৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ এই দিনে

এদিন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে আসা বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের প্রধান ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাঈদ চৌধুরী পিটিআইকে এক সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, প্রতিটি দেশেরই এখন শরণার্থী সমস্যা ও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে এগিয়ে আসা উচিত। এখানে স্বার্থের খোঁজ না করে মানবিকতার খাতিরেই এগিয়ে আসা উচিত। এক্ষেত্রে জাতিসংঘকেই প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে। আজ বাংলাদেশকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চলছে। অথচ কিছু দেশ এখনো অব্যাহতভাবে গণহত্যা, নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরেও পাকিস্তানকে সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়েই যাচ্ছে। এটি দুঃখজনক। বাংলাদেশ এখন স্বতন্ত্র। বাংলাদেশের মানুষের এখন একমাত্র লক্ষ্যই বিজয় অর্জন করা।'

ঢাকায় এদিন

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এ এম মালিক রেডিও পাকিস্তানে ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটি বিশেষ অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গভর্নর বলেন, 'ছাত্রদের কোনো ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপে অংশ না নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে হবে। দেশ এক সংকটময় সময় অতিবাহিত করছে এই সঙ্কটকালীন সময়ে ছাত্রদের এগিয়ে আসতে হবে। ভবিষ্যৎ নেতৃত্বর জন্য ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। যদি কোনো ছাত্রকে দেশদ্রোহী কার্যকলাপে অংশ নিতে দেখা যায় তবে তাদের শাস্তির মুখোমুখি করা হবে।'

২৬ সেপ্টেম্বর গোপীবাগে পাকিস্তান মুসলিম লীগের ঢাকা জেলার সভাপতি মোহাম্মদ হোসেনের বাসভবনে হামলা চালায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা। এসময় গেরিলা ও বাড়ির পাহারাদারদের সঙ্গে গোলাগুলি হয়।

ভারতে এদিন

২৬ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে 'নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বৈপ্লবিক মতবাদ ও বাংলাদেশ' এক আলোচনা সভার প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাবে বলা হয় 'বাংলাদেশ বিষয়ক আলোচনার জন্য এশীয় দেশগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো উচিত। বিশেষ করে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করা চীন ও ইরানকে। সেখানে শেখ মুজিবের মুক্তির বিষয়টিও তুলে ধরা হোক। এতে করে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম বিশ্বব্যাপী জোরদার হবে।

২৬ সেপ্টেম্বর ভারতের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড বিসিসিআইয়ের বার্ষিক সভায় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে মুক্তিসংগ্রামের সাহায্যে বিসিসিআই একাদশ চারটি চ্যারিটি ম্যাচ খেলবে হবে সিদ্ধান্ত হয়। সভায় একই সঙ্গে ২৬ সেপ্টেম্বর সর্বভারতীয় কিষান সভার ২১তম বার্ষিক অধিবেশনের প্রস্তাবে সোভিয়েত চুক্তির বিষয়ে অনুধাবন করার আহবান জানানো হয়। এতে বলা হয় ভারত সোভিয়েত চুক্তির পর আর কোনো ধরনের সংকোচ থাকা উচিত নয়। কারণ এই চুক্তির ফলে ভারত এবং সোভিয়েত নিজেদের সমর্থন প্রকাশ করেছে মুক্তিসংগ্রামের প্রতি।

পাকিস্তানে এদিন

২৬ সেপ্টেম্বর করাচিতে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কাউন্সিল অধিবেশনে উত্থাপিত এক প্রস্তাবে বলা হয় অতিসত্বর শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হোক। পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা ও নিপীড়ন বন্ধ হোক। শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তিনিই নির্বাচিত হতেন। অথচ নির্বাচনে নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি। এটি সম্পূর্ণরূপে তার প্রতি ও পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রতি অবিচার। পূর্ব পাকিস্তানে কী হচ্ছে তা সমস্ত পৃথিবীর মানুষ দেখছে। ওখানে কী ধরনের বর্বরতা চলছে। এটি আমাদের পাকিস্তানি হিসেবেও চূড়ান্ত লজ্জাজনক।'

