৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ এই দিনে

১৯৭১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। এদিন নওয়াবগঞ্জ এলাকার মুক্তিযোদ্ধা অবস্থানে পাকসেনাদের ঢাকার বড় খাল ও আড়িয়াল বিল হয়ে তিনদিক দিয়ে আক্রমণের দ্বিতীয়দিনও কাটে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধে। হানাদাররা কখনো পিছু হটে কখনো শক্তি সঞ্চয় করে আবার আক্রমণে ফিরে আসে। গেরিলারা শক্ত অবস্থান থেকে পাক হামলার মোকাবেলা করতে থাকে। চলতে থাকে যুদ্ধ।

মুক্তিবাহিনী লে. মোরশেদের নেতৃত্বে আখাউড়া-হরশপুর রেলওয়ে লাইনে মুকুন্দপুরের কাছে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন পেতে তার সঙ্গে বৈদ্যুতিক তার যোগ করে ৩০০ গজ দুরে রিমোট কন্ট্রোল স্থাপন করে অবস্থান নেয়। পাকবাহিনীর এক কোম্পানি সৈন্য বোঝাই একটি ট্রেন অ্যামবুশ অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়ে মাইনের উপরে এলে মুক্তিযোদ্ধারা মাইন বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে ইঞ্জিনসহ ট্রেনটি বিধ্বস্ত হয় এবং ২ জন অফিসারসহ ২৭ জন পাকসেনা নিহত হয়।

৪ বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে ৫০ জনের মুক্তিযোদ্ধা দল রাত ১টায় কুমিল্লার দক্ষিণে পাকসেনাদের কংসতলা ঘাঁটিটি আক্রমণ করে। তিনঘণ্টা প্রতিরোধ যুদ্ধের পর সুবেদার শাহজামানসহ ১৬ জন পাকসেনা নিহত এবং ৮ জন আহত হলে পাকসেনারা তাদের অবস্থান পরিত্যাগ করে কুমিল্লায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

ফেনীতে মুক্তিবাহিনী ক্যাপ্টেন পাশার নেতৃত্বে পাকসেনাদের নয়ানপুর ঘাঁটির উপর আর্টিলারির গোলা নিক্ষেপ করে। এরপর ক্যাপ্টেন আশরাফের নেতৃত্বে আরেকদল মুক্তিযোদ্ধা নয়ানপুরে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর এই আক্রমণের মুখে পাকবাহিনী নয়ানপুর ছেড়ে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনের মূল ঘাঁটিতে আশ্রয় নেয়।

সিলেটে মুক্তিবাহিনীর ৫০ জন যোদ্ধার একটি দল পাকসেনাদের শাহবাজপুর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। ১০ মিনিট পর পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে ১৫ জন পাকসৈন্য ও রাজাকার নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা অক্ষত অবস্থায় নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে।

৭ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী রামচন্দ্রপুর পাকবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকবাহিনীর ২০ জন সৈন্য ও ১২ জন রাজাকার নিহত এবং ১৩ জন সৈন্য আহত হয়। অপরপক্ষে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ২ জন আহত হন। মুক্তিবাহিনী খুলনার হরিনগরে পাকবাহিনীর একটি গানবোট ও সৈন্য বোঝাই কিছু লঞ্চকে অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে পাকবাহিনীর গোনবোট আরোহী নিহত এবং রাডার এন্টেনা ধ্বংস হয়। পরে প্রচণ্ড গোলাবিনিময়ে পাকসেনাদের ৪টি লঞ্চ পানিতে ডুবে যায়।

৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী বানারীপাড়ায় পাকবাহিনীর কয়েকটি লঞ্চকে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকবাহিনীর ৩টি লঞ্চ পানিতে ডুবে যায় এবং ৪০ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। খুলনার পাইকগাছা থানা আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধারা। এতে থানার ৬/৭ জন রাজাকারসহ থানা স্টাফরা গেরিলাদের হাতে বন্দি হয়।
চট্টগ্রামের চম্পকনগর বিওপির কাছে একটি কালভার্ট উড়িয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধারা। ফলে চম্পকনগরের সাথে পাকসেনাদের সড়ক যোগাযোগ সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি সম্মেলনে নিউজিল্যান্ডের প্রতিনিধি এইচ সি  টেম্পল্টন বলেন, ‘আমাদের দেশের পক্ষ থেকে কমনওয়েলথ এবং যুক্তরাজ্যকে পূর্ব পকিস্তানের নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য অনুরোধ করছি। আমরা বিশ্বাস করি তাদের সরকার স্বীয় জনগণের অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সঠিক নীতি অবলম্বন করবে।’

