২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ এই দিনে
এদিন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে দেখা করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং।
সরদার শরণ সিং জাতিসংঘ মহাসচিবকে বলেন, `বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান ভারত একা করতে পারবে না। সবারই উচিৎ শরণার্থী সমস্যার ব্যাপারে এগিয়ে আসা এবং এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা। শরণার্থী সমস্যা নিরসন কেবল ভারতের একার দায়িত্ব না। পাকিস্তান নিজেরা এই সমস্যার পেছনে কলকাঠি নেড়ে শরণার্থী সমস্যার সৃষ্টি করেছে। মানুষ প্রাণে বাঁচতে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'যতক্ষণ পর্যন্ত পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না করা হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান হবে না। সমাধান আসুক, পাকিস্তান আসলে এটা চায় না। নয়তো বারবার ভারতকে অহেতুক দোষারোপ করে এবং মিথ্যাচার রটাতে পারতো না।'
ঢাকায় এদিন
১৯৭১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) সভাপতি নুরুল আমিন বলেন, 'বেআইনি আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়া হলে পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর কার্যক্রমের যৌক্তিকতাকেই নস্যাৎ করা হবে।'
একই দিনে পূর্ব পাকিস্তানের একজন সরকারি মুখপাত্র বলেন, 'গঙ্গা ব-দ্বীপের চালনায় একটি মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়েছে। জাহাজটি পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য সামগ্রী নিয়ে এসেছিল। সম্প্রতিকালে একটি ব্রিটিশ জাহাজও চালনা বন্দরে বোমা বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অবস্থা যথেষ্ট গুরুত্বের দাবিদার।'
সেপ্টেম্বরের ২৪ তারিখে ঢাকায় নবনিযুক্ত মন্ত্রীদের সংবর্ধনা দেয় তেজগাঁও শান্তি কমিটি। জামায়াতে ইসলামীর ডেপুটি আমির মাওলানা আবদুর রহিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় আব্বাস আলী খান, মওলানা এ কে এম ইউসুফ, আখতার উদ্দিন আহমদ, মওলানা ইসহাক ও অং শৈ প্রু চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত হন। সভায় মন্ত্রীদের উদ্দেশে মানপত্র পাঠ করেন তেজগাঁও শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান।
২৪ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর বৈঠক আহ্বান করেন। ২ অক্টোবর নাখালপাড়ায় জামায়াতের প্রাদেশিক কার্যালয়ে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে এবং বৈঠকে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, উপনির্বাচন এবং পার্টি-কর্মীদের করণীয় নিয়ে আলোচনা করা হবে বলে জানানো হয়।
আন্তর্জাতিক মহলে এ দিন
২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সদস্য মওলানা এ টি সাদী বলেন, 'বিচ্ছিন্নতার কারণে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ছিল অনিবার্য। দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে যেটুকু না করলে নয়, সেনাবাহিনী তাই করছে। বাংলাদেশ আন্দোলন হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।'
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
২৪ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি শক্তিশালী দল ১৭টি নৌকায় মুক্তিবাহিনীর রেইডিং দলকে আক্রমণ করার জন্য নবীনগরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় বিদ্যাকোর্ট গ্রামের কাছে পৌঁছালে মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদার বাহিনীর নৌকাগুলোর ওপর আক্রমণ করে। এ সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পাঁচটি নৌকা ডুবে যায়, ২৫ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয় এবং ৩৫ জন আহত হয়।
২৪ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে মুক্তিযোদ্ধারা সিন্দরখান-কলেঙ্গা রাস্তার ওপর ছোট ছোট পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে বাঙ্কার খনন করে হানাদারদের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকে। এদিন দুপুরে হানাদার বাহিনীর একটি বড় দল ২০-২৫ জন রাজাকারকে সামনে দিয়ে কালেঙ্গার দিকে অগ্রসর হয়। এক পর্যায়ে রাজাকার ও হানাদারেরা অ্যামবুশ এলাকার মধ্যে ঢুকে গেলে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা আক্রমণ করে। আচমকা ভয়াবহ আক্রমণে দিশেহারা হয়ে ঘটনাস্থলেই বহু হানাদার সেনা নিহত হয়। এক পর্যায়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে হানাদার সেনারা। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর হামলার সামনে হানাদার বাহিনীর প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে তারা পালাতে শুরু করে। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর এক অফিসারসহ ৬১ জন সেনা নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। অন্যদিকে, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান শহীদ হন।
২৪ সেপ্টেম্বর ৩ নম্বর সেক্টরের ধর্মঘরে মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন ভুঁইয়ার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দলের ওপর আক্রমণ চালায়। হানাদার বাহিনী এ সময় তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে লেফটেন্যান্ট হেলাল মুর্শেদের কোম্পানি বাম দিকের ফ্ল্যাঙ্ক প্রোটেকশনে এবং ক্যাপ্টেন নাসিমের কোম্পানি ডান দিকে ফ্ল্যাঙ্ক প্রোটেকশনে অবস্থান নিয়ে ক্যাপ্টেন ভুঁইয়ার মুক্তিযোদ্ধা দলকে সাহায্য করেন। হানাদার বাহিনী এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে দিশেহারা হয়ে পিছু হটে যায়। এই যুদ্ধে ১০ হানাদার সৈন্য নিহত হয়।
২৪ সেপ্টেম্বর চার নম্বর সেক্টরের খড়মপুরে মুক্তিবাহিনীর ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল খড়মপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৪০ জনের একটি দলের ওপর আক্রমণ চালায়। এ সময় হানাদার বাহিনী ও তিন ইঞ্চি মর্টার, এমজি ও এলএমজির সাহায্যে পাল্টা আক্রমণ গড়ে তুললে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হানাদার বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ সময় পাঁচ হানাদার সৈন্য নিহত হয় এবং ১০ জন আহত হয়।
২৪ সেপ্টেম্বর ৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এক প্লাটুন সৈন্যকে অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে চার জন হানাদার সৈন্য নিহত ও দুজন আহত হয়। এদিন বিকেলে মুক্তিযোদ্ধারা একই জায়গায় এক প্লাটুন হানাদার সৈন্যকে আবারও অ্যামবুশ করে। এ সময় চার জন হানাদার সেনা নিহত হয়।