২৬ সেপ্টেম্বর সারগোদায় জমিয়তে উলামা ইসলামের সংবাদ সম্মেলনে দলটির সাধারণ সম্পাদক মুফতি মাহমুদ বলেন, 'উপনির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য অবিলম্বে রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হোক এবং পশ্চিম পাকিস্তানে সেনা শাসন সরিয়ে বেসামরিক সরকার গঠন করা হোক। নয়তো শান্তির আশা করা যায় না। একমাত্র গণতন্ত্র পুনর্বহালের মধ্য দিয়ে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ 

২৬ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে ২নং সেক্টরে ২৫০ সৈন্য ও রাজাকারদের একটি দল রামগঞ্জ বাজারের দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনীর ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল রামগঞ্জ বাজারের পূর্বদিকে অবস্থান নেয়। পরে হানাদার সৈন্য ও রাজাকারদের দলটি অগ্রসর হওয়ার সময় তাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায় মুক্তিবাহিনীর দলটি। এই হামলায় ২০ হানাদার সেনা ও রাজাকার নিহত হয় এবং ২৭ জন আহত হয়।

২৬ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জে মুক্তিবাহিনী রায়চন্দ্রপুরের মধুমতী নদীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর খাদ্য ও অস্ত্র বোঝাই ৪টি নৌকার উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দুটি নৌকা ডুবে যায়। ১৫ জন রাজাকার ও ২ জন পাঞ্জাবি পুলিশ নিহত হয়।

২৬ সেপ্টেম্বর ৪নং সেক্টরে মৌলভীবাজারের বড়লেখায় মুক্তিবাহিনীর ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল কুমারসাইলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর হামলা চালায়। এসময় দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টা যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী নিজেদের ক্যাম্পে ফিরে যায়। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৯ জন সৈন্য নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।

২৬ সেপ্টেম্বর ৮নং সেক্টরের বানপুর সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দত্তনগর ঘাঁটি আক্রমণ করে। এসময় হানাদার বাহিনীর ২ সৈন্য নিহত হয় এবং ২ জন আহত হয়।

২৬ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দলের উপর  অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর দলটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় এবং সবাই নিহত হয়।

 

২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: দেশের বিভিন্ন জায়গায় গেরিলাদের আক্রমণে বহু পাকসেনা নিহত

 

 
৮ নম্বর সেক্টরের বানপুর সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর এক প্লাটুন যোদ্ধা পাকবাহিনীর ওপর দত্তনগর ঘাঁটি আক্রমণ করে। ফাইল ছবি

৮ নম্বর সেক্টরের বানপুর সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর এক প্লাটুন যোদ্ধা পাকবাহিনীর ওপর দত্তনগর ঘাঁটি আক্রমণ করে। ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল আজকের মতোই রবিবার। আগের দুইদিন অর্থাৎ ২৪-২৫ সেপ্টেম্বরের যুদ্ধে এম এল পয়েন্টারের পাকসেনাদের পরিণতির পর পাকসেনারা আরেকটি লঞ্চে নওয়াবগঞ্জের দিকে অগ্রসর হলে গেরিলাদের আরেকটি দল এই লঞ্চের উপর আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা দ্রুত লঞ্চ ঘুরিয়ে চলে যায়।

১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল সিলেটের গুথুমার পাক বিওপি আক্রমণ করে। এতে ২ জন পাকসেনা নিহত হয়। এদিন দেবীপুরে এক গেরিলা অ্যামবুশে কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। ফেনী নদী তীরবর্তী আন্ধারমানিক বিওপিতে পাকসেনাদের রোল কল করার সময় গেরিলারা আক্রমণ করলে একজন জেসিওসহ কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়।

২ নম্বর সেক্টরে ২৫০ জন পাকসেনা ও রাজাকারদের একটি দল রামগঞ্জ বাজারের দিকে অগ্রসর হয়। এই খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনীর ৫০ জনের একটি দল রামগঞ্জ বাজারের পূর্বদিকে পাকসেনাদের জন্য অ্যামবুশ পাতে। পাকসেনা ও রাজাকারের দল অ্যামবুশের আওতায় এলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে ২০ জন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত এবং ২৭ জন আহত হয়।

