২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ এই দিনে
নিউইয়র্কে ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনে বাংলাদেশসংক্রান্ত বিতর্কে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বক্তব্য দেওয়ার সময় পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে নাটকীয়তা সৃষ্টি হয়। সরদার শরণ সিং বক্তব্য দেওয়ার সময় আগা শাহি বৈধতার প্রশ্ন তুলে বাধা দিয়ে বলেন, তাঁর মাধ্যমে বাংলাদেশে সংঘর্ষের কারণ বর্ণনার মাধ্যমে ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছে।
- তবে আগা শাহির বাধা দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সাধারণ পরিষদের সভাপতি ইন্দোনেশিয়ার ড. আদম মালিক সরদার শরণ সিং বক্তব্য দেওয়ার সময় চুপ থাকেন। তিনি শরণ সিংয়ের বক্তব্যকে বিধিবহির্ভূত বলেননি। সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত বারুদি আগা শাহির পক্ষ নিয়ে প্রস্তাব করেন, শরণ সিংয়ের বক্তৃতার পুস্তিকা সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা হয়ে গেছে। তাঁর বক্তৃতার যে অংশ নিয়ে আগা শাহি আপত্তি করছেন, সেসব বাদ দেওয়া উচিত।
- সরদার শরণ সিং সব বাধা উপেক্ষা করে বাংলাদেশ পরিস্থিতির পটভূমি এবং তারই পরিণামে ৯০ লাখ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেওয়ায় উদ্ভূত জটিল অবস্থার জোরালো বিবরণ দেন। সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, ইসলামাবাদের সামরিক শাসকদের সবাই যেন বুঝিয়ে বলেন যে নির্যাতন চালিয়ে সফল হওয়া যাবে না। রাজনৈতিক সমাধানই অত্যাবশ্যক। এই জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানান।
- সরদার শরণ সিং বলেন, পাকিস্তানের সামরিক চক্র বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়ে জাতিসংঘের সনদ যেভাবে লঙ্ঘন করেছে, তাতে বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার নেই। যে দল পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গড়ত, তারাই আজ সামরিক আদেশে নিষিদ্ধ।
- জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নেতা মাহমুদ আলী বলেন, ভারত সরকারের সঙ্গে তাঁর সরকার আলোচনায় বসতে এবং নিরাপত্তা পরিষদের মধ্যস্থতা মেনে নিতে রাজি আছে। তবে ভারতের বিপজ্জনক নীতির জন্য পরিষদের উচিত ভারতকে সতর্ক করে দেওয়া।
- বাংলাদেশ সমস্যা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে সোভিয়েত নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এ দিন তিন দিনের সফরে মস্কো পৌঁছেন। ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি সোভিয়েত নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করবেন।
- বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দপ্তর মুজিবনগরে এ দিন দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের জানায়, খুলনার সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে বেশ কিছু এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে এসেছে। মুক্তিবাহিনী শত্রুসেনার অবস্থান লক্ষ্য করে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করলে ২০ জন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত এবং ১৫ জন গুরুতর আহত হয়। মুক্তিবাহিনী মুক্ত এলাকার বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে।
- ২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা কায়েমপুর পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের চাপের মুখে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা কায়েমপুর ঘাঁটি থেকে পশ্চাদপসারণ করে। যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কয়েকজন বীরযোদ্ধা শহীদ ও আহত হন। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি থেকে মেশিনগান, মর্টারসহ বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করেন। এই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কসবার কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর অন্য একটি ঘাঁটিতে মর্টার হামলা চালায়। সংঘর্ষে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন।
- পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসকের দপ্তর থেকে এই দিন জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে জনগণকে সতর্ক করে বলে দেওয়া হয় যে কোনোক্রমেই নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবের বিচার সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা যাবে না।
২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: খুলনায় রাজাকারের একটি দল অস্ত্রসহ আত্মসমর্পন করে
রাজাকারদের সাহায্যেই পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্ফাথান জানতে পারত। ইল ছবি
১৯৭১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল সোমবার। এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ‘বাংলাদেশ’ বিষয়ে আলোচনার জন্য তিনদিনের সরকারী সফরে মস্কো রওনা হন।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদল পাকসেনাদের একটি দলকে মাগুলা বাজার থেকে রসদ নিয়ে দোহার থানার কাম্পে যাবার পথে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে ১৪ জন পাকসেনা নিহত ও ৮ জন আহত হয়। গেরিলা যোদ্ধারা পাকসেনাদের সমস্ত রসদ দখল করে। ৪নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের একটি দলকে রসদ নিয়ে বড়াইল ক্যাম্পের দিকে যাবার পথে অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে ২ জন পাকসেনা নিহত হয়।
সিলেটে কুমারশৈলের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের উপর পাকবাহিনী হামলা চালায়। ১ ঘন্টাব্যাপী হামলায় বেশকয়েকটি মুক্তিযোদ্ধা বাঙ্কার ধ্বংস হয়।
খুলনা পাইকগাছা থানার গরুইখালী গ্রামে রাজাকারদের একটি দল টহল দিতে এলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ঘিরে ফেলে। ফলে উপায়ান্তর না দেখে রাজাকারদের পুরো দলটি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পন করে।
৬নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনী কমান্ডার মোত্তালিব ও কমান্ডার এস এম ফারুকের নেতৃত্বে হিলিতে পাকসেনাদের সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ আক্রমণে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আসাম রেজিমেন্ট ও বিএসএফ গোলন্দাজ ইউনিট সহায়তা করে। আড়াই ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার মোত্তালিব মর্টারের গোলায় আহত হন। এ আক্রমণে মাইনের সাহায্যে হিলি রেলওয়ের কিছু অংশ ধ্বংস হয়।
মুক্তিবাহিনী ময়মনসিংহের গফরগাঁও এলাকায় পাকসেনাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। এই সংঘর্ষে ২ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী মর্টারের সাহায্যে নওয়াবগঞ্জ থানায় পাকসেনাদের রামচন্দ্রপুর ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়। এতে পাকবাহিনীর ৭ সেনা নিহত হয়।
পাকবাহিনী নদীপথে নওয়াবগঞ্জ যাবার সময় দুইবার পর্যুদস্ত হবার পর পদব্রজে নওয়াবগঞ্জ অভিমুখে অগ্রসর হলে ৫০ জন গেরিলার একটি শক্তিশালী মুক্তিযোদ্ধা দল গালিমপুরের কাছে পাকসেনাদের আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ ৩৫ জন সৈন্য নিহত এবং অনেক আহত হয়। বাকি পাকসেনারা ছাত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর ১টি এলএমজি, ৩টি ষ্টেনগান, বেশকিছু রাইফেল ও প্রচুর গোলাবারুদ দখল করে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বক্তৃতাকালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বাংলাদেশের পরিস্থিতি উল্লেখ করে ভারতে অবস্থানকারী শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটি মীমাংসায় আসার জন্য পাকিস্তানিদের প্রতি আহ্বান জানান।
মওলানা এম এ মান্নানের নেতৃত্বে মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির একটি প্রতিনিধি দল ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে দেখা করে তাকে একটি কোরআন উপহার দিয়ে বলেন, পাকিস্তানি নিরাপত্তার জন্য ওলামা ও মাদ্রাসা শিক্ষকরা রাষ্ট্রবিরোধীদের উৎখাতে লে. জেনারেল নিয়াজীকে পূর্ণ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।