মীপুর জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল রামগঞ্জ ও পানিয়ালার রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ করলে কয়েকজন হতাহত হয়।
কুমিল্লার হোমনায় ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃসাহসিক অভিযানে কয়েকজন পুলিশ ও রাজাকার নিহত হয়।
৭ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা ঠাকুরগাঁওয়ে একটি সড়কে মাইন পেতে রাখে। সে মাইন বিস্ফোরণে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি খাদ্যবাহী ট্রাক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ময়মনসিংহের ফুলপুর-হালুয়াঘাট সড়কে ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের পুঁতে রাখা মাইনের বিস্ফোরণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি সাঁজোয়া যান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়, মুক্তিযোদ্ধারা এ দিন যশোর, কুমিল্লা-ফেনী ও সিলেট অঞ্চলে সীমান্ত এলাকার ১৭টি স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালান। এসব হামলায় বহু পাকিস্তানি সেনা হতাহত এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দখল করা হয়।
২ অক্টোবর ১৯৭১: কুমিল্লার হোমনায় পাকসেনাদের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর এক দুঃসাহসিক অভিযান
মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দখল করে। ফাইল ছবি
১৯৭১ সালের ২ অক্টোবর দিনটি ছিল শনিবার। এদিন মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা, যশোর ও সিলেট সীমান্তে ১৭টি এলাকায় পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে একযোগে আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের আচমকা মর্টার ও কামান হামলায় রণাঙ্গণগুলোতে কয়েক’শ পাকসৈন্য হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দখল করে।
মুক্তিবাহিনী কুমিল্লার কালিপুর, পরশুরাম, খাজুরিয়া, শাহপুর, কাউয়ামতলা, নয়নপুর, বজ্জলা, হরিমঙ্গল, ছাগলপুর, রাজপুর, শালদা নদী, মধুগ্রাম, সিলেটের রাধানগর, জয়ন্তিপুর, রাজঘাট ও যশোরের বেনাপোলের হিজলতলী গ্রামে শত্রুবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। ১নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রামের চম্পকনগর বিওপি’র উপরাবার আক্রমণ করে। এতে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং ১ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
নোয়াখালী অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের ২টি দল রামগঞ্জ ও পানিয়ালার রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ করে কয়েকজন রাজাকারকে হত্যা করে।
সিলেটের বাউরভোগ মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের উপর হানাদাররা রাতে গোলাবর্ষণ করে। মুক্তিবাহিনী ময়মনসিংহের ফুলপুর-হালুয়াঘাট রাস্তায় মাইন পুঁতে এ্যামবুশ পাতে। পাকবাহিনীর একটি ট্যাংক মাইনের উপর এলে মাইন বিস্ফোরণে ট্যাংকটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়।
মুক্তিবাহিনীর এ্যামবুশ দল দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও-এ পাকসেনাদের জন্য মাইন পেঁতে রাখে। পাকহানাদারদের একটি খাদ্যবাহী ট্রাক ঠাকুরগাঁও-এর দিকে মাইনের উপর এলে মাইন বিস্ফোরণে ট্রাকটি ধ্বংস হয়। কুমিল্লার হোমনায় মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের বিরুদ্ধে এক দুঃসাহসিক অভিযান চালায়। এই সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ১১ জন পুলিশ ও ৫ জন রাজাকার নিহত হয়। পরে ১৫ জন রাজাকার তাদের অস্ত্রশস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
সিলেটের সাগরনালে মুক্তিবাহিনী পাকহানাদারদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চালালে রাজাকারদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই সংঘর্ষে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। গভর্নর ডা. এ এম মালিক খুলনায় কোর্ট প্রাঙ্গণে বিভিন্ন স্তরের নাগরিক সমাবেশে বলেন, খাঁটি পাকিস্তানীদের মধ্যে যারা সীমান্ত অতিক্রম করে ওপারে গেছেন তাহারা ফিরে এলে তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া হবে। তিনি সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আসুন আমরা আর অতীতকে নিয়া ঘাটাঘাটি করব না এবং আমরা এমন কিছু করব না যাতে শত্রুর সুবিধা হয়। পরে তিনি স্থানীয় জেলা স্কুল ময়দানে সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও রাজাকার সমাবেশে বক্তব্য দেন। তিনি রাজাকারদের সততা নিষ্ঠা ও চরিত্রের দ্বারা জনগণের স্নেহ ভালবাসা অর্জন করার আহ্বান জানান। রাজাকারদের বিগত কার্যক্রমের প্রশংসা করে তিনি বলেন, আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা ও জনগণের নিরাপত্তা বিধানে ত্যাগের মনোভাব নিয়া তাদের সেবা অব্যাহত রাখার উপদেশ দেন। তিনি বলেন, ‘দুষ্কৃতকারীরা আমাদের আত্মীয়স্বজন হলেও তারা বর্তমানে আমাদের শত্রু। কাজেই তাদের ক্ষমা করা যাবে না।’
সফররত মার্কিন পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির সদস্য পিটার ও ফ্রেলিং হুইসেনকে পাকহানাদাররা তথাকথিত কুমিল্লার অভ্যর্থনা কেন্দ্র দেখাতে নিয়ে যায়। হানাদাররা এলাকার ক্ষয়ক্ষতি এবং গোলাচিহ্ন দেখিয়ে এগুলোকে মুক্তিযোদ্ধাদের কাজ বলে প্রতিনিধিদের কাছে উল্লেখ করে।
খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী নওয়াজেশ আলী খান চুয়াডাঙ্গা সফর করেন। চুয়াডাঙ্গায় তিনি সকলকে পাকিস্তানের সেবায় জন্যে কাজ করার আহ্বান জানান।