পাকিস্তান সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলেন, গত ২৮ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লীস্থ পাক হাইকমিশনের ৪ জন কূটনীতিককে স্বপরিবারে হরিয়ানার কাছে একটি চেক পোস্ট থেকে পুলিশ আটক করে অজ্ঞাত স্থানে আটক রাখা হয়েছে। তারা বাঙালী কূটনীতিক ছিলেন। তারা সরকারি নির্দেশে একটি বাস যোগে পাকিস্তান প্রত্যাবর্তন করছিলেন। ভারত পূর্বপরিকল্পিত ভাবে কাজটি করেছে কারণ ঘটনাস্থলে সাংবাদিক ফটোগ্রাফার রাখা হয়েছিল। ভারতের এধরনের কাজ কূটনীতিক শিষ্টাচারের পরিপন্থী। ঐ ঘটনা দুই দেশের সম্পর্ক আরও অবনতি ঘটাবে। পররাষ্ট্রদপ্তর আজ ভারতীয় ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে দপ্তরে ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানায়। প্রতিবাদলিপিতে কূটনীতিকদের আশু মুক্তি দাবি করা হয়।

করাচীতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও পিপলস পর্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আরী ভুট্টোর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ঘটনাবলী নিয়ে তিন ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তাহরিকে ইশতেকলাল পার্টির প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএ-দের অবস্থা যাই হোক আর যেখানেই তারা থাকুন সাধারণ ক্ষমাকে সম্প্রসারিত করে তাদের সবাইকে ক্ষমা এবং স্বপদে পুনর্বহাল করা উচিত। তিনি বলেন, যারা নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন, তাদের ক্ষমতায় আসা উচিত। তার এই প্রস্তাব গ্রহণ করলে প্রদেশে মৃত্যুজনিত কারণ ছাড়া উপনির্বাচনের প্রয়োজন হবে না। তিনি বলেন স্বেচ্ছাসেবী (রাজাকার) ও শান্তি কমিটি মফস্বলে খুব অত্যাচার করছে। তিনি আরো বলেন, পরাজিত দলের সদস্যদের মন্ত্রী করা সঠিক হয়নি।

সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে সেনাবাহিনী সদরদপ্তর থেকে ২ নম্বর সেক্টরের সৈনিকদের পুনর্গঠন ও কে-ফোর্স গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। বিগত কয়েক মাস ধরে অবিরাম যুদ্ধে এবং জীবন ধারণের নিত্য প্রয়োজন আহার নিদ্রা থেকে বঞ্চিত ও যুদ্ধ সামগ্রীর অপর্যাপ্ততা ইত্যাদি প্রবল প্রতিকূলতার দরুন এ সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা স্বাভাবিক কারণেই অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল বিধায় তাদের বিশ্রাম ও নতুন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক এবং ৪র্থ বেঙ্গলের পুরনো ও অভিজ্ঞ সৈনিকদের নিয়ে আরও কয়েকটি ব্যাটালিয়ন গঠন করার প্রয়োজনে এই নির্দেশ আসে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফ সাবসেক্টর কমান্ডারদের নিয়ে হেডকোয়ার্টার মেলাঘরে একটি কনফারেন্স করে নিচের সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করেন –

