২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ এই দিনে
এদিন ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সে দেয়া এক বক্তৃতায় ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হোম বলেন, 'নিউইয়র্ক সফরকালে আমাদের সঙ্গে জাতিসংঘের মহাসচিব ও বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করার কথা রয়েছে। এই বৈঠকে আমাদের পূর্ব বাংলার ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হবে। আমরা রাজনৈতিক সমাধানের উপরে জোর দিচ্ছি। আশা করছি ভালো কোনো সমাধান আসবে।'
২৩ সেপ্টেম্বর উল্লেখ করে ২৪ সেপ্টেম্বর দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় 'বাংলাদেশের ব্যাপারে কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের চৈতন্যোদয়' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, 'কয়েকটি আরব রাষ্ট্র গোপন কূটনীতিতে লিপ্ত হয়েছে এবং পূর্ব বাংলায় নিরপরাধ অসামরিক নাগরিকদের হত্যা করা থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের নিরস্ত্র করার জন্য 'গোপনে' পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে চিঠি লিখেছে। মিশরের সরকারি দৈনিক আল আহরমের' একজন জ্যেষ্ঠ সম্পাদক ড. ক্লোভিস মাকসুদ এ কথা জানান।'
ভারতে এদিন
২৩ সেপ্টেম্বর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র সাংবাদিকদের বলেন, 'পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় রাজ্যের শরণার্থী শিবিরগুলোতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ভারতবিরোধী প্রচারণায় বাংলাদেশ সরকার ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার উদ্বিগ্ন। এ বিষয়ে মুজিবনগর ও কলকাতার সরকারি সূত্রে জানা যায়, কোনো কোনো বিদেশি রাষ্ট্র পাকিস্তানের হয়ে ভারতীয়দের মাধ্যমে অপপ্রচার চালাচ্ছে। কয়েকটি সেবাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা নানা কার্যক্রমের আড়ালে শরণার্থীদের অর্থের প্রলোভন দেখাচ্ছে।'
২৩ সেপ্টেম্বর দিল্লির পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মী এস এম নুরুল হুদা পাকিস্তান দূতাবাস থেকে পদত্যাগ করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন।
২৩ সেপ্টেম্বর জলন্ধরে এক সংবাদ সম্মেলনে ভিয়েতনামের কনসাল জেনারেল গুয়েন অ্যান ভু বলেন, 'বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি ভিয়েতনাম সরকারের পূর্ণ সমর্থন আছে। মার্কিন সরকার ও তাদের মিত্ররা গোটা বিশ্বে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।'
পাকিস্তানে এদিন
২৩ সেপ্টেম্বর গেজেট অব পাকিস্তান ঘোষণায় বলা হয়, 'পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ইয়াহিয়া খান স্বীয় ক্ষমতাবলে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের ৮ জন অফিসারকে বরখাস্ত করেছেন। গেজেট অব পাকিস্তানে উল্লেখিত সেই আট জন অফিসারের নাম ও বরখাস্তের তারিখ প্রকাশিত হয়। এ এম আবদুল ফতেহ (১৯- ৮- ১৯৭১), এম হোসেন আলী (১৭- ৪ - ১৯৭১), এস এ করিম (৪- ৮- ১৯৭১), এনায়েত করিম (৪ - ৮- ১৯৭১), এস এ এম এস কিবরিয়া (৪- ৮- ১৯৭১), এস মোয়াজ্জেম আলী (৪ - ৮- ১৯৭১), মহিউদ্দিন আহমদ (১- ৮- ১৯৭১) ও আনোয়ারুল করিম চৌধুরী (১৭- ৪- ১৯৭১)।'
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
২৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে নাইজার, জর্ডান, ইন্দোনেশিয়া প্রতিনিধিদলের কাছে এক ঘরোয়া আলোচনায় পূর্ব পাকিস্তানের গোলযোগের বিশদ বর্ণনা দেন পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি মাহমুদ আলী মাহমুদ আলী। এসময় তিনি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারত যাতে হস্তক্ষেপ না করে তা ভারতকে বোঝানোর জন্য তাদের অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, 'সোভিয়েত-ভারত সামরিক চুক্তির পর ভারত নিরপেক্ষ দেশের মর্যাদা হারাইয়াছে ফলে জোট নিরপেক্ষ ভুক্ত দেশগুলির উচিত ভারত হইতে দূরে থাকা।'
২৩ সেপ্টেম্বর মার্কিন সিনেটে শরণার্থীসংক্রান্ত উপকমিটির চেয়ারম্যান প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি সিনেটর শরণার্থীদের জন্য ৩০০ কোটি রুপির বিল পেশ করেন। এই বিলের প্রস্তাবে এডওয়ার্ড কেনেডি বলেন, 'শরণার্থীদের প্রতি এগিয়ে আসা মানবিক প্রয়োজন। পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের দিকে না তাকালে বোঝা যাবে না এখনো বিশ্বে কতোটা অসহায় মানুষ কেবল প্রাণ বাঁচাতে কতোটা আশ্রয় প্রত্যাশী।'