৯ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা অঞ্চলে পাকসেনাদের উপর বিভিন্ন সময়ে বিক্ষিপ্ত আক্রমণে ৬টি লঞ্চ দখল করে নেয়। এই ৬টি লঞ্চে ৫০টি ব্রাউনিং অ্যান্টিএয়ারক্রাফট মেশিনগান ও প্রতি লঞ্চে এলএমজি ও বিভিন্ন অস্ত্রসহ ১০/১২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়োগ করা হয়। ফলে লঞ্চগুলি গানবোটের সমতুল্য হয়ে ওঠে। এ লঞ্চগুলো সক্রিয় হলে ৯ নম্বর সেক্টরে বিভিন্ন অঞ্চলে অস্ত্র ও রসদ পৌঁছানো এবং মুক্তাঞ্চলে টহল সহজ হয়। ফলে এ অঞ্চলে পাকসেনাদের দৌরাত্ম হ্রাস পায়।৪ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর ৬০ জন যোদ্ধার একটি দল কুমারশৈল চা বাগানে অবস্থানরত পাকসেনাদের বিরুদ্ধে এক অভিযান চালায়। এতে দু’পক্ষে আড়াই ঘণ্টা গোলা বিনিময় হয়। এই সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ৯ জন নিহত ও কয়েকজন আহত হয়।

৫ নম্বর সেক্টরের তামাবিল সাব-সেক্টর ব্রেভো কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে মো. রফিকুল আলম কোম্পানির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৮ নম্বর সেক্টরের বানপুর সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর এক প্লাটুন যোদ্ধা পাকবাহিনীর ওপর দত্তনগর ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ২ জন নিহত ও ২ জন আহত হয়। ঢাকার গোপীবাগে শহর মুসলিম লীগ সভাপতি মোহাম্মদ হোসেনের বাসভবনে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা আক্রমণ চালায়। এতে পাহারাদারদের সঙ্গে গেরিলাদের প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। তবে কোনো হতাহত হয়নি।

মুক্তিবাহিনী গোপালগঞ্জ মহকুমার রায়চন্দ্রপুর মধুমতী নদীতে পাকিস্তানীদের খাদ্য ও অস্ত্র বোঝাই ৪টি নৌকার ওপর দুঃসাহসিক অভিযান চালায়। এই অভিযানে পাকবাহিনীর দুটি নৌকা ডুবে যায় এবং ১৫ জন রাজাকার ও ২ জন পাঞ্জাবী পুলিশ নিহত হয়। রাজশাহী সীমান্তে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একটি দলকে অতর্কিতে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকসেনা দলের সকলেই নিহত হয়।
রাজশাহীর ২ নম্বর সেকশনের মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব ক্যাডেট কলেজের কাছে ২টি বিদ্যুৎ পাইলন উড়িয়ে দেন।

গভর্নর ড. এ এম মালিক মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রচারণা চালানোর উদ্দেশ্যে রেডিও পাকিস্তানে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গভর্নর ছাত্রদের কোন ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপে অংশ না নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান।

জামায়াতে ইসলামীর একটি দল লন্ডন সফর করে। সেখানে এক সভায় সফরকারী জামায়াতে নেতা মওলানা খলিল বলেন, পৃথিবীর কোন শক্তি নেই পাকিস্তানকে বিভক্ত করে। অপর নেতা মওলানা হামিদী স্বাধীনতা সংগ্রামকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বলেন, তথাকথিত বাংলাদেশের কোন অস্তিত্ব নেই।

জমিয়তে উলামা ইসলাম (হাজারভি) এর সাধারণ সম্পাদক মুফতি মাহমুদ পশ্চিম পাকিস্তানের সারগোদায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে উপ-নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য অবিলম্বে রাজনীতির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহবান জানান। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে গঠিত মন্ত্রীসভা অবৈধ আখ্যা দিয়ে তা বাতিলের দাবি জানান। তিনি বলেন এই মন্ত্রীসভা আসন্ন উপ-নির্বাচন প্রভাবিত করবে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে বেসামরিক সরকার গঠনের দাবি জানান। তার দলের পশ্চিম পাকিস্তান সাধারণ সম্পাদক গাউস হাজারভিও বলেন রাজাকার বাহিনীতে শুধু জামাতের লোক নেয়া হয়েছে। তিনি এই বাহিনীতে অন্যান্য দলের কর্মী নেয়ার দাবী জানান।