ক) চতুর্থ বেঙ্গল থেকে পুরনো ও অভিজ্ঞ সৈনিক নিয়ে আরও দুটি ব্যাটালিয়ন করা হবে।
খ) ৪র্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানি ও হেডকোয়ার্টারের কিছু সৈনিক ৪র্থ বেঙ্গলেই থাকবে এবং তাদেরকে নিয়ে ৪র্থ বেঙ্গল পুনর্গঠন করা হয়। এই ব্যাটালিয়নটি পরিচালনার জন্য ক্যাপ্টেন গাফফারকে নিযুক্ত করার হয়। এই ব্যাটালিয়নটি পুনর্গঠন এবং পুনর্বিন্যাসের জন্য কনাবন বেইস-এ একত্রিত করা হবে।
গ) ৪র্থ বেঙ্গলের ‘ডি’ কোম্পানি এবং ‘বি’ কোম্পানির কিছু সৈন্য নিয়ে নতুন করে ৯ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করে মেজর আইনুদ্দিনকে এই ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। এই ব্যাটালিয়নটিকে কসবা বেইস-এ পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস করা হয়।
ঘ) ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানি এবং বি কোম্পানির অবশিষ্ট সৈনিকদের নিয়ে ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করে মেজর সালেককে এই ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। মেজর সালেক এবং ৪র্থ বেঙ্গলের এই কোম্পানি শালদা নদীতে যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় তাঁকে তাঁর সৈন্যসহ বেলোনিয়াতে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়। ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বিলোনিয়া-রাজনগর বেইস-এ পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস করা হয়।
ঙ) ২ নম্বর সেক্টর অধিনস্ত সব যোদ্ধাদের তিনভাগে বিভক্ত করা হয়। নবগঠিত ৪র্থ, ৯ম ও ১০ম রেজিমেন্টকে নিয়ে কে-ফোর্স নামে ব্রিগেড গঠন করা হয়।
চ) নবগঠিত এই ব্রিগেডের আলাদা হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে সেখানে স্টাফ অফিসার হিসেবে মেজর মতিন এবং ক্যাপ্টেন আনোয়ারুল আলমকে নিযুক্ত করা হয়।
ছ) গেরিলা হেডকোয়ার্টার মেলাঘরেই রাখা হবে। মেজর হায়দার সেক্টর কমান্ডারের অধীনে গেরিলা স্টাফ অফিসার নিযুক্ত হন।
জ) ১৮টি সেক্টর কোম্পানি কোম্পানি হিসেবেই থাকে এবং তারা কে-ফোর্স হেডকোয়ার্টারের অধীনে রয়ে যায়। তাদেরকে সাধারণত কমান্ডো হিসেবে শত্রুপক্ষের পশ্চাৎভাগে (গভীরাভ্যন্তরে) ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালাবার কাজে নিয়োগ করা হবে।
ঝ) গেরিলারা তাদের নিজ নিজ এলাকায় পাকসেনাদের নির্মূল করে নিজ নিজ এলাকা শত্রুমুক্ত করবে। পাকসেনাদের ছোট ছোট দলে বিচ্ছিন্ন করে তাদের শক্ত ঘাঁটিগুলোকে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য করবে।
ঞ) কে-ফোর্স ব্রিগেডকে পাকসেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটিগুলিকে দখল করার কাজে নিয়োগ করা হবে এবং উদ্ধারকৃত মুক্ত এলাকার প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকবে।
ট) অক্টোবর মাসের ১৪ তারিখের মধ্যেই কে-ফোর্স পুনর্গঠনের কাজ শেষ করা হবে।
ঠ) কে-ফোর্স পুনর্গঠনকালে পাকসেনারা যাতে তাদের হৃত মনোবল পুনরুদ্ধার করতে না পারে এবং প্রাধান্য বিস্তারে সক্ষম না হয় সেজন্য কোম্পানিগুলো এবং কমান্ডোপ্লাটুনগুলো গেরিলাদের সহায়তায় ৪র্থ বেঙ্গলের অপারেশন এলাকায় নিয়োজিত থেকে শূন্যতা পূরণ করতে তাদের তৎপরতা অব্যাহত রাখবে।
ড) অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জাম যা কিছু আছে তা পুনরায় বিভিন্ন দলের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে বণ্টনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
ঢ) গোলন্দাজ বাহিনীর প্রথম ফিল্ড রেজিমেন্ট কে-ফোর্স এর অধীনে নিযুক্ত করা হয়।
ণ) কে-ফোর্স এবং ২ নম্বর সেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফের অধীনে থাকবে। তবে খালেদ মোশাররফের অবর্তমানে এই দুটি বাহিনী বিভক্ত হবে। কে-ফোর্সের অধিনায়কত্ব করবেন মেজর আব্দুস সালেক চৌধুরী ও ২ নম্বর সেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করবেন মেজর এ টি এম হায়দার।