১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ এই দিনে
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৯ সেপ্টেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন দিল্লিতে ৩ দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ২৫ দেশের প্রতিনিধিরা উত্থাপিত প্রস্তাবে বলেন, বাংলাদেশের জনগণের যে দাবি সেই দাবিই আমরা আমাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তুলে ধরবো জাতিসংঘে। সম্মেলনে গঠিত কমিশন এবং প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এদিন সম্মেলনে উপস্থিত ৪৫টি দেশের প্রতিনিধিদের বিভিন্ন কমিশনে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। একটি প্রস্তাবে বেশ কয়েকজন কমিশন সদস্য বলেন, 'কমিশনের প্রধান স্যার সেনার্থ গুনবর্ধনের নেতৃত্বে আফগানিস্তানের কাবুল থেকে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি পর্যন্ত একটি পদযাত্রার ব্যবস্থা করা হোক।'
দ্বিতীয় একটি প্রস্তাব প্রতিনিধিদের মাধ্যমে উত্থাপিত হয়। সিদ্ধান্ত হয় বেশ কয়েকজন প্রতিনিধি ডেনমার্কের এমপি নিয়েলসনের নেতৃত্বে শিগগির বাংলাদেশে যাবেন এবং স্বচক্ষে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন দেবেন। এদিন সম্মেলনের আরেকটি প্রস্তাবে বলা হয় কমিশনের সদস্যরা পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করবেন এবং শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদন দেবেন।
পাকিস্তানে এদিন
১৯ সেপ্টেম্বর করাচিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের উদ্দেশ্যে নিউইয়র্ক যাওয়ার আগে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি মাহমুদ আলী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালিয়েছে বলে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কেননা প্রদেশে সেনাবাহিনীর তৎপরতা এমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি করেনি যার জন্য 'গণহত্যা' শব্দটি ব্যবহৃত হতে পারে।'
১৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করে, '১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ৭৮টি শূন্য আসনে এবং প্রাদেশিক পরিষদের ১০৫টি শূন্য আসনে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।'
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
১৯ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট এক বিবৃতিতে বলেন, 'এখন কেবল রাজনৈতিক সমাধান আসতে পারে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সমঝোতার মাধ্যমে। এজন্য সবাইকে নিয়ে বৈঠক করতে হবে। যদি কেউ আলোচনায় আসতে অসম্মতি জানায় তবে বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়। পাকিস্তান যদিও দাবি করছে এটি তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, আদতে তা নয়। এখন এটি আঞ্চলিক শান্তির জন্য যেমন হুমকি ঠিক একইভাবে পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া মানবিক বিপর্যয়কে আরও দীর্ঘায়িত করবে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। এদিকে আমরা দেখছি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আহবান করছেন। যদিও তা এই মুহূর্তে কতোটা বাস্তবসম্মত তা যথেষ্ট প্রশ্নের দাবি রাখে। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা এখনো স্বাভাবিক নয়। এই অঞ্চলের মানুষের দিকে তাকানো বিশ্বের সব মানবিক মানুষের দায়িত্ব। একই সঙ্গে পাকিস্তান সরকারকেও উদ্যোগ নিতে হবে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে। কারণ এই সমস্যার জন্য তারাই একমাত্র দায়ী। পরিস্থিতি অনুকূলে না আসা পর্যন্ত শরণার্থীরা নিজ দেশে ফিরবে না। কারণ তারা প্রাণ বাঁচাতেই ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। সব মিলিয়ে যদি আলোচনায় সবাই আসতে পারে তবে অধিকতর সহজ হবে।'
১৯ সেপ্টেম্বর বিবিসিতে প্রচারিত এক সংবাদে বলা হয়, 'জাতিসংঘ মহাসচিব উ' থান্ট ভারত উপমহাদেশের অবস্থা নিয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন, রাজনৈতিক মীমাংসা ব্যতীত পূর্ব পাকিস্তানের মৌলিক সমস্যার সমাধান হবে না। তিনি অপ্রতুল সাহায্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বিশ্ববাসীর কাছে আরও সাহায্যের আহ্বান জানান।'
দেশব্যাপী গণহত্যা
বান্দাইখাড়া গণহত্যা
১৯ সেপ্টেম্বর ভোরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল রাজাকারদের সহযোগিতায় নওগাঁর আত্রাইয়ের বান্দাইখাড়ায় গণহত্যা চালায়। এসময় শতাধিক নিরীহ মানুষ শহীদ হন।
