১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ এই দিনে
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৫ সেপ্টেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এক বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বিভিন্ন দেশে পাকিস্তান দূতাবাসে চাকরিরত বাঙালি রাষ্ট্রদূত, কূটনীতিবিদ ও দূতাবাস কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলে, 'আজ ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে যে সকল বাঙালি কূটনীতিবিদ ও দূতাবাস কর্মীগণ পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পক্ষাবলম্বন ত্যাগ না করিবে এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করিবে তারা বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হবে।'
ঢাকায় এদিন
১৫ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) প্রধান নুরুল আমিনের সভাপতিত্বে দলের কার্যকরী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পিডিপির কার্যকরী কমিটির সদস্যরা। বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে দলের সহসভাপতি মাহমুদ আলীকে পিডিপির পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি হিসেবে মনোনীত করা হয়।
১৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় বেতারে গভর্নর আব্দুল মালিকের দেয়া ভাষণ নিয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে 'নতুন যাত্রা শুরুর আহ্বান' শিরোনামে বলা হয়, 'গভর্নরের বেতার ভাষণ: ভীতি বিদ্বেষ সন্দেহ ও তিক্ততা পিছনে ফেলিয়া নতুন যাত্রা শুরুর আহবান। পরস্পরকে দোষারোপ করা বা কাহারো ঘাড়ে দোষ চাপাইবার সময় এটা নয়। শক্তি নয় আলোচনা দ্বারা সমস্যা সমাধানোপযোগী মুক্ত সমাজ গড়িয়া তুলিতে হইবে।'
ভারতে এদিন
১৫ সেপ্টেম্বর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, 'আগামী ১৬ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দেখা করতে মুজিবনগর যাবেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধর।'
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অংশ নেয়ার জন্য প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের যে প্রতিনিধি দল জাতিসংঘে যাবেন তাদের সঙ্গে আলোচনা করতেই ডিপি ধর মুজিবনগর যাচ্ছেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অংশ নিতে আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে যাচ্ছেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ ও ফণীভূষণ মজুমদার।
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
১৫ সেপ্টেম্বর ফিলিপাইনের ম্যানিলায় পাকিস্তান দূতাবাস থেকে পদত্যাগকারী বাঙালি রাষ্ট্রদূত খুররম খান পন্নিকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলে, যদি তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ফিলিপাইনে কোনো ধরনের প্রচারণা চালান এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালান তবে তাকে ফিলিপাইন থেকে বহিষ্কার করতে ফিলিপাইন সরকার বাধ্য হবে।
১৫ সেপ্টেম্বর ইরানের তেহরানে পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও ইরানের রাজা শাহ পাহলভির মধ্যে দুই দিন ব্যাপী আলোচনা শেষ দিনে ইরান ও পাকিস্তান যৌথ ইশতেহার প্রকাশ করে। ইরানের রেজা শাহ পাহলভি বলেন, 'আমরা অখণ্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী। এবং আমরা পাকিস্তানকেই সমর্থন দিয়ে যাবো। পাকিস্তানের প্রতি আমাদের সম্পর্ক অটুট থাকবে।'
১৫ সেপ্টেম্বর রয়টার্সে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহী সম্প্রতি জাতিসংঘে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের বিশেষ দূতদের বৈঠকে বিশ্বশান্তি পরিষদের ভারতীয় প্রতিনিধি কৃষ্ণ মেননের বক্তব্যকে শিষ্টাচার বহির্ভূত ও পাকিস্তানের নামে মিথ্যাচার বলেই আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, কৃষ্ণ মেনন এমন বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কেবল একটি দেশের সার্বভৌমত্বের উপরেই আঘাত হানেননি বরং বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরই উসকে দিয়েছেন। যার মাধ্যমে তিনি জাতিসংঘের সনদের প্রতিও অবমাননা প্রদর্শন করেছেন। কারণ জাতিসংঘের সনদে কোনো দেশের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন ও সার্বভৌমত্বের প্রতি আঘাত জাতিসংঘের মূলনীতির বিরোধী।'
১৫ সেপ্টেম্বর ডেনমার্কে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাঈদ চৌধুরী ডেনমার্কের পার্লামেন্ট স্পিকারের সঙ্গে এক বৈঠকে অংশ নেন। এসময় তিনি বাংলাদেশের ভয়াল পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। ডেনমার্কের স্পিকার বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। এদিন আবু সাঈদ চৌধুরী ডেনমার্কের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে দিনব্যাপী সাক্ষাৎ করেন এবং এদিন রাতে একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে অংশ নেন। সাক্ষাৎকারে তিনি ডেনমার্কের বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবসায়ী কর্তৃক পাকিস্তানকে অস্ত্রের চালান প্রসঙ্গে বলেন, ডেনমার্ক সরকারের উচিত পাকিস্তান সরকারের কাছে ডেনমার্কের যেসব নাগরিক অস্ত্র বিক্রি করছে সেসব অস্ত্রের বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। কারণ এই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে পূর্ব বাংলার নিরীহ সাধারণ মানুষের উপরেই।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
