২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ এই দিনে
এদিন নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ৫ প্রতিনিধি এরই মধ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দেওয়ার জন্য নিউইয়র্ক পৌঁছান।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দেওয়ার জন্য প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ১৬ সদস্যের প্রতিনিধি দলের মধ্যে বাকি ১১ প্রতিনিধি এদিন নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে দিল্লি ত্যাগ করেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের নেতৃত্ব দেন ব্রিটেনে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত এবং লন্ডনস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রধান আবু সাঈদ চৌধুরী। বাংলাদেশ সীমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক নিযুক্তির প্রস্তাব, গণহত্যা, নিপীড়ন ও মানবতাবিরোধী কার্যক্রম বন্ধ ও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে যৌক্তিকতা নিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব তুলবেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা।
ঢাকায় এদিন
২১ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশন ইতোপূর্বের ঘোষিত সময়সূচি বাতিল করে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের শূন্য আসনে উপ-নির্বাচনের নতুন তারিখ ঘোষণা করে। পুনর্বিন্যাস্ত সময়সূচি অনুসারে ভোট গ্রহণ ১২ ডিসেম্বর শুরু হয়ে ২৩ ডিসেম্বর শেষ হবে।
ভারতে এদিন
২১ সেপ্টেম্বর হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় 'বিশ্বের প্রতি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান' শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'বাংলাদেশকে নিয়ে করা আন্তর্জাতিক সম্মেলনের পক্ষ থেকে বিশ্বের সব দেশের সরকারকে আজ আহ্বান জানানো হয়েছে বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দিতে এবং পশ্চিম পাকিস্তানি জান্তার প্রতি সব ধরনের সামরিক সাহায্য বন্ধ করতে। এই সম্মেলনের এক প্রস্তাবে ঘোষণা করা হয় যে- বাংলাদেশের মানুষের এই রাজনৈতিক আন্দোলন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখতে হবে একটি জাতির মুক্তির আন্দোলন হিসেবে। বিশ্বের সকল সরকার ও জনগণের কাছে উদাত্ত আহ্বান জানানো হয় বাংলাদেশ তাৎক্ষণিক এবং কার্যকরী সহায়তা প্রদানের জন্য। উক্ত প্রস্তাবে বর্ণিত এই সাহায্য বলতে কোনো রাষ্ট্র বা ব্যক্তির জন্য এটা সামরিক সাহায্য হতে পারে আবার কারও জন্য হতে পারে অর্থনৈতিক এবং অহিংস সাহায্য।'
২১ সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে প্রকাশিত 'বাংলার বাণী' পত্রিকায় 'বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় কী দেখিলাম' শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'অতি সম্প্রতি 'বাংলার বাণী'-র একজন প্রতিনিধি বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা সফর করে ফিরে এসেছেন। সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের প্রতিনিধি যে বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন তারই শেষ অংশ এখানে ছাপা হল। অধিকৃত এলাকায় পাকসেনারা যথেচ্ছভাবে স্থানীয় অবাঙালী কুলি-কামিন এবং চোর-ডাকাত, গুন্ডা-বদমায়েশদের নিয়ে বদর, রাজাকার ও মুজাহিদ বাহিনী গঠন করছে। তাদের সঙ্গে কিছু মুসলিম লীগ ও জামায়াতের গুন্ডা-পান্ডাও যুক্ত হয়েছে। তারা পাকবাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় যে ঘৃণ্য কেলেঙ্কারির ইতিহাস সৃষ্টি করছে তা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না।'
২১ সেপ্টেম্বর কলকাতায় শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের আগে এক সংবাদ সম্মেলনে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা ও হাউজ অব কমন্সের এমপি ফ্রেড ইভান্স বলেন, 'শরণার্থীরা কোন অবস্থা থেকে পালিয়ে এসেছেন তা কল্পনারও অতীত। তবে আমরা আশা করছি ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে স্বীকৃতি দেবে। কারণ এরই মধ্যে ব্রিটিশ গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশের পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে। ব্রিটিশ সরকার যেন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন করে এই জন্য আমরা এরই মধ্যে হাউজ অব কমেন্সের ২২০ জন এমপির স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে পেরেছি। আশা করছি তা ৩০০ ছাড়িয়ে যাবে।'
পাকিস্তানে এদিন
২১ সেপ্টেম্বর লাহোরে এক সমাবেশে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান নুরুল আমিন বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি ভালোর দিকেই যাচ্ছে মনে হয় এবং আশার আলো দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, দেশের দুই অংশকে এক রাখা কেবল গণতন্ত্রের মাধ্যমেই সম্ভব, তা সামরিক সরকারের জন্য কোনোভাবেই সম্ভব নয়।'
এদিন করাচি বিমানবন্দরে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রার আগে নূরুল আমিন সাংবাদিকদের বলেন, 'পাকিস্তানের সংহতি ও অখন্ডতা সম্পর্কে নতুন আস্থা নিয়ে দেশে ফিরে যাচ্ছি।'
