১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ এই দিনে
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৬ সেপ্টেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তান সরকারের একজন মুখপাত্র জানান, নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সামরিক ট্রাইব্যুনালে গোপন বিচারের কাজ শেষ হয়েছে। শিগগিরই তাকে তার কৃতকর্মের সাজার মুখোমুখি হতে হবে।
এদিন মুজিবনগর থেকে ঐতিহাসিক ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্রদের মিছিলে পুলিশি হত্যাকাণ্ডের নবম বার্ষিকী উপলক্ষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে দেয়া এক ভাষণে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, '১৯৬২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বরই মূলত বাংলাদেশে একনায়কত্ব ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। দাবি আদায়ের জন্য আইয়ুবের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে যেভাবে ছাত্ররা গর্জে উঠেছিলেন রাজপথে তা স্বৈরাচারি আইয়ুবের সহ্য হয়নি। আইয়ুবের পতন যেভাবে হয়েছে ইয়াহিয়ার পতনও সেভাবেই হবে।'
১৬ সেপ্টেম্বর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, পররাষ্ট্র আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান ডিপি ধর। এসময়ে তাদের মধ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অবস্থান নিয়ে আলোচনা হয়।
পাকিস্তানে এদিন
১৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) প্রধান নূরুল আমিন সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের এক প্রতিনিধিকে বলেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আমন্ত্রণেই তার পশ্চিম পাকিস্তান সফর। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে আমরা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা করবো। পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা পরিস্থিতিরও অবনতি হয়েছে তার জন্য ত্রাণ সরবরাহের আবেদনও আমরা জানাবো। একই সঙ্গে দেশদ্রোহী মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় চর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কিভাবে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে পারে আমাদের সেনাবাহিনী সেই প্রসঙ্গ নিয়েও আলোচনা হবে। একই সঙ্গে শান্তি কমিটি ও রাজাকারেরা কীভাবে আরও সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে তা নিয়েও সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হবে।'
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
১৬ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ১৭তম কমনওয়েলথ সংসদীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ভারতের তামিলনাড়ু বিধানসভার স্পিকার কে এ মথিয়ানগন বলেন, 'বাংলাদেশে যে ধরনের নৃশংসতা চলমান রয়েছে তা বন্ধে কমনওয়েলথ দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। এটি কেবল মানবিক বিপর্যয়ই নয় বরং আঞ্চলিক শান্তির জন্যও হুমকি। যার প্রভাব এখন ভারতে চরমভাবে বিদ্যমান।'
১৬ সেপ্টেম্বর ডেনমার্ক প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অধিবেশনকে সামনে রেখে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে নির্বাচিত ডেনিশ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
দেশব্যাপী এদিন
১৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ নিয়াজী চট্টগ্রাম সফর করে রাঙ্গামাটিতে যান। সেখানে তাকে অভ্যর্থনা জানান চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়। এসময় ত্রিদিব রায় পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বাহিনী ও আদিবাসীদের কর্মকাণ্ড নিয়াজীর কাছে তুলে ধরেন।
১৬ সেপ্টেম্বর জামালপুরের ইসলামপুর থানা আলবদরের ইনচার্জ এবং জেলা শান্তি কমিটির প্রচার সম্পাদক মুহম্মদ আব্দুলবারী দৈনিক সংগ্রামে পত্রিকায় এক চিঠিতে লেখেন, 'জামালপুরে পাকিস্তানপন্থী ও ইসলামপন্থী ছাত্ররা আলবদর বাহিনী গঠন করে দুষ্কৃতকারীদের জামালপুর, শেরপুর, ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ ও নালিতাবাড়ি এলাকা থেকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।'
১৬ সেপ্টেম্বর খুলনা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক 'কালান্তর' পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'গত ১৫ দিনে খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার সাড়ে ৬৩ বর্গমাইল অঞ্চল থেকে মুক্তিবাহিনী খান সেনাদের হটিয়ে মুক্ত এলাকা স্থাপন করেছে।'
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
১৬ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কায়েমপুর ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ ও তুমুল যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ২০১ জন সৈন্য নিহত এবং ৮৩ জন আহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ৬ জন আহত হয়। যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পিছু হটে গেলে মুক্তিবাহিনী কায়েমপুর ঘাঁটি নিজেদের দখলে নেয়।
এদিন যশোরের বোয়ালীয়ার বেলেরডাঙ্গায় মুক্তিবাহিনীর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বেলেডাঙ্গা অবস্থানের উপর হামলা চালানোর বেশ কয়েকদিন পর টানা যুদ্ধে কোনো ফলাফল না দেখে এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে নিজেদের ক্যাম্পে ফিরে আসে।
১৬ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে সারদা পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ওপর মর্টার আক্রমণ চালায় মুক্তিযোদ্ধারা। এসময় পুলিশ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অবস্থান করা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৩০ সৈন্য নিহত হয় এবং ৫০ জন আহত হয়।
১৬ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কানপুর অবস্থানের উপর হামলা চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনীর হামলায় ২ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয় এবং ৭টি বাঙ্কার ধ্বংস হয়।
১৬ আগস্ট খুলনার ভোমরায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। এই সময় হানাদার বাহিনীর ৪ জন সৈন্য নিহত হয়।
১৬ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার চামুবসতিতে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনী তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুললে হানাদার বাহিনী এক পর্যায়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৩ সৈন্য নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।