১৫ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার শালদা নদীতে মুক্তিবাহিনীর এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা সারাদিন রেকি শেষে রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত আর্টিলারি হামলা চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প দখল করে নেয়। একপর্যায়ে বিপর্যস্ত হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর উপর আর্টিলারি হামলা শুরু করে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর বিপুল প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পিছু হটে। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ২৫ জনের মতো সৈন্য নিহত হয়।
১৫ সেপ্টেম্বর বরিশালের বানারিপাড়ায় মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার জামালের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একদল মুক্তিযোদ্ধা বানারিপাড়া থানা আক্রমণ করে। এসময় হানাদার বাহিনী ও পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় মুক্তিবাহিনীর। প্রায় ৪ ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে যেতে বাধ্য হন। ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার পথে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর একটি লঞ্চ দখল করে নিয়ে যায়।
১৫ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ মহকুমার কোটালিপাড়া থানা আক্রমণ করে হেমায়েত বাহিনীর একটি দল। এসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী থানার মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পাল্টা আক্রমণ শুরু করলে হেমায়েত বাহিনীর সঙ্গে তাদের প্রায় ১৪ ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধ হয়। এরপর হেমায়েত বাহিনী কোটালিপাড়া থানা নিজেদের দখলে নেয়।
১৫ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের কুমারঘাট, মাচারঘাট, বান্দিয়া ও নিমুরী এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এসময় ৫ রাজাকার নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়।
১৫ সেপ্টেম্বর খুলনার পাইকগাছার রাডুলির বাকা গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর গানবোট থেকে হামলা চালায়। অতর্কিত হামলায় প্রথমে মুক্তিবাহিনী কিছুটা প্রতিরোধ করতে পারলেও এক পর্যায়ে পিছু হটে। যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
১৫ সেপ্টেম্বর চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার কুড়ুলগাছি ইউনিয়ন কার্যালয়ের রাজাকার ক্যাম্পে থাকা রাজাকারদের উপর অতর্কিত হামলা চালায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল। এসময় মুক্তিবাহিনীর হামলায় ৬ রাজাকার নিহত হয় এবং দুই জন আহত হয়।
১৫ সেপ্টেম্বর ভোররাতে লালমনিরহাটে মোগলহাটের কাছে দুরাকুটিতে মুক্তিবাহিনীর বড় একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রসদ সরবরাহের রেলওয়ে বগি উড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে রেললাইনে অ্যান্টি ট্যাংক মাইন স্থাপন করে। সকালের দিকে রেললাইন দিয়ে রসদ সরবরাহের বগি যাওয়ার সময় মুক্তিবাহিনীর পেতে রাখা অ্যান্টি ট্যাংক মাইন বিস্ফোরণ হলে বগিটি বিস্ফোরিত হয়। এসময় মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে শুরু করে, এমন সময় পার্শ্ববর্তী অন্যান্য বগি থেকে হানাদার সৈন্যরা মুক্তিবাহিনীর হামলার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রায় দেড় ঘণ্টা ব্যাপী চলা এই যুদ্ধের এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনীর বিপুল প্রতিরোধের মুখে এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী পিছু হটে। এই যুদ্ধে এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হন। অন্যদিকে বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা হতাহত হয়।
১৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পটিয়ায় কালারপোলের পুলিশ ফাঁড়িতে অতর্কিত হামলা চালায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল। এসময় হানাদার পুলিশেরা প্রথমে প্রতিরোধ গড়ে তুললেও এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
১৫ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপুরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনীর হামলায় দুটি পাকিস্তানি বাঙ্কার বিনষ্ট হয়। মুক্তিবাহিনীর এই হামলায় ৩ জন হানাদার সেনা নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। একই দিন সকালে মুক্তিবাহিনী নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর সড়কের পাশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চন্দ্রগঞ্জ প্রতাপ উচ্চ বিদ্যালয় ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়েই হানাদার বাহিনী ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়ে যায়। এসময় প্রায় ৪০ হানাদার সেনা হতাহত হয়।
১৫ সেপ্টেম্বর ফেনীর পরশুরামের আমজাদহাটে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দলের উপর অ্যামবুশ করে। এসময় তাদের মধ্যে দুই ঘণ্টা ব্যাপী যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ৮ জন সৈন্য নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।