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
২১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ৭৪টি জোটনিরপেক্ষ দেশের সরকারের প্রতিনিধিদল একটি খসড়া ইশতেহার তৈরি করে। এতে শরণার্থী সমস্যাকে মানবিক সমস্যা হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। বলা হয় বাস্তুচুত শরণার্থীরা যেন নিরাপদভাবে স্বদেশে ফিরে যেতে পারে তার জন্য নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর জোট নিরপেক্ষ দেশগুলোর পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের সম্মেলনে এটি তুলে ধরা হবে।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
২১ সেপ্টেম্বর মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের বল্লা গ্রামে রাজাকারদের সহযোগিতায় হানাদার বাহিনীর একটি দল লুটপাট করতে এলে গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উপর হামলা চালায়। এসময় ২ হানাদার সৈন্য নিহত হয়। বাকিরা পালিয়ে ক্যাম্পে ফিরে যায়। পরে এদিন হানাদারদের বড় একটি দল গ্রামে প্রবেশ করে পৈশাচিক নির্যাতনের পর ১৬ নিরীহ গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে।
২১ সেপ্টেম্বর কুমিল্লায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৩৩ বেলুচের 'বি' এবং 'ডি' কোম্পানি মেজর দুররানির নেতৃত্বে চাঁদলা থেকে নৌকায় করে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে আক্রমণের উদ্দেশ্যে মন্দভাগের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় এ খবর পেয়ে সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা মন্দভাগ শালদা নদী এলাকায় অবস্থান নেয়। এসময় আরও দুটি দল গ্রামের ডান এবং বাম দিকে অবস্থান নেয়। এদিন রাত একটার সময় হানাদার সৈন্যরা মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যূহের কাছে পৌঁছলে ক্যাপ্টেন গাফফারের দল তাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। প্রায় ৬ ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ ২৬ জন হানাদার সৈন্য নিহত ও অনেকে আহত হয়। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিজেদের দখলে নেয়।
২১ সেপ্টেম্বর কুড়িগ্রামের রৌমারীতে মুক্তিবাহিনীর সি' কোম্পানির একটি প্লাটুন লেফটেন্যান্ট কাইয়ূম চৌধুরীর নেতৃত্বে রৌমারীর চর কোদালকাটিতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এদিন হানাদারবাহিনীর দুই কোম্পানি সৈন্য মর্টারের সাহায্যে মুক্তিবাহিনীর চরকোদাল ঘাঁটি আক্রমণ করলে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা দুর্ধর্ষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী পিছু হটে। এই যুদ্ধে প্রায় ৩৫ হানাদার সৈন্য নিহত হয়।
২১ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের ভালুকা ঘাঁটি থেকে প্রায় ৪০০ রাজাকার ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল ৪ ভাগে ভাগ হয়ে বড়াইদ এলাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এদিকে বড়াইদ গ্রামে আফসার ব্যাটালিয়নের কোম্পানির হেডকোয়ার্টার। হানাদারদের আসার খবর পেয়ে আফসার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার মোমতাজউদ্দিন খান, প্লাটুন কমান্ডার সামছুদ্দিন, মনির উদ্দিন, মো. মোতালিব মাস্টার ও হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে হানাদার বাহিনীর ৪টি রাস্তা প্রতিরোধ করে। দীর্ঘ ৪ ঘণ্টা গুলিবিনিময়ের পর হানাদার বাহিনী ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে ১৪ জন পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য নিহত হয়।
২১ সেপ্টেম্বর ২নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর ২০০ গেরিলার একটি দল পালং থানায় অবস্থানরত হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। প্রায় ৪ ঘণ্টা সম্মুখ যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনীর সদস্যরা ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে প্রায় ৫০ জন হানাদার সৈন্য, রাজাকার ও হানাদার পুলিশ নিহত হয়। যুদ্ধ শেষে মুক্তিবাহিনী পালং থানা নিজেদের দখলে নেয়।
২১ সেপ্টেম্বর সিলেটের গোবিন্দগঞ্জ গ্রামে মুক্তিবাহিনীর একটি দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গোবিন্দগঞ্জ গ্রামের চারপাশে ফাঁদ পাতে। এদিন সকালে ৩ জন হানাদার সেনাসহ রাজাকারদের একটি দল নৌকাযোগে ওই গ্রামে এসে একজন রাজাকার রেকি করতে গ্রামে প্রবেশ করলে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। এসময় মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে বাকি সৈন্যরা নৌকা নিয়ে পালিয়ে যায়।
২১ সেপ্টেম্বর সিলেটের কুমারশৈল চাবাগানে মুক্তিযোদ্ধাদের পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে বেশ কজন হানাদার সেনা নিহত হয়।
২১ সেপ্টেম্বর বরগুনার পাথরঘাটায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এই হামলায় ৫ হানাদার সেনা নিহত হয় এবং ৩ জন আহত হয়।