২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভারত সরকার 'বাংলাদেশ প্রশ্ন' উত্থাপনের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
২৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের ভোজসভার আয়োজন করে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই সভায় জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট, সাধারণ পরিষদের সভাপতি ইন্দোনেশিয়ার আদম মালিক, সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকোসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
২৩ সেপ্টেম্বর আসন্ন ইন্দিরা গান্ধীর সোভিয়েত ইউনিয়নের সফরের প্রস্তুতির জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান ডিপি ধর মস্কোতে পৌঁছান। এদিন ডিপি ধর সোভিয়েত সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফিরুবিনের সঙ্গে বৈঠক করেন।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
২৩ সেপ্টেম্বর ফেনীর ছাগলনাইয়ার বল্লভপুর ও চম্পকনগরে রাত সাড় ৩টার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানের উপর মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি কোম্পানী ব্যাপক আর্টিলারি আক্রমণ চালায়। জবাবে হানাদার বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি কোম্পানির ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ সময় একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ২ মুক্তিযোদ্ধা আহত হন ও ১ জন ভারতীয় সৈনিক আহত হন।
২৩ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বাতিসা ইউনিয়নের লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা ও ১৬ জন গেরিলা মর্টার ও রকেট লাঞ্চারের সাহায্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গোবিন্দমাণিক্য দিঘী ঘাঁটির ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদারদের ঘাঁটির কয়েকটি বাঙ্কার ধ্বংস হয় এবং ১৫ জন হানাদার সেনা নিহত হয় ও ১০ জন আহত হয়। প্রায় এক ঘণ্টা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের অবস্থানে নিরাপদে ফিরে আসেন।
২৩ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচলের পথ উন্মুক্ত রাখতে ১০/১২টি রেইডিং পার্টি আক্রমণে যায়। এসময় প্রায় ২০টি পাক অবস্থানে রেইডিং পার্টির আক্রমণে বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা হতাহত এবং একটি গাড়ি ধ্বংস হয়।
২৩ সেপ্টেম্বর জয়পুরের পাঁচবিবিতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুললে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হানাদার বাহিনীর ব্যাপক যুদ্ধ হয়। কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী পিছু হটে। এই যুদ্ধে ৬ জন হানাদার সেনা ও ২ রাজাকার নিহত হয়।
২৩ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজারের কুমারসাইল চা বাগানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল। এসময় ৮ জন হানাদার সেনা নিহত হয় এবং ১০ জন আহত হয়। এদিন মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দল কুমারসাইল চাবাগানের রাস্তায় অ্যামবুশ থেকে হানাদারদের রেঞ্জারদের উপর আক্রমণ করলে ২ রেঞ্জার নিহত হয়। এরপর পালানোর সময় মুক্তিযোদ্ধাদের মাইন ফিল্ডে ঢুকে পড়লে বেশ ক'জন রেঞ্জার আহত হয়।
২৩ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপুর থেকে রামগঞ্জে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি বহরে হামলা চালায় মুক্তিবাহিনী। এসময় হামলায় ২২ হানাদার সেনা নিহত হয় এবং ২৫ জন আহত হয়।
২৩ সেপ্টেম্বর মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল দৌলতপুর থানায় আক্রমণ করে। এসময় মুক্তিবাহিনী ৭৫ জন পুলিশ ও রাজাকারদের বন্দি করে সমস্ত অস্ত্র গোলাবারুদ ও রসদ নিজেদের দখলে নেয়।
২৩ সেপ্টেম্বর পশ্চিম দেবীপুরে হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল। এসময় অ্যামবুশে ২ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।