এদিন ভোরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল রাজাকারদের সহযোগিতায় নৌকায় করে আত্রাই নদী পথে এসে বান্দাইখাড়া বাজারে নামে। এরপর বাজারে থাকা প্রায় ৩৫০ মানুষকে আটক করে বান্দাইখাড়া বাজারের পাশে একটি ফাঁকা জায়গায় এনে হাত পিছমোড়া অবস্থায় বেঁধে লাইন করে দাঁড় করায়। এরপর নারীদের পাশবিক নির্যাতন করে, ঘরবাড়ি লুটপাট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। হানাদার বাহিনীর ব্রাশফায়ারে শতাধিক নিরীহ মানুষ শহীদ হন। এসময় ভাগ্যক্রমে গুরুতর আহত অবস্থায় ৮ জন গ্রামবাসী প্রাণে বেঁচে যান।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
১৯ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপুরে রামগঞ্জ থেকে লক্ষ্মীপুরে ১০টি জিপে করে হানাদারদের আসার সংবাদ পেয়ে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারির নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল মীরগঞ্জ ও ফজলচাঁদ হাটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় হানাদার বাহিনী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গাড়ি থেকে নিচে নেমে আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে। প্রায় ৯ ঘণ্টা যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী পিছু হটে। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকজন সৈন্য নিহত হয়।
১৯ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বাতিসা ইউনিয়নে লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি মুক্তিযোদ্ধা দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশের গোবিন্দমানিক্যের দীঘি অবস্থানের ওপর দুর্ধর্ষ অভিযান চালায়। এসময় গোবিন্দমানিক্য দীঘি অবস্থানে পাকিস্তানি হানাদারদের দুটি বাঙ্কার ধ্বংস হলে বাঙ্কারের মধ্যে থাকা ৬ জন হানাদার সেনা নিহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর দলটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বাতিসা বাজার ঘাঁটি আক্রমণ করলে হানাদারদের ৬টি বাঙ্কার ধ্বংস হয় এবং ২০ জন হানাদার সেনা নিহত ও ১২ জন আহত হয়। অন্যদিকে দুই জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
১৯ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের ভালুকার রাজৈগ্রাম এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার লুটতরাজ চালানোর সময় আফসার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার চাঁন মিয়ার নেতৃত্বে আফসার বাহিনীর এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। এসময় ৭ হানাদার সেনা নিহত হয়। প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধের একপর্যায়ে হানাদার বাহিনী পিছু হটে পালিয়ে যায়। একই দিন ভালুকার পোনাশাইল এলাকায় চাঁন মিয়ার নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে রাজাকার ও হানাদারদের ব্যাপক গুলি বিনিময় হয়। এসময় দুই হানাদার সেনা নিহত হয়।
১৯ সেপ্টেম্বর ২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল মালোচিন বাজারে অবস্থানরত হানাদার পুলিশের একটি দলের উপর আক্রমণ চালায়। এই সময় ১৯ জন হানাদার পুলিশ নিহত ও ৩ জন আহত হয়।
১৯ সেপ্টেম্বর যশোরের বোয়ালিয়া বাজারের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যুহ আক্রমণ করলে রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। প্রায় ৪ দিন চলা এই যুদ্ধে ৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তিন গ্রামবাসী শহীদ হন। অন্যদিকে বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়।
১৯ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপুরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির ক্যাম্পে রকেট লঞ্চার দিয়ে হামলা চালালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দুটি বাঙ্কার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসময়ে বাঙ্কারের থাকা ২ হানাদার সেনা নিহত হয় এবং একজন আহত হয়।
১৯ সেপ্টেম্বর বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা কমান্ডার মীর মঞ্জুরুল হক সুফীর নেতৃত্বে তাজুরপাড়া গ্রামে প্রবেশকারী হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়। এসময় বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়।
১৯ সেপ্টেম্বর ৮ নম্বর সেক্টরের গোজাডাঙ্গা সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মোহাম্মদপুর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে হানাদার বাহিনীর একজন মেজরসহ ৬ জন সৈন্য নিহত হয়।
১৯ সেপ্টেম্বর দিনাজপুরের অমরখানায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। এসময় ৮ জন হানাদার সেনা নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।