১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ এই দিনে
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১২ সেপ্টেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, আগামী ২৭ আগস্ট ২ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। এ সফরে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি, সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন ও কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ব্রেজনেভের সঙ্গে তার বৈঠকের কথা রয়েছে।
এই বৈঠকে বাংলাদেশ বিষয়ই মূলত আলোচ্যসূচিতে স্থান পাবে। এছাড়া বাংলাদেশের পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসনের ভয়াবহ পৈশাচিকতার চিত্র কী করে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে তুলে ধরা হবে এবং একই সঙ্গে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ বিষয়ে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থান কেমন হবে তা নিয়েও ইন্দিরা গান্ধী সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
এদিন 'ঢাকা বিচ্ছিন্ন নগরী' শিরোনামে মুজিবনগর থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, 'মুক্তিবাহিনী ঢাকার সঙ্গে বাংলাদেশের অবশিষ্ট অংশের রেল ও সড়ক পথের যোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সেনাবাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণের ফলেও ঢাকার সঙ্গে বিভিন্ন জেলার রেল চলাচল প্রায় বন্ধ। বাংলাদেশের ভেতরে সন্ধ্যার পর থেকে সড়ক বা জলপথে সব রকম যানবাহন সম্পূর্ণরূপে চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। জানা গেছে, পাক বাহিনী শহরের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা অবলম্বন করেছে। শহরের বাইরে যাবার সড়ক ও জলপথে "ফটক প্রথা প্রবর্তন করা হয়েছে ও সশস্ত্র জঙ্গী প্রহরী মোতায়েন রাখা হয়েছে। ট্যাঙ্ক ও ইলেকট্রিসিটির স্টেশনগুলিতে সেনাবাহিনী সদাসর্বদা প্রহরা দিচ্ছে। শহরে অসংখ্য নলকূপ বসানো হচ্ছে। ঢাকা টেলিভিশন সেন্টার ও রেডিও পাকিস্তান প্রাঙ্গণে কঠোর প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছে।'
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সহ-সভাপতি মাহমুদ আলী পাকিস্তান সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে ঢাকায় আসেন। এদিন তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'ইউরোপের বেতার, টিভি, সংবাদপত্রগুলো একই সুরে প্রচার করে চলেছে যে পূর্ব পাকিস্তানে একটা অঘটন ঘটে গেছে। পাকিস্তানের সাম্প্রতিক নির্বাচনে যে দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে তাদের ক্ষমতা না দিয়ে সেনাবাহিনী সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের জনগণের দাবি নস্যাৎ করতে চায়। কারণ নির্বাচনের ফলাফল পশ্চিম পাকিস্তানিদের মনঃপুত হয়নি। ইউরোপের বুদ্ধিজীবীরা আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন, যা ঘটবার ঘটেছে। এখন যারা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে তাদের নেতার সাথে আপস করে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। পশ্চিমা দেশসমূহে এই ধারণা জন্মেছে যে, পাকিস্তানে নির্বাচনে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে তাদের সাথে আপস না করলে বর্তমান সমস্যার সমাধান হবে না। আমরা তাদের বলেছি নীতিগতভাবে আমরা এর বিরোধী নই। তবে নির্বাচনে যে দল জয়ী হয়েছে সেই দলের নেতা পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছেন। এমন নেতৃত্বের সাথে আপস হতে পারে না। আজ তার সঙ্গে যদি কোনো মীমাংসায় আসতে হয় তবে তা অখণ্ড পাকিস্তানের ভিত্তিতে হতে হবে।'
ভারতে এদিন
১২ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে ভারত–বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির উদ্যোগে আয়োজিত ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলনের সমাপ্তি অধিবেশনে বলা হয় 'বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে আরও দেরি যদি হয় তবে সাম্প্রদায়িকতা বাড়তে পারে। একই সঙ্গে গণতন্ত্রবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ভারত ও বাংলাদেশ, উভয় জায়গাতেই প্রবল হয়ে উঠবে। ভারতের উচিৱতৎ বাংলাদেশকে পূর্ণ স্বীকৃতি দেয়া। এতে করে বিশ্ব মহলে অন্য দেশগুলোও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসবে।'
সমাপ্তি অধিবেশনে এদিন উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় তিন মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী, ওয়াই বি চ্যাবন ও সিদ্ধার্থ শংকর রায়। দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশ মিশনের হাইকমিশনের আমজাদুল হকের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অধিবেশন শেষ হয়।
কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক বলেন, 'ছয় দফার ভিত্তিতে ইয়াহিয়ার সঙ্গে এখন আপসের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, প্রায় এক কোটি মানুষ আজ শরণার্থী এবং কয়েক লাখ লোক নিহত। খুনিদের সাথে আলোচনার কোনো প্রকার সিদ্ধান্ত হয়নি। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন।'
দেশব্যাপী এদিন
১২ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সম্মেলনে শান্তি কমিটির সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে শান্তি কমিটির সদস্যরা আওয়ামী লীগ ও মুক্তিবাহিনীকে চিরতরে বিনষ্ট করতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে একযোগে কাজ করতে শপথ নেন।
১২ সেপ্টেম্বর বিপ্লবী বাংলাদেশ নামের একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৯ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা নোয়াখালী শহরের কুখ্যাত দাঙ্গার হোতা গোলাম সারোয়ারকে হত্যা করেছেন। হ্যান্ড গ্রেনেড দিয়ে কমান্ডোরা তাকে হত্যা করেন। এতে স্থানীয় জনসাধারণ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
১২ সেপ্টেম্বর সাটানি, নারায়ণঘাট, আবাদের হাট, কাকভাঙ্গাসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকটি দলের তীব্র সংঘর্ষ হয়। এসময় এই সংঘর্ষগুলোতে ১০ হানাদার সেনা নিহত হয় এবং ২ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
১২ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার ভোমরায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় ২ হানাদার সেনা নিহত হয়।
১২ সেপ্টেম্বর ফেনীর ছাগলনাইয়ায় মুক্তিবাহিনীর পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে ২ জন হানাদার সেনা নিহত হয় এবং আরও ২ জন আহত হয়।
১২ সেপ্টেম্বর কুমিল্লায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল গুথুমা নদীতে টহলরত পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর এই অতর্কিত হামলায় হানাদার বাহিনীর ৪ জন নিহত হয়।